সম্পাদকের কলমে
নারায়ণ দেবনাথ-
সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম ।
ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম ।
নমস্কার সহ
অঙ্কুর রায়
সংখ্যার সম্পাদক
অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী
প্রধান সম্পাদক
লেখা পাঠানোর জন্য
আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com
Total Pageviews
By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.
টিয়া রঙ শাড়ি
মিত্রা হাজরা
পিয়ালের চোখে মুখে ভাসছে পলাশপুর গাঁয়ের বালিকা বেলার নস্টালজিয়া। ছোটবেলার এক্কা দোক্কা, কানামাছি, বা বৌ বসন্ত খেলা। ফুলি, ললিতা, মুকুলা, নন্দা তাদের সাথে হৈ হৈ, স্কুল, আড্ডা, গল্প। বিশাল উঠোন পাশাপাশি দালান কোঠা--পারিবারিক সম্প্রীতির এক মস্ত ইমারত। একান্নবর্তী পরিবার, দাদু অভয়চরণ রায় তখন বেঁচে। বড় জেঠু, মেজ জেঠু, ছোটকাকা,বড়মা,মেজ মা, তাঁদের সেই দেবী প্রতিমার মত মুখ। সাদা লাল পাড় শাড়ি, ঠোঁট পান খেয়ে টুকটুকে লাল, মায়া ভরা সব মানুষ। আসলে মা নেই পিয়ালের,এনারাই মানুষ করেছেন তাকে।
সকাল থেকে সেদিন হৈ হৈ, মুম্বাই থেকে আসবেন ছোট পিসীমনির আদরের বুমলা --তাঁর ভাসুরের ছেলে ইন্দ্রনীল। গাঁয়ে নাকি কি সব সমীক্ষা করতে আসবেন ।বিকেলের দিকে এলেন---দূর থেকে পিয়াল দেখেছে, একহারা চেহারা। ভাসা ভাসা চোখ, সৌম্য ভাব, নম্র বিনয়ী। ওর স্বল্প সংযত কথাবার্তা সকলকেই আকর্ষণ করে, আর পিয়ালকে করে মুগ্ধ। তাঁর দৃষ্টিতে কি যে ছিল--- পিয়াল যেন কেঁপে উঠেছিল প্রথম দেখেই।
ওকে সাথে নিয়েই পরদিন থেকে ইন্দ্রনীল ঘুরতে থাকেন গ্রামে গ্রামে, সকলের সাথে কথা বলেন, খোঁজ খবর নেন সাক্ষরতার হার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেন, শৌচাগার নির্মাণ--রান্না র গ্যাস এসেছে কিনা গ্রামে বা যে সমস্ত সরকারের উন্নয়নমুখী যোজনা আছে তার সুবিধা পাচ্ছে কিনা, বিপি এল কার্ড, এই সবখোঁজখবর করেন। এভাবেই কটা দিন কেটে গেল।
সেদিন কাজের শেষে ছাদে বসে ছিলেন ইন্দ্রনীল। বড়োমা বললো, যা তো মা, জলখাবারটা দিয়ে আয় ছেলেটাকে। আকাশে অল্প মেঘ ছিল--- হাওয়া দিচ্ছিল ঠান্ডা ঠান্ডা, বাড়ির পাশের কৃষ্ণ চূড়া গাছটা হাওয়ার দোলা দোল খেয়ে যেন আগুনের শিখার মত লাগছিল। মোটা কান্ড বেয়ে একটা কাঠবিড়ালী নেমে এলো ছাদের কার্নিশে ।একটা হলুদ মথ ভয় পেয়ে ওড়াওড়ি শুরু করলো পিয়ালের গায়ের কাছে। আপনার খাবারটা খেয়ে নিন, বলে প্লেটটা এগিয়ে দেয় পিয়াল। হাত না বাড়িয়ে, মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন--তুমি খুব সুন্দর। লজ্জায় লাল হয়ে গেল পিয়াল, সে আজ টিয়া রঙ তাঁতের শাড়ি পরেছে,কপালে লাল টিপ, তা কি ইচ্ছে করে--- কাল আমি একটা কবিতা লিখেছি। ও মা, তাই !আপনি কবিতা লেখেন--শোনান তবে, সামনে বসে পড়লো সে।
---যা পেয়েছি, তাতেই জীবন দিব্যি চলে যাবে,
আশ্চর্য কোমল ছায়া হৃদয় জুড়ে,
ইচ্ছে পাখি বন্দী হয়ে আছে-- ওকে
মুক্তি দিও, বেঁধে রেখো না।
আমার কুয়াশা ঘরে ওকে মানায় না।
ধীরে ধীরে কবিতাটা পড়ে ইন্দ্রনীল,মনে হলো যেন এক ঝাঁক রঙিন পাখি উড়ে গেল আকাশে।
সেদিন রাতে দেখলো সবার মুখ থমথমে, কি হয়েছে বুঝতে পারে না পিয়াল। শুনলো চিঠি এসেছে পিসীমার, জেঠু জেঠিমারা বাবা ফিসফিস করে কথা বলছে সব। পরদিন সকাল থেকে সে আর ইন্দ্রনীল কে দেখতে পায়নি বাড়িতে। খুড়তুতো ভাই বিল্টুকে জিজ্ঞাসা করে জানে, ইন্দ্রনীল চলে গেছেন। ভাই--- বললো দিদিভাই, উনি ইন্দ্রনীল দা নন, ওনার নাম তন্ময়, ইন্দ্রনীল দার বন্ধু। ইন্দ্রনীল দাই ওনাকে আগে পাঠিয়েছেন, ওনার কাজ পড়েছে, পরে আসছেন। তাহলে পরিচয় টা দিল না কেন তন্ময়? শুনলো ওর মা বাবা নেই, মামার বাড়ি মানুষ, কাজকর্ম ও সেভাবে এখনো পায় নি, লেখালেখি করে।
এরপর কলেজে পড়তে পড়তেই পিয়ালের বিয়ে হয়ে যায়--- ইন্দ্রনীল এর সাথে--- ওদের বাড়ির লোক পিয়ালকে দেখে আর দেরি করতে চায় নি। পিসীমার তাড়া ছিল সবচেয়ে বেশি। পিয়াল আজ মুম্বাই বাসী, ওদের একটা মেয়ে ইন্দ্রাণী। সেভাবে পলাশপুরে আর আসা হয়না পিয়ালের। আজ আসছে কাকার ছেলে বিল্টুর বিয়েতে। নিমন্ত্রিত রা সব আসতে শুরু করেছেন, জনসমাগমে সারা বাড়ি পরিপূর্ণ ।কাশ্মীরি তসরের পাঞ্জাবি আর শান্তিপুরী ধুতি পরে ইন্দ্রনীল তার সামনে, বলোতো কেমন লাগছে, শালাবাবু পরিয়ে দিল জোর করে। হেসে পিয়াল দুই আঙুলে মুদ্রা দেখিয়ে বলল ফাটাফাটি। ইন্দ্রাণী ছোটাছুটি করছে, মেজ মা র গলা-- ওরে পড়ে যাবি, পিয়াল দেখ মা, ও তো ব্যথা পাবে! ইন্দ্রাণী ওর দিদিমাদের নয়নের মনি। বড় মা বললো-- যা তো মা উপরে, ললিতা, মুকুলাকে বল--নতুন বৌ কে সাজিয়ে নীচে নিয়ে আসতে, নিমন্ত্রিত রা তো সব এসে পড়েছেন। পিয়াল সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো ছাদে। সহসা দৃষ্টি গেল সেই কোণের দিকটায়, চোখের সামনে ভাসতে লাগলো আগেকার দৃশ্য। আকাশে মোহময় চাঁদ,আর কেউ আবৃত্তি করছে--যা পেয়েছি, তাতেই জীবন দিব্যি চলে যাবে---
কেন সত্যি কথাটা সেদিন আমাকে বললে না তন্ময়? কেন আর কখনো দেখা দিলে না। বিয়ের পর ও ভেবেছিল মুম্বাই তে তার দেখা পাবে, শুনলো সে গ্রাম থেকে এসেই কোথায় যেন চলে গেছে।
আজ পলাশপুরে আসার পর থেকেই মনে হচ্ছে---দুরন্ত বেগে ছুটে চলা ট্রেনের জানলার বাইরের দৃশ্যের মত পরিচিত মুখটা যেন অপরিচয়ের চিহ্ন নিয়ে পিছলে গেছে। সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়েও তাকে অনুভব করা যাচ্ছে না । তুমি খুব সুন্দর, খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে ---তাকিয়ে দেখলো ইন্দ্রনীল উঠে এসেছে ছাদে, আজ কি প্রথম দেখলে নাকি! না তা নয়, এই শাড়িটায় তোমাকে বড় সুন্দর লাগছে, তাকিয়ে দেখে পিয়াল---টিয়া রঙ বেনারসী, কপালে লাল টিপ। পিয়ালের হাতটা ধরে নীচে নামতে থাকে ইন্দ্রনীল। নিঃশ্বাস যেন আটকে আসছে পিয়ালের, শাড়িটা অসম্ভব ভারি লাগছে, হাত ছাড়িয়ে বলল-- তুমি নীচে যাও, আমি এই শাড়িটা ছেড়ে অন্য শাড়ি পরে আসছি, বড় ভারি লাগছে শাড়িটা। ইন্দ্রনীল কে আর কথা বলতে না দিয়ে, পিয়াল আবার উপরের সিঁড়িতে উঠতে থাকলো, এ শাড়ি ছাড়তে হবে--- কিভাবে ভুলে গিয়েছিল টিয়া রঙের কথা! কিছুতেই আর পরবে না টিয়া রঙের শাড়ি।
Subscribe to:
Posts (Atom)
0 comments:
Post a Comment