সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
![]() |
| অঙ্কনে- অমিত দাস |
সত্যজিতের ভূত
অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী
প্রবন্ধটা লিখবো যখন ভাবছি, তখন হঠাৎ মাথার মধ্যে ছোটবেলায় ঠাকুরমা’র কাছ থেকে শোনা বিভিন্ন ভূতের রকমারি মূর্তি আমার চোখের সামনে ভাসতে শুরু করলো, যার চেহারার আদল প্রায় সবটাই আমার কল্পনা । যাই হোক ভূত বলে কথা , তাদের নিয়ে তো ছেলেখেলা চলেনা। তাই পুরনো কাসুন্দিতে আরেকটু লেবুর রস মেশানোর মতো ব্রহ্মদৈত্যি থেকে শাঁকচুন্নির মতো বিভিন্ন আপদমস্তক ভূতের চেহারা ও চরিত্র গুলিকে সামনা সামনি এনে যখন ভূতের রাজার ঘরে ঢুকিয়ে দিলাম দেখলাম তারা বাংলাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে রীতিমত ভারতীয় হয়ে গেছে । পরশুরামের “ভুশুণ্ডির মাঠ” এর ভূতেরা কিলবিল করতে করতে যখন আমাদের ঘরে ঢুকে পড়েছিল, তিনি ভূতের যে ভারতীয় রুপ দেবার চেষ্টা করেছিলেন তা কে সার্থক ভাবে পর্দায় প্রতিস্থাপন করলেন সত্যজিৎ ।
উপেন্দ্রকিশোর কিন্তু ভূতের অবয়ব সম্পর্কে খুব বেশি কিছু লেখেননি । “তাদের চোখ গুলো জ্বলছে যেন আগুনের ভাঁটা, দাঁতগুলো বেরোচ্ছে যেন মুলোর সার” এই টুকু বলেই ক্ষান্ত দিয়েছিলেন, কিন্তু তাদের ভূত করে তুলেছিলেন সত্যজিৎ। আসলে উপেন্দ্রকিশোরের ভূতের মধ্যে কোথাও একটা মানুষের বৈশিষ্ট্য রয়ে গিয়েছিল যা সত্যজিৎ ইচ্ছে করেই হলিউডি ষ্টাইল দিতে জাননি, তাই উপেন্দ্রকিশোরের “কুঁজো আর ভূত” এর ভূত ভাল মানুষের প্রতিচ্ছবি হয়েই রয়ে গেছে। সত্যজিৎ শুধু ভূতের ছায়া ছবিকে নিজের মতো গড়েছেন যেখানে তিনি সমাজের প্রতিটি মানুষকে ভূতের অবয়বে আশ্চর্য ভাবে তুলে ধরেছেন ।
উপেন্দ্রকিশোরের গল্পে কিন্তু কোন ভূতের রাজা ছিলনা, কিন্তু সত্যজিৎ কালো আলোআঁধারির সামনে মুকুটপড়া দুপাশের দাঁত বার করা এমন রাজাকে নিয়ে এলেন যার সিংহাসন আছে, যা কে দেখে রাজার মতো সমঝদার মনে হয় । তার আশীর্বাদের হাত সত্যজিতের মাস্টারস্ট্রোক , যা বোধহয় ভূত সমাজকে অন্য জাতে তুলে দিয়েছে । দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ভুত বা রাক্ষস, বা হেমেন্দ্র কুমার রায়ের মতো ভয়াল ভয়ঙ্কর ভূত, বা ছোটবেলায় ঠাকুরমার কাছ থেকে শোনা হাড় হিম করা গল্পের সাথে ছড়া, “দুপুর বেলা, ভূতে মারে ঢেলা” যেন সত্যজিতের ভূতের কাছে এসে অনেক বেশি প্রাদেশিকতার সীমা ছাড়িয়ে ভারতীয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু আবার “মনিহারা” সিনেমা করতে গিয়ে তিনি আদি অকৃতিম রবীন্দ্রনাথের ভৌতিক স্পৃহাকে সচেতন ভাবে পর্দায় এমন করেই জাগিয়ে তোলেন কারন তিনি জানতেন, সেই ভৈতিকতাকে জাগিয়ে না তুললে তার সিনেমার আঙ্গিকটা পুর্ন হবে না কারন “মনিহারা” গল্পটি লেখা হয়েছে ভূতকে উদ্দেশ্য করেই। কিন্তু গুপি-বাঘার ভূতেরা সত্যজিতের সম্পুর্ন নিজের কল্পনার ফসল। তাদের সারল্যতের সাথে অন্য কোন ভূতের কোন তুলনাই হয় না । গুপি গাইন বাঘা বাইনে ভূতেদের মধ্যে নির্ভেজাল ভারতীয়ত্ব আরোপ করেছেন, তা তাদের পোশাকে আমরা দেখতে পাই, যেখানে বাঙালি থেকে দক্ষিণী বা ভারতীয় ব্রিটিশ দের পোশাকের আদল, হাতে ছড়ি এমন ভাবে দেখা দিয়েছে যা সেই ভূত কে ভয়ের কাঁটায় বন্দি না হয়ে আনন্দের মধ্যে নিয়ে গেছেন, আর সেই খানেই সত্যজিতের সাফল্য ।
সত্যজিতের আরেক সৃষ্টি হল তারিণী খুড়ো যে সারা জীবনে যা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন তার মধ্যে রয়েছে ভূতেদের প্রাবল্য । কিন্তু একটা জিনিস এখানে উল্লেখিত যে তারিণী খুড়োর ভূতেরা বা প্রেতাত্মা সেই ভূত বা প্রেতাত্মা নয় যাকে দেখলে পাঠকের ভয় করবে। কিন্তু সে দুষ্টু দের শাস্তি দেয়, খানিকটা গল্পের নায়কের মতো । “মহারাজা তারিণী খুড়ো” তে আমরা যে প্রেতাত্মার কথা পাই, যে সুন্দর ইংরাজিতে কথা বলে, বেশ বোঝাই যায় পড়াশোনা জানা ভুত। আসলে সত্যজিতের ভুতের মধ্যে আমরা কোন ভাবে ভূত সুলভ গা ছমছমে ভাব সেটা পাইনি । আসলে উপেন্দ্র কিশোর বা সুকুমার - তারা দুজনেই ভূত কে শুধু আমাদের অতীত ছাড়া অন্য কোন চোখে দেখেননি । তারিণী খুড়োর ছত্রে ছত্রে তাই ভূতের মুখে অতীত কথার প্রাবল্য যা ভূতের মুখে রামনাম না বলা গেলেও বাংলাদেশে খ্যাত নামা ভূতেদের গোত্রে যে এরা পড়েনা তা বলাই যায় ।
সব শেষে আসি সত্যজিতের ভূতের স্কেচের কথায়, বা সত্যজিতের আঁকা ভূতের ছবির কথায়, যেখানে মানুষের বা বলা ভাল ভূতের অবয়বের মধ্যে অন্ধকার ছায়া থাকলেও তাকে বোঝা যায় সে মানুষের মতো । তাই কোথাও গিয়ে সত্যজিতের ভূত তার নিজের স্বাতন্ত্র বজায় রেখেছে, আর সত্যজিৎ ইচ্ছে করেই সেই কাজ করেছেন। ভূতের রাজাকে কোথাও গিয়ে ভগবানের মতো ‘বর’ দেবার ক্ষমতা দিয়ে প্রমান করেছেন রাজা কিন্তু রাজাই হয় সেই ভূত হোক বা মানুষ।তাকে আদ্যোপান্ত বাঙালির মতো সাজিয়ে, মাথায় টোপর পরিয়ে এবং সাথে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে ভূতকে নিজের বাড়ির লোক বানিয়েছেন, যদিও তার ভূতত্ব রয়েই গেছে তার অন্ধকারে, হাওয়ায় মিলিয়ে যাবার মধ্যে। ভূতের রাজা কখন গিয়ে আমাদের মনের মণিকোঠায় ঢুকে পড়েছে তা আমরা জানতেও পারিনি তাই তো মনে মনেই গেয়ে যাই- “ভূতের রাজা দিল বর, জবর জবর তিন বর”।

0 comments:
Post a Comment