সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.


 হানাবাড়ির রাত


শম্পা চক্রবর্তী


       লকডাউনের আগের বছর, পূজার ছুটিতে আমরা আলিপুরদুয়ার মহকুমার অন্তর্গত বক্সা অরন্যে ঘুরতে গেছিলাম;কোনো রকম আগাম বুকিং না করে। কথায় বলে না "উঠলো বাই তো কটক যাই" অনেক টা সেই রকম। 

          একদিন সকালে কাঞ্চন কন্যা এক্সপ্রেস ট্রেন করে রওনা দিলাম বক্সার উদ্দেশ্যে। আলিপুরদুয়ার স্টেশন থেকে গাড়ি নিয়ে নিঝুম অরন্যের পাকদন্ডি দিয়ে পথ হারানোর গান গাইতে গাইতে দুপুর নাগাদ পৌঁছে গেলাম বক্সা ফোর্টে।গাইডের সাহায্য নিয়ে ধ্বংসাবশেষ দেখলাম ;বিনাবিচারে কয়েদ হয়ে থাকা অনুশীলন সমিতি,যুগান্তর দলের বিপ্লবী দের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে,শহীদ বেদীতে বুনো ফুল অর্পণ করে জয়ন্তী বনবাঙলো তে যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা হয় হয়। এবার সময় রাতে মাথা ঢোকানোর ঠিকানা জোগাড় করা। 

          ভরা পর্যটক মরশুমে সব গেস্ট হাউসের একটাই কথা "ঠাই নাই ঠাই নাই"। ছয়জনের দল ছিল আমাদের, সাথে দুটি বাচ্চা ও;এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি হঠাৎ খেয়ালের ফল। আমাদের অবস্থা প্রত্যক্ষ করে একটি কঙ্কাল সার মানুষ কোথা থেকে উদয় হয়েদয়াপরবশ হয়ে জানাল , একটি জায়গা পাওয়া যাবে-আমরা তো এই প্রস্তাবে লাফিয়ে উঠলাম, বললাম" আপনি সাক্ষাৎ ভগবান হয়ে এসেছেন, তাড়াতাড়ি নিয়ে চলুন। "উনি বললেন, " দেখুন আপনারা থাকতে পারেন কিনা! "সমবেত কণ্ঠে চিৎকার করলাম" পারব না কেন? খুব পারব"

              অতঃপর লোকটি আমাদের নিয়ে গেল, জয়ন্তী নদীর তীরে একটি বাড়িতে, বাড়িটির ভগ্ন দশা দেখে আমাদের উদ্যমে ভাটা পড়লে;লোকটি বললো, বাইরে থেকে এমন লাগলেও ভেতরের অবস্থা চমৎকার; ইষ্ট দেবতার নাম জপ করে , বাইরের থেকে কোনো রকমে খুন্নিবৃত্তি মিটিয়ে সেই লোকটি র সাথে বাংলোর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে প্রবেশ করলাম। 

           ওমা,ভেতরে ঢুকে দেখি চমৎকার সব ঘর! বাচ্চাদের তো খুব মজা, বড়ো বড়ো আকারের ঘর গুলো দেখে;ওরা ছুটোছুটি করতে লাগল। দুগ্ধফেননিভ বিছানায় সারাদিনের ক্লান্তি অপসারণের জন্য শরীর এলিয়ে দিলাম। তক্ষকের আওয়াজ শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। 

          হঠাৎই মাঝরাতে খুব চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে গেল;বাচ্চাদের ঘুম কাতুরে বাবাদের কাছে রেখে আমি ও আমার বোন শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলাম: দেখি পুরানো আমলের জমিদার গোছের এক লোক একটি  গরীব লোককে চাবুকের বাড়ি মারছে;লোকটি আর্তনাদ করে বলছে "মাপ কইরা দ্যান হুজুর, উই ট্যাহা মোর বিটির বিহা লাগি। " "বিটির বিহা? আচ্ছা, উর বিটিটাক লিয়া আয় বটে। " "না বাবু, মোর বিটিক ছাড়ান দ্যান, মুই উই ট্যাহা দিয়া দিম্। "

           এরমধ্যেই কতগুলো পাগড়ি পড়া লাঠিয়াল একটি সুন্দরী পঞ্চদশী কন্যাকে নিয়ে এসে ঘরটিতে ফেলল, মেয়েটি লোকটি কে বলল, "মোর বাপক ছাড়ান দে তু " মেয়েটির কথায় সেই জমিদারের কী অট্টহাস্য! "ছাড়ান দিব !ছাড়ান দিব তো বটেই, আগে তু মোরে খুস কর" "দোই হুজুর, মোর গুটে(একটি) বিটিয়া, উয়াক ছাড়িদে"

            এরমধ্যেই ঘরটিতে বহু লোকের সমাগম হল, জমিদারের লাঠিয়ালরা সেই বিপুল সংখ্যক মানুষের আগমন ঠেকাতে পারলনা। সেই মানুষ দের মধ্যে একজন বৃদ্ধ বলে "তুর পাপের ঘড়া পূর্ণ হৈছে বটেক,আর তুকে পাপ করতে দিবক লাই";এই বলে মানুষ গুলো জমিদার ও তাঁর লাঠিয়াল গুলো কে পিছমোড়া করে বেধে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দিল। 

        ঘটনার আকস্মিকতায় আমি ও বোন জ্ঞান হারালাম;শরীরের ওপর কিছু ঠান্ডা জিনিস চলে যাওয়ায় জ্ঞান ফিরল আমাদের, ধরফর করে উঠে বসে  আবিষ্কার করলাম, মাকড়শার ঝুল শরীরে মেখে ধ্বংসপ্রায় একটি ঘরের মধ্যে আমরা। চকিতে মনে পড়ে গেল গতরাতের ঘটনা;বাকিদের জন্য তখন পাগলপ্রায় অবস্থা আমাদের। বট গাছের ঝুড়িতে ধাক্কা খেয়ে, বাদুড় -চামচিকার ডানার খোচা খেয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় আলো লক্ষ্য করে যখন সেই ধ্বংসাবশেষের বাইরে এলাম, তখন দেখলাম প্রচুর মানুষের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ছোট্ট চারটি হাত আমাদের দিকে ছুটে আসছে। 

            গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হলো আমাদের, ট্রমা কাটলে শুনলাম-গতরাতে আমাদের ঐ বাড়িতে ঢুকতে দেখেছিলেন কেউ কেউ;তাঁরাই ভোর বেলা ঐ বাড়িতে ঢুকে আবিষ্কার করেন যে, আমাদের দুই পতিদেবতা দুই বাচ্চা কে নিয়ে বের হবার রাস্তা ও আমাদের কে খুঁজে চলেছেন। সেই মহৎ হৃদয়ের লোকেরা এদের উদ্ধার করে আমাদের না পেয়ে একপর্যায়ে , তাঁর কাছে জানতে পারলাম, এখানে ব্রিটিশ আমলে ছিল ডলোমাইট খনি, চুনের কারখানা। এশিয়ার বৃহত্তম ডলোমাইট ও চুনের যোগান দিত জয়ন্তী;এখানে লাভের গন্ধ পেয়ে বাইরে থেকে এসেছিল লোভী ঠিকাদারেরা।এখানকার সরল আদিবাসী মানুষ গুলো কে শোষণ করে ও তারা থেমে থাকেনি;তাদের কামনার আগুনে পুড়ে মরত কিশোরী, যুবতীরা। এক রাতে এক ঠিকাদার এমন জঘন্যতম কাজে নিয়োজিত হলে;অঞ্চলের সমস্ত মানুষেরা ক্ষেপে উঠে ঠিকাদার ও তাঁর অনুচরদের জীবন্ত অবস্থায় জ্বালিয়ে দেয় এবং তার কুঠি বাড়িতেও আগুন দেয়। তখন থেকেই এই বাড়ি এমন অবস্থায় পড়ে আছে। 

             মনে প্রশ্ন জাগে, তবে ঐ লোকটি কে? যে আমাদের রাত্রি যাপনের আয়োজন করে আমাদের থেকে ঈশ্বরের তকমা পেয়েছিল। এর উত্তরে পঞ্চায়েত প্রধান জানান, এই অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায় অত্যাচারিত মানুষের অতৃপ্ত আত্মা;বাইরের লোককে এরা সেই লোভী ঠিকাদারের আসনে বসিয়ে এই বাড়িতে নিয়ে এসে, সেই শেষ রাতের দৃশ্যপট টি দেখায়;প্রাণে মারে না। 

          প্রধানের বাড়িতে মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে, অতৃপ্ত আত্মা দের উদ্দেশ্যে "বাইরের লোকেদের" তরফ থেকে ক্ষমা  প্রার্থনা করে, ট্রেনে উঠে বসলাম। 

0 comments: