সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

ইন্টারনেট 

 কাশীধামের নক্রদানব

রানা সেনগুপ্ত


 ‘‌ সারা ভারতে বারাণসী বা কাশীধাম হলো শ্রেষ্ঠ ধর্মপিঠ। সেখানকার সিঁধুলিয়া মোড়ের বড়ি হাভেলির বহুরাণি কুন্তীবাঈ সে শহরের সবচেয়ে ধর্মপ্রাণা মহিলা। প্রতিদিন ভোরে বাড়ি সংলগ্ন ঝিলে স্নান সেরে পুজোয় বসেন।গৃহদেবতা গিরিধারীলালার পুজোয় কাটে  কয়েক ঘণ্টা। তা বলে তাঁর মত সংসার করতে কেউ পারতেন না। হাভেলির প্রতিটি কোনায় ঘুরতো তাঁর নজর। অত বড় প্রাসাদের কোথাও এককণা ময়লাও পড়ে থাকতো না।

  শ্রাবণের গঙ্গা ভয়ংকর চেহারা নেয় বারাণসীতে। ফলে সে নদীতে স্নান রীতিমত বিপজ্জনক। কিন্তু বহুরানি স্নান করতেন নিজেদের প্রাসাদ সংলগ্ন ঝিলে। একদিন সেখানেই বিপদ ঘণিয়ে এলো। স্নান করতে নেমে তিনি বুকজলে তলিয়ে গেলেন। তাঁর সঙ্গে থাকা দাসী বিমলা পরে বলেছিল, এক বিশাল মগরমচ্ছ বা কুমির বহুরাণিকে গিলেছে। তারপর অতল জলে  অদৃশ্য হয়েছে। এমন হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ, বারাণসীর সমস্ত পারিবারিক জলাশয়ের সঙ্গে সেকালে গঙ্গার যোগসূত্র রাখা হতো।.‌.‌.‌’‌ বললেন লালাবাবু।

 লালাবাবুর জন্মদিনে আমাহার্স্ট স্টিটের বাড়িতে রাজ্যের শিকারি জড়ো হয়েছেন। তিনি ভারতের প্রায় সব, এমনকি বিদেশের নানা অরণ্যে শিকার করেছেন। তাঁর বন্ধু বা ভক্তের সংখ্যা নেহাত কম নয়।  ফলে নাইজেরিয়ার কুলিনান ব্রোনেট থেকে বিহার ঝাড়খণ্ড উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি জায়গা থেকে বহু শিকারি এসেছেন। আর এতজন শিকারি জমা হলে যা হয়, শিকারের গল্পই হতে থাকে। কুলিনান সম্প্রতি আফ্রিকান হাতি আর কেপ বাফেলো শিকার করেছেন। উত্তরাখণ্ডের মিনতানি প্রসাদ ফিরেছেন টাঙ্গানিকার দু’‌টি নরখাদক সিংহ মেরে। তাঁরা সবিস্তারে সে কাহিনি বর্ণনা দিচ্ছেন। আর শিকারিদের কেউ চোখ গোল করে, কেউ বা নিস্পৃহভঙ্গীতে সে শিকারের ঘটনা শুনছেন।

 হলঘরের অন্যদিকে শিলংয়ের মাধব বাহাদুর আর বিহারের বাঁকেলাল প্রসাদ একটা খবরের কাগজ নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন। সে কাগজে খবর বেরিয়েছে, নীলনদের লাগোয়া কায়রো শহরে এক দানবাকৃতি কুমিরের দেখা মিলেছে। সেটা যখনতখন লোকালয়ে হানা দিয়ে গরু মহিষ ছাগল কুকুরের পাশাপাশি মানুষও ধরে খাচ্ছে। ২০ ফুট লম্বা হিংস্র কুমিরটাকে শিকার করতে কোন দেশের কোন শিকারিকে ডাকা হবে, তা নিয়ে দু’‌জনের তুমুল তর্কাতর্কি!‌।

  অনেকে কফির পেয়ালায় ঠোঁট ডোবাচ্ছেন। কেউ আবার  কেক প্যাস্ট্রিতে মনোযোগী। হাসাহাসি তর্ক গুলতানিতে আড্ডা যখন দারুন জমে উঠেছে, এমন সময় তামিলনাড়ুর ভেঙ্কি নারোদা লালাবাবুকে লক্ষ করে বলে উঠলেন, ‘‌ হ্যাভ ইউ এভার কিল্ড আ হিউজ ক্রোকোডাইল, লালাজি?‌’‌  নিমেষে সব হৈচৈ থেমেছে। সকলে একদৃষ্টে লালাবাবুর দিকে তাকিয়ে। লালাবাবু কি বলবেন? তিনি হাতি গণ্ডার বুনো মোষ বাঘ সিংহ প্যান্থার এমনকি আমাজনের গভীর অরণ্যে‌ মানুষখেকো অ্যানাকোণ্ডাও শিকার করেছেন বলেই জানি। কিন্তু কোনদিনই কুমির শিকার করেছেন বলে আমি, যে রাজেন চৌধুরী ওঁর সঙ্গে ছায়ার মতই লেগে থাকি, কখনও শুনিনি।

 লালাবাবু সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন না। কফির পেয়ালা শেষ করে চুরুট ধরালেন। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘‌ বারাণসীতে একবার একটা মানুষখেকো কুমিরকে হত্যার ঘটনায় আমার কিঞ্চিৎ অবদান ছিল। সে এক অতি বিয়োগান্ত কাহিনি। তাই  গল্পটা আমি আগে কখনওই কাউকে বলিনি। অনেকদিন হয়ে গেল। তবু মনে হয় যেন সেদিনের ব্যাপার।’‌

 আর যায় কোথায়!‌ সকলেই লালাবাবুকে ধরে পড়লেন, সেই ঘটনাটা শোনাতে হবে। লালাবাবু চুপ করে ভাবতে লাগলেন। মনে মনে সেই শিকারের পটভূমিকা গুছিয়ে নিচ্ছেন।

                                   ২

 লালাবাবু বলতে শুরু করলেন—  স্বাধীনতা তখনও আসেনি। সেবার আসামের নানা জঙ্গলের ঘুরে সরকারের হয়ে বেশ কয়েকটি হাতি ধরেছি খেদা করে ফাঁসি শিকারের পদ্ধতিতে। কাজটা করে দেবার জন্য আসামের গভর্নর মেজর ডানকান আমাকে আশাতীত মোটা টাকার পারিশ্রমিক দিয়েছেন। সে অঢেল টাকা নিয়ে কি করবো, ভাবতে ভাবতে কলকাতা ফিরলাম। ফিরেই শুনলাম, বরানগরের বাসিন্দা অশীতিপর সেজো কাকিমা আমাকে নাকি দিনরাত খুঁজছেন। খুব জরুরী তলব।

 দেখা করতে যেতেই বিরাশি বছরের সেজো কাকিমা জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘‌ ওরা লালা। আমাকে একবার কাশীধামে নিয়ে চল বাবা। স্বপ্ন দেখেছি, সেখানেই আমার মৃত্যু হবে। যদি হয়, মণিকর্ণিকা ঘাটে আমাকে পুড়ি্যে ফিরিস বাবা। সরাসরি স্বর্গে যাবো তাহলে। কাশীতে সাতদিন থাকলেই নাকি মরবো।’‌

 আমি বললাম, ‘‌ তা আমাকেই এই কাজটা করতে হবে কেন?‌ তোমার ছেলেমেয়েরা কোথায়?‌ তাদেরই বলো না, তোমাকে নিয়ে যেতে। তা ছাড়া তোমার এখনও একটাও চুল পাকেনি। দাঁতগুলোও অটূট। অর্থাৎ তুমি সহজে মরছো না। মাঝ থেকে আমার সময়টাই বরবাদ হবে।’‌

 সেজো কাকিমা ভ্রকুটী করে বললেন, ‘‌ আমার ছেলেমেয়েরা আবার মানুষ নাকি?‌ সারাদিন স্বার্থপরগুলো নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। কত মাস আমাক সঙ্গে কেউ দেখা পর্যন্ত করেনি, জানিস!‌ আর তোর তো কামধান্দা কিছুই নেই। বেকার বাউন্ডুলে কোথাকার‌ ! বিয়েটা পর্যন্ত করলি না।‌ তোর আত্মার পিণ্ডলাভ হবে না। তুই–ই আমাকে নিয়ে চল। যা খরচা লাগে, আমি দেবো।’‌

 রাজি না হয়ে উপায় ছিল না। এরপর যদি না বলি তাহলে সেজো কাকিমা গুনগুন করে কাঁদতে শুরু করবে আর আমাকে ও তাঁর নিজের গুষ্টিকে গালমন্দ করবে। টিকিট কেটে বুড়িকে নিয়ে ট্রেনে উঠে বসলাম। ভাবলাম, কাকিমা মরবার আগে অন্তত কাশীধামের হাজারখানেক মন্দির ঘুরেফিরে দেখুক। আমারও শরীর আর মনের বিশ্রাম হবে।

 আমার বয়স যখন তিন, তখন মা মারা গিয়েছিলেন। বাবা বিদায় নেন আটের মাথায়। এই কাকিমাই বাপ–মা মরা ছেলেকে বুকে করে মানুষ করেছিল। তাই মনে হয়েছিল, তাকে তীর্থে নিয়ে যাওয়া আমারও পূন্যলাভ। উঠলাম সিঁধুলী মোড়ের কাছে বর্ধমানের রাজাদের প্রসাদ গোপালভবনে। কাকিমার জন্য দু’‌জন দাসী আর দু’‌জন পাহারাদার নিয়োগ করে দিলাম। একটা টাঙাও ভাড়া নিলাম। কাকিমা রোজ সকালে উঠে গঙ্গা নাইতে যায়। বিশ্বনাথ মন্দিরে পুজো দেয়। অন্নপূর্ণা মন্দিরে ভোগ খেয়ে বাড়ি ফিরে সন্ধ্যায় দশাশ্বমেধঘাটে গিয়ে আরতি দেখে। মরা দূরের কথা, তার স্বাস্থ্যের উন্নতি হতে শুরু করলো।

 বারাণসী বাঙালিদের সেকেন্ড হোম। ফলে সেখানে অসংখ্য বাঙালি পরিবার থাকে। আমি তাদের সঙ্গে আড্ডা দিই আর ঘুরে ফিরে কাশীর লাড্ডু প্যারা মালাই রাবড়ি লস্যি আর পান সাটাই। মাসখানেক পারে দেখলাম,  জামাকাপড়গুলোও ক্রমে আঁট হচ্ছে। মানে, আমিও মোটা হতে শুরু করেছি।সর্বনাশ!‌

                                   ৩

 সিঁধুলিয়া মোড়ের বড়ি হাভেলির গোপাল সিং রাণা, উদয়পুরের রাণাদের বংশধর। দশাশ্বমেধ ঘাটের দক্ষিণে পরপর যে সমস্ত ঘাট পড়ে তাদের একটির নাম রাণামহল । তা তৈরি করেছিলেন উদয়পুরের এক রাণা আর মহারাণি। সেই ঘাট তৈরির সময় থেকেই গোপাল সিংয়ের ঠাকুর্দা কাশীবাসি। গোপাল সিং আর কুন্তীবাঈয়ের সঙ্গে আমার দারুন সখ্যতা ছিল।বারানসী এলেই ওঁদের সঙ্গে চলে যেতাম শহর থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার দূরের চন্দ্রপ্রভা জঙ্গলে শিকারে। সেখানে এক সময় সিংহের বাসস্থান। চিতা, চিঙ্কারা, শম্বর, নীল গাই, বনবরাদের সংখ্যাও ছিল প্রচুর। এখন সেখানে বণ্যপ্রানীদের অভয়ারণ্য গড়ে উঠেছে। এই জঙ্গল হাঁকোয়া করে মাচায় বসে কুন্তীবাঈ নিজে বিশাল মদ্দা চিতা মেরেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমরা দিদি–ভাইয়ের সম্পর্ক। রাখীও পরাতেন। বারানসীতে এলেই আমার তাঁদের হাভেলিতে টানা নেমন্তন্ন।নিঃসন্তান এই দম্পতির বড় স্নেহে কাশীবাসের দিনগুলো কাটাতাম। যে দিনের কথা বলছি, তার আগের রাতে হাভেলি থেকেই ভুঁড়িভোজ সেরে ফিরেছিলাম। মাংসের পদই ছিল বাইশ রকমের !‌

 আমি বরাবরই লেটরাইজার। কিন্তু সকাল আটটা নাগাদ চারিদিকে ভীষণ হৈহল্লা শুনে ঘুম ভেঙে গেল। বেরিয়েও এসে শুনি বহুরাণিকে ভোরে কুমিরের খেয়ে ফেলেছে! মাথায় বজ্রাঘাত হলেও এতটা বিচলিত হতাম না।‌ দাঁত না মেজেই ছুটলাম হাভেলিতে। গিয়ে দেখি গোপাল সিংয়ের পুরোপুরি মচ্চিভঙ্গ অবস্থা। গভীর বিষাদে তলিয়ে হাভেলির উঠোনে মাটিতে থেবড়ে বসে রয়েছেন। ঘাটের দিক থেকে উচ্চস্বরে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। গিয়ে দেখি বহুরাণির সঙ্গে থাকা দাসী পুষ্পা লুটিয়ে পড়ে কাঁদছে। তার কাছে বসে হাভেলির বেতনভূক শিকারি মাধে সিং বোঝবার চেষ্টা করছে, ঘটনাটা কি করে ঘটলো।

 কান্নার তোড় কমলে পুষ্পা কোনমতে বলল, ‘‌ ভোরে বহুরাণি যথারীতি গলাজলে নেমে মন্ত্রোচ্চারণ করছিলেন। এই কাজে তাঁর বেশ সময় লাগে। বহুরাণির শুকনো পোষাক নিয়ে তাই ঘাটে দাঁড়িয়ে রোজকার মতই ঘুমে ঢুলছিলাম। একটা চিৎকারে ঘুমের চটকাটা ভেঙে দেখি বহুরাণি বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার করতে করতে প্রাণপণে সাঁতরে ঘাটে ওঠবার চেষ্টা করছেন। তাঁকে তাড়া করছে একটা বিশাল মগরমচ্ছ। সেটা মাঝপথেই বহুরাণিকে কামড়ে ধরে গভীর জলে ফিরে গেল। তারপর বহুরাণির শরীরটাকে শূন্যে ছুঁড়ে একেবারেই গিলে ফেললো। একটা তীব্র আর্তনাদ করে এরপর আমি জ্ঞান হারালাম।’‌ তারপরই মাধো সিংয়ের দিকে তাকিয়ে পুষ্প কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘‌ এখুনি যান। গঙ্গা মাইয়ে নৌকা নামিয়ে খুঁজে দেখুন, কুমিরটাকে মেরে বহুরানিকে নিয়ে আসুন।’‌

 মাধো সিং উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে বলল, ‘‌ আমি যাচ্ছি। আমার সঙ্গে যাবেন নাকি লালাজি?‌’‌ বেনারসে বেড়াতেই এসেছিলাম। তাই সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্রগুলোর একটাকেও আনিনি। খালি হাতে কি করে যাবো?‌ মাধো সিং ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে বলল, ‘‌ হাতিয়ারের জন্য চিন্তা নেই। হাভেলিতে রাণাসাহেবের হাতিয়ারখানা থেকে যা হোক একটা বেছে নিন। তবে যা নেবেন, যেন ভারি ধরণের হয়। কুমিরটার চেহারাটা পেল্লাই।‌ কয়েকদিন ধরেই একটা কানাঘুঁষো শুনছিলাম, একটা বিশাল মগরমচ্ছ নাকি গঙ্গার  উত্তরপাড়ের গ্রামগুলোতে হানা দিচ্ছে। মানুষ গরু ছাগল ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সেটা যে এখানেও হানা দেবে, স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।’‌

 জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‌ গঙ্গায় ঘুরে বেড়ানো কুমির এই ঝিলে এলো কি করে?‌’‌ মাধো সিং বলল, ‘‌ ঝিলের নিচের দিকে যে মস্ত সুড়ঙ্গ কাটা রয়েছে রাণাজির নানা ভানুপ্রতাপজির আমল থেকে। তাই তো গঙ্গাস্নান হচ্ছে ধরে নিয়ে এই ঝিলেই স্নান করতেন বহুরাণি। সেই সুড়ঙ্গ দিয়েই মগরমচ্ছটা ঢুকেছে।’‌

 জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‌  ঘটনাটা ঘটেছে ভোরে। আর এখন বাজে ন’‌টা। গঙ্গার বুকে ঘুরে, এখন কি করে বহুরাণি বা কুমিরটাকে খুঁজে পাবেন?‌’‌  মাধো সিং বলল, ‘‌ কুমিরটাকে তো খুঁজবো না। খুঁজবো ওর বাসাটা। মানে, আপনি বোধহয় জানেন না,  মগরমচ্ছদের অভ্যাস হলো শিকার ধরে নিয়ে গিয়ে একটা গর্তে ছিপিয়ে রাখে। তারপর সুবিধামত খায়। ভাগ্য ভালো হলে এখনো বহুরাণিকে আমরা জিন্দাই পেয়ে যেতে পারি। অন্তত রাণিজির শরীরটা চাই। সৎকার করতে হবে তো!‌’‌ কুমির শিকার কোনদিনই করিনি। ভাবলাম, হয়তো তাই হয়। কুমির শিকার ধরে নিয়ে কোথাও লুকিয়ে রাখে। কিন্তু সন্ধ্যে পর্যন্ত বর্ষার ভরা গঙ্গায় নৌকায় মাইলের পর মাইল ঘুরে এমন কোনও  গর্তের আভাস পেলাম না। হতাশ হয়ে ফিরে এলাম।

 তবে ততক্ষণে এক কঠিন প্রতিজ্ঞা করে বসেছি। যে কুমির আমার দিদিকে  শিকার করেছে, তাকে শিকার না করা পর্যন্ত এই যাত্রায় কাশীধাম ছাড়ার কোনও কথা নেই আমার!‌

                                   ৪

 লালাবাবু বললেন, ‘‌ এইখানে গল্পটা থামিয়ে আপনাদের কুমির সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। পৃথিবীতে কেউ বলে ১৪, কেউ বলে ২৩ প্রজাতির কুমির আছে। এদের ভেতর সাত ধরণের কুমির খুবই বিপজ্জনক। এগুলো খুবই বলশালী আর লম্বা। যেমন আমাজনের নদীতে থাকা ব্ল্যাক কেম্যানের দৈর্ঘ্য ১৩ ফুট। গঙ্গা ঘুরে বেড়ানো ‘‌মগর’‌দের দৈর্ঘ্যে হয় ১৩ থেকে ১৬‌ ফুট। আমেরিকান ক্রোকোডাইলেরা ১৬.‌৫ ফুট। ঘড়িয়াল প্রজাতিদের মেছো কুমির বলা হলেও, ১২ থেকে ১৫ ফুট লম্বা এগুলো সুবিধা পেলেই মানুষ শিকার করে। আমেরিকান অ্যালিগেটার প্রজাতি বড় হিংস্র। এরা দৈর্ঘ্যে ১৩ থেকে ১৫ ফুট। সব চেয়ে লম্বা প্রজাতিটি হলো সমুদ্রে থাকা সল্টওয়াটার ক্রোকোডাইল। এরা অন্তত ২০ ফুট লম্বা আর ৫০০ কিলো ওজনের। নীল নদের কুমিরেরাও ১৬.‌৫ ফুট থেকে ২০ ফুট হয়ে থাকে। যুগ যুগ ধরে কুমিরেরা মানুষ শিকার করে চলেছে। এই তো সেদিন কায়রো থেকে আমাকে সেখানে যেতে হবে বলে  টেলিগ্রাম পেলাম।  জানলাম ওখানে নীলনদের কুমির গ্রামে ঢুকে মানুষ আর পশু শিকার করছে। কয়েকদিন আগে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় পড়েছিলাম, বিহারের সাহেবগঞ্জ জেলার মগনশাহী গ্রামে প্রায় সাত ফুট লম্বা মগর প্রজাতির কুমির ধরা পড়েছে লোকালয়ে হানা দিয়ে। এই মগরেরা হিংস্রতায় নাকি সব প্রজাতিকে ছাপিয়ে যায়। একদা নাকি গঙ্গাতেই পৃথিবীর বৃহত্তম কুমিরদের দেখা যেতো। ১৯৫০ থেকে ৬০ ভেতর মানুষ  চামড়া আর মাংসের লোভে  এদের মেরে সাফ করে দিয়েছে। তবু গঙ্গায় আজো ৩ থেকে ৪ হাজার মগররের দেখা মেলে। একটা সময় সে নদীতে ছিল হাজারে হাজারে কুমির।

 আমরা অধৈর্য হয়ে বললাম, ‘‌ ‌থাক, থাক। কুমিরদের নিয়ে অত কথা বলতে হবে না লালাবাবু। আপনি গল্পটা শেষ করুন।’‌

 লালাবাবু বললেন, ‘‌ প্রতিজ্ঞা তো করে বসে রয়েছি। কিন্তু তা পূরণ করবো কি করে?‌ এদিকে রাণার মচ্চিভঙ্গ অবস্থা তখনও কাটেনি যে তাঁর পরামর্শ নেব। স্ত্রীর শোচনীয় মৃত্যুতে এমনই ভেঙে পড়েছেন, খাওয়াদাওয়া পর্যন্ত ছেড়েছেন। মাধো সিং আবার আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না। সে রোজ নৌকায় বাছাই বন্দুকবাজেদের নিয়ে নিষ্ফল টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে নদীর বুকে।

 দিন চারেক পরে মনমরা হয়ে বসে রয়েছি হাভেলির দরবার হলে,  গোপালজিউ মন্দিরের পুরোহিত নারায়ণপুকার পণ্ডিত এসে বললেন, ‘‌ ন’‌সাহসমনারুহ্য নরো ভদ্রানি পশ্যতি। এমন করে ভেঙে পড়লে বহুরাণির কি হবে? ওঁর দেহাবশেষ না পেলে তো সৎকার হবে না। আর শ্রাদ্ধশান্তিও হবে না। ওঁর ভাইপো লন্ডন থেকে এসেছে। সে কতদিন আর বসে থাকবে শ্রাদ্ধের জন্য ?‌‌ আপনি না বহুরাণির ভাই? এত নামী শিকারী আপনি। আপনার কোনও কর্তব্য নেই?‌‌’‌  বললাম, ‘‌ কিন্তু করবো কি?‌ সঙ্গে  নিজের হাতিয়ার নেই। মাধো সিং পাত্তা দিচ্ছে না। রাণাজিও প্রকৃতস্থ নন। আকাশপাতাল ভেবে কোনও পথই পাচ্ছি না।’‌

নারায়ণপুকার বললেন, ‘‌ আরে, কুমির শিকার করতে হাতিয়ার লাগে নাকি?‌ দরকার সাহস আর উদ্যমের। একটা টোপ বাঁধুন ঝিলের পাড়ে। খুব হাঁকডাক করবে এমন একটা ভঁইসা? লোভের চোটে‌ কুমিরের নানাও জল ছেড়ে উঠে আসবে। তখন সেটাকে পিটিয়ে মারুন না সবাই মিলে!‌’‌ কথাটা আমার বেশ মনে ধরলো।

 মাধো সিং দেখি এই টোপ দেবার প্রস্তাবে এক কথায় রাজি!‌ তাই পরের দিনই স্থানীয় গোয়ালাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হলো এক মহিষ। সেটা নাকি দারুণ ডাকাডাকি করে। ভোর হতে না হতেই ঝিলের হাঁটু জলে মহিষটাকে নামিয়ে তার গলায় মোটা  কাছি বেঁধে দেওয়া হলো। সঙ্গে বাধা হলো একটা মাঝারি চেহারার নোঙর। পরিকল্পনা হলো— যেই কুমির ঝিলের জল থেকে উঠে এসে মহিষটাকে গলধকরণ করবে অমনি তার গলার গভীরে  ঢুকে যাবে নোঙরটাও। সেটাকে টেনে সে জলের গভীরে তলিয়ে গেলেও, আমরাও ওই কাছি ধরে টান মারবো হেঁইও হেঁইও করে। কুমির উঠে এলেই তাকে গুলি করে মারা হবে। কাছিটার শেষ প্রান্ত বাধা ছিল পাড়ের একটা খুব মোটা আর মজবুত  অর্জুনগাছে।

 কুমির শিকারের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে না পড়তে বড়ি হাভেলি লোকে লোকারণ্য। সকলকে সাবধান করলাম, ‘‌ জল থেকে সকলেই দূরে থাকবে। আর কাছিতে টান পড়তেই ছুটে এসে  ঘাটের দিকে টানতে শুরু করবে সেটাকে।’‌ সবাই এককথায় রাজি।

 মহিষটা ঝিলে নামতে না নামতেই, ঠান্ডা জলের সংস্পর্শে এসে অস্বস্তিতে প্রবল ডাকাডাকি শুরু করলো। আমরা সকলেই জলের দিকে তাকিয়ে..‌.‌  যে কোনও সময় জল থেকেই উঠে আসবে সেই দানব। সঙ্গেসঙ্গে তাকে গুলি করতে হবে। রাণাসাহেবের হাতিশিকারের ভারি রাইফেল নিয়ে আমি আর মাধো সিং তৈরি।

 কয়েকঘণ্টা পার হয়ে গেল। মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়ার উপক্রম। মহিষও ডেকে ডেকে ক্লান্ত। ঘাটের কাছে এমন সময় আচমকাই ঝিলের নিস্তব্ধ জলে  বিশাল ঢেউ উঠলো‌!‌ সে ঢেউ মূহুর্তে ঢেকে দিল মহিষটাকে। পরক্ষণেই দেখি সেটা অদৃশ্য হয়েছে। জলের নিচে কোনও প্রাণী সেটাকে মুখে করে  বয়ে নিয়ে চলেছে, আর মহিষটা প্রাণপণে চারটে পা ছুঁড়ছে হাবুডুবু খেতে খেতে। সামান্য সময় পরেই কাছিতে টান পড়লো। পাড়ের মস্ত গাছটা মড়্‌মড়্‌ করে উঠলো। মাধো সিংয়ের ইশারায় সকলে মিলে টানতে শুরু করলো কাছি। সে কি টান!‌ একবার জন্তুটা পাড়ের কাছে এগিয়ে আসে। পরক্ষণেই মানুষদের হিঁচড়ে নিয়ে জলের দিকে চলে যায়। কতক্ষণ যে এমনি করে পার হয়ে গিয়েছে, মনে নেই। এবার যেন সে টান কমতে শুরু করলো। আরও বেশি লোককে কাছি ধরে টান মারতে বললাম। একটু একটু করে জল থেকে উঠে এলো একটা বিশাল কুমির!‌ সেটার হিংস্র প্রকাণ্ড চেহারা দেখেই টানতে থাকাদের পালিয়ে যাবার উপক্রম। মাধো সিংয়ের ধমকে অবশ্য তারা আর পালাতে পারলো না। পাড়ে তুলে ফেলা হলো নক্রদানবকে!‌

 এবার সেটা উপস্থিতদের দিকে মস্ত মস্ত ঝকঝকে দাঁতে ভরা হাঁ নিয়ে তেড়ে আসছে। মাধো সিং গুলি চালালো। কিন্তু তাক ফসকে  গুলি গিয়ে লাগলো কুমিরের শক্ত চামড়ায় ভরা পিঠে। গুলিটা ছিটকে গেল। এদিকে কুমিরটা এবার ঘাট অতিক্রম করে প্রায় পাড় উঠেছে। কোন রহস্যে সেটা গলায় বেঁধা নোঙর খুলেও ফেলেছে। তার ভয়ংকর হাঁ–য়ের আকার যেন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এবার কুমিরের দুটো চোখের ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে দিলাম রাইফেলের দুটো ভারি গুলি। তাতেও তার গতি রুদ্ধ হলো কই!‌ দেখি পালাতে গিয়ে মাধো সিং পড়ে গিয়েছে। আর তার দিকে একটু একটু করে এগিয়ে চলেছে সেই বিশাল কুমির। সেটার প্রকাণ্ড হাঁ–য়ের ভেতর পরপর চারটে গুলি করলাম। এইবার কুমিরটা লুটিয়ে পড়লো। দীর্ঘক্ষণ সেটাকে নিস্পন্দ দেখে জনতা আমার নামে জয়ধ্বনী দিয়ে উঠেছে। কুমির তাহলে সত্যিই মরেছে!‌ মাধো সিং কাছে এসে ধরা গলায় বলল, ‘‌ আপনে হামারি জান বাঁচায়ে লালাজি। মুঝে মাফ করে দিজিয়ে। ম্যয় তো আপকো আনাড়ি সমঝকে ইতনা দিন.‌.‌.‌’‌

 রাণাসাহেব মচ্চিভঙ্গ অবস্থায় ইস্তফা দিয়ে উঠে এসেছেন। আমাকে কঠিন আলিঙ্গনে বেঁধে ফেলেছেন। বারবার বলছেন, ‘‌ আপ নে হামরা লাজ বাঁচা দিয়ে লালাজি।’‌ কুমিরটার দৈর্ঘ্য মেপে দেখলাম। পাক্কা ২৩ ফুট!‌ তার পেট চিরে মিললো বহুরাণির গয়নায় মোড়া একখানি নিটোল হাত। সেটাকেই মণিকর্ণিকা ঘাটে পাঠিয়ে দেওয়া হলো বিধিমত সৎকারের জন্য।

 তারপর আর কি কি হলো, তা জানি না। আচমকাই সেজো কাকিমার শরীর খুব খারাপ হওয়া শুরু হতে,পরের দিনই তাকে নিয়ে কাশীধাম ছেড়ে কলকাতার ট্রেন ধরলাম। রাণা গোপাল সিং আমাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, হাভেলির সামনের দিকের প্রবেশপথের মুখে সেই নক্রদানবের স্টাফ করা দেহটা  দেয়ালে আঁটকে রেখেছেন। দলে দলে মানুষ এসে সেটাকে দেখে যাচ্ছে। সেজো কাকিমার ডাক্তার বদ্যির ঝামেলা মিটতে বাড়ি ফিরে সেই চিঠিও পেয়েছিলাম।

  জানতে চাইলাম,  ‘‌ কুমিরের চামড়াটা তো আপনারই পাওয়ার কথা। সেটাকে বাড়িতে ঝুলিয়ে রাখারও কথা। কেন আনলেন না?‌ লালাবাবু বললেন, ‘‌  স্মৃতি সবসময় কি সুখের হয়?‌ কিছু স্মৃতি বড় দুঃখ দিয়ে যায়। ওটাকে সামনে রাখলে তো বারেবারে আমার দিদি, বহুরাণির কথা মনে পড়ে যেতো। তীব্র শোকের সমুদ্রে ডুবে গিয়ে কোনও কাজই আর করতে পারতাম না। তাই  হাভেলি ছাড়বার আগে বলে এসেছিলাম, চামড়াটা রাণাসাহেবের হেফাজতেই থাকবে। বারাণসীর সিঁধুলিয়া মোড়ের সেই বড়ি হাভেলিতে গেলে আজও কুমিরটার স্টাফ করা শরীর দেখতে আর শিকারের গল্পটা শুনতে পাবেন।’‌

0 comments: