সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
নিশির ডাক
রূপা দত্ত চৌধুরী
১২ বছরের ক্লাস সিক্সে পড়া নাতির আবদার ভুতের গল্প বলতে হবে। নিরাপদ একজন বিজ্ঞানের স্নাতক কিন্তু সংসারে প্রয়োজনে গভমেন্টের ইউডিল্কারকের পরীক্ষায় পাশ করে চাকরি। তারপর শান্ত সৃষ্ট ভদ্রলোকের জীবন যাপন হলেও কিছুটা বিজ্ঞানভিত্তিক মানসিকতার লোক। কোন শিশুকে ভূতের গল্প বানিয়ে বলার পক্ষপাতী একদমই নয়। আজ রবিবার ৪০ বছর আগের একটি রাতের কথা হঠাৎই মনে পড়ে নিরাপদর। তারপর কখন বলতে শুরু করেছেন, খেয়াল নেই। বিধানসভা নির্বাচন নিরাপদ সেকেন্ড অফিসার, পাঁচজনের দল ভোটের সব জিনিস নিয়ে সোনারপুর স্টেশনের কাছাকাছি যখন রিজার্ভ বাস থেকে নামল তখন বিকেল পাঁচটা। সেখান থেকে অটো তারপর হেঁটে নলকাটি গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে যখন পৌঁছল তখন রাত আটটা। কলকাতার মানুষ খুবই অসুবিধা হচ্ছিল অন্ধকারে। নিরাপদর সঙ্গে একটা চার ব্যাটারী টর্চ ছিল সেটা জ্বেলে কোনো রকমে ইস্কুল ঢোকা হলো। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই কিছু লোক লন্ঠন নিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করল বুঝলাম। পঞ্চায়েতের লোক পাতকয়া থেকে জল তুলে হাত পা ধোয়ার ব্যবস্থা করা, তারপর খাওয়া-দাওয়া এ সবের ভালো বন্দোবস্ত করলেন ওরা। বেশ কটা লন্ঠন দিয়ে গেলেন। নিরাপদ অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিল একজন লুঙ্গি পড়া লোক দাঁড়িয়ে আছে উঠোনে। খাওয়া-দাওয়ার পর নিরাপদরা নিজেদের মধ্যে একটা ছোট্ট মিটিং করে রাতে শোয়ার আগেই সব কিছু গোছগাছ করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, কারণ, কাল সাতটা থেকে ভোট। বাইরে আসলেন দেখলেন চাঁদের আলো চারদিকে সুন্দর নরম আলো ভরে দিয়েছে। কিন্তু দেখলেন সেই লুঙ্গি পড়া লোকটি তখনও দাঁড়িয়ে, খটকা লাগলো, কিছু বলবেন জিজ্ঞাসা করল। নিরাপদর মানুষটি উত্তর দিল আমার থাকার কোন জায়গা নেই আমি এই উঠোনেই শুয়ে থাকি কিন্তু আজকে আপনারা এসেছেন তাই- নিরাপদ রেগে গিয়ে বললেন আমি ওসব কিছু জানি না, এতক্ষন লোকজন ছিল, বলতে পারতেন, এখন গিয়ে শুয়ে পড়ুন রাত্রে পুলিশ আসবে তার সঙ্গে কথা বলবে। বিরক্ত নিরাপদ ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিল, আর বাকিদের সব দরজাগুলো একবার দেখে নেওয়ার জন্য বলল। রাতের বেলা হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। কে যেন ডাকছে নাম ধরে। তাড়াতাড়ি খিল খুলে বাইরে এসে চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখল রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে একজন গামছা পরা শীর্ণকায় মানুষ হাতে একটা ডাব। উত্তর দিতে যাবে হঠাৎ সেই লুঙ্গি পরা মানুষটি সামনে এসে দাঁড়ালো ইশারায় চুপ থাকতে বলল। আস্তে আস্তে করে বললো, উত্তর দিলেই মৃত্যু। এটা নিশি। নতুন লোক এসেছে খবর পেয়ে নাম ধরে ডাকছে, উত্তর দিলেই ডাবের মধ্যে তোমার প্রাণটাকে নিয়ে চলে যাবে কোন অসুস্থ লোককে দেবে। বিশ্বাস না করলেও কথা না বাড়িয়ে ভিতরে চলে এলো নিরাপদ। সকালে কাজের মধ্যে সবটাই ভুলে গেছিল নিরাপদ ভোট শুরু হয়ে গেছে থানা থেকে একজন সিপাহী এসেছে ঘটকপুকুর থেকে। একটু চা পাওয়া যাবে কিনা কোথাও দেখতে বললেন সিপাইকে। একটু পরেই হন্তদন্ত হয়ে হাজির পঞ্চায়েত প্রধান ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে বললেন সরি স্যার দেরি হয়ে গেছে আপনাদের চায়ের ব্যবস্থা এক্ষুনি করছি, আর বলবেন না ভোররাতে নিশির ডাকে সাড়া দিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে লক্ষ্মী বলে একটি ছয় বছরের মেয়ে। মামার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল তাই সেই তান্ত্রিককে খুঁজতেই এত দেরি হল আমার হঠাৎ মনে পড়ল। সবকিছু খুব আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম, খুঁজে পেয়েছেন, উত্তর দিলেন পঞ্চায়েত প্রধান। পেলে তো চেষ্টা করে দেখতাম তাকে তো পেলাম না। সিগারেট খাওয়ার নাম করে দুবার ওই লুঙ্গি পরা লোকটিকে খোঁজার চেষ্টা করল নিরাপদ ভোটের লাইনেও। দু-একজন নিশির ডাকের কথা আলোচনা করছিল, মনের সব কৌতূহল চেপে ভোট পর্ব শেষ করল নিরাপদ, কিছুই আর ভালো লাগছে না। সব গুছিয়ে নিয়ে স্কুল বাড়ি থেকে বেরোবার আগে পঞ্চায়েত প্রধানের হাত জোড় করে জিজ্ঞাসা করলেন কোন অসুবিধা হয়নি তো স্যার। নিরাপদ ও সুযোগ বুঝে ওনাকে একটু আড়ালে ডেকে ভোররাতের কথা বললেন শুনে উনি গম্ভীর হয়ে গেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা দেখা মানুষটির কি দাড়ি ছিল। আপনার বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে আপনি ইসমাইল কাকাকে দেখেছেন ,উনি তো বছর তিনেক আগে মারা গেছেন খুব ভালো লোক ছিলেন। জোতদারের কাছে সব জমি জমা হারিয়ে এই দালানেই শুয়ে থাকতেন। গ্রামের লোক কয়েকবার ওনাকে দেখেছে, উনি মাঝে মাঝে দেখা দেন। নিরাপদর শরীর দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল, মাথা থেকে পা পর্যন্ত। আমি ব্যগ্রতার সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম সেই মেয়েটি কি রকম আছে? চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার আগেই মারা গেছে। উত্তরটা এলো যেন অনেকটা দূর থেকে। সবার ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম হাঁটতে শুরু করলাম আর প্রণাম জানালাম, সেই অজানা কি বলব “মানুষ” না “আত্মা”।
0 comments:
Post a Comment