সম্পাদকের কলমে
নারায়ণ দেবনাথ-
সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম ।
ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম ।
নমস্কার সহ
অঙ্কুর রায়
সংখ্যার সম্পাদক
অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী
প্রধান সম্পাদক
লেখা পাঠানোর জন্য
আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com
Total Pageviews
By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.
কাঁদুনে দীঘি
সুভাষচন্দ্র ঘোষ
রাত ১১টায় সখের যাত্রা দলের মহড়া শেষ করে শেখর তার বাড়ীর দিকে রওনা দিল।তার বাড়ী মুর্শিদাবাদ জেলার বাদশাহী সড়কের উপর অবস্থিত নগর গ্রাম থেকে ২কিমি দুরে আতাই গ্রামে।নগর কলেজ মোড় থেকে সোজা পূর্ব দিকে মাড়গ্রাম হয়ে একেবারে দ্বারকা নদীর পাড়ের সুন্দরপুর পর্যন্ত রাস্তা চলে গিয়েছে । যে সময়ের কথা বলছি তখন ও রাস্তাটি পাকা হয়নি। কাঁচা মাটির চওড়া রাস্তা, কিন্তু খুব চালু,১০-১২টা গ্রামের লোকজন ঐ রাস্তা ধরেই যাতায়াত করে । রাস্তার ধারেই বহু পুরোনো গ্রাম আতাই ।নগর ও আতাই গ্রামের ঠিক মাঝখানে রয়েছে একটা উত্তর-দক্ষিন লম্বা ৩০ বিঘার বড় দীঘি----নাম তার কাঁদুনে দীঘি । এই দীঘিরই উত্তর পাড় বরাবর চলে গিয়েছে মাড়গ্রাম-সুন্দরপুরের রাস্তা ।
কাঁদুনে দীঘির ঠিক মাঝ বরাবর
রাস্তার পাশে রয়েছে একটা বড় বটের y আকৃতির গাছ যার মাত্র দু'টো ডাল-- একটা ঐ রাস্তার উপর দিয়ে উত্তর দিকে,অন্যটি দীঘির কালো জলের উপর দিয়ে দক্ষিণ দিকে বিস্তার লাভ করে কবন্ধের মতো আকাশের দিকে দু'টো হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বটগাছের মোটা গুঁড়ির চারিদিকে অসংখ্য ঝুরি নেমে শিবের জটার মতো জটিল করে রেখেছে, গোড়ার মাটি বান-বৃষ্টির জলে ধুয়ে শেকড় গুলো অজগর সাপের মত বেড়িয়ে জায়গাটা জালের মত বিছিয়ে দিয়েছে। গাছের উপর উঠা সহজ বলে গ্রামের চাষারা কাছের পাতাগুলো কেটে নিয়েছে ছাগলকে খাওয়ানোর জন্য,তাই দুরবর্তী ডাল দুটোতেই শুধু রয়েছে ঝাঁকালো পাতা। দীঘির দক্ষিণ পাড়ে রয়েছে কয়েকটি পুরোনো শিমুল , অর্জুন গাছ ও বাঁশের জঙ্গল। পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি ঢ্যাঁঙা তালগাছ ও সর্বাঙ্গে কাঁটা ভর্তি নেড়া খেজুর গাছ ।
কাঁদুনে দীঘির পাড়ে গভীর রাতে একসাথে অনেক কচি বাচ্চা কাঁদে------ গ্রামের অনেকেই শুনেছে সেই করুণ কান্নার শব্দ।ঈশান কোণে জলের ধার ঘেঁষে যে ঢ্যাঁঙা তালগাছটা খানিকটা হেলে দীঘির জলের উপর দিয়ে সোজা আকাশে উঠেছে, সেই তালগাছের গোঁড়ায় একটা তামার পয়সা দিয়ে, গাছের হেলানো অংশে চেপে দীঘির একঘটি জল তুলে পিছন ফিরে না তাকিয়ে ঐজল নিয়ে যায় আশেপাশের গ্রামের অনেকেই। গ্রামের মানুষ মনে করে ঐ দীঘির জল ছিঁচকাঁদুনে ছোট বাচ্চার চোখে মুখে ছিটিয়ে দিলে তারা আর কাঁদে না ।
আশেপাশের গ্রামের মড়া সৎকারের জন্য বহরমপুরের
গঙ্গায় যাবার সময় ক্লান্ত শব বাহকরা কাঁদুনে দীঘির বটগাছের নিচে বসে বিশ্রাম নেয়, মৃতদেহের সঙ্গে দেওয়া বাড়তি কাপড় চোপড় দীঘির পশ্চিম পাড়ে ফেলে দিয়ে বোঝা হাল্কা করে। তাছাড়াও পশ্চিম পাড়ের নেড়া খেজুর গাছের গোড়াটা গ্রামের আঁতুড় শালাও বটে।ওখানে পড়ে রয়েছে যত রাজ্যের ছেঁড়া কাপড় ,মাটির হাঁড়ি। গ্রামের প্রসূতিদের ছেলে পিলে হলে মাটির হাঁড়িতে ভরে গর্ভফুল,রক্তমাখা কাপড় ইত্যাদি ধাইমারা ওখানে ফেলে দিয়ে দীঘিতে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে বাড়ি যায়।
ঐ কাঁদুনে দীঘির রাস্তা দিয়ে শেখর প্রতিদিন নগর থেকে রাত ১১টা-সাড়ে১১টায় টিউশনির শেষে সখের যাত্রার মহড়া সেরে বাড়ি ফেরে।
মহড়া ঘর
থেকে বেড়ুতেই সেদিন শুরু হল দমকা হাওয়ার সঙ্গে দু'চার ফোঁটা বৃষ্টি।ঘন অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না, বিদ্যুৎ এর ক্ষণ আলোয় অন্ধকারকে আরো ঘন করে তুলেছে।আজ শেখর টর্চ আনতে ভুলে গেছে।তাই কাদা রাস্তায় চটিজুতো হাতে নিয়ে সে গুনগুন করে গান করতে করতে প্রতিদিনের চেনা পথে দ্রুত হেঁটে আসছে। কাঁদুনে দীঘির বট গাছের নিচে আসতেই তার পা যেন মানুষের গায়ে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে মুখ দিয়ে অদ্ভূত একটা আর্ত চীৎকার বেড়িয়ে এলো।অমনি রাস্তার উপরের বটের ডালপালার প্রবল ঝাঁকুনির সঙ্গে তীক্ষ্ণ আর্তনাদ ও ঝটপট শব্দে ভীষণ ভয় পেয়ে শেখর কয়েক পা পিছিয়ে এল। ঠিক তখনি দুরে কোথাও সশব্দে বাদ পড়ল,তার তীব্র আলোয় শেখর দেখল দীঘির পশ্চিম পাড়ের নেড়া খেজুর গাছের উপর সাদা কাপড় পরে একটা খুব লম্বা মানুষ একবার উঠছে একবার বসছে।ভয়ে শেখরের শরীর প্রায় অবসন্ন ,মনে হল এখনি সে অজ্ঞান হয়ে যাবে।
দা------দা, কোথায় তুমি?----- দূরে শেখরের ভাই বিনয়ের ডাকে শেখর সাড়া দিয়ে বলল----- আমি কাঁদুনে দীঘির বট গাছের নী------চে।
ওখানেই দাঁড়াও তুমি, আমি আস------ছি ----------- বিনয় বলল।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিনয় ছাতা ও টর্চ নিয়ে গাছের নিচে চলে এল ।পাঁচ ব্যাটারী টর্চের তীব্র আলোয় দেখা গেল গাছের নিচে মাঝরাস্তায় পাশের গাঁয়ের পাঁচু মাতাল আকণ্ঠ মদ গিলে পড়ে আছে, ওর গায়েই শেখরের পা পরেছিল। দীঘি থেকে আঁজলা ভরে জল তুলে ওর চোখে মুখে ছিটিয়ে দিতেই পাঁচুর জ্ঞান ফিরল কিন্তু উঠতে পারল না । শেখর বিনয় দু'জনে তাকে ধরাধরি করে মাঝরাস্তা থেকে পাশে গাছের গুঁড়ির দিকে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল----- যেন অন্ধকারে কোন গরুর গাড়ি ওর উপর দিয়ে না যেতে পারে।
উপরে টর্চ মেরে দেখল--- রাস্তার ঠিক উপরের ঝাঁকড়া ডালে পেতে রাখা জালে অন্ততঃ ২০-২৫ টা বাদুড় আটকে রয়েছে।
কেউ বাদুড় শিকার করার
জাল পেতে রেখেছে ওখানে। শেখরের ভয়ার্ত চীৎকারে ভয় পেয়ে বাদুর গুলোও চীৎকার করে পালাবার চেষ্টা করছিল ,তাই ডগার পলকা ডাল অত আন্দোলিত হচ্ছিল।
শেখর এবার টর্চের তীব্র আলো পশ্চিম পাড়ের খেজুর গাছের উপর ফেলে দেখলো একটা বড় সাদা ধূতি খেজুর গাছের কাঁটায় একদিক আটকে গেছে, বাতাসের তীব্রতায় একবার উঁচু হয়ে উঠছে, তীব্রতা কমলে আবার নিচে পড়ে যাচ্ছে----অন্ধকারে ওটাকেই মনে হচ্ছিল কেউ উঠাবসা করছে।
বিনয় বলল----- শিমুল গাছে অনেক শকুনের বাসা আছে,রাতে শকুনের বাচ্চারা মানুষের বাচ্চার মতোই কাঁদে।
শেখর মনে মনে হেসে ভায়ের সঙ্গে বাড়ির পথে পা বাড়াল।তখন মেঘ অনেকটা কেটে গেছে--- বাতাস ও কমে গেছে, শুধু শোনা যাচ্ছে কাঁদুনে দীঘির জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ।
Subscribe to:
Posts (Atom)
0 comments:
Post a Comment