সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

মালেশিয়া ভ্রমন 

তপন কুমার দাস 


আজ সকালে এসে পৌছেছি মালয়েশিয়া তে। রাজধানী কুয়ালালামপুরে র পথে এগিয়ে চলেছি দূষণ মুক্ত শান্তি র পৃথিবী গড়ার আবেদন নিয়ে। এটি আমাদের পর্যায় ক্রমে বিশ্ব পরিক্রমার চতুর্থ অধ্যায়। মালয়েশিয়া থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে ইন্দোনেশিয়া র বালিতে গিয়ে শেষ হবে আমাদের যাত্রা। সুন্দর সাজানো রাজপথ। যাত্রী এবারেও আমি একা। না , একেবারে একা নই, সাথে রয়েছেন স্থানীয় মানুষেরা, আমার একধারে ব্যানার ধরে আমাদের কেরালার মানুষ আর অন্যধারে মালয়েশিয়ার অধিবাসী।


পুরো মালয়েশিয়াই পাহাড়ে ভরা। পাহাড় দিয়ে ঘেরা বলা যায়না, সারা দেশজুড়েই পাহাড় যেন এখানে ওখানে কেউ ওপর থেকে বসে দিয়েছে। পাহাড় কেটে পথ, তাই পথ ও ক্রমাগত উর্ধ ও নিন্ম গামী। প্রচন্ড রৌদ্র তাপ আর আদ্র তায় উঠতে উঠতে হাপিয়ে উঠি।পাহাড়ি ঢাল বেয়ে ওভার ব্রিজে উঠতে উঠতে নজরে পরে সুন্দর ছবির মত করেই ধাপ কাটা, গিরিরাজ যেন মর্ত্যের ছাদে মানে ব্রিজে এসে পথ রাখছেন। আবার কথাও পথ হয়েছে পাতালগামী।

 
শহরটা যে একো উন্নত আর আধুনিক, ধারণা ছিলোনা। ক্রমাগত ওভারব্রিজ ভাঙতে ভাঙতে যখন কুয়ালালামপুর যখন এসে পৌছালাম তখন প্রায় সন্ধ্যে। একজায়গায় ছবি তোলার জন্যে দাঁড়াতে, এগিয়ে এসে হাসিমুখে ছবি তুলে দিলেন ব্যাঙ্গালরের নির্মাণ শ্রমিক। সস্তায় কোথায় থাকা যায় ? উত্তর এলো, কোয়ান্টান চলে যান ,অনেক বাঙ্গালী থাকেন, ওরা একটা কিছু ব্যবস্থা করে। 

পৌছে বাঙালি নজরে আসার আগেই গুরুদ্বয়ারা নজরে এলো, ঢুকে পরতেই সমাদরে আগেই তারা খাবার ঘরে পৌছে দিলো। তাদের দৌলতেই রাতের ঠাইও মিলে গেলো।

পরদিন সকাল কিছু জরুরী কেনাকাটার জ‍ন‍্য অপেক্ষা করতে হলো।সাত সকালেই হকার্স মার্কেটে আলাপ হলো,বাংলাদেশের এক ছাত্রের সাথে।বাড়ি আমাদের দিনাজপুরের লাগোয়া। এখানে পড়াশোনার।পাশাপাশি একটি হোটেলে কাজ করে, তার সাথে রাতজেগে সেলাই করে রমজানের পোষাকের চাহিদা মেটাচ্ছে অতিরিক্ত কিছু উপার্জনের আশায়। ইচ্ছে আছে এখানে কিংবা অষ্ট্রেলিয়ায় সেটেলড্ হবার।বললাম এই অল্পবয়সে বাড়ি ছেড়েছো, মন খারাপ করেনা ? দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবাব এলো,আর করলে কি করা যাবে ? এটা আমাদের বাচার লড়াই। ওর কাছে ফোনটি চার্জ হতে দিয়ে বেড়িয়ে এলাম। কানে তখনো কথাটা বাজজিলো। সত‍্যিই বাচার লড়াই ! পুরো হকার মার্কেট জুড়ে 80ভাগ বাংলাদেশী। কেউ কেউ ভাবতে পারেন, বাংলাদেশী রা ভারতেও আছে, সর্বত্র আছে। 

তাঁদের জানার জন‍্য বলি, কাজের সন্ধানে এদেশে আসা বোধহয় দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠি হলো তামিল। প্রতি মোড়েই তামিল কিম্বা বাংলাদেশী মানুষকে আপনি খুজে পাবেনই। আদিম মানুষ বাচার সন্ধানে যাযাবরের জীবন বেছে নিতো।সভ‍্যতার এতো অগ্রগতি, তাও মানুষের মৌলিক চাহিদার পূরণ হলোনা। সেই বাচার জন‍্য আজ ও মানুষ দেশান্তরী। বিশেষত ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভাগ দেশগুলির মানুষের যেনো, রাজনৈতিক স্বাধীনতা জুটিলেও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, কাজের স্বাধীনতা,খেয়ে পড়ে বেচেঁ থাকার স্বাধীনতা আসিলো না।

দুপুর থেকে বৃষ্টি, শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সেদিন কুয়ালালামপুর ছাড়লাম। ভীড় ঠেলতে ঠেলতে যখন শহরের বাইরে এলাম, তখন সন্ধ্যে গড়িয়েছে। জ্যাম থেকে ছাড়া পেয়ে গাড়িগুলোও গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। 


গতির পাশে থাকলে আপনিই গতি বেড়ে যায়, আমার সাইকেল ও তাই ছুটছে। ওভারব্রিজের পর ওভারব্রিজ। শেষ ব্রিজটা থেকে নেমে বাদিকের লেনে জায়গা নিতে গিয়ে দেখি পাশাপাশি দুটো গাড়ি কাছে চলে-এসেছে। কি মনে করে হটাৎ ই থমকে গেলাম। তারপর ই মুহুর্তের স্মৃতিভ্রম, মনে হল আমি বোধ হয় উড়ে যাচ্ছি। ছিটকে আট দশ ফুট দুরে যখন পরলাম, তখন সম্বিত ফিরলো। পাহাড়ের কাছ থেকে হার না মানতে শিখেছি, মুহুর্তে তাই দাড়িয়ে পরলাম। দেখি গাড়ির চালক ভদ্রলোক আতঙ্কে গাড়ি থামিয়ে ছুটে এসেছে। বলল, ঠিক আছেন আপনি ? আমি বললাম হ্যা। আমি কিছু বলার আগেই উনি ততক্ষনে আমার সাইকেলটা গাড়িতে তুলে নিয়েছেন। আমাকে বললেন উঠুন, আমি তখন ভাবছি যাক বৃষ্টির হাত থেকে বাচা গেলো। উনি জিজ্ঞাসা করলেন আপনি কোথায় যাবেন ? বললাম কাজান। ততক্ষনে ওনার পাশের সিটে জায়গা নিয়েছি। বললাম আপনার বাড়ি ? বলল এই কাছেই। ভদ্রলোক বললেন আপনি ভাববেন না, আপনাকে আমি নামিয়ে দিয়ে আসছি। আমি আর আপত্তি করলাম না। তখনো জানি না আমার সাইকেল দেহ রেখেছে। হটাৎ নজর গেলো গাড়ির সামনের স্ক্রিনের দিকে, কাচ-টায় গোল গোল করে ফাটল ধরেছে, ভাবলাম গাড়িটার যত্ন নেন না ভদ্রলোক। স্ক্রিনের দিকে আমার তাকানো দেখে ভদ্রলোক বলে উঠলেন, আপনার হেলমেট টা খুব ভালো। আমার তখন অবাক হবার পালা। এ্যা ! বুঝলাম, হেলমেট টাই এই যাত্রায় আমায় বাঁচিয়ে দিয়েছে।

কাজানে এসে গেছে, কোথায় নামাবো ? আজ কোথায় থাকবেন ? ভদ্রলোকের প্রশ্নে মুস্কিলে পরলাম। ওভাবে তো কিছু ঠিক করা নেই। যখন যেখানে পারি রাত কাটাই। বললাম বৌদ্ধ মন্দির একটা আছে, পারলে ওখানে নামিয়ে দিন। উনি জিজ্ঞাসা করলেন আপনি হিন্দু? জবাব দিলাম জন্ম সুত্রে তাই, কিন্তু আমি মানবতাবাদী। ভালোবাসি সব ধর্মের মানুষকেই। উনি কি বুঝলেন কে জানে ? সোজা নিয়ে হাজির করলেন একটি দক্ষিণ ভারতীয় হিন্দু মন্দিরে। গাড়ি থেকে সাইকেল নামলে এতক্ষনে তার অবস্থা টের পেলাম, পেছনের চাকা, রিঙ, বেকে গেছে। সে এক পা ও এগোতে রাজি নয়।হাঁটু, কনুই, ছড়ে গেছে। পা ফেলতে গিয়ে দেখলাম, বা পায়েও লাগছে, স‍্যাক কাঁধে নিতে গিয়ে দেখলাম বা কাঁধে ও তথৈবচ।। বুঝলাম রাত আজ এখানেই কাটাতে হবে। ভদ্রলোক ততক্ষণে গাড়ি ঘুরিয়ে যাবার আগে আমায় বললেন আপনি ইচ্ছে করলে থানায় যেতে পারেন, আমি বললাম না না, দোষ আমার ও। উনি আমার হাতে ৫০টাকা(ভারতীয় টাকায় ১০০০/-) দিয়ে বললেন সাইকেল টা সারিয়ে নেবেন।

আমি এবার মন্দিরের দিকে এগোলাম। হিন্দুত্ববাদীরা শুনলে আঁতকে উঠবেন। মন্দিরের দ্বাররক্ষী একজন পাকিস্তানী। বললাম ভারত থেকে এসেছি, রাতটা এখানেই থাকতে চাই, আপত্তি আছে ? শুনেই ভদ্রলোক হৈ হৈ করে উঠলেন, না না । হবেনা। আমি সোজা হাজির হলাম প্রধান পুরোহিতের কাছে। তাকে বললাম, সাইকেল টা এ‍্যাক্সিডেন্ট হয়েছে আমি ও আহত, রাতটুকু যাতে এখানে যাতে যে কোন জায়গায় থাকতে পারি, তার অনুমতি দিন। সে এবং অন‍্যরা এগিয়ে এসে সমস্বরে বলতে লাগলো না না, এখানে রাতে থাকা যাবেনা। আমাকে মুখ ঝামটা করার ফাঁকে ই আবার দেখি মিষ্টি হেসে আরেকজনের দিকে আসুন আসুন করে এগিয়ে গেলেন, তাকিয়ে দেখলাম গাড়ি থেকে নেমে আসছেন এক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা, শাসাঁলো খদ্দের পেয়ে তার দিকে ই এগিয়ে গেলেন। তাদের মন্দিরের গুনগান আর দেবতা কতটা জাগ্রত তা বোঝাতে ব‍্যস্ত হয়ে পরলেন। বুঝলাম, দেবতা ও টাকায় বিক্রি হন। শাসাঁলো খদ্দের পেয়ে তার দিকে ই এগিয়ে গেলেন। তাদের মন্দিরের গুনগান আর দেবতা কতটা জাগ্রত তা বোঝাতে ব‍্যস্ত হয়ে পরলেন। বুঝলাম, দেবতা ও টাকায় বিক্রি হন। এখন আমার কথা শোনার সময় নেই তাদের। মন্দির বন্ধের আগে শেষ খদ্দেরটা যদি মারা যায়। হাঁটু, কনুই থেকে তখন রক্ত গড়াচ্ছে। স‍্যাক থেকে স্প্রে বার করে চোটের জায়গায় স্প্রে করলাম। তারা ফিরে এলে বললাম, তাহলে এক কাজ করূন, আমার সাইকেলটা অন্তত মন্দিরে রেখে দিন। ভারত, পাকিস্তান সবার এক সুর , সেটা হতে পারে, সাইকেল থাকতে পারে, কিন্তু কিন্তু আপনি থাকতে পারবেনা। অগত্যা সাইকেল আর ব‍্যাগ রেখে স‍্যাক কাঁধে বেড়িয়ে পরলাম। যাবার আগে একবার মন্দিরের চত্তরটা চোখ বুলিয়ে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। নাই নাই করে বিঘা আটেক জায়গা নিয়ে তৈরী, রয়েছে এসি, নন এসি ঘর কিন্তু সবই দেবতার প্রিয়পাত্র আর অতিথি আর অভ‍্যাগতদের জন‍্য। মনটা খারাপ হয়ে গেল, ভেবেছিলাম ভারতীয় বলে কাছে টেনে নেবে। ও বাবা !

 

মানুষের প্রতি যাদের মমত্ববোধ নেই, ভালোবাসা নেই, 'মন্দিরে তারাই ভক্ত হয়েছে আজি'। হয়েছেন দেবতা ঠিকেদার। এসি বা নন এসি নয়, এত বড় চত্তরে একটি ম‍্যাট্রেস পাতার ও জায়গা তারা দিতে পার‍লেন না, ভেবে অবাক হলাম। মনে মনে বললাম, যে ঈশ্বর আহত একজন মানুষকে আশ্রয় দিতে পারেন না, তার আর মহত্ত্ব কোথায় ?আমার ঈশ্বর বরঞ্চ সেই গরীব তামিল মানুষ গুলো,  যারা শেষ পর্যন্ত রাত ১১টা অবধি আমার থাকার ব‍্যবস্থা করার জন্য ব‍্যস্ত থাকলেন।আমার ঈশ্বর সেই বা়ংলাদেশী যুবকেরা, যারা তাদের জন্য ছোট ঘরখানি আমার জন‍্য ছেড়ে দিয়ে নিজেরা একটি ঘরে গাদাগাদি করে রাত কাটালেন।

পরদিন সকালে উঠে আগে সাইকেলের ডাক্তারের কাছে ছুটলাম। বুড়ো ভদ্রলোক , বয়সের কারনে মেজাজটা সব সময় চরমে। রাতে দেখিনি, রি়ং টা ভেঙ্গেই গেছে। সারাবার উপায় নেই, পাল্টাতেই হবে ,আমার থেকেও সাইকেলটার জন‍্য বেশি কষ্ট হচ্ছিল। নেই নেই করে সাড়ে পাচ হাজার কিমি পথ চলেছে আমার সাথে, একবারের জন‍্য ও বেগর বাই করেনি।কিন্তু বুড়োর কথায় আমার মেজাজ খারাপ হলো, বলে কিনা ১০০ ডলার লাগবে। ভারতীয় মুদ্রায় ৬৭০০/-। আমি বললাম সেকি ! একটা রিঙ এর দাম এতো ! বললাম, ইন্ডিয়া তে এর দাম বড় জোড় ১০ডলার। বার কয়েক বলতে ক্ষেপে উঠলো। বললো, না সারাবেন তো বাড়ি নিয়ে চলে যান,ওখানে সারিয়ে নেবেন। কি করা যায় , এখানে আর দোকান ও নেই। ছুটলাম তামিল ভাইএর দোকানে।‌ সব শুনে বললো, আপনি ওনার কাছেই যান, ও ‌মালয়েশিয়ান ডলারের কথা বলেছে। ঠিক তাই, খামোখা বুড়োর সাথে ঝগড়া করলাম। ২০০০/- দিতে ও খুশিমনে কাজ শুরু করে দিলো। ডাক। বিকেলে, ডাক্তার দেখিয়ে,নতুন চশমা বানিয়ে সাইকেল-হাতে পেয়ে যখন কাজান ছাড়লাম, তখন ৫টা বাজে।

 

হাইওয়ে মানে এশিয়ান হাইওয়ে ধরে পথ চলা। রাত ৯টায় এসে পৌছালাম নিলয়। হাইওয়ে পথের ধারে সুন্দর আধুনিক ব‍্যবস্থা সম্পন্ন বিশ্রামাগার।ইচ্ছে করলে রাত ও কাটানো যায়। দোকানী ইন্দোনেশিয়া র মেয়ে। দোকানদার ও তাই। 

ইন্দোনেশিয়ার অনেক কেই দেখলাম কাজের খোঁজে মালয়ে। খাবার পর্ব মিটিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার তাঁবু রয়েছে, ওদিকে টানিয়ে শোয়া যাবে ? বললো, কেন নয় ? যেখানে খুশি থাকুন। সকালে আমায় ঘুম থেকে তুলে, চার্জ দিতে দেওয়া ফোন ধরিয়ে বললো, চললাম বাড়ি, মানে ইন্দোনেশিয়ায়, ভালো থাকবেন।

হাইওয়ের ধারে শোয়া, সারারাত গাড়ির আওয়াজে ঘুম হয়নি। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পরেছিলাম। টেন্টের উপর সৌর কিরনের প্রথম পরশে চোখ মেললাম। উঠে তারাতারি তৈরী হয়ে বেড়িয়ে পরলাম। আজ সারাদিন এশিয়ান হাইওয়ে ধরেই চলা। সিঙ্গাপুর আগে পর্যন্ত পুরো পথটাই পাহাড়ের ওপর দিয়ে। যদি ও পাহাড় গুলোর উচ্চতা খুব বেশি নয়। গুগল ম‍্যাপ দেখে ভেবেছিলাম বাবা এই পাহাড়ী পথ ডিঙিয়ে এগোতে হবে ! কিন্তু বাস্তবে দেখলাম, ওঠা আর নামা আছে ঠিকই, তবে খুব বেশি উচু বা নিচুতে নিয়ে যাচ্ছে না।

একনাগাড়ে গাড়ির ঘরঘর শব্দ, সবাই ছুটছে, কারো এক মুহুর্ত অপেক্ষা করার সময় নেই, পৃথিবীর গতির সাথে পাল্লা দিয়ে ছূটতে হবে। আমি ও ওদের সঙ্গী। তবে আমি যাচ্ছি আমার গতিতে, রাস্তার একেবারে বা ধার ধরে। মাঝে মধ্যে গাড়ির চালক রা যেতে যেতে উইশ করে যাচ্ছে। ভালোই লাগছে। হটাৎ ই দেখলাম রাস্তার একদিক জুড়ে কাজ হবে বলে সিভিক ভলেন্টিয়ার রা রাস্তার মাঝে গার্ডার বসাতে বসাতে চলেছে। অন‍্য গাড়িদের সাময়িক গতি কমিয়ে যেতে বাধ্য করলেও আমাকে কিন্তু সেলুট করে আগেই পথ করে দিলো। আমি ভাবলাম বাবা ! জাতে উঠে গেলাম!

মাঝে একটি রেষ্ট এরিয়া য় জল নিয়ে গিয়ে শুনি ফোনে লোক গীতি বাজছে! একজন ঠিকা শ্রমিক শুয়ে। আমি বললাম কি দাদা, বাঙ্গালী ? বললো হ‍্যা। তবে বাংলাদেশী। বললাম, হোক না। ভাষাই তো একজায়গায় করে দিয়েছে।

মেঘ করে আসছে , কথা আর না বাড়িয়ে বেড়িয়ে পরলাম, ১কিমিও যেতে পারলাম না , মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। হাইওয়ে রাস্তা এই এক অসুবিধা, আসে পাশে তাকিয়ে ও কোন ‌দাড়াবার জায়গা পেলাম না। বাধ‍্য হয়ে সাইকেল রাস্তার পাশে রেখে, দৌড়ে পাশের জঙ্গলটায় বড় গাছের তলায় অাশ্রয় নিলাম। আকাশ যেন ভেঙ্গে পড়েছে। এখানে ও জলের ফোঁটা, তবে একটু কম। হটাৎ ই কি মনে হতে ওপর দিকে তাকালাম। দেখি ও বাবা! ওপর থেকে গাছ বেয়ে হাত় পাঁচেকের লম্বা সাপ আমাকে স্বাগত জানাতে নেমে আসছে। আমি অভিষেক নই। এক ছুটে যাই আবার রাস্তাতেই চলে এলাম। আরো আধঘন্টা ওভাবে ভেজার পর বৃষ্টি থামলো।

 

এগোতে শুরু করতেই আবার ও। এবার আর থামলাম না। হটাৎ ই হাইওয়ে রাস্তা মাথায় ওভার ব্রিজ এলো। কিন্তু বেশ কিছু বাইক আরোহীর মত ওখানে আশ্রয় নিলাম। যত বৃষ্টি বাড়ছে, ব্রিজের নিচে আশ্রয় প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। কিছু গল্প আর কথাও চলছে। বৃষ্টি কমলে একে একে সবাই এগোতে লাগলো, হটাৎ ই কলেজ পড়ুয়া গোছের একটি ছেলে এসে আমার হাতে ২০০টাকা ধরিয়ে দিলো। আমি অবাক, বললাম একি! টাকা কেনো ? বললো পথে কিছু খেয়ে নেবেন। ভেজা গেঞ্জিটা খুলে গায়েএকটা গামছা জড়িয়ে ছিলাম। ভাবলাম, বোধহয় ও আমাকে দীনজনদের একজন বলে ও ভেবেছে।পরে দেখলাম না, এটাই মালয় এবং ইন্দোনেশিয়ার কালচার। ছোট বেলায় আমাদের বাঙালি বাড়িতে কোন আত্মীয় স্বজন এলে যাবার সময় ছোটদের ভালোবেসে হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে যেতেন, এ যেন অনেকটা সেই রকমই।

বৃষ্টি আজ সারাদিনের সঙ্গী হয়েছে। যাই যাই করেও যেতে চায়না। এদিকে র দেশগুলোতে বর্ষার বিদায়ের সময় এখন, কিন্তু উষ্ণায়নের ধাক্কায়, ঋতু ও আজ বেসামাল, সময় জ্ঞান হারিয়েছে। সন্ধ্যা র আগে চা খেতে ঢুকেছিলাম হাইওয়ের আধুনিক চটিতে। কথায় কথায় সন্ধ্যা গড়ালো।আকাশের ভাব দেখে এখানে ই থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। দোকানের তামিল কর্মচারী দের মারফত আমার আসার খবর পৌঁছালো কাফের মালিকের কাছে। ভদ্রলোক এসে জড়িয়ে ধরলেন, বললেন বসুন, আমি আসছি। একটু পরে দুহাতে দুটো কফি কাপ নিয়ে হাজির, বললেন, কফি ছাড়া গল্প জমেনা। তা বটে, মাথা নাড়লাম আমি। ভদ্রলোকের নাম হাজি। এই চটিতে ৪-৫টি দোকান রয়েছে তার। তবে পয়সা থাকলে ও তার গরম নেই। ভদ্রলোক ইংরেজি তে অনেকটাই সরগর। 


কথা শরু করলাম আমিই। বললাম কেমন আছেন আপনারা, এদেশের মানুষেরা ? উত্তর দিলেন মোটামুটি ভালো। বললাম, চাষবাসের খবর ? দুঃখ করে বললেন, বাগিচা ছাড়া আমাদের ফসল কোথায় ?এই প্রজন্মের ছেলেরা আর চাষের কাজে ঢুকতে রাজি নয়। এত জমি থাকতেও আমাদের খাদ‍্য আমদানি করতে হয়। আমি বললাম ঠিক ই, আসার পথে অনেক জমিই দেখলাম অব‍্যবহ্রত। সরকার থেকে তো কোন উদ্যোগ নিতে পারে ? সে আর কোথায় ? বললাম, ছেলে মেয়েরা সব স্কুলে যায়। উত্তর এলো,তা যায়। ছেলে মেয়ে দের কাজ কারবারের খবর কি? বেকারের সংখ্যা কেমন, বললেন, তার প্রায় ৭-৮ শতাশ হবে। পরিকাঠামো তো গড়ে তোলা হয়েছে অনেকটাই, শিল্প গড়ে উঠেছে কতটা ? বিদেশি কোম্পানি, বহুজাতিক সংস্থার দাপট কতটা? বললেন, ও ট্র‍্যাডিশনাল শিল্প কমছে। বাড়ছে বহুজাতিক কোম্পানি।পয়সা নিয়ে বিগত সরকার এদেরকে সমাজে-জায়গা করে দিয়েছে। অনেক কাজ করলেও শুধু মাত্র এই দূর্নীতি র কারনেই আগের সরকার কে জনগন ক্ষমতা থেকে বিদায় দিয়েছে। কথাটা আমি পথে তামিল এবং বাংলাভাষীদের ও কাছেও শুনেছি। আমি মনে মনে ভাবলাম বিশ্বায়নের নামে বিশ্ব লুটের ব‍্যবস্থায বিপর্যস্ত প্রায় সব দেশই।এরা তাও জবাব দিয়েছে। আর ভারতে ? বছরের পর বছর ধরে, জল, জমি, জঙ্গল খনি, সবই বেচা চলছে সরকারের উচ্চ স্তরের টাকা ছড়িয়ে,তাও আমরা নিশ্চুপ, দূর্নীতি যেন গা সওয়া হয়ে উঠেছে আমাদের । বললাম, শেষ প্রশ্ন করি, তামিল কিম্বা বাংলাদেশের বহু মানুষ রয়েছে এখানে। ওদের সম্পর্কে আপনাদের মনোভাব কী? অন‍্যান‍্য দেশে জাতি ধর্মের নামে বিড়াল চলছে, জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মানূষকে, আপনাদের এখানে অবস্থাটা কী ? জবাবে বললেন, দেখুন দূঃখ আছে ঠিকই। তাও এখানে কিন্তু আমরা সবাই মিলে মিশে গেছে আছি, তাই ই থাকতে চাই। বললাম বাঃ ! এই তো চাই। পথে তামিল বা বাংলার মানুষরাও কিন্তু একে স্বীকৃতি দিয়েছেন। সত‍্যি কথা বলতে কী ? মালয়, সিঙ্গাপুর এব়়ং ইন্দোনেশিয়া এই তিন দেশই কিন্তু এই প্রশ্নে দৃষ্টান্ত স্বরুপ হয়ে উঠেছে ।


ভোরের আজানের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গল। উঠে তৈরী হয়ে বেড়িয়ে পরলাম। ষোল কিলোমিটার দুরের এ্যাক্সিট দিয়ে বেড়িয়ে পড়তে হবে হাইওয়ে ছেড়ে। আজকের গন্তব্য ইতিহাস খ‍্যাত মালাক্কা বন্দর। হাইওয়েতে পথ মসৃণ। গতি ও বেশি,তাই অচিরেই এ‍্যাক্সিটের কাছাকাছি চলে এসেছি, হটাৎ ই সামনে এসে দাঁড়ায় একটি মোবাইল ট্রাফিক পুলিশের ভ‍্যান। ভাবলাম সিভিক পুলিশ এর মতো এরাও বোধহয় আমাকে হ‍্যন্ডসেক করে স্বাগত জানাবে। ও বাবা ! আমাকে দাড় করিয়ে বললো, আপনি জানেন না, হাইওয়ে ধরে সাইকেল চালানো নিষেধ। আমি বললাম কই কেউতো আমায় বলেনি। আর আমি তো আপনাদের সরকার কে চিঠি আর রুটম‍্যাপ দিয়ে আগেই জানিয়েছিলাম, কই তারা তো আমায় বারণ করেন নি, বরঞ্চ আমায় স্বাগত জানিয়েছেন। তারা বললেন, না , হাইওয়ে তে প্রচন্ড গতিতে গাড়ি যায়, আপনার নিরাপত্তা র জন‍্যই বলছি। কথাটা মেনে নিয়ে তাদের অস্বস্ত করে বললাম, আমি মালাক্কা যাবো। সামনের এ‍্যাক্সিট দিয়েই বেড়িয়ে যাবো।হাইওয়ে তে মানুষ জন পাই না, আপনারা বরঞ্চ আমার একটি ছবিতে তুলে দিন। খুশি মনে ই গাড়ি থেকে নেমে ছবিও তুলে দিলো। ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম।


কিছুটা দুরে বামমুখী পথ দিয়ে বেরোতে সামনের তোরনদ্বার, কিছু ঐতিহাসিক স্থাপত্য ও আমায় স্বাগত জানালো। স্বাগত জানালো সিঙ্গাপুরের সীমান্ত শহর জহড়বাড়ু থেকে আগত একটি ২৫জনের বাইক আরোহীর দল। কুয়ালালামপুর থেকে বালি এই দীর্ঘ পথ সাইকেলে যাবো শুনে সেলুট ও করলো।


 এগিয়ে চললাম আমি, আরো প্রায় ২৫কিমি পথ পেরিয়ে যখন শহরে প্রবেশ করলাম, পুস্পবৃষ্টি নয়, বৃষ্টি এসে আমায় ধুইয়ে দিলো।

শহরটা যথেষ্ট বড়, ভেতরে ঢুকে এক তামিল ফুল বিক্রেতা কে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় থাকা যায় ? উনি আমাকে কাছের হোটেলের ঠিকানা দিয়ে পাছে চিনতে না পারি, তাই নিজেই চলে এলেন সাইকেল নিয়ে। হোটেল এর দাম একটু বেশিই। আমি ভাবছি দেখে উনি বললেন চলুন, আপনায় শিখ গুরুদ্বোয়ারা তে নিয়ে যাই। তারই দৌলতে অবশেষে ঠাঁই মিললো।
 

বিকালে বেড়িয়ে পরলাম শহর দেখতে। একসময় এখানে ডাচ দের শাসন ছিলো। শহরের প্রানকেন্দেই ঐতিহাসিক স্মৃতী বিজরিত ডাচ ফোর্ট ও তাদের ঘর বাড়ি ও প্রশাসনিক এলাকা। আমাদের রাইটার্স বিল্ডিং আর লালবাজারের আদলে গোটা এলাকাটি লাল রং, দিয়ে অতীতকে ধরে রাখার চেষ্টা।


ভোরের আলো ফোটার আগেই লঙ্গরখানা র কড়াই হাড়ি ঠোকাঠুকি তে চোখ মেলতে বাধ‍্য হলাম। এই মানুষ গুলোর কোন বিরাম নেই, রোজ এত মানুষের পাত পাততে হয়, তার জন‍্য এদের উদয়াস্ত কি পরিশ্রম ই না করতে পারেন ! পারিশ্রমিক পান কিনা জিজ্ঞাসা করার সাহস হয়নি। পান না পান , গুরুর প্রতি নিবেদিত ভাবনা থেকেই যে তাদের এই শ্রমদানে দৃঢ়তা সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আসলে ভুল হোক আর ঠিক হোক, আদর্শের আর বিশ্বাসের টানেই মানুষ অনেক কিছু ত‍্যাগ করতে পারে।


তবে কাল রাতে কথা হচ্ছিল স্থানীয় অধিবাসী শিখদের সাথে। তারা কিন্তু দেখলাম ভারত ও বাংলাদেশ থেকে কাজের জন্য আসা মানুষদের উপর বিরক্ত। আমি বললাম যাবে কোথায় বলুন ? দেশে কোন তেমন কাজ নেই, তাই, খাদ‍্যর সংস্থান করতে ই তো এখানে আসা। কেন বাপু,য় যাকনা দেশে, লড়ে নিক না সরকারের সাথে সেখানে। কথাটা কেমন যেন ধাক্কা মারলো আমাকে। সত‍্যিইতো সবাই আমরা পালিয়ে নিজের মত করে বাচঁতে চাইছি, একটা স্বাধীন দেশ ৭০বছর পার করে দিলো, তাও নিজের লোকগুলোর খাওয়া পরার ব‍্যবস্থা করতে পারলো না। বছরের পর বছর ভোট হয়, যে মানুষের ভোটে সরকার গড়ে, সেই মানুষগুলোই কেমন অবহেলিত,ছন্নছাড়া জীবন কাটাচ্ছে, আর আমরা তা মেনেও নিচ্ছি !

