সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
বন্যা আর হারিয়ে যাওয়া বালক
সৌমিত্র চৌধুরী
সেদিনও এরকম বৃষ্টি ছিল। সকাল থেকে শুরু হয়ে সারা দিন চলছে তো চলছেই।
আজও শুরুর দিকে অনেকক্ষণ টিপ টিপ করে চলল। তারপর একেবারে ঝমঝমিয়ে। থামতেই চায় না। অঝোর ধারায় অনেকক্ষণ বড় বড় ফোঁটায় শব্দ করে জল ঝরল। দুপুরের দিকে ধরে এল। বিকেল থেকে আবার শুরু মুষলধারায়।
এবার বৃষ্টি হয়েছে কম। আষাঢ় মাসের প্রথম দিকে ঘোলাটে আকাশ কৃপণের মত ছিটেফোঁটা বৃষ্টি ঢেলেছিল। কয়েক পশলা বৃষ্টি সঙ্গে ঝড়। শ্রাবণ মাসের তিন সপ্তাহ নির্জলা কাটিয়ে তেড়ে ফুরে বৃষ্টি এল। আবহাওয়া অফিস দিনকয়েক আগে জানিয়েছিল, ‘এই জেলায় বৃষ্টিপাত খুব কম। অন্যবারের তুলানায় ষাঠ শতাংশ ঘাটতি।’
আজকের একটানা বৃষ্টি ঘাটতি আনেকটাই পুষিয়ে দেবে মনে হয়। আরও দুদিন নাকি জোর বৃষ্টি হবে। তেমনই পূর্বাভাষ। এরকম চললে তো মদনপুর পঞ্চায়েতের সব গ্রাম ডুবে যাবে। জমি তো ডুববেই। বাড়ি ঘর তলিয়ে যাবে। বন্যায় ভাসিয়ে দেবে উঁচু রাস্তা, রেল লাইন, পঞ্চায়েত অফিস, মায় স্কুল বাড়িটাও। শহরটা বাঁচবে কি!
স্কুলের দোতলায় প্রায় ফাঁকা ক্লাশ রুম। জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ভাবছিলেন বিধুবাবু। বিধুশেখর দাস। মদনপুর হাতিপোতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। অঙ্কের রাগী মাস্টার। লম্বা বেতের মত শরীর। গম্ভীর কুঁচকানো মুখ। মানুষটাকে হাসতে দেখেনি কেউ। গোমড়া মুখো অঙ্ক-স্যারকে ছাত্ররা ভয় খায় খুব।
চল্লিশজন ছাত্রর মধ্যে বেশীর ভাগই গরহাজির। মাত্র চারজন এসেছে ক্লাশে। বৃষ্টির কারণে ঘর বন্দী সবাই। ক্লাশ ফাঁকা। ছাত্র না এলে কী পড়াতে ইচ্ছে হয়! পাটিগণিতের দুটো অঙ্ক বোর্ডে লিখে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বিধুবাবু বললেন, ‘তোরা নিজেরা কর। একটু চেষ্টা করলেই পেরে যাবি।’
ছাত্ররা চেষ্টা করছে। গল্পও চলছে। ফিসফাস কথা। অঙ্কে মন নেই। অন্য দিন ক্লাশে কোনও ছাত্র কথা বললে গর্জন করে ওঠেন বিধুবাবু। আজ বলছেন না কিছু। মানুষটা যেন অন্যরকম। গম্ভীর মুখে চিন্তার গাঢ় ছাপ। ফাঁকা ক্লাশে পড়ানোয় মন নেই। একমনে বৃষ্টি দেখে চলেছেন।
একরকম একটানা বৃষ্টি! মন বিষণ্ণ হয়ে যায়। দূরের একতলা বাড়িটা ডুবে গেল। পাশের নারকেল গাছেটা দাঁড়িয়ে আছে। গাছের নীচে অনেকগুলো মাটির ঘর ছিল। কোনটাই দেখা যাচ্ছে না। পূবদিকের ওই চত্বরটায় যেন কোন গ্রাম, কোন বসতি কোনকালে ছিল না। ছিল কেবল নারকেল আর আমগাছ। যেগুলোর বৃষ্টি মাখা ঝাপসা মাথা হাওয়ায় দুলছে। ওই দিকে জল জল আর জল। উঁচু জমির উপর স্কুল। স্কুলমাঠও জলে থৈ থৈ। এখন গোড়ালি ডুববে। একটু পরে হাঁটুও ডুবে যাবে।
সেদিনও সকালে আকাশ ছিল থমথমে। কিছু একটা ঘটবে ঘটবে ভাব। থোকা থোকা মেঘ মাথার উপর ঝুলছিল। মেঘগুলো হঠাৎ জমাট বেঁধে সারা আকাশে ছড়িয়ে পড়ল। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠছিল। মা বলল, ‘আমার খুব ভয় কচ্ছে।’
বাবা তখন নির্বাক। একটু পরেই মেঘের বুক থেকে আওয়াজ উঠল, গুরুম গুরুম। বিকট শব্দে কয়েকবার বাজ পড়ল। বড়রা বলল, ‘বাদল নামিছে। পলায়ে আয়।’ মায়ের দিকে তাকিয়ে বাবা বলল, ‘মনে হইতেছে সব ডুবা যাইব। চিড়ে গুড় কিছু সঙ্গে বাঁধি লও।’
বাড়িঘর ডুবে গেছিল সেদিন। রাস্তার ধারে উঁচু বাঁধে ত্রিপল খাটিয়ে গাদাগাদি করে থাকতে হয়েছিল। বাবা-মা, বোন আর বিধু। আশেপাশে অনেক লোক। গরু মহিষ ছাগলও থাকতো। খাবার নেই, পিপাসার জল অল্প। এক ঢোকের বেশী বরাদ্দ ছিল না। শুকনো মুড়ি খেয়ে থাকা।
তিন দিন পর বৃষ্টি কমল। নৌকায় করে সাহায্য বিলি করতে এসেছিল শহরের চার-পাঁচ জন মানুষ। মেঘলা দিনে ওদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে ফিরছিল বিধু। বাঁধের পারে বাবলা গাছের নীচে সাহায্য নিতে লাইনে অনেক লোক। বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে চিড়ের প্যাকেট, জল আর গুড় হাতে পেল বিধু। তারপরেই আচমকা বৃষ্টি নামল। খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে অনেক লোক। জলের তোরে বাঁধের সামনে খানিকটা অংশ হঠাৎ ভেসে গেল। সামনে পেছনে শুধু জল জল আর জল। জল বাড়ছে ক্রমশ। কোমর ছাড়িয়ে বুকে উঠে এল। আকাশ ভাঙা বৃষ্টির মধ্যে আমগাছের ডাল ধরে সারা রাত ঝুলে রইল বিধু।
পরদিন নেমে এল গাছ থেকে। জল কাদা ভেঙে খুঁজল অনেক। ত্রিপলের নীচে মা, দিদি, বাবার কাছে ফিরতে পারল না। কী করে যেন হারিয়ে গেল সবাই! চেনা পথ আর খুঁজে পায়নি বালক বিধুশেখর। অনেক মানুষকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনারা দেখেছেন চণ্ডীপুরের বলাই দাসকে?’
কেউ দেখেনি। শহরের কিছু লোক জল আর খাবার দিতে এসেছিল। তারাই বিধুকে সঙ্গে নিয়ে গেল। বড় করল। বিধু ইস্কুলে পড়ল। কলেজেও। তারপর চাকরি। বাবা-মাকে দেখাশোনা করেছে বিধু। নিজের বাবা-মা নয়। পালক বাবা-মা।
বড় হয়ে চণ্ডীপুরে অনেকবার খুঁজতে এসেছে বিধু। নিজের বাড়ি, বাবা-মা দিদির খবর পায়নি। সুবল কাকাকে দেখেছিল। ঘোষ পুকুরের ধারে জমিতে হাল মারছিল। কাজ থামিয়ে মানুষটা বলল, ‘আমি বেঁচে গেছি। তবে সেদিন ভেসে গেছিল অনেক লোক। চণ্ডীপুর শুধু নয়, ভগবানগোলা, কুলগাছি, বিজাপুরের শয়ে শয়ে মানুষ।’
নিজের বাবা, মা, দিদিকে দেখতে ইচ্ছে করে। বাবা বলতেন, ‘ভগবান কত নিষ্ঠুর, আমরা জানি।’ ঠিক কথা। জীবনভোর নিষ্ঠুরতা দেখে এলাম। মনে মনে বললেন মাষ্টারমশায়। কত বছর আগের কথা। বিধুশেখরের ছেলে এখন বড় স্কুলে পড়ে। ক্লাশ থ্রি। ইংরাজি মিডিয়াম। গাড়ি করে স্কুলে যায়। নিস্তব্ধ ঘরে বসে বৃষ্টি দেখতে দেখতে একমনে ভাবছিলেন বিধুশেখর।
হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে গেল। স্বভাব বিরুদ্ধ আর্ত চিৎকার ছুঁড়ল এক ছাত্র, ‘স্যার, বৃষ্টি তো থামছে না। ঘর তো ডুবে যাবে।’
রাগী মাষ্টারের মুখে কথা নেই। অন্য দিনের মত ধমক দিলেন না রাগী মাষ্টার। তাঁর মুখে চিন্তার ছাপ।
-কোথায় যাব স্যার? বাবা-মাকে খুঁজে পাব তো? ‘
-তোর বাড়ি কোন গ্রামে?
-গোপালগঞ্জ।
-ওদিকটা তো নীচু।
-হ্যাঁ সার। সব জল গড়িয়ে ওদিকেই যায়।
কথা নেই বিধুবাবুর মুখে। ভাবছেন, ওই গ্রামটা ডুবে গেল নদীটা আরও চওড়া হবে। কূল ছাপিয়ে বইবে জলের স্রোত। দুপাশ ডুবিয়ে সব ধ্বংস করে দেবে। চারশ বর্গ কিলোমিটার ধানি জমি, অসংখ্য গ্রাম ডুবিয়ে দেবে। বড় বাড়ি গুলোও জলের তলায়। হাজার হাজার মানুষ যাবে কোথায়?
-এখন কী করবো স্যার। ঘর তো ডুবে যাবে।
নিরুত্তর মাস্টারমশায়। উত্তর দেবার আগেই প্রশ্ন ছুটে এল, ‘বাবা-মাকে খুঁজে পাব স্যার?’
-দেখি কী করা যায়?’ নরম স্বর শিক্ষকের। পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে বোতাম টিপলেন। খানিক পরে বললেন, ‘ফোন লাগছে না কোথাও রে!’
-এখানে থাকতে দেবে স্যার?
-খাবি কী এখানে?
-জানি না। জল তো বেড়ে গেল স্যার। বাবা-মাকে খুঁজবো কোথায়?
-চল্লিশ বছর আগে বছর ছয়েকের এক বালক। এক ছাউনি থেকে আরেক ছাউনিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করছে, ‘আমার বাবাকে তোমরা দেখেছ? চণ্ডীপুরের রবি দাস?
চল্লিশটা বছর পার করেছে জীবন। স্বাধীনতা পাওয়া সাত যুগ পেরিয়ে গেল। কিন্তু বন্যা সেই আগের মতন। বাড়ি ঘর মন্দির মসজিদ জমি জিরেত গরু ছাগল সব ভসিয়ে নিয়ে যায়। সঙ্গে অসুখ মৃত্যু হাহাকার।
-স্যার, কোথায় যাব আমরা।
-হেডমাস্টারকে বলে দেখি।
-কী বলবেন স্যার?
-স্কুলের একটা ঘরে যদি বানভাসিদের থাকতে দেন!
মনে মনে ভাবছেন বিধুশেখর। হেডসার নিশ্চয় রাজী হবেন। পাকা ঘরে বন্যায় ভেসে যাওয়া কয়েকটা ছেলে থাকতে পারবে। সরকারি সাহায্য কিছু জুটবে। মুড়ি চিড়ে জল। প্রাণে তো বেঁচে থাকবে। এটুকু উন্নতি হয়েছে, স্বীকার তো করতেই হবে। আগে বন্যায় লোক মারা পড়ত অনেক।
-আচ্ছা স্যার।’ ক্লাশ এইটের রমেন ম্লান মুখে বলল।
কোমর জল ভেঙে নিজের বাড়িতে চলে যেতে পারবেন। ভাবছেন বিধুবাবু। ক্লাশ রুম থেকে বেরতে গিয়ে পেছন ফিরলেন।
-কী খাব স্যার?
-আমার বাড়িতে কেউ আয়। শুকনো খাবার আর জল নিয়ে যা।
-আচ্ছা স্যার’। মাথা ঝাঁকাল রমেন। ওর পাশে বসা বিধান নিচু গলায় বলল, ‘স্যারটা খুব ভাল রে! কেমন হাসি মুখ।’
রমেন বলল, ‘আবার জল দেবেন, রাতের খাবারও। খুব ভাল লোক, তাই না!’
-হুঁ’। ডাম্ফু বলল, ‘খুব বৃষ্টি হলেই মানুষটা কেমন হয়ে যায়, বুঝলি!
-কেমন হয়ে যায়?
-মুখে কাঁদো কাঁদো ভাব। রাগ নেই। মাস্টারটা কী ভাবে কে জানে!
0 comments:
Post a Comment