সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.


দেশ বনাম বিদ্বেষ 

অঙ্কুর রায় 


দেশ হল এক ভূখণ্ড, যেখানে মানুষ থাকে। আর অভিধান বলে বিদ্বেষ অর্থ হিংসা, ঈর্ষা, অপ্রীতি, শত্রুতা। অর্থাৎ বিরূপ মনোভাবের প্রকাশই হল বিদ্বেষ। দেশ আর বিদ্বেষের মাঝে এই বনামটা তবে কেন? নিতান্ত ছন্দ করার জন্য বা চমক আনার জন্য যে নয় এটা এখনই বলতে পারি। তবে ঠিক কী কারণে মাঝে আছে বনাম সেটা বোঝার জন্য শেষ পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরার দরকার আছে। 


সেদিন গল্প হচ্ছিল। কথায় কথায় রাজনীতি, দাঙ্গা এসবের কথাও উঠলো। একজন সহকর্মী বেশ জোর দিয়ে এবং গর্বের সঙ্গে বললেন - আমি আমার ছেলের মাথায় একদম ঢুকিয়ে দিতে পেরেছি ওদের একদম বিশ্বাস করবি না। এমনি কথা বল,গল্প কর ঠিক আছে কিন্তু বিশ্বাস করবিনা। কোন সম্পর্ক তৈরির কথাও ভাববিই না। আর বিয়ে করার তো প্রশ্নই ওঠেনা। সাথে সাথেই আরেকজন বলে উঠলো আমিও মেয়েকে বলে দিয়েছি - যদি ওদের কাউকে বিয়ে করিস তবে তোকে ত্যাজ্য করবো। সাথে সাথেই গর্ব ,তৃপ্তি এবং নিশ্চিন্ততার সাথে বললো - তবে আমার মেয়ে ওদের একদম পছন্দ করে না, তাই কখনই বিয়ে করবে না। এবং দেখলাম বাকি সহকর্মীদের চোখেমুখেও একটা জোরালো সমর্থন। কেউ প্রশ্ন তুললোই না এ কথার মানে কী? ছেলে বা মেয়েটির রূপ,গুণ, যোগ্যতা, পরিবার এসবের কোন অর্থ নেই? শুধু ধর্মেরই গুরুত্ব? না এসব কথা কেউ বললো না। আমিও বলিনি। সবসময় উল্টো কথা বলে সকলের চক্ষুশূল হতে কার ই বা ভালো লাগে? 


ওদের বলতে ঠিক কাদের কথা বলা হচ্ছে তা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। হিন্দু মধ্যবিত্ত বাঙালি শুনেই বুঝে নেবে এই 'ওরা' কারা। কৌতুহল হয় এ কথা জানতে ওদের মধ্যেও এমন ভাবনাচিন্তা আছে কিনা, এমন কথা ওরা শুনলেও এত সহজেই বুঝে নেবে কিনা যে ওদের বলতে কাদের কথা বোঝানো হচ্ছে? পরিস্থিতি যা তাতে মনে হয় বুঝে নেবে। সমাজটা যেন আড়াআড়ি দুটো টুকরোয় ভেঙে গেছে - আমরা আর ওরা। 


বিপদ হল এই আমরা ওরা-র বর্গ বিভাগ আজকে আর শুধু হিন্দু - মুসলমানে আটকে নেই। আটকে নেই শুধুমাত্র কিছু প্রমাণসাপেক্ষ মনগড়া ধারণায়। এর বিষ চারিয়ে গেছে আমাদের সত্তার গভীরে। লক্ষ্য করে দেখুন বললাম আমাদের। হ্যাঁ আমাদের। বিষ যখন বিষয় তখন আর আমরা - ওরা নেই ,শুধুই আমরা। ঘৃণা, বিদ্বেষ, হিংসা সেই ঐক্য সাধন করতে সমর্থ হয়েছে যা প্রীতি, বিশ্বাস, শুভেচ্ছার পক্ষে আজ অসাধ্য শুধু নয় অচিন্ত্যনীয়। অবশ্য এটা নতুন কোন বিষয় নয়। ঘৃণার ঐক্যশক্তি ভালোবাসার থেকে চিরকালই বেশি। সন্ত কবীরের সেই কাহিনীটা মনে পড়ে যাচ্ছে যেখানে গোঁড়া হিন্দু পণ্ডিত আর মোল্লারা একসাথে বাদশার কাছে কবীরের নামে নালিশ জানায় যে কবীর ধর্মীয় শুদ্ধতা রক্ষা করছেন না। তাঁর উদারতা ধর্মের গণ্ডি মানছে না। বাদশা কবীরকে ডেকে পাঠালেন। অকুতোভয় কবীর গিয়ে দেখেন বাদশার দরবারে মোল্লা আর পণ্ডিতরা একত্রে দাঁড়িয়ে আছে। কবীর বললেন - হায় আমি তো মিলনই চেয়েছিলাম। বিশ্ববিধাতার সিংহাসনতলে তোমাদের মিলনের স্থান সংকুলান হল না, স্থান হল কিনা দেশের বাদশার অপ্রশস্ত তখতের নিচে? তোমাদের মেলাতে চেয়েছিলাম প্রেমে, ভক্তিতে আর আজ তোমরা মিলেছ বিদ্বেষে? 


এই অবিশ্বাস, এই বিদ্বেষের এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে। প্রতিদিনই যে ইতিহাসে নতুন নতুন অধ্যায় সংযোজিত হচ্ছে। দেশভাগ, কাশ্মীর, সীমান্ত বিরোধ, জঙ্গি কার্যকলাপ ,বাবরি মসজিদ, গোধরা,  এন আর সি ইত্যাদি বৃহৎ অধ্যায়ের পাশাপাশি আছে অগণ্য পর্ব এবং উপপর্ব। আর তারই পাশে আছে ক্ষুদ্র, সংকীর্ণ, উদ্দেশ্য নিয়ে নিরন্তর ইন্ধন। এই বিদ্বেষের ইতিহাস আলোচনা  কোন প্রবন্ধের ধারণক্ষমতার বাইরে। এর জন্য প্রয়োজন একটা রীতিমত স্থূলকায় মহাভারত। 


কিন্তু বাস্তব হল আপাত অসাম্প্রদায়িক মানুষও নিজের অজান্তেই সাম্প্রদায়িক ও সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আর বিদ্বেষ এক তীব্র বিষের মতন শরীরের একটির পর একটি অঙ্গ অবশ করে দিচ্ছে। কোন আচরণ, কোন কথা, কোন মনোভাব যে সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট হয়ে যাচ্ছে তা তলিয়ে না ভাবলে বোঝা মুশকিল হয়ে যায় অনেকসময়। আরও বড় মুশকিল হল তলিয়ে দেখার ইচ্ছা, সময় এবং সুযোগটাই অমিল। সকলের তালে তাল রাখতে গিয়ে তলিয়ে ভাবার ইচ্ছা এবং সুযোগ চলে যায়, প্রতিটি বিষয়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে বা চটজলদি সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে সময় বেড়িয়ে যায় হাতের বাইরে। 


বিদ্বেষ যদি শুধুই হিন্দু মুসলমানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো তাও একটা কথা ছিল, আশা ছিল যে অসুখ হয়তো একদিন সারবে। কিন্তু বিষ ছড়িয়ে পড়েছে সারা শরীরে। ঐ যে সেদিন গল্প হচ্ছিল বললাম সেই গল্পের কথাতেই বরং আবার ফিরে যাই। যে কোন আড্ডার বৈশিষ্ট্যই হল বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে চলে যাওয়া। যখন সেই ওদের সাথে বিয়ে না করার কথা হচ্ছিল তখন বোঝাই যাচ্ছে সেই ওরা কেউ ওখানে ছিল না। আড্ডা চলছে। চলতে চলতে উঠলো ডাক্তার বদ্যির কথা। একজন বললো আমি ডাক্তার দেখাতে যাবার আগে তার পদবী দেখি। মণ্ডল, প্রামাণিক এসব কোটার ডাক্তারদের কাছে যাই না। এবারও সমর্থন এল অতি দ্রুত এবং জোরালো। না এবারও কিছুই বলিনি। কেন? জানিনা, হয়তো আমি এসবের মধ্যে পড়ি না বলেই। অবশ্যই যারা পড়ে সেই ওরা তখন কেউ নেই দেখেই এই কথা বলা হয়েছে। 


লক্ষ্য করে দেখুন ওদের পরিচয় কিন্তু এবার পাল্টে গেছে। ওরা মুসলমান নয়। ওরা হিন্দু। কিন্তু নিচু জাতের হিন্দু। তাই ওরা ওরা। অন্য। অপর। এইভাবে একের পর এক আমরার বিপ্রতীপে ওদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া চলছে। এবং চলছেই। যারা দাঁড় করাচ্ছে তারা যে খুব ভেবে একাজ করছে তা কিন্তু নয়। ওরা যে সবসময় জল অচল তা ও নয়। বিদ্বেষের বিষ মন এবং বুদ্ধি অবশ করে দিয়েছে। আমরার দাঁড়ানোর জায়গা আছে শুধু বিদ্বেষে। প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে এ আমরা কোথায় এলাম? কোন সময়ে? কোন পরিবেশে? 


আশা করি বিদ্বেষ বিষয়টা মোটামুটি বোঝা গেছে। এখনও দেশের বিপ্রতীপে কেন আছে বিদ্বেষ সেটা কি বোঝেননি?  না বিভেদের মাঝে ঐক্যর কথা,  যা শুনতে শুনতে , বলতে বলতে তার অর্থ হারিয়ে ফেলেছে, সেই কথা আর বলছিনা। বলছি না ঐতিহাসিকভাবেই হিন্দু সংস্কৃতির মধ্যে যে একটা সংকীর্ণতা আছে সে কথাও, কারণ এটা একটা  আলাদা , সমান্তরাল হলেও আলাদা প্রবন্ধের বিষয়। শুধু বলতে চাই দেশের কথা। দেশ, যার অর্ধেকটা আলো, বাতাস, জল, মাটি দিয়ে গড়া আর বাকি অর্ধেকটা মনগড়া। আর মন যদি বিদ্বেষের বিষে জর্জর হয়ে যায়, তবে দেশের অর্ধেকটাই যে মাটি হয়। জানিনা এই বিষের চিকিৎসা কী। হয়তো মনকে বোঝানোই এর  একমাত্র চিকিৎসা। নয়তো বিদ্বেষ বাড়তে বাড়তে দেশটা একদিন পুরো মাটিই হয়ে যাবে।

0 comments: