সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
আলোচাষীর স্বপ্নসুদীপ ঘোষাল
বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের রঙীন চাদরের মত উঠোনে শীতকালে বসে ওরা। নোটন নোটন পায়রার মত গল্প করে ঘন্টার পর ঘন্টা। কি এত গল্প ওদের,কেউ জানে না । প্রতিবেশিরা হিংসে করে বলে, লোকদেখানি ভালবাসা।
আসলে ওরা নন্দনপুকুরের পাড়ে তেঁতুলগাছের নিচে ঘর বেঁধেছে পুতুলখেলার মত। কনকের স্বামী দাসপাড়ার মণি,নাম তার রূপচাঁদ। রূপকে দেখলেই গল্প করার ছলে অনেক মহিলা একটু কাছে আসতে চায় একটু স্পর্শ চায় ভালবাসার। যদি বল কেন, কি কারণ। তা বলা মুস্কিল। এক একটা সুপুরুষ আসে, দেখে আর জয় করে মন। ফুলকে তো তোমার আমার সকলের ভাল লাগে কারণ ছাড়াই।
কনক বলে, তোমার কাজ করার দরকার নাই। আমি বাবুদের বাড়ি কাজ করি। খেয়ে পড়ে চলে যাবে আমাদের। রূপ বলে, তাই আবার হয় গো। লোকে নিন্দে করবে। বলবে, গতর বাগাইছে। বৌকে পাঠায় পরের বাড়ি। তোমাকে কাজ করতে হবে না গো। আমি রোজগার করব গতর খাটিয়ে। তারপর মাসেল ফুলিয়ে বলে, এই দ্যাখ আমার বাহুর জোর।
কনকের গায়ের রঙ চাঁপা ফুলকে হার মানায়। মসৃণ পেলব তার মুখমণ্ডল। জোড়ায় যখন যায় বাবুপাড়ার লোকগুলো বলে, রূপ বটে দুজনার। না খেয়েও কি করে হয়?
কোন কোনদিন রূপের রোজগার ভাল না হলে উপোস যায়। ওদের জমি নাই। বাবুদের দুবিঘে জমি ওরা দুজনে দেখাশুনো করে আর খায়।আজ শ্রাবণমাসের সন্ধ্যাবেলা রাতের অন্ধকারে কে যেন কালি ঢেলে দিয়েছে। নিকষ অন্ধকারে কনক আর রূপ শুয়ে আছে মাটির মেঝেতে। ভীষণ এক মেঘগর্জনে বৃষ্টি দাপিয়ে বেড়াল কনকের শরীর জুড়ে। তারপর ফাগুন এল। ফুলে রঙে ভরে গেল প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে কনকের পেট। রূপ কনকের পেটে কান পেতে শোনে আগামীর ছটফটানি। জমির বাঁজা রূপে গ্রাম ছাড়ল রূপ। মুম্বাইয়ের এক হোটেলে কাজ পেল। কনক পোয়াতি হয়ে একা একা পাড়ার বুড়িমাসির কাছে থাকে। বুড়িমাসির ঘরদোর নাই। রূপ যাওয়ার আগে সুদে টাকা ধার করে ব্যবস্থা করে গিয়েছে দুজনের।
তারপর বিশ্বজুড়ে করোনা এল। কনকের চিন্তা বাড়ল। রূপ কেমন আছে। বেঁচে আছে তো।
বুড়িমাসি বলে, চিন্তা করবি না। যার কেউ নাই তার' ভগমান' আছে।.
করোনার প্রকোপে গ্রামে গ্রামে মড়ক লাগলো। আজাড় হয়ে গেল পৃথিবীর ভান্ডার। কত লোক যে ছটফটিয়ে মরে গেল তার হিসেব রাখে কে? কনকের কোলজুড়ে এল আলো। রূপচাঁদের ভালবাসার আলো। কনক এখন কাজে যায়। কনকের রূপ দেখে পঞ্চায়েতের পার্টির লোক বলল, আমাদের দলে নাম লিখা। তোকে এবার জেতাব পঞ্চায়েতের ভোটে। বুড়িমাসি বলল, তু যা। আমি তোর ছেলেকে মানুষ করব।
ভোটে জিতে কনক আজ মেম্বার হয়েছে পঞ্চায়েতে। তবে তারজন্যে রূপের সম্পত্তি বাঁধা দিয়েছে কনক। দলের একজন একরাতে তার নরম মনের কোণে লুকিয়ে থাকা রূপকে চুরি করেছে। ছ্যাঁচড়া চোর আর লম্পট একই কথা,বলে বুড়িমাসি। তোকে রূপের এই আলো কে জ্বলিয়ে রাখতে হবে জীবনজুড়ে। রূপের মত যেন বাইরে খাটতে যেতে না হয়।
কনক বুড়িমাসির কথা শুনে বুঝেছিল এই বাঁজা জমিগোলাতে প্রাণ আনতে হবে। সে মাইকে এখন ভাষণ দেয়, জমিগোলা বাঁজা ফেলে না রেখে ফসল ফলাও আমার রূপসোনারা। বাবুদের জমিতে তোমরা চাষ কর। আমরা বাংলার লোক পথ দেখালে এগিয়ে আসবে হাজার হাজার গ্রাম। চাষ কর চাষ।
কনকের কথায় কাজ হয়েছিল। শয়ে শয়ে গ্রামের ছেলেরা চাষকাজে নেমে পড়েছে উৎসাহে। পঞ্চায়েত থেকে প্রধান হয়ে কনক চাষিদের লোনের ব্যবস্থা করে দিল সবাইকে। সবুজে সবুজে ভরে গেল বাঁজা মাঠ। সোনার ধানে ভরে গেল মাঠ।
কনক আজও খুঁজে বেড়ায় রূপকে। মাসিবুড়ি বলে, "অতিবড় সুন্দরী না পায় বর... " কনক সবুজ মাঠে যায়। ফাঁকা নীল আকাশে মাথা তুলে কনক বল, রূপ তুমি কোথায়। আমার কথা শুনছ। তুমি ফিরে এস বাংলার সবুজ বুকে।ধীরে ধীরে কাল কেড়ে নেয় রূপকে হয়ত করোনা বা প্লেগের রূপে। কনক এখন মাঠে যায়। ছেলেকে চাষ করতে দে'খে মন ভরে যায় মায়ের। অতি সুক্ষ্ম তরঙ্গের স্পন্দন শোনার অপেক্ষায় মৌন হয়ে অপরূপ প্রকৃতির, কোলে আশ্রয় নিতে চায় কনক ।চাওয়া,পাওয়ার উর্ধ্ব জগতে ভাসতে ভাসতে ছাই হোক নশ্বর দেহের অহংকার। স্থূল পদার্থ নিয়ে পরমাণু বিজ্ঞানীরা অপেক্ষায় থাকেন না।অণু পরমাণু নিয়েই তাঁরা ব্যস্ত।তা না হলে হিমালয়ের চূড়া কিংবা জমি জায়গা নিয়েই তারা টানাটানি করতেন বেশি।
কনকের ছেলে বি এ পাশ করেছে।সে বলে, আকাশকে আমরা পৃথিবীর মানুষ, স্বার্থপরের মত খন্ড খন্ড করেছি।এটা কাটোয়ার আকাশ, ওটা দিল্লীর, ওটা রাশিয়ার আকাশ। অখন্ডতার বাণী আমরা ভুলে যাই।আকাশ চিরদিন অখন্ডই থাকে।তাকে খন্ডিত করার অকারণ অপচেষ্টা না করাই ভালো।তবু কাঁটাতার হয়,সীমানা ভাগ হয়। অদ্ভূত মূর্খতার অন্ধকারে ডুবে আছে প্রাণীকুল।
সে বলে, আলোর অন্তরে বাদ্য বাজে, 'অনন্ত নাদ' এর ভেরী।সূক্ষ্ম তরঙ্গে মিশে যায় তার অস্তিত্ব,ভুলে যায় তার অবস্থান। এ অনুভূতি ঝর্ণার মত,কবিতার মত,ভালোবাসার মত, নদীর প্রবাহের মত। জোর করে সে গতি পাল্টায় না। সৃষ্টির সবাই ভয়ে কাজ করি। অস্তিত্ব বিনাশের ভয়ে। সৃষ্টি মানুষের প্রশ্বাস,স্থিতি মানুষের ক্ষণিক ধারণ ,প্রলয় মানুষের সমাপ্তির সূচনা।
কনকের ছেলে শিক্ষিত। সে মাকে বলে, আলোর অনুসন্ধানীর ভয় নেই, তাই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই নেই। লোভ নেই, তাই অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা নেই।অকাল বার্ধক্য নেই। আছে শুধু আনন্দ,ছেলেমানুষি,বোকামি,সরলতা,সোজা পথে হাঁটার অখন্ডতার সোজা রাস্তা...।কনক মন দিয়ে কথাগুলো শোনে। কোন উত্তর দেয় না। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে ছেলেকে বলে , পরিযায়ী হয়ে কোন বাপ মায়ের ছেলেকে আর যেন রাস্তায় মরতে না হয়, ট্রেনে কাটা পরে মরতে না হয়। আলো বলে, এ কাল রোগ তো আর বারবার আসে না। অখন্ড ভারত, বিশ্ব আবার সুস্থ হবে। তখন তো আর কোন চিন্তা থাকবে না মা গো।
কনক কাঁদে, অজানা আশায় বুক বাঁধে। কোন উত্তর দেয় না...
0 comments:
Post a Comment