সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

 নতুন দিনের সূর্য

সৌম্যশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

                                                           

                                                                এক

          “আরে – আরে – আরে – এ কী করছেন আপনি? বইগুলোকে এইভাবে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছেন কেন? তবে যে বললেন কয়েকটা কথা বলে চলে যাবেন! তাহলে ---?” বসুধা বললেন। মেঝেতে পড়ে থাকা বইগুলোকে প্রায় বুক দিয়ে আগলে ধরে চিৎকার করে উঠলেন।
          সত্যপ্রকাশ যাদব কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। উনি সতুগড়া থানার অফিসার ইনচার্জ। খুব কড়া লোক। আজ বহুদিন ধরে এই থানাতে আছেন। মাঝে একবার বদলীর কথা হয়েছিল, কিন্তু অনেক ওপর তলার লোককে ধরে ব্যাপারটাকে রদ করিয়ে দিয়েছেন।
          কালো শক্তপোক্ত লম্বা চেহারা। চোখদুটো অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা – তাকালেই বুকের ভেতরটা যেন শিরশিরিয়ে ওঠে। এখন বসুধার কথার উত্তর দিলেন। বললেন, “কই – ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছি না তো – সার্চ করছি।
          হ্যাঁ, তখন তাই বলেছিলাম বটে – কয়েকটা কথা বলে চলে যাব। কিন্তু এখন দেখছি ভাল করে সার্চ করা দরকার। তাই আপনার বাড়ী ঘর সব কিছু, এমনকি প্রয়োজন হলে আপনাকেও ওলোট পালোট করে দেখব। কেন, আপত্তি আছে নাকি?”
          “আপত্তি আছে মানে – নিশ্চয় আপত্তি আছে!” বসুধা জবাব দিলেন। বইগুলো ছেড়ে দিয়ে প্রতিরোধের ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়ালেন। তেজি গলায় বলে উঠলেন, “আর আমাকে ওলোট পালোট করে দেখবেন মানে – কী দেখবেন? নোংরা নোংরা কথা বলতে খুব ভাল লাগে, তাই না? কিন্তু সার্চ করতে গেলে তো ওয়ারেন্ট লাগে। ওয়ারেন্ট দেখান – তবে সার্চ করতে দেব, নইলে নয়।
          রাত এখন এগারোটা বাজে – আপনি লোকজন নিয়ে আমার ঘরে ঢুকে রীতিমত অসভ্যতা শুরু করেছেন। কোন মানুষকে এইভাবে হ্যারাস করা যায় না। সব কিছুরই একটা সময় অসময় আছে। এটা তো আর মগের মুলুক নয় – একটা গণতান্ত্রিক দেশ!”
          “হ্যাঁ, গণতান্ত্রিক দেশই তো – মগের মুলুক কেন হবে।” সত্যপ্রকাশ উত্তর দিলেন। কেমন যেন হায়নার ভঙ্গিতে হাসলেন। “মগের মুলুক হলে কি আর এত কথা বলতাম – না এতক্ষণ অপেক্ষা করতাম? কবেই তো কত কিছু করে দিতাম।”
          “কত কিছু করে দিতেন মানে – কি করতেন? খুন – জখম – নির্যাতন – ধর্ষণ? নাকি আরো অন্য কিছু?” বসুধা যেন প্রায় ঝাঁঝিয়ে উঠলেন। “মাঝ রাতে একজন মহিলার সঙ্গে এইভাবে কথা বলতে আপনাদের লজ্জা করে না? নাকি এই সব আপনাদের বোকা বোকা বাহাদুরি দেখানোর অঙ্গ?”
          “না ম্যাডাম – লজ্জা লাগে না।” সত্যপ্রকাশ হঠাৎই যেন কিছুটা নির্লিপ্ত হয়ে পড়লেন। “তাছাড়া আমার সঙ্গে তো চারজন মহিলা কনস্টেবল রয়েছেন। কই তাদের জিজ্ঞাসা করুন তো দেখি, আমি লজ্জা পাওয়ার মতো কোন কথা বলেছি কিনা? আর বাহাদুরি কখনো বোকা বোকা হয় না। বাহাদুরি চিরকাল বাহাদুরিই।
          হ্যাঁ, সার্চ ওয়ারেন্ট আছে – দরকার হলে দেখাব। তবে সব সময় তা প্রয়োজন হয় না। আপনি এতক্ষণ যে কথাগুলো বললেন সেগুলো সবই সাধারণ মানুষদের জন্যে। কিন্তু আপনি তো সাধারণ মানুষ নন – যথেষ্ঠই বিখ্যাত। আর আপনার নামে তো অজস্র কমপ্লেন আছে।”
          “আমার নামে কমপ্লেন আছে – কী কমপ্লেন আছে?” বসুধা জানতে চাইলেন। কেমন যেন হতবাক হয়ে গেলেন
           সত্যপ্রকাশ জবাব দিলেন। কুৎসিত ইঙ্গিতে চোখদুটো নাচালেন, “শুনবেন শুনবেন – সময় মতো সবই শুনবেন। তার জন্যে এত তাড়াহুড়ো কিসের? সময় তো আর এত সহজে শেষ হয়ে যাচ্ছে না – আমিও চলে যাচ্ছি না। রাত যে এখন অনেকটাই বাকি!
          আপনারা কেমন মানুষ জানেন তো? দেশে থাকবেন- দেশের সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করবেন। সরকারী স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশুনা করবেন। হায়ার স্টাডি করতে বিদেশ যাবেন। তার জন্যে যার কাছ থেকে যত রকম সাহায্য পাওয়া সেগুলো আদায় করবেন। আবার দেশে ফিরে এসে তাদেরকেই উঠতে বসতে গালাগাল দেবেন মানুষের কাছে গরম গরম বক্তৃতা দিয়ে হিরো সাজবেন। ভুল্ভাল তথ্য দিয়ে তাদের ক্ষেপিয়ে তুলবেন। তারপর আন্দোলনের নামে ইচ্ছা করে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবেন। এতে ল-এন্ড-অর্ডারের প্রবলেম দেখা দেবে - চারিদিকে গন্ডগোল বাধবে।
          নিরীহ মানুষগুলো আপনাদের আসল চালাকিটা বুঝতে পারবে না। তারা আপনাদের বিশ্বাস করে চোখ কান বুঁজে তথাকথিত সেই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তারপর চূড়ান্ত বিপথগামী হয়ে জ্ব্লে পুড়ে ঝলসে রাখ হয়ে যাবে। আর আপনারা তার সব রকম আঁচ থেকে নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রেখে নিশ্চিন্তে দিন কাটাবেন!
          নাঃ, এটা চলতে দেওয়া যায় না- সাধারণ মানুষকে এই ভাবে ঠকতে দেওয়া যায় না।”
          “এগুলো একদমই বাজে কথা – আপনার বানানো।” বসুধা বললেন। চিৎকার করে উঠে রাগী গলায় প্রতিবাদ জানালেন। “আমি আজ পর্যন্ত কাউকে ঠকাইনি। কোন সরকারী স্কলারশিপও পাইনি – বিদেশেও যাইনি। সে রকম কোন আন্দোলনেও যোগ দিইনি, গরম গরম বক্তৃতাও করিনি। কারণ ওগুলোর সম্বন্ধে আমার মনেই যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে।
          আমি শুধু লোকেদের নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হতে বলেছি। তাদের সে অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বলেছি। অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে বলেছি। অন্যের বিপদে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে বলেছি। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ বন্ধ করতে বলেছি। কিন্তু এ তো কোন অন্যায় কথা নয়। তাহলে ----? 
          “কী তাহলে? এ কথাগুলোই তো চূড়ান্ত উস্কানিমূলক – পুরোটাই লোক দেখানো। ভেদাভেদ বন্ধ করার নামে মানুষকে ভড়কানো – আরো বেশী করে বিভেদ ছড়ানো। কিন্তু আপনি জিজ্ঞেস করছিলেন না যে আপনার নামে কমপ্লেনটা কি?
          সবচেয়ে বড় কমপ্লেন হল যাযোদিয়াদের কারখানাটা হতে না দেওয়া। অথচ এই কারখানাটা হলে জায়গার চেহারাটাই পালটে যেত। নতুন নতুন মানুষ আসত – অনেক ইনভেস্টমেন্ট হত। স্থানীয় মানুষেরা চাকরি পেত – দুবেলা পেট ভরে খেয়ে বাঁচত।
          কিন্তু আপনাদের ধ্যান ধারণা সবই পুরানো দিনের বস্তা পচা। মানুষের সার্বিক উন্নতি আপনারা চান না। শুধুমাত্র যে কোন ভাবে নিজেদের লাইম লাইটে রাখার চেষ্টা। আর তাড়িয়ে তাড়িয়ে প্রচারের মজা লোটা। তাতে যদি সাধারণ মানুষের ক্ষতি হয় তো হোক – আপনাদের তাতে কিছুই এসে যায় না!”
          “তার মানে – কী সব আজে বাজে কথা বলছেন বলুন তো? এ সব কথা আপনাকে কে বলল? কী বোঝেন কী আপনি আমাদের ধ্যান ধারণা সম্বন্ধে? মানুষের উন্নতি আমরা সবাই চাই। তবে সে উন্নতি সমস্ত এলাকাটাকে বিষাক্ত করে দেওয়ার বিনিময়ে নয়। আর আপনি কোন কারখানাটার কথা বলছেন বলুন তো – প্যারিস গ্রীন কারখানাটার তো?       
কিন্তু প্যারিস গ্রীন মানে কি সেটা জানেন তো? প্যারিস গ্রীন হচ্ছে কপার আরসেনেট। গোটা পৃথিবীতে এই ধরণের কারখানা বহু দিন আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে কারখানার আশেপাশে বিস্তীর্ণ এলাকায় আরসেনিক দূষনের সম্ভবনা থাকে। আর এই দূষণ মানুষকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। হাজার চিকিৎসা করেও তখন কোন ফল পাওয়া যায় না। কারণ বিষটা ততোদিনে খাবার জলের সঙ্গে মিশে শরীরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
অন্য দেশে যাওয়ার দরকার কী – আমাদের দেশেই তো একসময়ে এই ধরণের কারখানা ছিল। ওখানে প্যারিস গ্রীন তৈরী হত। পাট চাষে কীটনাশক হিসাবে ব্যবহার হত। কিন্তু কারখানার বর্জের সঙ্গে ওখানে ভয়ঙ্কর রকম আরসেনিক দূষণ ছড়িয়ে পড়ে। নব্বই-এর দশকে বিপদটাকে চিহ্ণিত করতে পেরেই সরকার থেকে সে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। 
 কিন্তু ততোদিনে যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। দূষণের ফলে বহু মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। অনেকে মারা গিয়েছেন – অনেকে জীবনমৃত হয়ে বেঁচে রয়েছেন।
সব জেনেও আপনি সেই কারখানার হয়ে ওকালতি করছেন? শুধুমাত্র কিছু অর্থ আর কিছু মানুষের স্বার্থ সাধন করতে  সাধারণ মানুষকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে চাইছেন - আশ্চর্য তো!
কিন্তু আপনারা ওকালতি করলেও সাধারণ মানুষ তা মেনে নেবে কেন? নেয়ওনি – সবাই মিলে প্রজেক্টটা বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে। তাকে যদি আপনি আন্দোলন বলেন তো আমি নাচার।      
          আর ঐ দাবি তো শুধু মাত্র আমরা কয়েকজনই করিনি – এটা এ অঞ্চলের প্রতিটি শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের দাবি ছিল। সেখানে আলাদা করে কাউকে কৃতিত্ব দেওয়া যায় না।
          এটা ঠিক, যারা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এই দাবিকে সমর্থন করে এসেছে আমি তাদেরই একজন। পরে আরো অনেকেই এতে যোগ দেয়। আবার অনেকে ছেড়ে চলেও যায়।”
          “হ্যাঁ, ছেড়ে চলে যায় তার কারণ আপনি অন্যায় ভাবে ব্যাকডোর দিয়ে লালজিকে ডেকে এনে অরাজনৈতিক আন্দোলনটাকে রাজনীতির রঙ লাগাতে চেয়েছিলেন! তখন তো লালজি প্রায়ই আপনার বাড়ীতে আসতেন। গোপনে এসে মাঝ রাতে আপনাদের সঙ্গে মিটিং করতেন!”
          “লালজিকে আমি ডেকে নিয়ে এসেছিলাম? আমাদের বাড়ীতে আসেন – মিটিং করতে? এ সব কী আজে বাজে কথা বলছেন বলুন তো?” বসুধা বললেন। যেন প্রায় চিৎকার করেই উঠলেন।
          সত্যপ্রকাশ যাদব উত্তর দিলেন। গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, “যা বলেছি ঠিকই বলেছি। শুধু শুধু চিৎকার করলে তো আর হবে না। এর প্রতিটা কথার প্রমান আমার কাছে আছে।
          আর আমি তো আসেন বলিনি – আসতেন বলেছি। কিন্তু আপনি মুখ ফসকে সত্যি কথাটা বলে ফেলেছেন। সত্যি কখনো চাপা থাকে না – বুঝেছেন? তার মানে লালজি এখনো আপনার বাড়ীতে আসেন!
          এটা অবশ্য আমি আঁচ করেছিলাম – লালজি এখনো শহরে ঢুকছেন। নইলে চারিদিকে এত মারপিট খুনোখুনি হয় কী করে? তবে লালজির মিটিংগুলো যে এখনো আপনার বাড়ীতেই হচ্ছে সেটা বুঝতে পারিনি।
          তার মানে আবদুলকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটাও আপনার বাড়ীতেই নেওয়া হয়েছিল! সেই রাতে মিটিং সেরে নিজের ডেরায় ফেরার পথে লালজি নিজের হাতে আবদুলকে গুলি করে খুন করে। ওর দোকানটাও পুড়িয়ে দিয়ে যায়!
          এমনকী গতকাল রাত্রে ডঃ প্রসাদের হাসপাতালে ভাঙচুরটাও তো আপনারাই ঘটিয়েছেন। তখন কিছুক্ষণের জন্য লালজিকেও ওখানে দেখা গিয়েছিল! ওঃ, খবরটা যদি একটু আগে পেতাম তাহলে আর বলতে হত না – মালটাকে ঐ খানেই পটকে একেবারে পেছনে ভরে দিতাম।”
          “কি বললেন, আমি ডঃ প্রসাদের হাসপাতালে ভাঙচুর করেছি? মোটেও না। আপনি মিথ্যা বলছেন।” বসুধা বললেন। যেন গর্জন করে উঠলেন। “ও সব ভাঙচুরে আমি বিশ্বাস করি না। ওতে আমি ছিলাম না – ভবিষ্যতেও থাকব না।
          আর লালজিকেও আমি চিনি না – আজ পর্যন্ত চোখেই দেখিনি। আপনি ভুলভাল কথা বলে অকারণে আমাকে ফাঁসাতে চাইছেন।”
          “তাই, লালজিকে চোখেই দেখেননি – চেনেন না? আপনাকে ফাঁসাতে চাইছি? কিন্তু কাল রাতে যে অনেকেই আপনাদের দুজনকে কথা বলতে দেখেছে!” সত্যপ্রকাশ জবাব দিলেন। যেন চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলেন।
          “কিন্তু ও কথা থাক। এ সব কী বই পড়েন আপনি – অ্যাঁ? এ সবই তো উসকানিমূলক বই – আজে বাজে উল্টোপাল্টা কথা লেখা! এ তো আমরা মেনে নিতে পারিনা – মেনে নেবও না।”
          বললেন। বলেই শেল্ফ থেকে একটা মোটা বই নিয়ে সজোরে মেঝেতে ছুঁড়ে দিলেন। বইটা জন পিটারসনের লেখা। খুবই বিখ্যাত বই – ‘দা উইনকি বার্ডস’ – প্রায় ছ’শো পাতার পেপার ব্যাক বাইণ্ডিং। মূলত জন পিটারসনের নিজের জীবনকে নিয়ে লেখা। হারারে – তখন যার নাম ছিল সলস্‌বেরী – সেই সলস্‌বেরীর জেলে বসে প্রায় পাঁচ বছর ধরে বইটা লিখেছিলেন।
          জন পিটারসন ছিলেন গত শতাব্দীর একজন সমাজকর্মী। ষাটের দশকে এখনকার জিম্বাবুয়ে – তৎকালীন রোডেশিয়ায় কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের অধিকার রক্ষার লড়াই-এর অন্যতম মুখ। কিন্তু তখনকার বৃটিশদের মদতপুষ্ট স্মিথ সরকার কোন কারণ না দেখিয়েই একদিন তাঁকে গ্রেপ্তার করে। পরে দীর্ঘ সাত বছর হাজত বাস করার পর দেশদ্রোহীতার অজুহাতে ফাঁসি দেয়!
          জন পিটারসন কিন্তু রোডেশিয়ার মানুষ ছিলেন না – ওঁর বাড়ী ছিল আয়ারল্যান্ডে। পড়াশুনো বিখ্যাত ডাবলিন বিশ্ববিদ্যালয়ে – সেখানকার পদার্থ বিজ্ঞানের স্নাতক।  
          এর পরেই জড়িয়ে পড়েন রোমান ক্যাথালিক চার্চের কর্মকাণ্ডে। তখনই ঠিক করে নেন নিজের ভবিষ্যত কর্মসূচী। ঐ চার্চের নির্দেশেই ফাদারের দায়িত্ব নিয়ে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এসে হাজির হন সলস্‌বেরীতে। ধীরে ধীরে এক আত্মীক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন সেখানকার দরিদ্র নিরন্ন নিপীড়িত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষগুলোর সঙ্গে। তারপর একদিন মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শুরু করেন বর্ণবৈষ্ম্যের বিরুদ্ধে তাদের অধিকার রক্ষার লড়াই!
          ওঁর মৃত্যুর পর আশির দশকে স্বাধীন জিম্বাবুয়ে সরকার নিজেদের দায়িত্বে ‘দা উইনকি বার্ডস’ বইটা প্রকাশ করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বইটা আউট অফ প্রিন্ট হয়ে যায়। বছর পাঁচেক হল এশিয়া প্যাসিফিক থেকে আবার নতুন করে ছেপে বেড়িয়েছে!
          সেই বইটা মাটিতে পড়ল – পড়েই একবার ছিটকে উঠল, ওপরের বাইণ্ডিংটা খুলে গেল – পাতাগুলো সব আলগা হয়ে চারিধারে ছড়িয়ে পড়ল।
          মুহূর্তেই বসুধা কেমন যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। কিন্তু পরক্ষণেই রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে স্থান কাল পাত্র ভুলে সত্যপ্রকাশ যাদবকে দু হাত দিয়ে সজোরে ধাক্কা দিলেন।
          সত্যপ্রকাশ মনে হয় এটার জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না। আচমকা ধাক্কায় যেন পড়ে যাওয়ার মতো হলেন। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর প্রবল  আক্রোশে বসুধার গালে সপাটে একটা চড় কষালেন।  বসুধা সে আঘাত সামলাতে পারলেন না – মুখ থুবড়ে ছিটকে পড়লেন।
          সত্যপ্রকাশ কিন্তু এখানেই থেমে গেলেন না। চুলের মুঠি ধরে বসুধাকে টেনে তুলে দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠলেন,    “আমাকে ধাক্কা – আমাকে – সত্য দারোগাকে?
          এতক্ষণ কিছু বলছিলাম না – মেয়েছেলে বলে ছাড় দিচ্ছিলাম। কিন্তু এখন আর মেয়ে ফেয়ে বলে মানব না – মেরে মুখ ভেঁঙে দেব। শালি কুত্তি, দেশের খাবি, দেশের নিবি – আবার দেশের পেছনেই বাঁশ ঢোকাবি!
          অ্যাই, সবাই মিলে ধরতো মাগিটাকে – টেনে তোল ভ্যানে। পুলিশের গায়ে হাত তোলার মজাটা আজ ভাল করে বুঝিয়ে দেব!
          আর ভাল করে খোঁজ – সিডি, মোবাইল, ল্যাপটপ, ডাইরী, পেনড্রাইভ কোন কিছু যেন বাদ না যায়। সব কিছু থানায় নিয়ে চল। এ শালি যেন কিছুতেই ছাড় না পায়। এমন ভাবে কেস সাজিয়ে উএপিএ-তে চালান করে দেব যাতে আর কোনদিন বাইরের আলো দেখতে না হয়!”

                                                                                দুই
         
    এটা অবশ্যম্ভাবী ছিল। সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বসুধা যেদিন মেছুনির ডালা থেকে শালগ্রাম শিলা উদ্ধারের জন্যে হাত বাড়িয়েছিলেন, সেদিনই ওঁর ভবিষ্যত স্থির হয়ে গিয়েছিল!

          এ কাজে তো বাধা আসবেই – সে হাতে তো আঘাত লাগবেই। ভিমরুলের চাকে ঢিল মারলে কামড় তো খেতে হবেই। সেটাই তো যুগ যুগ ধরে চলে আসছে – নতুন কিছু তো নয়?
          বসুধা মানে বসুধা রায়, সতুগড়ার পেছিয়ে পড়া মানুষ অধ্যুষিত অঞ্চল নামো পাড়ার কমল কামেনী হাই স্কুলে চাকরি করেন। উঁচু ক্লাসে অঙ্ক শেখান। বছর সাঁইতিরিশ আটতিরিশ বয়স। এমনিতে ভাগলপুরের বাসিন্দা। তবে জন্মটা বাদ দিয়ে বাকী সব কিছুই ব্যারাকপুরে।
          বিয়েও হয়েছিল ব্যারাকপুরের ছেলের সঙ্গে। তবে সে বিয়ে টেকেনি, বছর খানেকের মধ্যে দু পক্ষের সম্মতিতে মিউচুয়াল ডিভোর্স হয়ে যায়। নিঃসন্তান – মা বাবা আত্মীয় স্বজন কেউ কোত্থাও নাই।
          আগে দমদমের কাছে একটা কিন্ডার গার্ডেন স্কুলে পড়াতেন। পরে এই চাকরিটা পেয়ে সতুগড়ায় এসেছেন। এখানে নামো পাড়াতেই একটা বাড়ীতে ভাড়ায় থাকেন। আগে শনিবার দুপুরে স্কুলের হাফছুটির পর ব্যারাকপুর চলে যেতেন। আবার রবিবার সন্ধের ট্রেনে সতুগড়া ফিরে আসতেন। তবে ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর আর কোথাও যান না – বছরের তিনশো পঁয়ষট্টি দিন এখানেই থাকেন।
          প্রথম প্রথম স্কুলের বাইরে খুব একটা কারোর সঙ্গে মিশতেন না – বরং একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে নিজের অজান্তেই জড়িয়ে পড়েন এখানকার দরিদ্র অসহায় মানুষগুলোর দিন যাপনের সঙ্গে। তারপর ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন তাদেরই একজন – তাদের আত্মার আত্মীয়!
          তবে হঠাৎই একটা ঘটনা ওঁকে এনে দেয় আলোচনার মুখ্য ভূমিকাতে – রূপালী বলে একটি মেয়েকে ডাইনির অপবাদ দেওয়াকে কেন্দ্র করে!
          রূপালী ছিল বাল্য বিধবা। পরের বাড়ীতে রান্নার কাজ করত। বসুধাদের বাড়ীর খুব কাছে একটা ঝুপড়িতে থাকত। সংসারে কেউই ছিল না। তবে অনেকেই ওর অনেক কিছু হতে চেয়েছিল। একজন তো কলকাতায় নিয়ে গিয়ে আলাদা ঘর ভাড়া করে রাখবে বলেছিল। কেউ আবার রাত টুকুর জন্যে দু হাত ভরে মূল্য ধরে দিতে চেয়েছিল!
          কিন্তু রূপালী এই ফাঁদে পা দেয়নি। সব প্রলোভনকে এড়িয়ে খুব সন্তর্পণে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখত। কিন্তু শুধু ও বাঁচিয়ে রাখতে চাইলে তো আর হবে না – অন্যদেরও সেটা চাইতে হবে। বিশেষ করে মহাদেব ঘোষালের মতো ক্ষমতাবান মানুষকে!
          তাই মহাদেববাবুর প্রস্তাবে রাজী না হওয়াতে রূপালীর কাজগুলো সব চলে গেল। বাজার হাটও বন্ধ করে বেচারিকে এক ঘরে করে দেওয়া হল। রটে গেল রূপালী নাকি ডাইনি হয়ে গেছে!
          ভেতরের রহস্যটা অনেকে বুঝতে পারল, অনেকে পারল না। যারা পারল না তারা দূর থেকে রূপালীকে দেখলেই পালাতে শুরু করল। যারা পারল, তারাও এর প্রতিবাদ করতে সাহস পেল না!
          ঠিক সেই সময় এগিয়ে এলেন বসুধা। শুধু নিজের বাড়ীর রান্নার কাজটা দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না এই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে একটা জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করলেন। এ বিষয়ে একটা ঘটনা অনভিপ্রেত হলেও ওঁকে কিছুটা সাহায্য করল। কলকাতা থেকে ফেরার পথে মহাদেব ঘোষাল গাড়ী অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেলেন।
          তবে পদ্ম মুর্মুর ক্ষেত্রে কিন্তু তা ঘটেনি। পদ্ম মুর্মুর বিয়ে হয়েছিল ওদের জনগোষ্টির আর পাঁচটা মেয়ের মতো খুবই অল্প বয়েসে – স্কুল জীবন শেষ না করেই। বসুধাদের স্কুলেই পড়ত পদ্ম। পড়াশুনোর চেয়ে ব্লাউজ কামিজের কাটিং আর তাতে নক্সা তোলাতেই ছিল বেশী আগ্রহ।
          বিয়ের পরে সন্তান আসতে বেশী দেরী হয়নি পদ্মর – ঠিক তেমনি সতীনের আসতেও নয়। তবু স্বামীর সংসারটাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছিল বেচারি – মুখ বুঁজে সব অত্যাচারকে সহ্য করে। তবে সব কিছুরই একটা সীমা আছে – তাই এক সময় দু বছরের সন্তানকে কোলে নিয়ে বাধ্য হয়েই ফিরে এসেছিল বাপের বাড়ীতে!
          কিন্তু বাপের বাড়ীতেও তো সেই চরম দারিদ্র – নতুন করে সেখানে আবার অন্নের সংস্থান করা কঠিন। সেই সময় বিপত্তারিণী রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন বসুধা। শহরের মধ্যে এক পরিচিত বুটিকে কাজ জুটিয়ে দিয়েছিলেন পদ্মর।
          সেই মেয়েই আজ ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে গড়ে তুলেছে তার নিজেস্ব ব্যবসা! লোনের ব্যবস্থাও বসুধারই করে দেওয়া। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ছিলেন তাঁর পরিচিত। তাই নিজে গ্যারেন্টার হয়ে লোনের ব্যবস্থা করতে অসুবিধা হয়নি।
          পদ্মের এই উদ্যোম উৎসাহিত করেছিল আরো অনেক মেয়েকে। অভাব অনটন লাঞ্ছনার বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তি পেতে তারা গড়ে তুলেছিল ছোট ছোট সেল্ফ হেল্প গ্রুপ। এতে তাদের সংসারে চূড়ান্ত সমৃদ্ধি না এলেও স্বাচ্ছন্দ এসেছে, ফিরেছে শান্তি, জেগেছে নতুন আশা। তাই নিজের অজান্তে বসুধা কখন যেন অঙ্কর দিদিমণি থেকে হয়ে উঠেছেন শুধু মাত্র দিদিমণি – এই অভাবী মানুষগুলোর ভারসা স্থল!
          এ পর্যন্ত সব কিছু সঠিক না থাকলেও খুব একটা বেঠিক ছিল না। গোল বাধলো গত পরশু থানায় ডঃ প্রসাদের বিরুদ্ধে সাহানা সর্দারের শ্লীলতাহানির কমপ্লেন লেখাতে গিয়ে!

                                                                                তিন

          সাহানাও কমল কামেনী স্কুলের ছাত্রী। বসুধা যে বছর ঐ স্কুলে যোগ দেন সে বছরই বারো ক্লাস পাশ করে। পরে নারিসিং ট্রেনিং নিয়ে ডঃ প্রসাদের সুপার ফেসিলিটি হাসপাতাল ‘দা সুস্থতায়’ একটা টেম্পোরারি চাকরি করে। নামো পাড়ায় ওদের বাড়ীতেই ভাড়া থাকেন বসুধা।
          মানুষ হিসাবে সাহানা ছিল খুবই নরম স্বভাবের মেয়ে। একটু ভীরুও যেন। দেখে বয়েসের তুলনায় অনেক ছোট বলে মনে হয়। অধিকাংশ মেয়ের মতো জীবনের চলার পথে ছোটখাট দু একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা হলেও এ ধরণের ঘটনা ছিল ওর অজানা।
          ঐ দিন সব অজানার বেড়া যেন ভেঙে পড়েছিল। চাকরির স্থায়ী করণের টোপ ঝুলিয়ে ডঃ প্রসাদ ওর শরীরটাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন! সর্বশ্য হারিয়ে বেচারি তাই প্রতিকারের আশায় ছুটে এসেছিল বসুধার কাছে। বসুধাই ওকে নিয়ে গিয়েছিলেন থানাতে।
          কিন্তু ডঃ প্রসাদ তো আর যে সে লোক নন – ‘দা সুস্থতার মালিক’! অনেক মানুষের দন্ডমুন্ডের কর্তা। তার মধ্যে অজস্র নার্সও রয়েছে। যেমন ক্ষমতাবান তেমনি প্রভাবশালী! এই মানুষের বিরুদ্ধে কি এত সহজে কমপ্লেন নেওয়া যায়? তাছাড়া কই, আগে তো কেউ কনোদিন এই অভিযোগ করেনি! তাহলে ---?
          তাই থানার দারোগা কমপ্লেন নেওয়ার বদলে নির্লজ্জ ভাবে ডঃ প্রসাদ কোথায় কোথায় হাত দিয়েছেন – কী কী করেছেন সচক্ষে তার প্রমান দেখতে চাইলেন। বললেন, “ডঃ প্রসাদের মতো মানুষেরা সতুগড়ার গর্ব – আমাদের ছাতা – সমাজের স্তম্ভ!
          ঐ সব সমাজসেবীদের ওপর অন্যায় ভাবে আঘাত হানার চেষ্টা করলে প্রশাসন মেনে নেবে না। তাই এবারের মতো ছেড়ে দিলাম। কিন্তু ভবিষ্যতে এই ধরণের মিথ্যা রিপোর্ট লেখাতে এলে তার ফল ভাল হবে না – ধরে চালান করে দেব।”
          থানা কমপ্লেন না নিলেও কথাটা কিন্তু চাপা রইল না। কী ভাবে কে জানে খবরটা পেয়ে বাংলার সবকটা টিভি চ্যানেল তা ফলাও করে প্রচার করল। অধিকাংশ চ্যানেলই আবার ঘটনা সম্বন্ধে বসুধার প্রতিক্রিয়াও জানতে চাইল। আর সেই রাতেই কে বা কারা ‘দা সুস্থতায়’ তাণ্ডব চালিয়ে হাসপাতালের ওপিডি সেকশানের বেশ কিছু দামি যন্ত্রপাতি ভেঙেচুরে শেষ করে দিয়ে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল!
চার
          রাত শেষ হয়ে আসছে – তবে দিনের আলো ফুটতে এখনো অনেক দেরী আছে। সন্ধের দিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। গোটা সতুগড়া শীতের রাতের বৃষ্টিভেজা আমেজ গায়ে পরম নিশ্চিন্তে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে।
          সাহানাদের বাড়ীর সামনের ঘরটাতে এখন আলো জ্বলছে। ঐ ঘরটাতেই বসুধা থাকেন। ওঁকে থানায় নিয়ে গেলেও পুলিশের লোক এখনো ঘরটাতে তল্লাসি চালাচ্ছে।
          কিছুক্ষণ আগে ওরা সাহানার কাছেও এসেছিল। কোন ব্যাপার নিয়ে বেশী বাড়াবাড়ি করতে বারণ করে গেছে। বলেছে কথা না শুনলে ফল ভাল তো হবেই না – এমনকী হাজত বাসও অসম্ভব নয়!
          সাহানা জানে শুধুমাত্র ওকেই যে হুমকি দেওয়া হয়েছে তা কিন্তু নয় – রূপালী, টুম্পা, পদ্ম, চাঁপা, সরস্বতীরা কেউই এর থেকে বাদ যাবে না। আজ সবাই ওরা হুমকির শিকার!
          কিন্তু এই হুমকিটাই কি সব – এটাই কি তবে শেষ কথা? যুগ যুগ ধরে এভাবেই বিনা প্রতিবাদে দুর্বলের কণ্ঠ রোধ করা হবে?
          এটাই যদি মেনে নিতে হয় তবে আর এতদিন ধরে দিদিমণির সংস্পর্শে থেকে লাভ কী হল? দিদিমণি যে ওদের বাঁচতে শিখিয়েছেন – হার মানতে বারণ করেছেন। এই কি সেই শিক্ষা – এই কি তার প্রতিদান? নাঃ, প্রতিবাদ ওকে করতেই হবে – সামনে ওকে এগিয়ে যেতেই হবে। দরকার হলে একলাই যেতে হবে!
          ও জানে লজ্জা ওর পা আটকে ধরবে – অনিশ্চিত ভবিষ্যত ওকে পিছু টানবে – শারীরিক নিগ্রহের সম্ভবনা ওকে ভয় দেখাবে। তবুও থেমে থাকলে চলবে না। এগিয়ে যাওয়া মানেই তো জীবন – পেছিয়ে পড়ার অর্থই তো সব কিছুর সমাপ্তি – মৃত্যুর শীতলতা!
          ও এবারে বুক ভরে নিশ্বাস নিল। আকাশের দিকে চোখ তুলে একবার ধ্রুব তারার দিকে তাকাল। তারপর একটা জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে রাস্তায় নেমে এল! চারিদিকে নিশুতি অন্ধকারের ঘন নিস্তব্ধতা!
কিন্তু কী আশ্চর্য, এই অন্ধকারের মধ্যেও এত আলো কিসের? যেন দীপশিখার মতো দূরে দূরে আলো হাতে আকাশের যাত্রী!
নাঃ - তাহলে তো ও একা নয় ---!
ঐতো রূপালী, টুম্পা, পদ্ম, চাঁপা, সরস্বতী – সবাই আজ মোমবাতি হাতে এগিয়ে চলেছে! ক্রমশ সেই মৃদু আলো উজ্জ্বল থেকে আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠছে! আলোর সেই মিছিল বাঁধ ভাঙা সমুদ্রের মতো প্রবল উচ্ছাসে সতুগড়া থানায় আছড়ে পড়তে চলেছে!
          আর এদিকে অন্ধকার কেটে গিয়ে পুব আকাশ লাল করে আবার একটা নতুন দিনের সূচনা হচ্ছে!

0 comments: