সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
![]() |
| বৌদ্ধচিত্র |
প্রথম আন্তর্জাতিক বাঙ্গালী মনীষী শ্রীঅতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান
প্রকাশ চট্টোপাধ্যায়
প্রথম আন্তর্জাতিক বাঙ্গালী মনীষী হিসেবে সারা বিশ্বে খ্যাত, শ্রীঅতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে আজ আমরা ভুলে গেছি। বাঙ্গালী হিসেবে বিশ্বের দরবারে স্বাভিমানের প্রথম পরিচয় দেওয়া, শ্রীঅতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের জন্ম খ্রিষ্টীয় দশম শতকে, পাল সাম্রাজ্যের সময়, মুন্সিগঞ্জ জেলার (অধুনা বাঙলাদেশের বিক্রমপুর জেলা) বজ্রযোগিনী গ্রামে। দুঃখের বিষয়, তৎকালীন প্রায় কোন বিষয়েই লিখিত প্রামাণিক বিবরণ পাওযা যায় না, তাই তাঁর জন্ম-মৃত্যুর সঠিক সময় নিয়েও ঐক্যমত্যের অভাব আছে। অনেকের মতে, তাঁর জন্ম ৯৮০ খৃষ্টাব্দে, আবার অন্য মতে, তাঁর জন্ম ৯৮২ খৃষ্টাব্দে। হিন্দু তান্ত্রিক চন্দ্র রাজবংশের রাজা, পিতামহ শ্রীচন্দ্রের উত্তরসূরি, পিতা রাজা কল্যানশ্রী এবং মাতা প্রভাবতী দেবীর তিন পুত্রের একজন, শ্রীচন্দ্রগর্ভা, শিশু বয়স থেকেই ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান। শৈশব কালে লেখাপড়ার প্রথম পাঠ শেখেন তাঁর মায়ের কাছেই। এরপর বজ্রাসন বিহারে চলে যান লেখাপড়া শিখতে।
এরপর গুরু জেতারির কাছে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করেন পাঁচ রকম বিজ্ঞানের পাঠ দিয়ে। এরপর, উচ্চতর শিক্ষা লাভের উদেশ্যে পরিবার ও গৃহ ত্যাগ করে উত্তর ভারতে চলে যান এবং সেখানে পণ্ডিত রাহুলগুপ্তের কাছে কৃষ্ণগিরি মহাশ্রমে(বর্তমান মুম্বাইএর কাছে) শিক্ষালাভ সম্পন্ন করে গুহ্যবনবজ্র খেতাব লাভ করেন।
এরপর, মগধের ওদন্তপুরি মহাবিহারে, তৎকালীন মঠাধ্যক্ষ খ্যাতনামা বিদগ্ধ পণ্ডিত মহাচার্য শীলরক্ষিতএর নিকট হীনযান এবং মহাযান বৌদ্ধধর্ম বিষয়ে আরও উচ্চ শিক্ষা লাভ করে, মাত্র ১৯ বৎসর বয়সের মধ্যে, এখানকার শিক্ষা সম্পন্ন করেন এবং এরপর বৌদ্ধধর্ম ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন ধর্ম (বৈষ্ণবধর্ম, শৈবধর্ম, তান্ত্রিক হিন্দুধর্ম সবই) আত্মস্থ করেন। তিনি ৬৪ শিল্পকলা, তর্ক এবং যুক্তিবাদ সকলকিছুর বিষয়ে শিক্ষা, মাত্র ২২ বৎসর বয়সের মধ্যেই সম্পন্ন করেন। পাঠশেষে, মঠাধ্যক্ষ আচার্য শীলরক্ষিত, ধর্মে চমৎকারিত্বপূর্ণ বুৎপত্তির জন্য তাঁকে শ্রীঅতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান উপাধিতে ভুষিত করেন।
এরপর, আচার্য ধর্মরক্ষিত, মাত্র ৩১ বছর বয়সে অতীশকে বৌদ্ধভিক্ষুদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করেন।
জানা যায়, অতীশ বিভিন্ন সময়ে, নানা পর্যায়ে, অন্ততঃ ১৫০ জন গুরুর কাছে শিক্ষা লাভ করেন, যাদের একজন ছিলেন ধর্মকীর্তিশ্রী। অতীশ বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান তিনটি ধারাকেই সম্পূর্ণ আত্মস্থ করেন, যাদের মূল প্রবক্তা ছিলেন, ১)অসাঙ্গ এবং ভাসুবন্ধ, ২) নাগার্জুন এবং চন্দ্রকীর্তি, ৩)তিলোপা এবং নারোপা।
তিব্বতে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, তিনি মহাযান এবং বজ্রযান বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে, রাজা শ্রীবিজয়ের রাজত্বকালে ১২ বছর সুমাত্রায় কাটান। ১০১১ সালে অতীশ তাঁর শতাধিক ভক্ত শিষ্য এবং কিছু স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে সঙ্গে নিয়ে সুবর্ণদ্বীপে (সুমাত্রা, বা আধুনিক মালয়েশিয়া) গমণ করেন, এবং সেখানে গিয়ে সেখানকার খ্যাতনামা বৌদ্ধ ধর্মগুরু চন্দ্রকীর্তির কাছে বারো বছর ধরে বৌদ্ধধর্মের পাঠ গ্রহণ করেন।
এরপর ১০২৫ সালে, যে বছর দাক্ষিণাত্যের রাজা রাজেন্দ্র চোলা(১) সুমাত্রা আক্রমণ করেন, সেই বছরেই তিনি সিংহল হয়ে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন।
ভারতে আসার পরে, এদেশে তাঁর পাণ্ডিত্যের প্রচার এবং প্রসার হতে দেরী হয় নি। এখানে, ততদিনে হিন্দু ধর্মের মূল ভিত্তি, অবক্ষয়ের কবলে পড়েছে। তিনি সেই সময়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিখ্যাত ধর্মগুরুদের, আলাদা আলাদা ভাবে, তিনবার ধর্মের তর্কযুদ্ধে পরাস্ত করে, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব নিরঙ্কুশভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। এবং দেশে বৌদ্ধ ধর্মকে সংস্কার করে তার প্রসার এবং পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।
এইসময়, মগধসম্রাট পালরাজ মহিপালের অনুরোধে, তিনি বিক্রমশীলা মহাবিহারের (বর্তমানে বিহারের ভাগলপুরের সন্নিকটে) মঠাধ্যক্ষের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
এখানকার দায়িত্ব ছাড়াও, তিনি ১৫ বছর ওদন্তপুরি এবং সোমপুরি মহাবিহারের (পাহাড়পুর, নওগাঁও, উত্তরপূর্ব বাংলাদেশে) প্রধান হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। এই সোমপুরি মহাবিহারেই তিনি বিখ্যাত গ্রন্থ মধ্যমকরান্তপ্রদীপ অনুবাদ করেন।
এই সময়েই পালরাজা মহিপালের পুত্র নয়াপাল এবং কালাচুরির রাজা লক্ষীকর্ণের মধ্যে মতানৈক্যের কারণে যুদ্ধ বেধে যায়। উভয়েই আচার্য অতীশের অনুগত ভক্ত হওয়ায়, তাঁর মধ্যস্থতায় সেই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে, এবং শান্তি নামে।
এই সময়ে তিব্বতেও বৌদ্ধ ধর্ম প্রচলিত ছিল। তবে সেখানকার তৎকালীন তিব্বত রাজ ''লাং-দারমা''র প্রশ্রয়ে, এবং তাঁর অনুগামীদের স্বার্থান্ধতার কারণে, সেই ধর্মের প্রভূত বিচ্যুতি এবং অবমূল্যায়ন ঘটে। তাঁর অনুগামীরা ৭০ বছর ধরে বৌদ্ধ ধর্মকে কুসংস্কারে ভরিয়ে তোলেন। এরপর ধর্মরক্ষার্থে, ধর্মপ্রাণ এক ভিক্ষুর হাতে, রাজা লাং দারমার মৃত্যুর পর, পশ্চিম তিব্বতে ''গুজ'' (Guge) রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয় এবং তাঁদের আরাধ্য বৌদ্ধ ধর্ম ধীরে ধীরে স্পিতি, লাহুল, লাদাখ, জাঁসকার এবং উত্তর কিন্নরে প্রতিষ্ঠা ও প্রসার লাভ করে, এবং ক্রমে তিব্বতের সাথে এইসব জায়গাগুলি, সাংস্কৃতিক, জাতিগত এবং ধর্মবন্ধনে গভীরভাবে জড়িয়ে যায়। এইসময় গুজরাজ ''লা লামা ইয়াসে ওদ'' তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের উন্নতি এবং প্রসারকল্পে ভারতবর্ষ থেকে এদেশের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত, শ্রীঅতীশ দীপঙ্করকে সেখানে নিয়ে যেতে প্রয়াস শুরু করেন। এবং এর জন্য তিনি অতীশকে তাঁর দেশের সব সোনা দিয়ে দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। তবে অতীশ বয়সের কারণে, এবং তিব্বতে গমণপথের দুর্গমতার কারণে, প্রথমে সেখানে যেতে স্বীকৃত হন না। তবে গুজরাজের এই সোনা দিতে চাওয়ার কথা জানতে পেরে, তুরস্কের নোমাডিক রাজা কার্লুক তাঁকে আক্রমণ করে পরাস্ত করেন এবং এই আক্রমণ থেকে মুক্তি পেতে, তাঁর কাছ থেকে মূল্য হিসেবে গুজরাজের ওজনের সম পরিমাণ সোনা দাবি করেন। গুজরাজ ঘৃণাভরে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। বলেন, এত সোনার বিনিময়ে তাঁর এই মুক্তির চেয়ে, সেই অর্থে বৌদ্ধ ধর্মের উন্নতী অনেক বেশী কাম্য। তিনি বলেন, এই সোনা দিয়ে আমার মুক্তির বদলে, সেই সোনা শ্রীঅতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে সেই দেশে নিয়ে যেতে ব্যায় করা হোক। এরপর সোনা না দেওয়ায়, আক্রমণকারিদের হাতে রাজার মৃত্যু হলে তার ভ্রাতুষ্পুত্র ''চাং ছাব'' রাজা হন। তিনি এই সব ঘটনার কথা বিবৃত করে পুনরায় অতীশকে আমন্ত্রণ জানালে, এবার গুজরাজ ইয়াসে ওদের ধর্মানুরাগ এর কথা জানার পর অতীশ তা আর প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না, গ্রহণ করেন সেই আমন্ত্রণ। তবে, বিক্রমশীলা বিহার থেকে তাঁকে ছেড়ে দিতে প্রথমে কেউ রাজি হয়না। শেষে, তিনি ধর্ম সংস্কার এবং ধর্মপ্রসারে তিব্বতে না গেলে সেই তিব্বত দেশ অন্ধকারেই ডুবে থাকবে, তার কোনো উন্নতী হবে না, এই কথা জানালে, বিক্রমশীলা বিহারের তরফে, তাঁকে মাত্র তিন বছরের জন্য তিব্বতে যাবার জন্য ছেড়ে দিতে রাজি হন। তিন বছর পরে তিনি পুনরায় দেশে ফিরে আসবেন, এই কথা দিয়ে, এরপর শ্রীঅতীশ তাঁর কয়েকজন শিষ্যকে সঙ্গে নিয়ে তিনি নেপাল হয়ে তিব্বতের পথে রওনা দেন। পথের দুর্গমতা, তিব্বতের অকল্পনীয় ঠাণ্ডা ইত্যাদি নানা কারণে পথে প্রচুর বিপত্তি ও ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহাণী ঘটে। শেষে এইভাবে নেপালে পৌছোলে, সেখানে নেপালের রাজা অনন্তক্রান্তি তাঁকে বিপুলভাবে অভ্যর্থনা করেন। নেপাল রাজপুত্র পদ্মপ্রভা তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এবং অতীশ সেখানে খানা বিহার স্থাপন করেন। এরপর সেখান থেকে অতীশ তিব্বতে পৌঁছোলে তিব্বতরাজ চাং ছাব তাকে রাজকীয়ভাবে অভ্যর্থনা করেন। শ্রীঅতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের তিব্বতে পৌঁছোনোর পর তাঁকে দেওয়া এই রাজকীয় অভ্যর্থনার চিত্ররূপ আজও সেখানকার বৌদ্ধ মনাষ্ট্রিতে দেখতে পাওয়া যায়। সেইসময় তাঁর সন্মানে রাগধুন নামেক এক বাদ্যযন্ত্রের উদ্ভাবন করা হয়।
এরপর থোলিং বিহারকে মূল কেন্দ্র হিসাবে স্থাপনা করে, অতাশ দীপঙ্কর বৌদ্ধ ধর্মকে সঠিক পথ দেখাতে সারা তিব্বতে ঘুরে বেড়ান এবং সেখানকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন বৌদ্ধ ধর্মকে, মহায়ান ধর্মকে কুসংস্কারমুক্ত রূপে নবকলেবর প্রদান করেন। তাঁর প্রধান শিষ্য ড্রোমটন তিব্বতে কদম-স্কুল স্থাপন করেন, যার থেকে এরপর মহায়ান গেলুক-পা সম্প্রদায়ের শুরু হয়, পরে যার থেকে দালাই-লামা পরম্পরার সৃষ্টি হয়েছে।
তিব্বতের তানজুর (সংস্কৃত এবং পালি ভাষার বেদ এবং আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের তিব্বতী ভাষায় বৌদ্ধকরণ করে অনুবাদই তানজুর ও কানজুর) থেকে জানা গেছে অতীশ একশো পচাত্তরের ওপরে বই লিখেছিলেন এবং সম্পাদনা করেছিলেন। এছাড়া তিনি তিব্বতের অনেক জায়গায় সংস্কৃত ভাষায় প্রচুর পান্ডুলিপি আবিস্কার করেন এবং সেগুলিকে সেদেশের উপযোগী করে তিব্বতের ভূত ভাষায় অনুবাদ করেন। তিনি ভূত ভাষায় বেশ কিছু ধর্ম, চিকিৎসা এবং কারিগরী শিক্ষার বইও লেখেন। তিনি সংস্কৃত ভাষাতেও বেশ কিছু বই লেখেন। সেগুলি আজ আর পাওয়া যায় না, তবে তাদের ভূত ভাষার অনুবাদগুলি আজও রয়েছে। সেখানকার তানজুরে তাঁর ৭৯টি বই সংরক্ষণ করা হয়েছে। তাঁর লেখা প্রধান প্রধান বইগুলি হল বোধিসত্বপ্রদীপ, বোধিপাঠপ্রদীপ, চর্যাসংগ্রহপ্রদীপ, বোধিসত্বমান্যবলী, মধ্যমকরান্তপ্রদীপ, শিক্ষাসমুচ্ছায়া অভিসাম্য, প্রজ্ঞাপারমিতা পিণ্ডারার্থপ্রদীপ, একভীরা সাধনা ইত্যাদি।
তিব্বতে প্রভূত খ্যাতি ও সন্মান লাভ করলেও, বয়সের ভারে আর রাস্তার দূর্গমতার কারণে, স্বদেশ ভারতভূমিতে অতীশের আর ফেরা হয়ে ওঠেনি। তিব্বতের লাসার কাছে নেথান গ্রামে তারা দেবীর উদ্দেশ্যে নির্মিত ড্রোলমা লাখাং মন্দিরে ১৩ বছর অবস্থানের পর, সেখানেই শেষ নিঃশাষ ত্যাগ করেন, যা পরে বৌদ্ধ তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়। তাঁর পুতাগ্নির কিছুটা অংশ ১৯৭৮ সালে ২৪শে জুন ঢাকায় আনা হয়, এবং সেখানকার ধর্মরাজিকা বুদ্ধ বিহারে রাখা হয়। ২০০২ সালে, নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা হিসাবে বিখ্যাত শ্রীঅতীশের জন্মস্থান বজ্রযোগিনী গ্রামকে সন্মান জানিয়ে ইউনেসকো ওয়ার্লড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
এই যথার্থ মহাপ্রাণ এবং প্রথম বিশ্বজনীন বাঙ্গালীকে আজ আমরা বিস্মৃত হয়েছি। যদিও ধর্মপ্রাণ তিব্বতীদের কাছে শ্রীঅতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানএর স্থান ভগবান বুদ্ধের ঠিক পরেই। ওখানকার শীর্ষস্থানীয় লামারা তাঁর নাম দিয়েছিলেন ''জোবো ছেনপো'' বা এক শক্তিমাণ ঈশ্বর। ওখানকার লামারা, যাঁরা, সেখানকার ধর্মের ধারক-বাহক ছিলেন, আজও তাঁরা অতীশের অনুগামী ও অনুসারী হিসেবে গর্ব বোধ করেন।

1 comments:
ধন্যবাদ
Post a Comment