সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
ছবি
সুজিত ভট্টাচার্য্য
গোবরধনকে চা
করতে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে বাগানে গেল মলি।
ছোট ছিমছাম ছবির
মতো বাংলো। অনেকটা জায়গা নিয়ে। লোহার তার দিয়ে ঘেরা সমস্ত সীমানা। ব্রিটিশ আমলে
তৈরী। বাংলোর প্রবেশদ্বারে বিশাল লৌহ ফাটক। কালো পিচ ঢালা রাস্তা সোজা চলে গেছে
বাংলোর সদর দরজা পর্যন্ত।
চারপাশে সবুজ ঘাস। সুন্দর করে ছাঁটা। যেন সবুজ
গালিচা। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। ঘাসগালিচার মধ্যি খানে প্রমান সাইজের চা-টেবিল।
কয়েকটা চেয়ার। রৌদ্রের হাত থেকে বাঁচার জন্যে প্রকাণ্ড ছাতা। সাজান ফুলের বাগান। নানান
জাতি, নানান বর্ণের। সুগন্ধ বাতাসে। চতুর্দিকের বেড়ার গা
বরাবর সারি সারি দীর্ঘ জানা অজানা বৃক্ষ।
মৃদুমন্দ হাওয়ায় দুলছে তাদের শাখা প্রশাখা। পাখির কিচির মিচির শব্দে মুখরিত বাতাস।
প্রতিদিন বিকেলে বাগানে আসে মলি। এটা তার অভ্যাস। নগ্ন
পায়ে সবুজ ঘাসের ওপর খানিক হাঁটা হাঁটি। সঙ্গে কিছু হাল্কা ব্যায়াম। ঘাম ঝরানো। তারপর
চেয়ারে রাখা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে এসে বসে চা-টেবিলে। হাত দিয়ে অবিন্যস্ত চুল ঠিক
করে। অপেক্ষা করে অনিন্দ্যর জন্যে। সে অফিস থেকে ফিরলে এক সাথে চা খায়। গল্পগুজব
করে। প্রয়জনীয় কথাবার্তা সেরে নেয়। দিনের আলো সরে গেলে ঘরে ঢোকে।
পশ্চিম আকাশে রং ধরেছে। সূর্য হেলে পড়েছে নিচে।
ডালপালার জাফরির ফাঁক দিয়ে পড়ন্ত বিকেলের নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে সবুজ ঘাসে। একটু
একটু করে লম্বা হচ্ছে গাছের ছায়া। শেষ হয়ে আসছে দিনের আলো।
অন্য দিন এ সময় জোনাক ফিরে আসে স্কুল থেকে। হাত, মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে সেও
কিছুক্ষণ বসে বাগানে। মায়ের পাশে। আজ ফিরতে দেরী হবে। সামনে পঁচিশে বৈশাখ। স্কুলে
অনুষ্ঠান আছে। মঞ্চস্থ হবে রবীন্দ্র নাথের নাটক। মুখ্য চরিত্রে জোনাক। তারই
অনুশীলন চলছে স্কুলে।
গাড়ির শব্দ হ'লো। অনিন্দ্য ফিরল অফিস থেকে। গোবরধন গেট খুলে দিল।
গাড়ি পার্ক করে বাগানে বসল অনিন্দ্য। মলির মুখোমুখি। গোবরধন চা দিয়ে যায়। লাল চা। তাতে
সামান্য লেবু এবং চিনি। সঙ্গে নোনতা বিস্কুট। চায়ে চুমুক দিয়ে অনিন্দ্য জিজ্ঞেস
করে,
জোনাককে
দেখছি না। স্কুল থেকে ফেরেনি?
ফিরতে দেরী হবে। পঁচিশে বৈশাখ স্কুলে অনুষ্ঠান আছে।
জোনাক একজন অংশ-গ্রহনকারী। স্কুলের পর রিহার্সাল। এখন কিছুদিন ফিরতে দেরী হবে।
অনিন্দ্য অফিস
থেকে বাড়ী ফিরলে ডাকবাক্সের চিঠিগুলো চা-টেবিলে রেখে যায় গোবরধন। সাধারণতঃ চা পান
করতে করতে চিঠিগুলো পড়ে সে। চিঠিগুলো সামনে রাখতেই মনে পড়েগেল পার্থর চিঠির কথা।
মাসতুত বোন অলির স্বামী। খুব আদরের বোন। ভীষণ নেওটা ছিল অনিন্দ্যর। বিয়ের আগে
পর্যন্ত। চিঠিটা অফিসের ঠিকানায় এসেছে।
পকেট থেকে পার্থর চিঠি বের করে অনিন্দ্য। এগিয়ে দেয়
মলির দিকে।
কার চিঠি? প্রশ্ন করে মলি।
পার্থর।
কি লিখেছে?
নিজেই পড়ে দেখ।
***
কয়েক বছর আগের কথা। অলি তখন যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে
এম এ পড়ছে। হস্টেলে থাকে। হঠাৎ
জরুরী তলব।
কারণ মনে নেই। তবে অন্য একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল। মনে পড়তেই হাসি পেল অনিন্দ্যর।
অন্য সময় অনিন্দ্য গেলে ছুটে আসত অলি। জড়িয়ে ধরত তাকে। সেই ছেলে বেলায় যেমন করত।
নানান প্রশ্নে জর্জরিত করে তুলত তাকে। এখন এত বড় হয়েছে, তবুও কোন পরিবর্তন হয়নি। অনিন্দ্যর অস্বস্তি হোত। কিন্তু
আজকের চিত্র ভিন্ন। অন্যমনস্ক লাগছে তাকে। উচ্ছাসহীন, মনমরা। মুখের অবয়বে বিষাদের ছায়া। ব্যপারটা অনিন্দ্যর
কাছে বিস্ময়কর লাগল। এমন অবস্থা আগে কখনো দেখেনি। সে জিজ্ঞেস করে, কি রে? ভাল আছিস তো? শরীর?
শরীর ভাল। মন ভাল নেই। শান্ত ভাবে জবাব দেয় অলি।
কেন? চিন্তিত অনিন্দ্য। এতো জরুরী তলব?
বলব না।
তাহলে আমাকে ডেকে পাঠালি কেন? আমি চলে যাচ্ছি। কৃত্রিম রাগ
দেখায় অনিন্দ্য।
না। তুমি যাবে
না। আমি বলছি। কিন্তু কথা দাও তুমি হাসবেনা।
হাসব না। বলে ফ্যাল।
কাল রাতে একটা
বাজে স্বপ্ন দেখেছি।
সে তো ভাল কথা।
তুমি ঠাট্টা করছ। আমি বলব না।
বেশ ঠাট্টা করব না। বলে ফ্যাল।
দেখছি তোমার
বিয়ে হচ্ছে। একটা কাল কুৎসিত মেয়ের সঙ্গে। স্বভাবটাও খুব খারাপ। একেবারে দজ্জাল
গোছের। আমাকে একেবারে সহ্য করতে পারছে না। তোমার সঙ্গে দেখা করতে গেছি, কিন্তু কিছুতেই দেখা করতে দেবে না। উপরন্তু আমার
সঙ্গে খুব ঝগড়া করল। আমি কেঁদে ফেললাম। ঘুম ভেঙে গেল।
অলির চোখ সত্যি সত্যি ছলছল করে উঠল। অনিন্দ্য সেটা
লক্ষ করল। পরম স্নেহে জড়িয়ে ধরল তার আদরের বোনকে। পাগলি মেয়ে।
কথায় বলে কোলে পিঠে মানুষ। বাস্তবিক অলি অনিন্দ্যর
কোলে পিঠে মানুষ হয়েছে। প্রায় দশ বছরের
ছোট অলি। স্কুল ছুটি পড়লে অন্য কোথাও যাওয়া নেই। সটান চলে আসত অনিন্দ্যদের
বাড়ী। যত দিন ছুটি থাকত, তার লেখা পড়া বেড়াতে নিযে যাওয়া সবই অনিন্দ্য। দাদা
ছাড়া কাউকে বোঝে না। অনিন্দ্য বোনকে আগলে রাখত।
অনিন্দ্য যখন
চাকরিতে ঢোকে অলির বয়স চোদ্দ বছর। কিন্তু স্বভাবে সেই ছেলে মানুষ। যত দিন
থাকত সর্বক্ষণ অনিন্দ্যর পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াত। অফিস থেকে
ফিরে ফ্রেশ হয়ে যখন বোসতো, কোথা থেকে এসে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ত পিঠে। গলা জড়িয়ে বলত, ওঠো। আমাকে নিয়ে ঘোরো। ছেলে
বেলায় যেমনটি করত।
অনিন্দ্য কাছে টানে অলিকে। পাগল মেয়ে। স্বপ্ন কখন
সত্যি হয়?
এই
জন্যেই আমি তোকে পাগলি বলি। কথা ঘোরাল পরিবেশ হাল্কা করার জন্যে। অলি তখনো
ফোঁপাচ্ছে। খুব কষ্ট পেয়েছে। পুনরায় অনিন্দ্য বলল, বেশ। তোর পছন্দ করা মেয়েকেই বিয়ে করব। এবার মনে হয়
কাজ হোলো। স্বাভাবিক লাগছে এখন। কথাগুলো মনে পড়তে হেসে উঠল অনিন্দ্য। চলকে পড়ল
হাতের চা। জামা প্যান্টের ওপর। গরম স্পর্শে সম্বিৎ ফিরল।
কি হোলো, হাসলে যে? জিজ্ঞেস করে মলি।
অলির কথা ভেবে। সে দিনের ছোট্ট মেয়ে আজ কত বড় হয়ে
গেছে! এখন মা হতে চলেছে।
সত্যি ! বড় দুঃখে ছিল মেয়েটা। চঞ্চল, ছটফটে, আমুদে মেয়েটা দিন দিন কেমন হয়ে
যাচ্ছিল। বিয়ের ছ বছর পরে মা হতে চলেছে। অনেক যন্ত্রনা, গঞ্জনা শুনতে হয়েছে মেয়েটাকে। পার্থ সাথ না দিলে যে
কি হ'তো?
ঈশ্বর জানেন।
ঠিক বলেছ তুমি। কিন্তু চিন্তা মুক্ত হতে পারছি কই? পার্থ লিখেছে কেশটা
কমপ্লিকেটেড।
ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি সব কিছু যেন নির্বিঘ্নে
হয়ে যায়। দু হাত জোড়া করে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রণতি জানায় মলি।
সূর্যের তাপে ঝিম ধরেছে। চারপাশের আলো একটু একটু করে
কমে আসছে। ক্রমশঃ মিলিয়ে যাচ্ছে গাছের ছায়া। পাখিরা ফিরে যাচ্ছে যে যার বাসায়।
কোলাহল মুখরিত সাঁঝের বাতাস। মৃদু মন্দ বাতাস দুলিয়ে দিচ্ছে গাছের শাখা প্রশাখা।
চিঠির তারিখটা দেখতো। অনিন্দ্য বলে। কাপ ডিশ ট্রেতে সাজাতে সাজাতে মলি
বলে,
সতেরই
সেপটেম্বর ১৯৭৮।
আজ পঁচিশ। তার মানে আট দিন হয়ে গেছে। ধন্যবাদ পোস্টাল
ডিপার্টমেন্ট। আড়াইশো কিলোমিটার রাস্তা আসতে এত দিন? ব্যাঙ্গের হাসি হাসে অনিন্দ্য। এর মধ্যে
হয়তো অলির সন্তান ভূমিষ্ট হয়ে গেছে। বড্ড দেরী হয়ে গেছে। তুমি বরং গুছিয়ে নাও। আমি
আলমকে ফোন করছি। যদি কালকের ট্রেনের দুটো টিকিট পায়। পার্থ কি ভাববে কে জানে?
ভেবে কোনো লাভ নেই। আমি বরং গুছিয়ে নিই।
***
অলির ছেলে বেলার, বেড়ে ওঠার ঘটনা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা, ইয়ার্কি চলছিল। অনিন্দ্য এক
একটা ঘটনার বিবরণ দিচ্ছে আর মলি হেসে উঠছে। যদিও প্রত্যেকটি ঘটনা বহুবার অনিন্দ্যর
মুখে শুনেছে মলি। তবুও শুনতে ভাল লাগছে।
অলি খুব ভালবাসত অনিন্দ্যকে। বিয়ের পর এবাড়িতে এসে
অলিকে ভীষণ ভালবেসে ফেলেছিল মলি। ওর সহজ, সরল এবং ছেলেমানুষী স্বভাবের
জন্যে। শুধু তাই নয়, ছেলে বেলার ঘটনা বলে মাঝে মধ্যে অলিকে বিব্রত করত।
অলির রাগত ভাব দেখে আনন্দ উপভোগ করত মলি। কিন্তু পরক্ষণে কাছে ডেকে আদর করত। সে ননদ নয়, যেন নিজের সন্তান। সেই অলি আজ
সম্পূর্ণ নারী হতে চলেছে। ভাবতে বিস্ময় লাগে। ভালবাসার আবেগ ভরিয়ে দেয় তাকে।
আমাদের দেখে অবাক হয়ে যাবে অলি। অনিন্দ্য বলে।
খুব আনন্দ এবং ভরসা পাবে। যোগ করে মলি।
ঠিক বলেছ। এক বার ফোন করতে পারলে ভাল হ'তো। কিন্তু ওদের তো ফোন
নেই।
কলিং বেলের শব্দ হ'লো। হয়তো
জোনাক স্কুল থেকে ফিরল। মলি এগিয়ে গেল ঘরের দিকে। গোবরধন দরজা খুলল। জোনাক নয়।
খাঁকি উর্দি পরা একজন। পোস্টম্যান মনে হচ্ছে। লোকটি একটা কাগজ এগিয়ে দেয়। গোবরধন কাগজটা এগিয়ে দেয় মলির দিকে। টেলিগ্রাম।
ছ্যাৎ করে ওঠে মলির বুক। ভেতর থেকে অনিন্দ্য জিজ্ঞেস করে, কে? জোনাক নাকি?
না। পোস্টম্যান। একটা টেলিগ্রাম আছে।
আশংকা জাগে অনিন্দ্যের মনে। তড়িঘড়ি আসে বাইরের ঘরে। মলি এগিয়ে দেয় টেলিগ্রাম।
অনিন্দ্য খুলে ফেলে সেটা। আগে দেখে প্রেরকের নাম। পার্থ পাঠিয়েছে। চোখের
সামনে মেলে ধরে সেটা। মুহূর্তে অনিন্দ্যের
মুখ বিবর্ণ,
ফ্যাঁকাসে, রক্ত শূণ্য হয়ে গেল। সেটা লক্ষ
করল মলি। উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করল টেলিগ্রামের ভাষা।
অনিন্দ্য কোন উত্তর দিল না। টেলিগ্রামটা এগিয়ে দিল
মলির দিকে। তারপর হনহন করে ঢুকে পড়ল নিজেদের ঘরে। আলমারী খুলে বের করল পুরনো ছবির
এ্যল্বাম। সেখান থেকে অলির হাসিমাখা মুখের একটা ছবি বের করল। ছবিটা বড় করে বাঁধিয়ে
দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখতে হবে।
0 comments:
Post a Comment