সকালে উঠে চা খেয়ে বেড়িয়ে পরেছিলাম। সমুদ্র থেকে আসা ছোট নদীকে ঘিরে এই শহর। ভাটায় প্রায় জল কমে যায় অনেকটাই।এখানকার ছোট জেটি থেকে ছোট জাহাজগুলো মানুষ নিয়ে পাড়ি দিচ্ছে ইন্দোনেশিয়ায়, কিন্তু আমাকে যেতে সিঙ্গাপুর হয়ে। ফলে ফিরে এলাম শহর দেখে।




 গুরদ্বোয়ারায় দুপুরের খাবার খেয়ে বেড়িয়ে পরলাম। আজকের গন্তব্য ৫২কিমি দুরের মোয়ার শহর। শহর থেকে বেড়িয়ে ডানহাতি রাজ‍্য সড়ক কোষ্টাল লাইন বরাবর অনেকটা গিয়ে এশিয়ান হাইওয়ে অতিক্রম করে সোজা গিয়ে মিশেছে জহর বারু - সিঙ্গাপুর সীমান্তে।তরতর করে এগিয়ে চলেছে আমার সাইকেল। এ‍্যাক্সিডেন্ট এর দৌলতে, যদিও চাকা দুটি এখন ভারত ও পাকিস্তান। পাশাপাশি থাকে, কিন্তু কেউ কারো সাথে মিলতে পারেনা। কিছুটা পথ যেতেই হালকা পাহাড়ী চড়াই শুরু হলো। দুপারে নারকেল আর খেজুরের বাগান।
বাগিচা ফসলের ক্ষেত পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছি। হাজি সাহেব ঠিক ই বলেছিলেন, এত জমি অনাবাদি হয়ে পরে আছে, ভাবা যায়না, এটা জাতীয় অপচয় ও বটে। বিকেল হয়ে আসছে, হটাৎ ই একজায়গায় দেখি, খাবারের মেলা। রকমারি খাবার নিয়ে বসে গেছে। কিছুটা তার স্বাদ নিয়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মধ‍্যেই এগোতে লাগলাম। সন্ধ্যার মুখে পৌঁছে গেলাম মোয়ার। বড় শিল্প শহর। মোয়ার নদীর পাড়ে বড় শিল্প ও বানিজ্য শহর। 

শহরে ঢোকার মুখে দুর থেকেই নজরে পরলো সুলতানি মসজিদের চুড়ো। হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমায়। এই কথা দিনে আমি বুঝে গিয়েছিলাম, শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ মন্দির গুলো যেমন আমার রাতের আশ্রয়স্থল হয়েছিল এই যাত্রায় মসজিদ ই হবে আমার রাতের ছাদ, কারন এখানকার মসজিদে সবার অবারিত দ্বার। কাম্বোডিয়া কিম্বা শ্রীলঙ্কায় মসজিদে তাও জিজ্ঞাসা করেছিলো আমার ধর্ম কি? এখানে তার পাট নেই।রাজ‍্য সড়ক থেকে সামান্য ভেতরে, মোয়ার নদীর পাড়ে অনেকটা জায়গা নিয়ে সুলতানী মসজিদ।


 মালয়ের বড় মসজিদ গুলির একটি। প্রার্থনা গৃহের ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।অনেকেই বেড়াতে আসে এখানে়। নামাজ সবে শেষ হয়েছে, আমি ভেতরে প্রবেশ করতেই এগিয়ে এলেন এক ভদ্রলোক। বললেন বসুন, বলে ভেতরে চলে গেলেন, একটু পরে এলেন এক প্লেট খাবার নিয়ে। বললেন, দাদা, এমন সময় এলেন ! রমজানের মাস, আমাদের উপবাস চলছে, ভালো মন্দ কিছু খাওয়াতে পারলাম না,রমজানের মাস, আমাদের উপবাস চলছে, ভালো মন্দ কিছু খাওয়াতে পারলাম না, যা ছিল তাই দিলাম।আমি বললাম না না, অসুবিধা নেই, আমি পথে খেয়েই এসছি। বললাম রাতে থাকা যাবেতো ? বললেন হ‍্যা, হ‍্যা কোন অসুবিধা নেই, কিন্তু অসুবিধা হলো রাতে। এমনিতেই কোন মসজিদেই রাতে কেউ থাকে না। তাতে ও কোন অসুবিধা নেই, ফোনটা আমি চার্জে দিয়েছিলাম একটু দূরেই, রাত তখন সাড়ে দশটা। একটি ছেলে এসে বসলো মুখ ঘুরিয়ে বসলো ঐ ফোনের ই কাছে। কেয়ারটেকার যাবার সময় ইশারায় আমাকে বলে গেলো, ফোনটা কাছে এনে রাখুন, নিয়ে দৌড় লাগাতে পারে। আমি পরলাম এবার মুস্কিলে। যদি ও আমার বিশ্বাস, ধর্ম ভীরু মুসলিম মানুষজন মসজিদে কোন অপকর্ম করবে না, এবং সত‍্যি কথা বলতে কি, অনেক মসজিদে ই এবার একা একা রাত কাটিয়েছি, কিন্তু কোথাও কিছু হয়নি। সেদিন কিন্তু ছেলেটি র ঐভাবে একঘন্টা মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকা দেখে খটকা লাগলো, বুঝলাম মুখটা ও দেখাতে চাইছে না। ভরসা পেলাম না, একেই সারাদিনের ক্লান্তি তে একঘুমে সকাল হয়ে যাচ্ছে,তার মাঝে ও যদি ফোন বা অন্য কিছু নিয়েও চলে যায় , টের ও পাবোনা, ফোনটাই আপনাদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম।

রাত তখন সাড়ে এগারোটা, আর ঝুঁকি না নিয়ে মসজিদ ছেড়ে বেড়িয়ে পরলাম। এত রাতে শহরের দোকানপাট সব বন্ধ, কোথায় রাত কাটাবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। টেন্ট সাথে আছে, কিন্তু সাধারনত টেন্টে থাকতে গেলে লোকাল থানাকে জানিয়ে নিতে হয়। না হলে মাঝরাতে এসে পুলিশ ঝামেলা করবে, কিন্তু এখন থানাই বা পাবো কোথায় ? জিজ্ঞাসা ই বা করবো কাকে ? ভাবতে ভাবতেই একটা সেলুনের দোকান খোলা দেখে ঢুকে পরলাম। বললাম ভারত থেকে এসেছি, রাতে কোথায় থাকা এ যায় ? হটাৎ ই সেলুনের ছেলেটি সোল্লাসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো, এ‍্যা দাদা বাঙ্গালী। .... আমি বুঝে গেলাম, আজ রাতে আমি ওদের ই অতিথি।

আজিজ আর ওর দুই বন্ধু এখানে থাকে। ওর সেলুনের কাজ, মালিক ইন্দোনেশিয়ার। বছর ১২ এখানে আছে। ও‌ মাস গেলে ৫০০০/- বেতন, ভারতীয় মুদ্রায় এক লক্ষ টাকা। ওর বন্ধুর ব‍্যবসা, তার ও আয় অনেকটা। এই বাড়তি আয় ও এদেশে তাদের চলে আসার একটি কারন।তামিল মানুষেরাও অনেকে এখানে এসেছেন দু এক পুরুষ আগে। তাদের একটা অংশ আজ প্রতিষ্ঠিত। তবে বেশিরভাগ তামিল মানুষ কি এখানে, কি শ্রীলঙ্কায়, কিম্বা সিঙ্গাপুরে মজুর শ্রেণীর. কাজেই ব‍্যাপিত।

যাইহোক, কাল রাতে শুধু থাকার জায়গা র ভাগ দেয়নি, খাবারের ভাগ ও সমান ভাবে দিয়েছেন। আমি ভাবি, কে বলে ঘর শুধু চার দেওয়ালের মধ্যে ই রয়েছে, কবি ঠিক ই বলেছেন, ঘর রয়েছে দুনিয়া জোড়া, শুধু খুঁজে নেবার অপেক্ষা।

আজ আর বেশি দেরি করলাম না। এখন লক্ষ্য একটাই, জহরবাড়ু, সিঙ্গাপুর সীমান্ত। বিকালে পথ গিয়ে আবার মিললো এশিয়ান হাইওয়ে তে। এসেই যখন গেছি, হাইওয়ে ছেড়ে আজ আর ফিরে যাবো না। হাইওয়ে ধরে চললে রাস্তার দৈর্ঘ্য কমে, রাতের নিশ্চিত আশ্রয় ও জুটে যায়। আজ ও তাই হাইওয়ে চটিতে রাত কাটিয়ে, সকালে হাইওয়ে ছেড়ে আবার রাজ‍্য সরকার ধরলাম।


 অমনি পথ গেলো বেড়ে। ক্রমাগত চড়াই উৎরাই পেরিয়ে যখন জহর-বারু পৌছালাম, তখন বিকেল ৩টা।

ভেবেছিলাম এখানে দুপুরের খাওয়া সেরে, নিউজ মিডিয়া য় একটি খবর পাঠিয়ে তারপর সীমান্ত পার হবো, কিন্ত শহরের ওভারব্রিজ আর হাইওয়ে র গোলক ধাঁধায় পরে,অন‍্য বাইকগুলো কে ফলো করে এগোতে এগোতে একসময় আমি দেখলাম, যাঃ , আমি মালয়েশিয়া বর্ডারের সামনে। আর পিছিয়ে যাবার উপায় নেই। লাইনে দাঁড়িয়ে পাসপোর্টে এগিয়ে দিলাম, মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাতে ছাপ মেরে হাসিমুখে বিদায় জানালেন। পেছনে একবার তাকিয়ে দেখলাম, বিদায় মালয়েশিয়া, বিদায়। এখানে বলে রাখি সড়ক পথে গাড়ি নিয়ে, বাসে সিঙ্গাপুর চলে যাওয়া
যায়, তবে বাইক আরোহীর সংখ্যাই বেশি। তারা কর্মসুত্রে রোজ ই যাতায়াত করেন। জালে ঘেরা ওভারব্রিজ আমাদের হাজির করলো নদী ব্রিজে। এই নদীই দুদেশের সীমানা।

ব্রিজ পেরিয়ে সিঙ্গাপুর সীমানা র শুরু। বিরাট আধুনিক চেকপোস্ট। অনেক গুলো লেন। বাইক লেনে জায়গা নিলাম। আগে থেকেই আমার আসার খবর দূতাবাস মারফৎ তারা জানতেন। দেরি দেখে আবার মেল পাঠিয়েছিলেন। তার উত্তরে সকালে ই আমি আমার আজই আসার খবর মেল করে দিয়েছিলাম। ফলে চেকপোস্টে আমার খুব বেশি দেরি হলোনা। হাসিমুখে স্বাগত জানালেন তারা। পা রাখলাম আধুনিক শহর সিঙ্গাপুরে। 

স্বপ্নের শহর সিঙ্গাপুর, পুজিবাদী তথা ভোগবাদী দুনিয়ার অগ্রগতির প্রতীক সিঙ্গাপুর। ব‍্যাঙ্কক থেকে ও এগিয়ে। সুন্দর প্রশস্ত নিখুত রাজপথ, সুউচ্চ কমপ্লেক্স, নিখুত যান ব‍্যবস্থা ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রন। মানুষের চেহারায় যদি তার আর্থিক অবস্থার ছাপ মেলে, তাহলেও অন‍্য উন্নত পুজিবাদী দেশগুলি থেকে এদেশ কে এগিয়ে রাখতে হয়,কিন্তু পরিবেশ ভাবনার জগতে কিন্তু সে সবাইকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। আমার ভাললাগার কারন এই জায়গাতেই।

চেকপোষ্ট পেরিয়ে এপারে এসে পেছন ফিরে বেশ কয়েকটা ছবিও তুলে নিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। একজন পুলিস অফিসার মিষ্টি হেসে এগিয়ে এলেন। বললেন, এই ! আপনি জানেন‌ না চেকপোষ্টে ছবি তোলা মানা। আমি বললাম, তা জানিনা, তবে স্মৃতিতে ধরে রাখার চেষ্টা। মিষ্টি হেসে বললেন, না ছবি ডিলিট করে দিতে হবে। বলে এগিয়ে এলেন। আমি ফোনটা ওনার হাতে দিলাম,কিন্তু ওনার কপাল মন্দ তখনি চার্জ চলে গেলো। ভদ্রলোক হেসে ছেড়ে দিলেন।আমি অবশ‍্য স‍্যাটেলাইট দুনিয়ার যুগে এই কড়াকড়ির মানে বুঝিনা। যাই হোক ভদ্রলোক এবার জিজ্ঞাসা করলেন, যাবেন কোথায় ? মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এলো, পাঞ্জাবি টেম্পল। ও ! বেড়িয়ে বাদিকে চলে যান। চেকপোষ্ট থেকে ছাড়া পেয়ে তখন সব গাড়িগুলিই এখন ছুটতে লেগেছে। তার মাঝেই আমি সাবধানে বাদিক ঘেষে এগোতে থাকি। 

ওভারব্রিজ থেকে নেমে বাদিকে ঘুরতেই মেট্রো স্টেশন, বাস স্ট‍্যান্ড। একটু এগিয়ে ডানদিকে রাস্তার মোড়ে বড় বড় করে লেখা, 'সিঙ্গাপুর, এ বাইক সিটি'।

বাইক বলতে আমরা ভারতীয়রা মটর সাইকেল কেই বুঝি। কিন্তু বাইরের দুনিয়ায সাইকেল ই বাইক হিসাবে পরিচিত। 'বাইক সিটি' লেখা খানি দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম, নির্দিষ্ট কিছুটা এরিয়াতে হয়তো সাইকেল পথ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ও বাবা ! ছোট অঞ্চল কোথায় পাচ কিমি পথ চলে এলাম, বাইক পথের দৈর্ঘ্য ক্রমশ বেড়ে ই চলেছে। ভিয়েতনামে রাস্তার পাশে অনেকটা জায়গা সাইকেল ও বাইকের জন‍্য ছাড়া থাকত, আর এখানে দেখলাম, রাস্তাতেই নামতে হচ্ছে না। রাজপথের পাশে ফুটপাত,কখনো, অফিস, কাছারি, লোকের বাড়ি, বাগান কিম্বা পার্কের মধ‍্যে দিয়ে টুং টা়ং ঘন্টি বাজিয়ে চলেছে আমার আদরের সাইকেল। বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা, রাতের থাকার আস্থানা লিটল ইন্ডিয়া পৌঁছতে গিয়ে আমায় কম করে ৩০কিমি পথ সাইকেলে যেতে হয়েছে , কিন্তু একবার ও রাজপথে নামতে হয়নি। রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রে ও পথচারি ও সাইকেল যাত্রীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা । যখনই ওপারে যাবার প্রয়োজন হবে, আপনি আপনার কাছে র সিগন্যাল পোস্টর নিচে র দিকে রাখা সুইচটি টিপে দিন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ই হোয়াইট জেব্রায় সবুজ আলো জ্বলে উঠবে। আপনি নিশ্চিন্তে পার হয়ে যান। এটা শ্রীলঙ্কা তেও দেখেছিলাম, তবে যা এতো বিরাট আকারে নয়।

আরেকটি মজার ব‍্যাপার হলো, মেট্রো স্টেশন, বাস স্ট্যান্ড,হাট বাজার, অফিস আদালত সর্বত্র সাইকেল পরে আছে, কিম্বা দাড়িয়ে আছে। কেউ পাহারায় নেই। একজনকে দেখলাম, বাড়ি থেকে বেড়িয়ে, পথের ধারে পরে থাকা একটি সাইকেল তুলে নিয়ে চালিয়ে বাসস্ট্যান্ডে গেলেন, বাস দেখতে পেয়ে সাইকেল পথের ধারে ফেলে রেখে বাসে উঠে পরলেন, আমি ভাবছি, যা ! সাইকেলটার কি হবে ? ও বাবা ! কিছুক্ষণ পর দেখি আরেকজন লোক বাস থেকে নেমে ঐ সাইকেলটা নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। আমি ভাবলাম বা ! বেশ মজার ব‍্যাপার তো ! শহরময় এভাবে ই দাঁড়িয়ে আছে অজস্র সাইকেল, চক্রাকারে সবাই ব‍্যবহার করছে। পরিবেশের প্রতি দায়পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতা কতটা আন্তরিক হলে এবং কতটা বড় পরিকাঠামো গড়ে তোলা গেলে এটা করা সম্ভব, তা ভাবলে বিস্ময় জাগে।

আমাদের রাজ‍্যে এই সময় কালে কলকাতা বাদে রাজ‍্যের বাকি অ়ংশে ছাত্র - ছাত্রীদের মধ‍্যে লাখ বিশেক সাইকেল বিলি হয়েছে, যার প্রয়োজন আছে সেও পেয়েছে, যার প্রয়োজন নেই সেও পেয়েছে। যাদের দরকার নেই, এমন সাইকেলের কিছু অংশ যদি এই ভাবনার রূপায়নে ব‍্যয় করা হতো, তাহলে বোধহয় কলকাতায় কার্বনের নির্গম়নের মাত্রা কিছুটা কমিয়ে আনা যেতো।



লিটল ইন্ডিয়া মানেই বুঝছেন, অনেক ভারতীয়র বাস এখানে। সাধারণত তাই হয়, বিদেশ বিভূঁইয়ে সংখ‍্যা লঘু মানুষেরা তাদের নিরাপত্তা ও অন্যান্য সুবিধার স্বার্থে একসাথে বাস করতে পছন্দ করে। হোক না দুর, তবু ভারতীয় হয়ে আর অন্য জায়গায় যাই কেনো? সেই রাতে যখন লিটল শেষ প্রান্তে গুরদ্বোয়ারায় পৌছালাম তখন রাত প্রায় দশটা। মন্দিরের সবাই নিদ্রা গিয়েছেন। বাধ‍্য হয়ে আবার ফিরে এলাম লিটল ইন্ডিয়ার প্রান কেন্দ্রে। নামে ইন্ডিয়া হলেও আদতে বা়ংলাদেশী ও তামিল মানুষের ই ভীড় এখানে। অত রাতে তখনো দোকান পাট, মানুষ জনে জমজমাট রয়েছে এরিয়া। তাদের একজনকে জিজ্ঞাসা করে একটু কম দামে হোটেল মিললো, ডর্মেটারি তাও ১৩০০/- এখানে অবশ্য বাস, গাড়ি হোটেল সবই এসি।

পরদিন বৃষ্টিস্নাত সকালে ঘুম ভাঙ্গলো বেলা নটায়। উঠেও উঠতে ইচ্ছে করছেনা, পকেট আর মন দুজনেই শরীর কে জানান দিলো , উহু ! এই বিলাসিতা অলসতা ডেকে আনবে, এ তোমার জন্য নয়। উঠে রেডি হয়ে বেরিয়ে পরলাম আবার গুরদ্বোয়ারার উদ্দেশ্যে, কিন্তু মন্দিরের সেক্রেটারী জানান দিলো সরি ! হাউসফুল জায়গা দিতে পারছিনা। টেন্ট যখন আছে বলছেন তা হলে ইষ্ট কোষ্ট পার্কে চলে যান, ওখানে সরকারী-ভাবেই ক‍্যাম্পিং এর জায়গা রয়েছে।


 দুরত্ব কম নয়,১৮কিমি পথ চলতে চলতে ভাবছিলাম, ইস্ টেন্টের কথাটা না বললেই হতো ! মনে মনে খানিকটা বিরক্ত ও হয়েছিলাম, কিন্তু যখন ফ্লাইওভার টপকে পার্কে পোছালাম, তখন ভদ্রলোককে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারলাম না। ভাবলাম আরে! এ কোথায় এসেছি, এতে স্বর্গ ! সত্যি ই তাই সামনে দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র, উপকুল লেখা বরাবর প্রায় ১৬কিমি জায়গা জুড়ে সিঙ্গাপুরের পূর্ব প্রান্তে এই ইষ্ট কোষ্ট পার্ক।


ডানদিকে সমুদ্র কে রেখে গাছপালায় ছাওয়া সুন্দর পথ ধরে দেখতে দেখতে এগোচ্ছি। অদ্ভুত এক পরিবেশ! সকাল থেকে সবাই নিজের মত করে ব‍্যস্ত এখানে। কেউ, হাঁটে, কেউ ছোটে, কেউবা সাইকেলে। ছোটদের যেন বাধ৺ভাঙ্গা উচ্ছাস। কেউ আবার দুচাকার ব‍্যালেন্সের গাড়িতে , কেউ চাকা লাগানো জুতো পড়ে অথবা জালের দড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার কসরত করছে!


 ওদের উচ্ছাস আর আনন্দে একটা স্বর্গীয় পরিবেশ। মনে পরলো আমার কোলকাতার কথা। ছেলেমেয়ে গুলোকে আমরা ভালো একটা খেলার মাঠ দিতে পারিনা, ওদের ছেলেবেলা ফিরিয়ে দিতে পারিনা আমরা ! বড়বেলায় ওরা আর আমাদের কি দেবে ?

অবশেষে পৌঁছালাম পার্কের শেষ প্রান্তে ডি ব্লকে। সমুদ্র কে সাক্ষী রেখে বড় এক গাছের ছায়ে ঘর বাঁধলাম আমার। 

 


চারপাশে তাকিয়ে দেখি, আরো কিছু পরিবার, প্রেমিক প্রেমিকা এবং দলবেঁধে ছেলেমেয়েরা ও হাজির, উইকেট এন্ড কাটাতে এসেছে। সবাই গল্পে ব‍্যস্ত, আমি তখন একমনে তাকিয়ে সাগরের পানে। ধীরে ধীরে সূর্য চলেছে অস্তরাজে, দুরে দল বেঁধে দাড়িয়ে থাকা জাহাজের সারিতে জ্বলে উঠলো আলো, আকাশে সেজে উঠলো তারই আলোকমালায়। পূর্নিমার সেই রাতে তাঁবুতে আধোশোয়া আমি,বাইরে চাদের আলোক ছটায় সাগরের মৃদুমন্দ ঢেউয়ে রূপালী আলোর ঝিলিক। ভাবছিলাম আহা ! এই উন্মুক্ত আকাশ ছেড়ে, এত বড় মেঘের ছাউনি ছেড়ে, বৃথাই আমরা রোজ ঐ ১০/৮ফুট ঘরে গুতোগুতি করে মরি।

পরদিন ভেবেছিলাম রেষ্ট নেবো। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠলো না। সকালে চোখ মেলে দেখলাম, বাচ্চা বুড়ো সবাই দৌড়াচ্ছে। সিঙ্গাপুর বাসী ভীষণ রকম স্বাস্থ্য সচেতন, সকাল হলেই সবাই মাঠে। পঞ্চাশোর্ধ লোকেরা ও বেলা অবধি চার পাঁচ কিমি ছুটছে , কোলকাতা য় খুব একটা দেখা যায়না। যাই হোক, উঠে খানিকটা ওয়ার্ম আপ করে বেড়িয়ে 
ভারতীয দুতাবাস খুঁজতে গিয়ে আমার শহর ঘোরা হয়ে গেলো।খুঁজে বার করে তাদের কে আমার আসার খবর জানিয়ে আসতেই অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো।


ফেরার পথে লাইন ভুল করে, ঢুকে পরলাম হাইওয়ের মধ্যে। এখানকার হাইওয়ে তে সাইকেল চালানো একেবারেই মানা। আন্ডার পাসের ভেতরটা যেনো আগুনের গোলা ! সাই সাই করে ছুটছে সব গাড়ি। সাইডেও পা রাখার জায়গা নেই। বুঝতে পারছি উল্টো দিকে যাচ্ছি কিন্তু কিছু করার নেই। কি করে এই জতুগৃহ থেকে বেরোবো তাই ভাবছি ! হটাৎ দেখি হুটার র বাজিয়ে এক অল্প বয়সী ট্রাফিক অফিসার। সিসি টিভি দেখে ছুটে এসেছে। ও ঐ অবস্থায় হুটার বাজিয়ে আমায় বার করে নিয়ে এলো। তখন‌ যেনো নিজেকে আসামী না হয়ে ভি আই পি মনে হচ্ছিলো।

সিঙ্গাপুর একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। খুব বেশি বড় নয়। এখানে আমার মেয়াদ ছিলো ৩দিন। আজ মাঝের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে যাবো ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায়।

সিঙ্গাপুরের একটি বৈশিষ্ট্য হলো তার রেষ্টুরেন্ট গুলো। সকালে বিকালে শুধু নয়, সারাদিনই লোক গমগম করে। বিরাট বিরাট কমপ্লেক্স, তার লোকসংখ্যা ও কম নয়। পার্কে আধুনিক রেষ্টুরেন্ট থাকলেও স্থানীয় মানুষের সাথে মেলবার আশায় আমি আন্ডারপাস দিয়ে চলে যেতাম পাশের কমপ্লেক্স টায়। বড় বাজার, বড় সপি়ং মল সবই ওখানে। সাত সকালে রেষ্টুরেন্ট জমজমাট। তামিল দোকানদারের দম ফেলার ফুরসত নেই। ধোসা আর কফির অর্ডার দিয়ে বসলাম। একটু বেলা হয়েছে, বয়স্ক মানুষদেরই ভিড় বেশি। বেশিরভাগই অবসরপ্রাপ্ত।

টেবিলের উল্টো দিকেই একা বসে ছিল হান, কারো অপেক্ষায়। গল্প জুড়লাম ওর সাথে।বললাম ইন্ডিয়া থেকে এসেছি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলোতে পৌছাবার চেষ্টা করছি, দূষণ মুক্ত ও শান্তির পৃথিবী গড়ার আবেদন নিয়ে। সটান জবাব এলো, ভুল জায়গায় এসে পড়েছেন আপনি। হো হো করে হেসে উঠলাম আমি। সঠিক জবাব, কারন সত‍্যিই দেশটায় দূষণ নেই, 'Singapore is a garden city'

 
 কথাটিকে অনেকটাই বাস্তবায়িত করেছেন তারা। বললাম, আমি শুধু দিতেই আসিনি, কিছু নিতেও এসেছি। আপনাদের এই দূষণমুক্ত দেশ গড়ার উদ্যোগের কথা, শান্তি ও সম্প্রীতির সিঙ্গাপুর গড়ার কথা আমি পৌঁছে দেবো পৃথিবীর অন‍্য দেশে এবং আমার নিজের দেশেও। খুশি হলেন শুনে। বললাম পরিবেশ তো সুন্দর, কিন্তু কেমন আছেন এখানকার মানুষেরা। চাষের জমিই তো দেখলাম না সবইতো শহরে পরিনত হয়েছে, আপনাদের খাদ‍্যের যোগান আসে কোথা থেকে, ফসল ফলে কোথায় ? এর জবাব ওর কাছে ও ছিল না। বললো, এখানে বেশির ভাগ মানুষের জীবিকা ব‍্যবসা ও চাকুরী। বললাম ছোট দোকানদার ও শ্রমজীবীদের অনেকই তামিল বা বাংলাদেশের মানুষ, কোন সম‍স‍্যা হয়না ? বললো না, আমরা সবাই একসাথেই আছি। আমার ও অনুভব হলো, এরা বেশিরভাগ মধ‍্যবিত্ত মানুষ, ওনাদের পক্ষে গায়ে গতরে খাটা সম্ভব নয়। ফলে ওরাও বহিরাগত এই মানুষদের মেনে নিয়েছেন। অনেকটা ঠিক,কয়েক দশক আগে বিহার, উত্তর ভারত থেকে আসা মানুষদের বাংলায় এসে কাজ করার মত। প্রশ্ন গেলো, আচ্ছা, আপনাদের এখানে দরিদ্র মানুষ নেই ? বললো সে আর কোন দেশে না থাকে ? বেকারী ? আছে কিছুটা, 7-8 শতাংশ হবে হয়তো। আপনাদের গড় পড়তা বেতন ? ৪-৮হাজার সিঙ্গাপুরী ডলার। তবে মজদুরী র কাজে যুক্ত তামিল শ্রমিক দের সাথে কথা হচ্ছিল, তারা বেশিরভাগ ঠিকাদারের অধীনে কাজ করেন। তাদের গড় আয় দেড় থেকে দু হাজার ডলার, ভারতীয় মুদ্রায় এক সিঙ্গাপুর ডলার মানে ভারতীয় পঞ্চাশ টাকা। স্বাস্থ্যসরকারী ব‍্যাবস্থা আছে, তবে বেসরকারী ই রয়েছে বিরাট বিরাট হসপিটাল, মেডিক্ল‍্যেম সিষ্টেমের প্রাধান্য ই বেশি। আমার শেষ প্রশ্ন ছিলো, ভিয়েতনামে দেখেছিলাম,৫৮/৬০ এর পর সকলের জন্য পেনশন ব‍্যবস্থা। আপনাদের তেমন কিছু ? বললেন, না আমাদের তেমন কিছু নেই। যা আছে যা সরকারী ক্ষেত্রে, তবে কোথাও কোথাও প্রাইভেটে ও রয়েছে। বুঝলাম, দেশটায় উন্নতি হয়েছে অনেকটাই, তবে সবার দেশ হয়নি। ওনার ওঠার তাড়া ছিল, ধন্যবাদ জানিয়ে করমর্দন করে বিদায় নিলাম, উনি ও আমাদের কর্মসূচি র সফলতা কামনা করলেন।

 



 


 


0 comments: