সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
একুশের কথা
মিত্রা হাজরা
ভায়ের বুকের রক্ত আর মায়ের চোখের জলের বিনিময়ে পেয়েছি বাংলা ভাষার অধিকার। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি লাভের জন্য যে আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল সেই আন্দোলন কে ভাষা আন্দোলন হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই আন্দোলনের সূত্রে বাঙালির জাতীয়তাবোধের নব জাগরণ হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের বীজমন্ত্র রোপন হয়েছিল এই আন্দোলনের মাধ্যমে। ভাষা আন্দোলন শুধু অধিকার রক্ষার আন্দোলন নয়, এই আন্দোলনের সফলতা বাংলা সহ যে কোনো ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল। এর ফলশ্রুতি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস '--স্বীকৃত হয়েছে একুশ ফেব্রুয়ারী ।
বাংলায় সুফী সাধকেরা এসেছিলেন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে, তাঁরা মূলত ছিলেন আরব, পারস্যএর লোক। সাথে এসেছে আরবী, ফার্সী ভাষা। তাঁরা সাধারণ মানুষের সাথে মিশেছেন, তার ফলে বেশ কিছু মানুষ এই ভাষা ও ধর্ম গ্রহণ করে। বখতিয়ার খিলজীর কাছে লক্ষণ সেন পরাজিত হলে আসে মুসলমান শাসকেরা ---বাংলা ভাষার শব্দভান্ডার দ্রুত ভরে ওঠে আরবী, ফার্সী, তুর্কী শব্দে। এই সময় কিছু ধর্মান্ধ মুসলমান জিগির তোলে আরবী আল্লার ভাষা, বাংলা হিন্দুর ভাষা। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়ের পর---ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বঙ্গদেশে রাজ শক্তিতে পরিণত হয়, তাই ইংরেজী ভাষার প্রসার ঘটলো বঙ্গে, তবে সে কেবল গুটিকয় ইংরেজ ও বাঙালির মধ্যে। এদেশে শাসন করতে হলে রাজ কর্মচারীদের এদেশের ভাষা শিখতে হবে ---তখন বাংলা ভাষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলো ইংরেজ। ইংরেজ শাসকদের বাংলা শেখানোর জন্য--- A grammar of the Bengal language ---নামে গ্রন্থ প্রকাশ করলেন-ব্রাসি হ্যালহেড,তখন ই বাংলা ভাষাকে সরকারী কাজকর্মে ব্যবহারের পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রস্তাব ওঠে। দীর্ঘ সংগ্রামের পর-- স্বাধীনতা লাভ হয় তবে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ দুভাগ হয়---, ভারত আর পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে---15--আগষ্ট ও 14--আগষ্ট। ভারতের সরকারী কাজকর্মের ভাষা হয়-হিন্দী, আর পাকিস্তানের ভাষা উর্দু। ঠিক এই সময় থেকেই বাঙালিদের মধ্যে বাঙলা ভাষার মর্যাদা দানের প্রশ্নও উঠতে থাকে, কারণ পূর্ব পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষের ভাষাই তো বাংলা। তখন থেকেই বাঙালির মনে বিতৃষ্ণা আসে উর্দুর উপর, মনে হয় জোর করে একটা ভাষা তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই সময় বাঙালিদের মধ্যে বাংলাকে মর্যাদা দেওয়ার জন্য দৃঢ়তা প্রকাশ করে--গণ আজাদি লীগ। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ --"পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা সমস্যা "বলে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। এই গণ আজাদি লীগের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন--- কামরুদ্দিন আহমদ। এদের ম্যানুফেস্টোতে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল মাতৃভাষা মাধ্যমে শিক্ষাদান করাতে হবে। বাংলা হোক পূর্ব পাকিস্তানের সরকারী ভাষা।
বাংলা ভাষাকে গণপরিষদের ভাষা গ্রহণের প্রস্তাব করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি সরকারী কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর খাজা নাজিমুদ্দিন তা এক কথায় নাকচ করেন। তিনি বলেন এ অবাস্তব প্রস্তাব, অধিকাংশ মানুষ চায় উর্দু। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান বলেন--পাকিস্তানে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করছে কিছু মানুষ, লক্ষ কোটি মুসলমানের ভাষা উর্দু। এর বিরুদ্ধে শুরু হয় গণ আন্দোলন। সরকার দমন নীতি প্রয়োগ করে, মিছিল, জমায়েত নিষিদ্ধ হয়---, পুলিশ লাঠি চালিয়ে এ আন্দোলন দমাতে চায়, আরো জোরদার আন্দোলন শুরু হয়, প্রথমে ছাত্ররা, তারপরে সাধারণ মানুষ এতে জড়িয়ে পড়ে। মুসলিম লীগ কাউন্সিল সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান, ছাত্রলীগ আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদ, ভিপি আবদুর রহমান চৌধুরী ধর্মঘট ও হরতাল ডাকেন। পুলিশ গ্রেপ্তার করে মুজিবর রহমান, অলি, আহাদ, শওকত আলী প্রমুখদের। ঢাকায় সভা, সমাবেশ, মিছিল নিষিদ্ধ করা হয়, দমন পীড়ন অব্যাহত থাকে। এবার সাধারণ মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। দলে দলে সমবেত হতে থাকে, আইন অমান্য করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছে সকলে জমায়েত হলে পুলিশ গুলি চালায়। শহীদ হন-- আবুল বরকত, রফিক উদ্দীন আহমেদ, আব্দুল জব্বার, আব্দুস সালাম। উত্তাল হয়ে ওঠে পূর্ববঙ্গ। জনমানুষের জোয়ার ওঠে রাজপথে। নবাবপুর রোডে বিশাল জানাজার মিছিলে পুলিশ আবার ও গুলি চালায়, অহিদুল্লাহ বলে একটি নয় বছরের বালক রক্তাত্ব হয়ে রাজপথে লুটিয়ে পড়ে, শকিউর রহমান, ওয়াহিদুল্লা, আবদুল আউয়াল শহিদ হন। সরকার প্রচার চালায় কমুনিষ্ট ও পাকিস্তান বিরোধীদের প্ররোচনায় ছাত্ররা পুলিশ কে আক্রমণ করেছে। চললো লড়াই--লড়াই। 1953--21ফেব্রুয়ারি পালনের উদ্দেশ্যে ছাত্র ছাত্রী রা লাল কাগজে শহীদ মিনার তৈরি করে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল মোড়ে--যেখানে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়েছিল বাংলা মায়ের ছেলেরা, রক্তে লাল হয়েছিল রাজপথ
সেখানে শহিদানের আত্মার মাগফেরত কামনায় মোনাজাত করেন। ঢাকার ছাত্রছাত্রীদের একুশের স্মরণে শহিদ দিবস পালন তখন থেকেই শুরু হয়। প্রভাত ফেরী, কালো ব্যাজ ধারণ করে সকলে সমবেত হন আজ ও।
পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষা স্বীকৃত হয়েছে অনেক ত্যাগ, অনেক রক্ত, অনেক লড়াই এর মধ্য দিয়ে। এর ই পরিণতি--1971--এর পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি। 1999--এর17-নভেম্বর ইউনেস্কো সম্মেলনে একুশে ফেব্রুয়ারি কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। 2000--খ্রী--একুশে ফেব্রুয়ারি প্রথমবার পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
একুশ মোদের এনে দিল, নতুন আশার সূর্য/ এই ভাষাকে মাথায় রাখি বাজাই রণ তূর্য।
"একুশ "----আমাদের দুঃখ, আমাদের বেদনার দিন, আবার ''একুশ''বাঙালি হিসাবে আমাদের গর্বের দিন।
*তথ্যসূত্র ----ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস---ঢাকা বাংলা একাডেমী ও বিভিন্ন পত্র পত্রিকা।
0 comments:
Post a Comment