সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
ভিক্টর ট্রাম্পার আর একটি বিকেল
রানা সেনগুপ্ত
ওই পুরনো বিবর্ণ টুপিটাই সর্বনাশ করলো। ওটা না থাকলে আমি আদিদার শেষ বলটাতে ছক্কা মারি না। ছক্কাটা না হলে ম্যাচটাতে জগনমোহন মহাবিদ্যালয়ও জেতে না। সেন্ট মেরি কলেজের মূলপর্বে যাওয়াটা আটকে যায় না। আমিও চিরতরে দোলনকে হারাই না। টুপিটার বদলে হেলমেট মাথায় থাকলে আমার মত এমন এক এলেবেলে লেগির পক্ষে আদিদার মত বোলারের বাউন্সার হুক করবার সাহস হয় কি করে! এগারো নম্বর ব্যাটসম্যাস আর কবে কোথায় শেষ বলে ছক্কা মেরে ম্যাচ জেতায়! বন্ধুরা ম্যাচটা জেতানোর আনন্দে আমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে মাঠের বাইরে বের হবার সময় আমি ওই স্কন্ধারুঢ় অবস্থাতেই এই সব ভাবছিলাম।
ছোটমামা গানের জগতে এক কিংবদন্তী। তিনি প্রায়ই দেশ–বিদেশ ঘুরে বেড়ান। আর যেখানেই যান, একমাত্র ভাগনে, আমার জন্য নিয়ে আসেন কিছু না কিছু উপহার। বিদেশি উপহার দেখে বন্ধুদের চোখ চড়কগাছ হতে থাকে। আর আমার আনন্দে বুক ভরে উঠতে থাকে। ছোটমামার দৌলতেই নিজের ক্রিকেট কিটের ভেতর যে সব ব্যাট, প্যাড আছে, তা বিলিতি ও বেশ দামী। কিন্তু তা হলে কি হবে। আমি সে সব কাজে লাগিয়ে মোটেই আজ পর্যন্ত এমনকি পাড়া টুর্ণামেন্টেও একটা ফিফটি দূরের কথা, তিরিশ পর্যন্ত করতে পারিনি। দলে আমাকে নেওয়া হয় দূরন্ত ফিল্ডিংয়ের জন্য। লোকে সাউথ সিটির জন্টি রোডস বলে ডাকে প্রকাশ্যেই। আর খুব দরকার পড়লে দু–চার ওভার লেগস্পিন করতে হয় । তাও যদি নির্ভরযোগ্য বোলারেরা মার খেয়ে যায়, যদি তারা উইকেট না নিতে পারে, একমাত্র তখনই। ক্যাপ্টেনেরা বারবার এসে বলে যায়, ‘দেখিস, সুজন! একদম ফ্লাইট করাস না। ছক্কা খাস না। কোনমতে টেনে টেনে বল করে ওভারটা শেষ করে দে।’ আমার অতি ধীরগতির ডেলিভারি ছক্কা মারতে গিয়ে কেউ যদি বাউন্ডারি লাইনে ক্যাচ তুলে আউট হয়ে যায়, তখন ক্যাপ্টেনেরা বলে, ‘ উইকেটটা সুজনের না। যে ক্যাচ ধরেছে, তারই।’
এমনি করেই দিনটিন কেটে যাচ্ছিল। স্বপ্নেও ভাবিনি, ‘দূর্দান্ত’ পারফরমেন্সের জেরে কলেজ টিমে ডাক পাবে সুজন চক্রবর্তী। আমার জায়গায় চান্স পাবার কথা অলরাউন্ডার বিজিত সরকারের। কিন্তু গেমসস্যার হারুনস্যারের জেদে আমাকে দলে নেওয়া হল। তিনি নাকি বলেছিলেন,‘ যে মাঠে খেলাগুলো হবে, সেই সল্টলেক স্টেডিয়ামের পিচে দ্বিতীয় ইনিংসে স্পিন ধরে। আমাদের যদি পরে বল করতে হয়, সুজনের টিপিক্যাল লেগস্পিন কাজে আসবে।’ হারুনস্যার আসলে নতুন এসেছেন। তাই আন্তঃ কলেজ ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় জগনমোহন মহাবিদ্যালয়ের ইতিহাস জেনে ওঠার সুযোগ পাননি। আমাদের কলেজ কোনদিন এই প্রতিযোগিতার কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠেনি। প্রতিবারই প্রথম, দ্বিতীয় রাউন্ডেই বিদায় নেয়। আমাদের ক্রিকেট টিমেকে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো পাত্তাই দেয় না। দেবার কথাও নয়। ক্যাপ্টেন দেবাংশু মল্লিক এবার ম্যাচ জেতবার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস। সে যে ভঙ্গিতে আমাদের নেট করাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে আমারা ওয়ার্ল্ডকাপের ফাইনালে নামছি। দেবাংশু বারবার বলে দিয়েছে, এগারো নম্বরে নামলেও, ব্যাটে আমাকে কিছু রান দিতেই হবে। তাই এই ক’দিন আমাকে নেটে বোলিংয়ের চেয়ে অনেক বেশি ব্যাট করতে হচ্ছে। আর কুঁকড়ে গিয়ে বারবার বোল্ড হবার ধরণ দেখে দেবাংশু গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ছে। এদিকে বিজিতের ব্যাটে চার–ছক্কার ঝড়! দেখে, দেবাংশু বলছে, তোকে খেলাতে পারবো বলে তো মনে হচ্ছে না। ক্যাপ্টেনের মুখে এমন চিতাবনি শুনে মন খারাপ করেই ঘুরে বেড়াচ্ছি।
এমন সময় ছোটমামার আবির্ভাব। অন্যান্যবার তিনি ঝোলা থেকে চমৎকার সব উপহার বের করেন। দামী পারফিউম, মোবাইল ফোন, খুদে ল্যাপটপ, নাইটভিশনগ্লাস...। এবার সে সব কোথায়! ছোটমামা কি না একটা পুরনো, বিবর্ণ টুপি আমার দিকে বাড়িয়ে বললেন, ‘ এটা তোকে দেওয়া আমার সব চেয়ে দামী উপহার, বুঝলি।’
অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছি দেখে বললেন, ‘ টুপিটা কার বলতে পারিস? পারলি না তো? এখুনি তুই লাফিয়ে উঠবি নামটা শুনলে!’
মহা ধন্ধে পড়ে গেলাম। কার টুপি! কি এমন বিখ্যাত মানুষ তিনি! যে নামটা শুনে লাফিয়ে উঠতে হবে? ছোটমামা বললেন, ‘ পারলি না তো? তাহলে সব খুলেই বলি। এবার আমি গিয়েছিলাম অস্ট্রেলিয়া। নানা শহরে গান করে এলাম মেলবোর্ণে। সেখানে একদিন ঘুরতে বেরিয়েছি, দেখি খুব পুরনো একটা নিলামের দোকান। তাতে নানা রকমের ব্যাট, বল, প্যাড এই সব বিক্রি হচ্ছে। এক–এক পিসের দাম যা, তাতে সেগুলোতে হাত দেবার উপায় নেই।’
ছোটমামা আবার বললেন, ‘ এটা–সেটা দেখে বেড়াচ্ছি দেখে নিলামের দোকানের মালিক, এক থুথ্থুড়ে বুড়ো, এগিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, বিশেষ কিছু খুঁজছি কি না। বললাম, কি চাই ঠিক বুঝতে পারছি না! সে কথা শুনে বুড়ো আমাকে নিয়ে এগিয়ে গেল দোকানের অন্ধকার দিকটায়। ততক্ষণে বুড়োকে বেশ জমিয়ে নিয়েছি। আমি যে ইন্ডিয়া থেকে এসেছি, গানটান করি, এসব বলেছি। বুড়ো দেখি ভারতীয় গানের দারুন ভক্ত। সুযোগ পেয়ে তাকে তানসেনের মিয়াঁ কি মল্লার, দীপক ইত্যাদি রাগ দু’কলি করে শুনিয়েও দিয়েছি। সে তো গদগদ। শেষে চলে আসার সময়, আমাকে সেই অন্ধকার কোন থেকে একটা বিবর্ণ টুপি তুলে দিয়ে বলল, ভেবেছিলাম এটা জীবনে বেচবো না। কিন্তু তুমি একে ইন্ডিয়ান, তার ওপর তানসেনের পরম্পরা ধরে রেখেছো। তাই তোমাকে এটা উপহার দিলাম। এই টুপিটা কার জানো? ভিক্টর ট্রাম্পারের!’
— ‘ভিক্টর ট্রাম্পারের খেলা কোনদিন দেখবার সুযোগ হয়নি আমার। কিন্তু দেখেছেন বেরিদাদের মত মুষ্টিমেয় কয়েকজন। বেরিদা মানে বুঝলি তো? বেরি সর্বাধিকারী। তো, তাঁরা দেখি ট্রাম্পারের কথা উঠলে এত উচ্ছসিত হয়ে যান যে মনে হয়, তারপর পৃথিবীতে আর কোনও ব্যাটসম্যানই যেন জন্মায়নি, যাঁর প্রতিভা ট্রাম্পারের সমান।’ বলে চললেন ছোটমামা। ‘ মজা করে বুড়োকে বললাম, ট্রাম্পার কি ডবলিউ জি গ্রেস, ডন ব্রাডম্যান, জ্যাক হবসের চেয়ে বড় ব্যাটসম্যান! বুড়ো চটে উঠে বললে, কাদের নাম করছো তুমি? ট্রাম্পার যদি প্রথম শ্রেনীতে প্রথম হয়ে থাকেন তো, এই লোকগুলো তৃতীয় শ্রেনীতে পড়ে! আমি আর কথা না বাড়িয়ে টুপিটা নিয়ে নিলাম। তোর কথা মনে পড়লো। তুই তো ক্রিকেট খেলিস। এই টুপিটাকে রেখে দে। মাঝেমধ্যে ধূপধুনো দেখাস। হয়তো ট্রাম্পারের আত্মা তোকে আশীর্বাদ করতে পারেন।’
সত্যি বলতে গেলে কি, ট্রাম্পারের নাম পর্যন্ত শুনিনি। টুপিটা হাতে দিয়ে ছোটমামা চলে যেতেই ইটারনেট খুলে সার্চ করে দেখি, উইকিপিডিয়াতে লেখা আছে, ভিক্টর ট্রাম্পার : মোস্ট স্টাইলিস্ট অ্যান্ড ভার্সাটাইল ব্যাটসম্যান। তিনি জন্মেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ডার্লিংহোস্ট শহরে ১৮৭৭ সালের ২ নভেম্বর। সেই শহরেই মারা যান ১৯৫১ সালের ২৮ জুন। তাঁর টেস্ট ডেবিউ ২২ বছর বয়সে ১৮৯৯ সালের ১ জুন। ৪৮টি টেস্টে খেলেছিলেন ৮৯টা ইনিংস। মোট রান ৩১৬৩, সেঞ্চুরি আটটা, সর্বোচ্চ ২১৪। এমন কিছু বিশাল মাপের রেকর্ড তো নয়! তাই ১২০ বছর আগে টেস্টম্যাচ খেলা ব্যাটসম্যানকে নিয়ে আদিখ্যেতার মত কিছু দেখলাম না। তাই দেয়ালে টুপিটাকে টাঙিয়ে ধূপধুনো দেবার বদলে সেটা ভরে ফেললাম ক্রিকেট কিটে। টুপিটার ব্যাপারে কাউকে, এমন কি দোলনকেও কিছু বলিনি।
এইখানে দোলনের পরিচয়টা দিয়ে রাখি। আমি আর দোলন যাকে বলে, ইন লাভ। লেখাপড়া আর খেলার বাইরে আমার যেটুকু জগত রয়েছে, সবটাই অধিকার করে রয়েছে দোলন। আমরা সুযোগ পেলেই ঘুরিফিরি। দুজনই দুজনকে না দেখতে পেলে পাগল হয়ে যাই। আর যতক্ষণ দেখা না হয়, বার্তার পর বার্তা পাঠাই হোয়াটসঅ্যাপে। ঠিকই করে রেখেছি, মানে আমাদের সিদ্ধান্ত— বড় হয়ে দুজনের সম্পর্কটাকে পরিনতির দিকে নিয়ে যাবো। আমি যেমন ঘনঘন দোলনের বাড়ি যাই, দোলনও আমাদের বাড়িতে আসে। আমরা দুজন প্রেম করছি, সর্বসমক্ষে ঘোষণাটা অবশ্য করা হয়নি। তবু, দুই বাড়ির সদস্যেরা মনে তো হয় আমাদের বেশ পছন্দই করেন। শুধু দোলনের দাদা আদিনাথ মুখোপাধ্যায় আমাকে একেবারেই পছন্দ করে না। আর সুযোগ পেলেই তার এই অপছন্দের কথা ঠারেঠারে বুঝিয়েও দেয়। প্রকারন্তরে নানাভাবে অপমান করে। অবশ্য আদিদাকে পটিয়ে ফেলবার প্রচুর চেষ্টা করে চলেছি। আদিতা প্রায় সাতফুট লম্বা। বাঁ–হাতে দারুন জোরে সুইং করায়। আর দারুন মারকুটে ব্যাটসম্যান। তার এই সুইংয়ের হদিস পেয়েছে, এমন কোনও ব্যাটসম্যান এ তল্লাটে কেন, গোটা জেলায় নেই।
আদিদাকে প্রায়ই ক্রিকেট নিয়ে নানা প্রশ্ন করি। যেমন লেট কাট কি করে মারতে হয়, লেগ গ্লান্স ক’ধরণের হয়, হুক করবার সময় বাঁ–পা এগিয়ে না পিছিয়ে রাখবো, ইত্যাদি। আদিদা রাগ রাগ চোখে আমার দিকে তাকায়। প্রায়ই অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য করে। এই তো সেদিন আদিদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, রিভার্স সুইং করাবার সময় বলের কোনদিকটায় পালিশ রাখতে হয়, কোনদিকটাতে পালিশ তুলতে হয়? আদিদা কিছুক্ষণ আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললো, ‘ করিস তো আস্তের ওপর সাজা বল। তোর ওই খবরে দরকার কি? আদার ব্যাপারি হয়ে সুখে থাক। জাহাজি হবার চেষ্টা করিস না!’ আমার মনে মনে খুব রাগ হয়েছিল। মনে মনেই বলেছিলাম, কোনদিন যদি সুযোগ আসে, হে আদনাথ মুখুজ্জে, তোমার ওই সুইংটুইংয়ের তোয়াক্কা না করে বলটাকে গঙ্গার ওপারে নির্বাসিত করবো। যদিও সে সুযোগ এগারো নম্বরে নামা একজনের আসবে কি না, তা নিয়েও আমারই রীতিমত সন্দেহ আছে।
দোলনের সঙ্গে আমার প্রেম কেমন করে জমে উঠেছিল, সে গল্পটাও বলে রাখি। তাহলে আপনাদের বুঝতে সুবিধা হবে, আদিদার শেষ বলে ছক্কাটা মেরে আমি নিজেই নিজের কি কি সর্বনাশ করেছি।
একদিন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দেখি, পাড়ার টিউটোরিয়াল হোমের সামনে একটা জটলা। উঁকি মারতে দেখলাম, একপাশে দোলন কাঁদোকাঁদো মুখে দাঁড়িয়ে। ও নাকি এমন একটা সহজ অঙ্ক ভুল করেছে, তাতে রেগে গিয়ে টিউটোরিয়ালের যুগলদা এক ক্লাস ছাত্রছাত্রীদের সামনেই বলেছে, দোলন, তোর মাথায় গোবরের স্টোরেজ। তোর দ্বারা অঙ্ক হবে না। যা যা, বাড়ি গিয়ে ব্রোনোলিয়া টানা ছ’মাস ধরে খেয়ে তারপর আয়। এই সুযোগে দোলনের বন্ধুরা ওর পিছনে লেগেছে। নানা কটূক্তি আর ইয়ার্কির চোটে দোলন বিপর্যস্ত। আর একটু হলেই কেঁদে ফেলবে।
অনেকদিন ধরেই আমার দোলনকে দেখলে বুকের ভেতর কেমন একটা বাজনা বাজে। একটা ওয়েকআপ কল। কিন্তু কিছুতেই ওর সঙ্গে কথা বলবার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। এই সুযোগে আমি ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলাম। তারপর দোলনের দিকে তাকিয়ে মিথ্যে করেই বললাম, ‘ অ্যাই! এখনও বাড়ি যাসনি? এখুনি চল। আদিদা তোকে আইসক্রিম খাওয়াবে বলে দাঁড়িয়ে কখন থেকে।’
আদিদা অনেক চামচা–বেলচা নিয়ে দিনরাত ঘোরে। দোলন আমাকে তাদেরই একজন বলে ধরে নিয়ে আমার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলো। অনেকক্ষণ হাঁটার পর আদিদাকে না পেয়ে অবাক হয়ে বললো, ‘ কই দাদা কোথায়? আর কতদূর যেতে হবে?’ আমি একটা আইসক্রিমের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘ আদিদা মোটেই তোকে আইসক্রিম খাওয়াতে ডাকেনি। তোকে আমিই আইসক্রিম খাওয়াবো। তারপর তোকে অঙ্ক কি ভাবে কষতে হয়, তা নিয়ে একটু জ্ঞান দেব। সেই জ্ঞানামৃত শ্রবণেই তুই অঙ্ক সামলে উঠতে পারবি। তাই, হ্যাভ আ আইসক্রিম বেবি।’
দোলন অন্যদিন হলে পায়ের স্পোটসস্যু খুলে আমাকে রাস্তায় ফেলে পেটাতো। কিন্তু ওই যে, অঙ্কভীতি কাটাবার একটুকরো আশ্বাস— এতেই দোলন ফেঁসে গেল। আর আইসক্রিম সাবড়ে আমি ফুটপাথে ওকে পাশে বসিয়েই ওর কষা অঙ্কের ভূল কোথায় বা গণিতভাবনার সমস্যাগুলো নেড়েচেড়ে ঠিক করে দিলাম। হাতে কলমে কয়েকটা অঙ্ক কষলাম নিজে, ওকেও দিয়ে কষালাম। দোলনের মুখে দেখি মেঘভাঙা হাসি ফুটে উঠেছে। ও বলেছে, ‘মাঝেমাঝে আমাকে তুই অঙ্কটা দেখিয়ে দিবি তো? ’ মাঝেমাঝে দেখিয়ে দিয়েছি আর সেই অঙ্কের সিঁড়ি বেয়েই আমি ধীরে ধীরে প্রবেশ করেছি ওর হৃদয়ে। আসলে আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে পামীর মালভূমির অবস্থান বা রাশিয়ার জলবায়ু সম্পর্কে, মাথাটাথা অনেক চুলকেও কিছুই বলতে পারবো না। কেউ যদি তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নিয়েও প্রশ্ন করে তো তেমনই হাল হবে । কিন্তু অঙ্কটা ভালই শিখেছি। ওখানে আমাকে সহজে কেউ হারাতে পারবে না।
এবার দোলনকে রেখে আবার খেলার মাঠে ফিরি চলুন। সেদিন নেটে নামতে গিয়ে দেখি, আমাদের দলের অন্যতম সেরা স্পিনার বিভূতিচরণ ওরফে বিভ বল করছে। সঙ্গে আরও কয়েকজন ক্রিকেটার, যারা দলে নেই। সকলেই স্পিন করাচ্ছে দেখে, আমি আর হেলমেট না পড়ে ছোটমামার দেওয়া সেই টুপিই , মাথায় দিয়ে নেমে পড়লাম। বিভর প্রথম বলটাই হাওয়াখাওয়ানো আর অফস্টাম্পের বেশ বাইরে। এটা ওর অন্যতম অস্ত্র। ব্যাটসম্যান বলটা বেরিয়ে যাবে ভেবে সেটাকে ছেড়ে দেবার চেষ্টা করবে আর বলটা অফস্ট্যাম্প পড়ে গোঁত্তা খেয়ে ঢুকে উইকেট ভাঙবে। বিভু ভেবেছিল প্রথম বলেই আমাকে বোল্ড করবে। এদিকে বলটা পড়তেই আমার শরীর কী করে যেন অফস্টাম্পের বাইরে বেরিয়ে গেল। ডান পা–টা বলের লাইনে চলে এসে বলটাকে তুলে দিল আকাশে। আরে, আরে— একি! বলটা বিশাল ছক্কা হয়ে কলেজের মাথায় থাকা ঘড়িটার পাশে আঘাত করলো। বিভুর চেয়ে বেশি অবাক হয়েছি আমি। বিভু তোম্বা মুখে বলল, ‘একবার বলটাতে ঠিকঠাক ব্যাট লাগিয়ে ফেলেছিল সুজন। ঝড়ে কাক মরেছে।’ বলে পরের বলটা করলো গুড লেন্থে। আবার অবাক হলাম নিজেকে দেখে। প্রায় মাঝপিচে চলে গিয়ে বলটাকে আবার মারলাম। আবার ছক্কা! তারপর এলেবেলেদের বলে বলে ছক্কা মারতে শুরু করলাম। এমনি করে খান দশেক ছক্কা মেরে বসে আছি!
ততক্ষণে হারুনস্যার নেটের পাশে দাঁড়িয়েছেন। চলে এসেছে আমাদের ক্যাপ্টেনও। এলেবেলেদের সরিয়ে কলেজের জোর বোলারদের হাতে বল তুল দেওয়া হয়েছে। তার আউটসুইং ইনসুইং করাচ্ছে। আছড়ে পড়ছে বাউন্সার। আর এই ঝড়ের ভেতরও দেখি আমি অবিচলিত। একের পর এক স্ট্রোক বেরিয়ে আসছে ব্যাট থেকে। হারুনস্যার হাসছেন, ক্যাপ্টেনের মুখ গম্ভীর। সেদিনই আমার এগারো নম্বরে থাকাটায় শিলমোহর পড়ে গিয়েছিল। এত স্ট্রোক কী কর বের হচ্ছে আমার ব্যাট থেক তা নিয়ে রীতিমত গবেষণা চলছিল। কৃতিত্ব দাবি করেছিল দেবাংশু। বলেছিল,‘ ওকে টানা ব্যাট করিয়েছি নেটে। এতদিনে ও ঠিকঠাক খেলতে পারছে।’ হারুনস্যার বলেছিলেন, ‘ দরকার হলে ওকে ব্যাটিংঅর্ডারে তুলে আনো। এমন করে যদি মারত পারে তো ম্যাচের রং বদল দেবে সুজন।’ দেবাংশু গম্ভীর হয়েই থেকেছে। গেমসস্যরের পরামর্শ তার মনে ধরেনি। মনে মনে হয়তো ঠিক করে রেখেছিল, যদি দরকার পড়ে তাহলে এমন সময় আমাকে ওপরে তুলবে, যখন টিম প্রবল সমস্যায়। তখন আমি ব্যর্থ হলেই দল থেকে বাদ দিয়ে দেবে।
প্রথম ম্যাচেই জগনমোহন মহাবিদ্যালয় ব্যাটিংবিপর্যয়ে পড়লো। সাতান্ন তুলতে না তুলতেই দলের নবম উইকেটের পতন । প্রতিদ্বন্দী মহাজোড় কলেজের একটা ছেলে বল কাট করাচ্ছে। কখনও আবার সুইং। তার তিন ওভারের পরে আমাদের সব মহারথেরা ধরাশায়ী। এগারো নম্বরে যখন নামলাম, তখন আমাদের ব্যাটিংয়ের পরে ওদের ব্যাট করিয়ে তারপরই লাঞ্চ হবে কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। হারুনস্যার মাথায় হাত দিয়ে বসে। ভাঙা গলায় বললেন, ‘ নিজের ন্যাচারাল খেলা খেলবে। কাউক ভয় পাবার দরকার নেই।’ দেবাংশু বলল,‘ দেখ যদি বিভকে একটু সাপোর্ট দিতে পারিস।’ সাতনম্বরে নামা বিভ টিঁকে আছে বাইশ বল। রান করেছে মাত্র তিন। আমি ঘাড় নেড়ে রওনা হলাম। একটা হাততালিও পড়লো না। ম্যাচের পর দেখেছিলাম, হেলমেট না, আমার মাথায় ছিল সেই বিবর্ণ টুপিটাই।
প্রথম যে বলটা খেললাম, সেটাতে কী সুইং ছিল, বলটা কতটা কাট করেছিল, এসব দেখতে পাইনি। সত্যি কথা বলতে গেলে, বলটাই আদৌ দেখতে পাইনি, এত জোরে এসেছিল । শুধু দেখলাম, মাঠের বাইর থেকে ওদের মিডঅফ বল কুড়োতে গিয়েছে। আর আম্পায়ার আকাশে হাত তুলে দাঁড়িয়ে। মানে একখান বিশাল ছক্কা খেয়েছে তিন ওভারে ন’টা উইকেট নেওয়া ফাস্টবোলার। এগারো নম্বরেরা মাঝেমধ্যে এমন তাড়ু মারে। ভেবে নিয়েই, পরের বলটা বাউন্সার দিয়েছে। আর এবারে অনেকগুলো হাততালির শব্দে চমক ভেঙে দেখলাম, শর্টলেগ বল কুড়িয়ে আনছে। আম্পায়ারের দু’হাত ফের আকাশে। ওভারের শেষ বলটাতেও এমনি একটা আকাশ ছোঁয়া ছক্কা মারতে গিয়ে দেখি, ব্যাটটা শূন্যে আটকে গিয়েছে। তার বদলে হাল্কা হাতে পুশ। আর বলটাকে কভারে ঠেলে দিয়ে একটা সিংগলস্। বিভ রাগ রাগ মুখে বলে গেল, ‘সিঙ্গলস নিতে গেলি কেন রে হতভাগা! এবারে তো আর একটা জোর বোলার আসবে।’ কেমন যেন ঘোরের মধ্যে তলিয়ে গিয়ে বলেদিলাম, ‘ বেশি কথা বলবি না। যখনই রান নিত কল করবো, ছুটতে শুরু করবি। ওদের সব বোলারকে আমি সামলে নিচ্ছি।’ ফের কে যেন আমার হয়ে মহাজোড়ের বোলারদের নিয়ে ছেলেখেলা শুরু করলো। তিরিশ ওভারের ম্যাচের শেষ বলটা খেলে যখন ফের স্ট্যান্স নিয়েছি , আম্পায়ার হেসে বললেন, ‘ আর তো ওভার বাকি নেই। থাকলে তোমার সেঞ্চুরিটা হয়ে যেত। ভেরি ওয়েলপ্লেড। তোমাকে এত দেরিতে নামলো কেন বল তো?’ স্কোর বোর্ডের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার নামের পাশে অপরাজিত ৯৭! বিভের নামের পাশে ১৩। জগমোহন কলেজ অতিরিক্তটিক্ত নিয়ে ১৪৭–৯। সে ম্যাচে বিভ দারুন বল করছিল। সাত ওভারে বাইশ রান দিয়ে ছ’টা উইকেট নিয়ে আমাদের জিতেয়েছিল। আমাক বল করতে ডাকা হয়নি। সে না হোক। এরপর থেকে আমাকে বাদ দিয়ে এই সিজনে অন্তত জগমোহন কলেজ নামবে না। কিন্তু পরের ম্যাচগুলোতে আমাকে আর ব্যাটিং তাণ্ডব দেখাতে হয়নি। প্রথম ম্যাচের পর ঘুরে দাঁড়ায় আমার কলেজ। সাতটা ম্যাচে জিতে ফাইনালেও পৌঁছে যায়। মাঝে একটা ম্যাচে শেষ তিন বল খেলতে নামে পরপর তিনটে ছক্কা মারি। বুঝতে পেরে গিয়েছিলাম, বিপদে না পড়লে ক্যাপ্টেন আমাকে আগে নামাবে না। আর দেবাংশু জেলা ক্রিকেটে দারুন নামকরা ব্যাটসম্যান। চারিদিকে তার প্রভাব যথেষ্ট। তাই হারুনস্যারও আর আমার ব্যাপারে ওকে ঘাটাতে সাহস পাননি।
দল থাকবো বুঝতে পেরে যখন বেশ স্বস্তিতেই, তখনই ঘটলো কাণ্ডটা। একদিন রাস্তায় বের হত না হতেই দেখি আদিদার জিম করা পালোয়ান চামচা দিলীপ দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই হাত চেপে ধরে বললো, ‘ চল, চল। অনেকক্ষণ তোর জন্য দাঁড়িয়ে। পায়ে বাত ধরে যাবার দশা। আদি তোকে ডেকেছে।’ আদিদা আমাকে ডেকেছে! ভাবতেই আমার শরীর জুড়ে একটা অপার্থিব আনন্দ খেলে গেল। যাক, ছক্কাগুলোর সুবাদে খোদ আদিবাবুর নজরে পড়েছি তাহলে। একটা কথাও না বলে দিলুর সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম।
আদিদা দলবল নিয়ে বসেছিল পাড়ার নুডলসের ঠেকে। এটা সন্ধ্যে বেলা খোলে। সকলে এখন তার সামনে আদিদারা ছাড়া কেউ নেই। আমাকে দেখতে পেয়েই আদিদা উঠে দাঁড়ালো। তারপর জ্বলন্ত চোখে, রাগ রাগ গলায় বলল, ‘ তুই দোলনকে আজকাল কী সব এসএমএস পাঠাচ্ছিস? এই এসএমএসগুলোর মানে কী? আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘ কোন এসএমএসের কথা বলছো ? বুঝতে পারছি না তো?’ আদিদার চোখ দুটো জ্বলে উঠলো। পকেট থেকে একটা মোবাইল বের করলো। দোলনেরটা! তারপর সেটার হোয়াটঅ্যাপের ঘরটা খুললো। তাতে জ্বলজ্বল করছে আজ সকাল আটটায় আমার পাঠানো এসএমএস— ওয়ানএলজিরোফাইভইইউ। এটা একটা গুপ্তসংকেত। মানে আসলে লেখা আছে— আই লাভ ইউ। আমরা এমনি করে সাংকেতিক এসএমএস পাঠাতাম পরস্পরকে। দোলন পাল্টা লিখতো—ওয়ানএলজিরোফাইভইইউ২। মানে, আই লাভ ইউ টু। তারপরই আমি লিখতাম 12155, মানে আসলে kiss। দোলন পাল্টা লিখতো 100012155, মানে হাজারটা চুমু।
হৃদপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠলো। আদিদা সব জেনে গিয়েছে? তাহলে তো ঘোর বিপদ। রাস্তায় ফেলে ক্যালাবে? নাকি কোথাও নিয়ে গিয়ে? বারবার দোলনকে বলতাম, একটা নতুন ফোন কেন। যাতে সব বার্তা মুছে ফেলার সুবিধা আছে । দোলন, আজ কাল পরশু করে কাটাচ্ছিল। এখন কিপটে মেয়েটার জন্য আমার তো প্রাণসংশয়! আদিদাকে বললাম, ‘ ওহো! একটা অঙ্কের জন্য দরকারি ফর্মুলা জানতে চেয়েছিল দোলন। আমি ভুল টাইপ করে ফেলেছি। ঠিক আছে, বাড়ি গিয়ে, আসল ফর্মুলা পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ আদিদা থমথমে গলায় বললো, ‘ তুই যে কলেজে পড়িস ,আদিনাথ মুকুজ্জে তার প্রিন্সিপ্যাল । এই এসএমএসের মানে আমি বুঝতে পারবো না, ভাবলি কী করে? যাক, তুই আমাদের পাড়ায় ভালো ছেলে বলে পরিচিত। তোকে ক্যালাতেই পারি। কিন্তু তবু একটা চান্স দিচ্ছি। বামন হয়ে চাঁদের দিকে তাকাস না। দোলনের সঙ্গে রাস্তায় কথা বলবি না। আমাদের বাড়িতেই পা রাখবি না। রাখলে কিন্তু...’ বলে আদিদা তার রক্তজল করা চাহুনিটা আমার সর্বাঙ্গে বুলিয়ে দিল। মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলাম। হয়ে গেল! আমার আর দোলনের প্রেমের এখানেই ইতি। এরপর দোলনকে রাস্তায় দেখতাম, আদিদার কোন না কোনো চামচাবেলচা পাহারা দিতে দিতে নিয়ে যাচ্ছে। দোলনও আর আমার দিকেই তাকাতো না।
তাহলে আর কী লাভ খেলে? কী লাভ ছক্কা মেরে? দোলনকে যদি জীবনে না পাই তো বাঁচে থেকেই বা লাভ? এই অবস্থাতেই একদিন ছোটমামার ফের এলেন। আমার ছক্কাকাণ্ডের কথা শুনে লাফিয়ে উঠলেন। বললেন, ‘ দেখেছিস! যা ভেবেছিলাম তাই হলো। ট্রাম্পারের আত্মা এই সামান্য টুপির মায়া কাটাতে পারছেন না। ব্যাটিংয়ের সময় তোর ঘাড়ে ভর করে ছক্কাগুলো মারছেন। টুপিটা হারাস না। নষ্ট করে ফেলিস না। যতদিন পারবি মাথায় দিয়ে খেল। তুই ব্যাটসম্যান হিসেবেই ইন্ডিয়া খেলবি, যদি এইসব চলতে থাকে।’ মনটায় আদিদা আলকাতরা ঢেলেছিল। ছোটমামা এক আকাশ কুয়াশা ভরে দিলেন। । যা করছেন সবই ভিক্টর ট্রাম্পার! আমার কৃতিত্ব বিগ জিরো। আমার হয়ে ক্রিকেট খেলছে ভূতে!
এমনি করে কয়েকদিন কেটে গিয়েছে। শেষে এলো সেই চরম দিনটা। আজ জেলা আন্ত কলেজ ক্রিকেট ফাইনাল। যে কলেজ জিতবে, তারা মূলপর্বে রাজ্যের সব ভাল ভাল কলেজের বিরুদ্ধে খেলবে। অনেক বড় এক্সপোজার পাওয়া যাবে। তেমন ভাল ব্যাটিং বা বোলিং করতে পারলে সরাসরি কলকাতার কোন দলে খেলবার সুযোগ। সারা বাংলা বিশ্ববিদ্যালয় দলে চান্স। ফাইনাল ম্যাচের আগের দিন এসব বলে হারুনস্যার ভোকাল টনিক দিচ্ছিলেন। আমাদের ফাইনালে জেতাটা হবে ভীষণ অঘটন। কারণ, উল্টোদিকে আদিদাদের সেন্ট মেরি কলেজ। যারা আবার মূলপর্বে বারবার উঠেছে। সাতবার জিতেছে সারা বাংলা কলেজ প্রতিযোগিতার পুরস্কার পঙ্কজ রায় ট্রফি। তার ওপর এবারে ওদের দলে সাতটা অলরাউন্ডারই কাঁপিয় দিচ্ছে। তিরিশ ওভারে তুলছে তিন–সাড়েতিনশো। প্রতিদ্বন্দী দলকে আশি থেকে একশো মার্জিনে নামিয়ে দিচ্ছে । ও তো দল নয়, মেশিন। মানুষ কী মেশিনকে হারাতে পারে?
কলেজ থেকে বেরিয়ে দেখি দোলন দাঁড়িয়ে। একা! আমাকে দেখে হাত নাড়লো। ইশারায় কাছে ডাকলো। আদিদার চিতাওবনি ভুলে মন্ত্রমুগ্ধের মত পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। দোলন ফিসফিস করে বললো, ‘ দাদা বলছে, কালকের ম্যাচটা তুই খেলিস না। আর যদি একান্তই খেলতে হয়, তাহলে দাদার প্রথম বলটাতেই বোল্ড হয়ে যাস্।’ আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম। দোলন বলল, ‘ দাদা নিজেই বলেছে তোকে কথাগুলো বলতে। যদি তুই শুনিস, তাহলে ... তাহলে আবার আমাদের মেলামেশা করত দেবে। আসলে দাদার উইকেটের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। দাদা এবারের টুর্নামেন্টের হাইয়েস্ট উইকেটটেকার হতে চায়। বোল্ড হয়ে যাবি তো সু ? আমি তোকে না দেখে থাকত পারছি না।’
আমার মাথা রাগের চোটে যেন ছিঁড়ে যাবে। গরগর করে বললাম, ‘ তা আমার মত এলেবেলেকে এই লোভনীয় প্রস্তাব দিচ্ছে কেন আদিদা ? আমি তো আস্তের ওপর সোজা বল করি। আমাকে ভয় পাবার কি!’ দোলন বলল, ‘ তুই বুঝি লোকাল কাগজ পড়িস না? রোজ তো তোকেই নিয়ে খবর করছে ওরা। ফাইনালের আগে নাকি লড়াই দাদার বোলিং আর তোর ব্যাটের। দাদার কলেজ তাই ভয় পেয়ে গিয়েছে। দাদা একটু আগে আমার ঘরে গিয়ে অনেক আদরটাদর করে তোকে কথাগুলো বলতে পাঠালো। সু, এটা তোর আর আমার ভবিষ্যতের ব্যাপার। রাজি হয়ে যা সু!’
জীবনে বোধহয় এত জোরে চিৎকার করিনি। আমার চিৎকার শুনে রাস্তার লোকজন ঘুরে তাকালো। বললাম, ‘ আদিদাকে বলে দিবি, মাথা নিচু করে বিকিয়ে গিয়ে, মেরুদণ্ড বন্ধক রেখে আমি তোকে চাই না। কাল যদি আমি দলে থাকি, যদি ব্যাট বা বল করবার সুযোগ পাই, তাহলে আদিদাকে তো বটেই, ওর কলেজের সবকটা বোলার বা ব্যাটসম্যানকে শেখাবো ক্রিকেট কাকে বলে। ফিরে যা দোলন। আদিদা বলেছে, আমি বামন। তোর মত চাঁদের দিকে তাকানোর যোগ্যতা নেই। জীবনে যদি যোগ্য হতে পারি, তাহলেই তোকে চাইবো রে। নইলে, এই আমাদের শেষ দেখা।’ কোথা থেকে এমন মনের জোর পেলাম কে জানে! দোলা দেখি কাঁদতে কাঁদতে চলে যাচ্ছে। বুকটা মুচড়ে উঠলো। ভাবলাম, ছুটে গিয়ে ওর হাতটা ধরে বলি, আমায় ক্ষমা করে দে রে! আমি সত্যিই তোর যোগ্য নই। পারলাম না। কে যেন আমার পা দুটোকে ফুটপাথে পেরেক দিয়ে গেঁথে দিলো।
ফাইনালের ম্যাচে আদিদার কলেজ দেড়শোর বেশি রান করতে পারেনি। বিভ দারুন বল করেছিল। চার ওভারে মাত্র সাত রান দিয়ে নিয়েছিল পাঁচ উইকেট। আমিও ওকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছিলাম। তিন ওভারে মাত্র তিন রান দিয়ে তুলেছিলাম তিনটে উইকেট। আর বাদি দুটো রানআউট আমারই কৃতিত্বে। সেই দুই ‘ গাড়িচাপা’ পড়া ব্যাটসম্যানের একজন আদিদা। মিড উইকেটে বল ঠেলে ছুটতে শুরু করেছিল। বোলার এইন্ডে প্রায় পৌঁছও গিয়েছিল। রানটা সম্পূর্ণ হয়নি আমারই ডাইরেক্ট থ্রো উইকেট ভেঙে দেবার পরিনতিতে। জ্বলন্ত চোখে আমাকে দেখতে দেখতে ফিরে গিয়েছিল আদিদা। ইচ্ছে করেই ওর দিকে তাকাইনি। মনে মনে বলেছি, আদিনাথ মুকুজ্জে, তুমি আমার জীবন থেকে দোলনকে কেড়ে নিতে পারো, কিন্তু আজ জিততে হলে তোমাদের একটা পাহাড়ের ডিঙোতে হবে। পাহাড়টার নাম সুজন চক্রবর্তী। একটা ন্যাতা পাকানো নিরীহ কেঁচোকে তুমিই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অ্যানাকোন্ডা বানিয়ে দিয়েছো। বোঝো, কেমন লাগে!
কিন্তু খচে গিয়ে আদিদা যে তাণ্ডবটা শুরু করলো, তার কথাও বলতে হবে। প্রথম ওভারে তিন, পরর ওভারে এক আর তার পরের ওভারে দুই উইকেট নিয়ে আদিদা যেন বুঝিয়ে দিলো, আমি হারিয়ে যাইনি। ম্যাচে ভরিমাচ আছি। আজ তোদের কোচুকাটা করবো। আমাদের রান ৫০–৬। উল্টেদিকে বোলারদের নিয়ে ছেলেখেলা করছে দেবাংশু। পরপর বাউন্ডারি আর সিক্সারের ঝড় তুলেছে। ৪০ করেছে। কিন্তু আদিদার মুখোমুখি হতেই সে কেমন যেন গুটিয়ে গেল। কোনমতে দুটো ওভার ডিফন্স করলো। তারপরের ওভারে ওর অফস্টাম্প ছিটকে দিল আদিদার লেগকাটার। এবার বিভর নামবার কথা। কিন্তু হারুনস্যার ওকে ঠেকালেন। তারপর আমাকে ইশারায় নামতে বললেন। ব্যাটবগলে আমি নামতেই আমাদের কলেজের সমর্থকেরা দারুণ উল্লাস শুরু করলো। আমি কোনদিকে না তাকিয়ে লেগস্ট্যাম্পে গার্ড নিলাম। আদিদা ছুটতে শুরু করেছে। তার সাতফুটের কাছাকাছি লম্বা শরীরটা যেন বিশফুট দেখাচ্ছে। আমার বুক দুরদুর করছো। মনে মনে বললাম, ট্রাম্পার সাহেব, আপনি আছেন তো? আমাকে বাঁচান স্যার। যেন কোনমতেই বোল্ড না হই। আদিদার অফকাটারটা পিচে পড়ে চকিতে ঘুরলো। আমি লেগের দিকে সরে গিয়ে সেটাকে তুলে দিলাম স্কোয়ার লেগের ওপর দিয়ে। ছক্কা!
এই পর্যন্ত আমার সব কিছু মনে ছিল। তারপর যেন ঘুমিয়ে পড়লাম সন্মোহিত হয়ে। ঘুম যখন ভাঙলো, তখন দেখি আমাদের আরও দুটো উইকেটের পতন ঘটেছে। শেষ বল করত আসছে আদিদা। মাঠের বাইরে থেকে হারুনস্যার, দেবাংশু দু’হাত তুলে ছক্কা মারতে ইঙ্গিত করছে। স্কোরবোর্ডের দিকে তাকালাম। দেখি আমরা ১৪৫–৯। শেষ বলটাতে ছক্কা মারতে পারলে, আমরাই জিতবো। না পারলো, আদিদারা। আমার নামের পাশেও দেখি লেখা আছে ৯৯! এত রান আমি করে ফেলেছি! আমিই?
আমাকে জল খাইয়ে ফিরে গেল টুলেভথ্ম্যান অরুণ। বলে গেল, ‘টেনশন নিবি না। ছক্কা না মারতে পারলে আমরা জিতবো না। তাত কী হলো? একটা প্রথম রাউন্ডে হেরে যাওয়া কলেজ ফাইনালে উঠেছে, শেষ বল পর্যন্ত টক্কর দিয়েছে। আবার কি চাই? দেবাংশুক হারুনস্যার বারবার বলেছিলেন তোকে ওয়ানডাউন নামাতে। নামিয়েছিল দেবাংশু? ক্যাপ্টেন না কান্ট্রিলিকার।’ মনে মনে বললাম, তুই জানিস না রে অরুণ, আমার না জিতে উপায় নেই। আমার অনেককেই, অনেক অনেক জবাব দেবার আছে।
আদিদা ম্যাচের শেষ বল ডেলিবভারি দিতে দৌড় শুরু করেছে। আমি তৈরি। আদিদার নিখুঁত বাউন্সারটা আমার শরীর লক্ষ করে ধেয়ে আসছে। এই বলের মোকাবেলা কী ট্রাম্পার সাহেবও করতে পারবেন? হঠাৎ আমি শূন্যে লাফিয়ে উঠলাম। তারপর বলটাকে শরীরের বাঁদিকে নিয়ে সপাটে ব্যাট চালালাম। চোখের সামনে বলটা আকাশে উঠে স্টেডিয়ামের সৌরভ গাঙ্গুলী স্ট্যান্ড পেরিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেল......
আমাকে কাঁধে নিয়ে মাঠের বাইরে নিয়ে এলো দেবাংশুরা। দেখি ছোটমামা বসে। আমাকে দেখেই ফিসফিস করে বললেন, ‘ বুঝলি সুজন। মেলবোর্ণের ওই বুড়োটা আমাকে ঠকিয়েছে। ব্যাটা ব্লাফ দিয়েছিল, টুপিটা ট্রাম্পারের বলে। আমার এক বন্ধু আজই চিঠি লিখে জানিয়েছে, ভিক্টর ট্রাম্পারের ব্যবহৃত সব কিছুই জাতীয় সম্পদ হিসেবে যাদুঘরে সংরক্ষিত। এমন কী যে টুপিটা ট্রাম্পারের বলে দিয়েছিল, তিনি ওরকম টুপিই পড়তেন না। তুই ওটা ফেলে দিস!’
মাথা থেকে নোংরা বিবর্ণ টুপিটাকে চোখের সামনে তুলে ধরলাম। বললাম,‘ তাহলে তুমি বলছো, ট্রাম্পারের আত্মাফাত্মা সব বাজে কথা। যা করেছি আমি নিজে। মায় শেষ বলে ছক্কাটাও?’ ছোটমামা আমকে আদর করে বললেন, ‘ ইয়েস ভাগ্নে। ইয়েস। অফটারঅল তুই কার ভাগ্নে দেখতে হবে তো?’
এদিকে মাইকে দেখি জোরে জোরে আমার নাম ডাকা হচ্ছে। ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছি! জীবনে এই প্রথমবার। পুরস্কারটা হাতে নিয়ে দেখি আদিদা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো। বললো, ‘ তুই তোর যোগ্যতা প্রমান করে ছেড়েছিল সুজন। আর তোকে ঠাট্টা করা যাবে না। আজ থেকে উই আর ফ্রেন্ডস। আর আমার ওপর রেগে থাকবি না তো?’ আমি আদিদার বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেললাম। জড়ানো গলায় বললাম, ‘ তুমি— তুমি, তুমিই তো। একটা এলেবেলেকে তুমিই ঘুরে দাঁড়াবার পথ দেখালে। না হলো কী ছিলাম তা তো কেউ না জানুক আমি জানি।’
আদিদা পিঠ চাপড়ে বললো, ‘ সত্যিকারের আগুন যাদের ভেতর থাকে তারাই ঘুরে দাঁড়াতে পারে। তুই প্রমান করেছিস, তোর ভেতরে আগুন রয়েছে। কাল থেকে ভোরে শুভশ্রী সংঘের মাঠে আসবি। ফুটওয়র্কে একটু গলদ আছে । শুধরে নিবি।’ তারপর আদিদা আমাকে ঘুরিয়ে দিল পিছন দিকটায়। দেখি কাঁদতে কাঁদতে দোলন এগিয়ে আসছে। ম্যান অব দ্যা ম্যাচের পুরস্কার হাতে দাঁড়িয়ে থাকা আমার, হ্যাঁ, হ্যাঁ আমারই দিকে।
আমার চোখ ফের ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছি দোলন আসছে, দোলন আসছে... কিন্তু ওর এইটুকু পথ পার হতে এতো সময় লাগছে কেন!
0 comments:
Post a Comment