সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
ভালোবাসা, কৃষ্ণচূড়া গাছ এবং তারপর
সুনির্মল বসু
স্টেশনের শেডের নিচে দেখা হতো প্রতিদিন, বসন্ত দিনে কৃষ্ণচূড়ার গাছের ঢেউ পেরিয়ে ও প্রতিদিন কলেজে যেত,
আমারও তখন সদ্য গোঁফ উঠেছে, হাতে একটা ডাইরি নিয়ে কলেজে ছুটছি, বন্ধুদের সঙ্গে চারমিনার সিগারেট শেয়ার করে টানছি, ট্রেনের রড ধরে ঝুলে কলেজ যাচ্ছি,
ওকে প্রথম দিনে দেখেই মনে মনে ভালোবেসে ফেললাম, সে আমার প্রথম প্রেম, অনুরাধা,
চোখে চোখে কথা হতো আমাদের,
তিনটে পয়তিরিশের ট্রেনে ও ফিরতো বলে,
অনার্স ক্লাস কেটে একই ট্রেনে এক কামরায় ফিরে এসেছি কতদিন,
কথা হোত চোখে চোখে, কি যেসব মুগ্ধতার দিন,
মনে মনে ওর উদ্দেশ্যে কত কথা বলেছি আমি,
মুখে কখনো কিছু বলিনি,
ওর সঙ্গে দেখা হলে, আমার দিনরাত্রি বদলে যেত,
ওর সঙ্গে দেখা না হলে, আমার রাতের ঘুম চলে যেত, সেই প্রথম আমি ভালবাসার জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলাম,
ও যে আমাকে ভালোবাসতো, তার অনেক প্রমাণ পেয়েছি, ওর বান্ধবী জয়িতা, অনিন্দিতা, আমাকে এই কথা জানিয়েছিল।
অথচ, আমরা কেউ একে অপরকে ভালোবাসার কথা বলতে পারিনি,
ফার্স্ট ইয়ার শেষ করে, সেকেন্ড ইয়ারের শেষাশেষি
ও অনেকদিন কলেজে আসছে না,
শুনলাম, বিয়ে ঠিক হয়েছে ওর,
আমার কিছুই করার ছিল না।
হাত খরচ চালাবার জন্য দুটো টিউশনি মাত্র সম্বল।
তাছাড়া, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবার একার আয়ের উপরে সংসার।
প্রথম প্রেমের কথা কেউ কখনো ভুলতে পারে না। অনুরাধা চলে গেল জীবন থেকে, সে যে কী অসম্ভব কষ্টের দিন, তা বলে বোঝাতে পারবো না।
তারপর পঁচিশ বছর কেটে গিয়েছে। আমি একটি কলেজে অধ্যাপক হয়েছি। সুস্মিতাকে বিয়ে করেছি। আমার ছেলে অভিলাষ জয়েনটে ভালো ফল করে ডাক্তারী পড়ছে।
সেদিন কলেজ থেকে বাড়ি ফিরতেই, সুস্মিতা বলল,
শুনেছো, আমাদের অভি বলছিল, ও নাকি রিমলি নামের একটি মেয়েকে ভালবেসেছে।
কই, আমাকে তো আগে কখনো এসব জানাওনি। তাছাড়া ওর ক্যারিয়ার এখনো তৈরি হয়নি। ওকে সেটা বোঝাও।
বুঝিয়েছি, মেয়েটির বাড়ির সবাই এ ঘটনা জানে।
ওর বাবা-মা একদিন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।
আমি মনে মনে খুব বিরক্ত হলাম।
ভাবলাম, আমাদের সময়ে সমাজের কথা ভেবে আমরা একে অন্যকে ভালবেসেও, মনের কথাটা অন্যের কাছে কখনো তুলে ধরতে পারিনি।
কী যুগ এলো।
রোববার সকালে বসে পরীক্ষার খাতা দেখছি, বাড়ির সামনে একটি মোটর গাড়ি এসে দাঁড়ালো।
সুস্মিতা বলল, ওনারা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
সকালবেলায় তীব্র বিরক্তিতে মন ভরে গেল।
বললাম, ওদের ভেতরে আসতে বলো।
মনে মনে ভাবলাম, সকালবেলায় হাজির হয়ে, আমার খাতা দেখার বারোটা বাজিয়ে দিল।
ওরা বৈঠকখানা ঘরে এলেন।
বললাম, ভেতরে আসুন।
মেয়ের বাবা-মা ঘরে এলেন।
ভদ্রলোক বললেন, আমি কল্যাণ মুখার্জি। ইনি আমার ওয়াইফ অনুরাধা মুখার্জি। আমাদের একমাত্র মেয়ে রিমলি আপনাদের ছেলে অভিলাষকে ভালোবাসে। রিমলি এবার ইংলিশে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেবে। ওদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে চাই।
সুস্মিতা বলল, কিন্তু ওদের পড়াশুনা তো শেষ হয়নি।
মিস্টার মুখার্জি বললেন, এখন কথাবার্তা হয়ে থাক।
ওরা দাঁড়িয়ে গেলে, আমরা ওদের বিয়েটা দিয়ে দেবো।
আমি অনুরাধার দিকে ফিরে তাকালাম।
কত বছর পর ওকে দেখলাম। মনের সব বিরক্তি এক লহমায় ধুয়ে মুছে সাফ।
আমার সকালটা ভালো হয়ে গেল।
অনুরাধাও আমার দিকে মিনতি ভরা চোখে যেন চেয়ে আছে।
যেন বলতে চাইছে, এখন কথাবার্তা হয়ে থাক, ওরা নিজেদের পায়ে দাঁড়ালে, আমরা চার হাত এক করে দেব। তুমি না যেন বোলো না, অনিমেষ।
আজকাল বয়স হয়েছে তো। দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে অনেক। সময়ের ফেরে পৃথিবী বদলে যায়। জীবন বদলে যায়। মানুষ বদলে যায়।
আমি ভাবছিলাম, আমাকে সময়টা ছিল অন্যরকম। আমরা একে অন্যকে ভালোবেসেও, লোক লজ্জার ভয়ে মুখে কোনদিন ভালোবাসার কথা বলতে পারিনি।
আমার ছেলে অভিলাষ, কিংবা অনুরাধার মেয়ে রিমলি সাহস করে নিজেদের ভালোবাসার গোপন কথা প্রকাশ্যে জানিয়ে দিতে পেরেছে।
কল্যাণবাবু বললেন, কাইন্ডলি একটু সময় নিয়ে আপনাদের ওপিনিয়ন জানালে, আমরা আপনাদের কাছে থ্যাংকফুল থাকবো।
সুস্মিতা বলল, একটু সময় দিন। ভেবে জানাচ্ছি। নেক্সট উইকে ফোন করবো।
ওরা কফি মিষ্টি খেয়ে বেরিয়ে গেলেন।
সুস্মিতা রাতে আমাকে বলল, অভিলাষ আমাদের একমাত্র ছেলে, ও কষ্ট পাক এমন কিছু আমরা করতে চাই না।
আমি বললাম, আমার চেয়ে ছেলের মা হিসেবে তুমি ওকে বেশি ভালো বোঝো।
আসলে, আমি বা সুস্মিতা একরকম এ বিয়েতে সম্মতি দেবার ব্যাপারে একমত হলাম।
পরদিন কলেজে গিয়েছি। ফোন এলো।
হ্যালো, কে বলছেন,
আমি অনুরাধা বলছি, অনিমেষ, কাল তোমাকে দেখলাম। একই আছো, আগের মতো। শুধু চুল ঝুলপিটা সাদা হয়েছে।
আমি বললাম, কাল তোমাকে দেখে আমি চমকে গিয়েছি। একদিন তো ভালবাসতাম, বলতে পারিনি।
আমাদের সময় অন্যরকম ছিল।
আমরা ছিলাম লাজুক, মুখচোরা।
অথচ, আমাদের পরের প্রজন্মকে দ্যাখো, ওরা কেমন সোজাসুজি ওদের ইচ্ছের কথাটা প্রকাশ করতে চায়।
তুমি কি করতে বলছো আমায়,
আমি চাই তুমি ওদের ভালবাসাকে সম্মান দাও।
আমার স্ত্রী সুস্মিতাও সেই কথা বলেছে।
আমরা বড্ড বোকা ছিলাম।
বোকা নয়, সরল।
অভিলাষ রিমলি অধিকার আদায় করে নিতে জানে।
হবে হয়তো।
ভালো থেকো। ফোন ছাড়ছি।
সুস্মিতা ফোনে সব জানিয়ে দেবে।
আমি ফোনটা রাখলাম। একটা প্রবল দীর্ঘশ্বাস এত আনন্দের মধ্যেও, বুকের মধ্যে থেকে যেন বেরিয়ে আসতে চাইলো।
আমি স্পষ্টত ই সেদিনের কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ায় স্টেশনের শেডের নিচে দাঁড়ানো অনুরাধাকে আবার নতুন করে যেন সেই পরিচিত চেহারায় দেখতে পেলাম।
0 comments:
Post a Comment