সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

 

ফেরা  ও  ফেরা

শৈবাল চক্রবর্তী

খাবার থালার দিকে তাকিয়ে সোনার ভীষণ রাগ হয়ে গেল। সেই গলা ফোটানো এক খাবলা ভাত, জল জল হলুদ মত কি নাকি ডাল আর একটা চেরা সিদ্ধ আলু। একটা ডিম তো এক আধটা দিন দিতে পারে।

-“আমি খাবো না” আলতো করে সে থালাটা ঠেলে দেয় সামনের দিকে। খুব জোরের সঙ্গে বলার বা ঠেলার অবস্থা যে নেই, সেটা বুঝেও তার এই প্রতিবাদ।

প্রতিমা দেখে। বলে না কিছু। একটা বছর বারোর উঠতি ছেলের চাহিদা মাপে। হীরু তখন ঘাড় কাত করে তার থালার ভাত খুঁটে খায়। আড়ে নজরে দাদা আর মাকে দেখে ফাঁকে ফাঁকে। কিই বা বলবে প্রতিমা। শেষ একটা মাস, এই তো চলছে দুইবেলা। সরকারি চাল কিছু বিনিপয়সায় মেলে, তাও অনিয়মিত। 

-“মাহ, কতদিইন ভাতে অন্য কিচ্চু খাইনা” হীরুও এবার বিনবিনিয়ে ওঠে।

আঁচলের খুঁট টানে প্রতিমা। আলতো ভাঙা গলায় বলে, “খেইয়্যে নাও বাপ….. বড় হইয়েছো না তুমি….. ঊঁ।”

 সোনা কথা বাড়ায় না। লাফ দিয়ে উঠে পড়ে ভাত ফেলে।

-“একি একি, মুখের ভাত ফেলে উঠতে নাই বাবা। আঁতকে ওঠে প্রতিমা।–“দুটিখানি খেয়ে নে। …… ঠিক আছে। আজ তোর বাবুকে বলবোখোন কটা ডিমের ব্যবস্থা করতে।”  

সোনা শুনলো না। বেরিয়ে গেল পা বাজিয়ে। বড্ড জেদ হয়েছে ছেলের, ভাবে প্রতিমা।

কোথা থেকে কি যে হয়ে গেল, দিব্বি তো দিন গুজরান হচ্ছিল। খুব স্বচ্ছল তারা ছিল না কিন্তু এমন দৈণ্যের দশা কখনো আসেনি। বুড়ি শ্বাশুড়ী নিয়ে পাঁচটা পেট। রোজগেরে মানুষটা মুম্বাইয়ের কাজকাম ছেড়ে প্রায় পালিয়ে এসেছিল। চারদিকে কি এক মারণ-রোগের খবর ছড়াচ্ছিল তখন। এখন ঘরে বসে। এই গাঁ কেন, আশেপাশে, কোথাও কোনো কাজকাম নেই।  চারিদিক শুধু কি হয় কি হয় ভয়। 

      ******************************************************

সুদাম তিনমাস হল গ্রামে ফিরেছে। প্রায় জোর করেই দৌলতরামের ম্যানেজার ওকে ফেরত পাঠিয়েছিল –“তু যা রে বাবা যা। হাল বহুত খারাপ। বিদেশ মে সবকুছ বন্ধ হো রহা হ্যায়। ইধার ভি হোগা। কামকাজ বন্ধ হুয়া তো খায়গা কেয়া, দেখেগা কৌন? যা জলদি অপনা ঘর ভাগ, যা!” 

এমনিতেই অনেকগুলো দিন সে বাইরে। বাড়ি থেকে ফোন আসা বেড়েছে। ভিতরে নাড়া পড়ে গেল। সেই রাতেই ফেরার ট্রেন ধরল সুদাম। হাতে দশ হাজার টাকা দিয়েছিল ম্যানেজার বাবু। - “আজ বিশ তারিখ। তেরা  কুছ পয়সা বনতা হ্যায়। পক্কা হিসাব তো নহী পর অভি ইসে লে যা। কাম আয়েগা।” সেদিন ছিল শুক্রবার। তারপর রবিবার থেকে দেশ জুড়ে সব বন্ধ। সব মানে সব। অনির্দিষ্টকাল।

এ’সব কেউ কোনোদিন দেখেছে? মানুষ কারফিউ, ব্ল্যাকাউট দেখেছে, বনধ করেছে লম্বা করে। অতিমারী তো শুধু ইতিহাসের পাতায় ছিল। কিন্তু এখন এক নতুন ছোঁয়াচে অসুখ থেকে বাঁচতে সরকার বলছে সব কিছু বন্ধ থাকবে, মানুষ ঘরে বন্ধ থাকবে। মানেটা কি? মানুষ কি খাঁচার প্রাণী?  কে জানে?  এমনটা কে কবে দেখেছে বা শুনেছে ।

আগে একবছর সুদাম বাড়ি আসতে পারেনি। প্রচন্ড কাজের চাপ। অলঙ্কারে নকশা আর ছিলা কাটায় তার কদর ছিল। জাভেরিবাজারে এ’ঘর সে’ঘর করতে করতে মনসুখভাই দৌলতরামদের কাছে শেষপর্যন্ত থিতু হয়ে গিয়েছিল সে। ঠিক চাকরি নয় কিন্তু এদের ফুরনে কাজে ভালোই পেত।  বাড়িতে পাঠিয়ে, নিজের খরচ সেরে, কিছু থাকতো। তাতে তার মাটির ঘরে খড়ের চাল টালির হলো। বাঁশ-খুঁটিতে আলকাতরা রং  লাগলো, উঠোনে বেড়া, ঘরে খুচরো আসবাব হলো। বউ বাচ্চার খাওয়া-পরা, গায়-গতর, অনেক কিছু পাল্টালো। কিন্তু এখন তো আর চলছে না। জমা পুঁজি ভেঙ্গে দুই মাস বসে খেয়ে কাটল। এখন সরকারি খয়রাতি আর হাতের তলানি পয়সাটুকু যা  ভরসা। জমি নেই যে চাষবাস করবে। তাই ফিরে ছোট্ট একটা দোকান খুলেছিল বাড়িতে। লজেন্স, বিস্কুট, বিড়ি, দেশলাই,  কিন্তু কিনবে কে? চালু দোকানই চলে না। কারো হাতে টাকাপয়সা বিশেষ নেই। সব ধারে খেতে চায়। মাস ঘুরল না, দোকান লাটে উঠল। এর পিঠে একদিন আচম্নিতে বয়ে গেল এক প্রলয়ঙ্কর ঝড়। তেমনই বৃষ্টি। সেদিন বিকেল-সন্ধ্যা জুড়ে সে কি তান্ডব। মাঠের ধান, সব্জি সব জলে ডুবে পচে-হেজে গেল। ফলধরা গাছ মাটিতে লুটিয়ে, বাড়িঘর ভেঙে, বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে, তছনছ হয়ে চারিদিক কেমন শশ্মানের চেহারা নিল। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।

 

প্রতিমা হীরুর মাথায় হাত রাখে। -“আমি এড্ডু খাইয়ে দিই?”  

-“হুঁ আচ্ছা মা, বাবু আসবে না?”

তাই তো। প্রতিমার হুঁশ হয়। মানুষটা কোথায় কখন যায় আজকাল। কত বেলা হল। তারপর  উঠে ভাতের হাঁড়িতে একটু জল ঢেলে দেয়।

সুদামের ফিরতে এ’দিন সন্ধ্যা হয়ে গেল। -“কই গো, কোথায় গেলে সব…….. সোনা! ……. হীরুটারও সাড়া পাচ্ছিনা।…….. ঘরদোর সব আন্ধার কেন?”

প্রতিমা তড়িঘড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। - “ওরা পাশেই আছে। ….. কোথায় গেছলে, সেই সক্কালে গ্যালে, আর এই ফেরা।……. সেই থেকে আস আস করে ভাত আগলে বসে আছি” সুদাম এগিয়ে আসে। প্রতিমা খেয়াল করে ওর হাতে গোটা দুই প্লাস্টিকের প্যকেট ঝুলছে। - “কি গো? কি নিয়ে এলে?”

-“শোনো, খবর আছে, বলছি। আগে এটা রাখ। এট্টু মাংস আছে,   খাসী। তেল, গুঁড়মশলা, কিছু টুকিটাকি আছে।”

-“তোমার মাথা খারাপ হোয়েচে!  টাকা কোথায় পেলে?”

- “বড় কথা বাড়াও আগেই! রমেশের সাইকেলটা নিয়ে সদর গেছলাম। কাজু শেখের কাছে কিছু ধার নিলাম। তিন মাসে শোধ কড়ার করে এয়েছি, কুড়ি পয়সা সুদে।”

প্রতিমার হু হু করে কান্না পায়। মানুষটা কি পাগল হল। এগিয়ে ওর জামার বুকটা খামচে ধরে।– “কি করে শুধবে তুমি, কি করেহ?” কান্না মেশা একটা হেঁচকি ওঠে গলায়।

-“আমি ফিরে যাবো বৌ। মুম্বাই ফিরে যাবো।” এই অবধারিত সত্যিটা সুদাম এতক্ষণ দেরী করছিল বলতে কিন্তু কান্নাকাটি যখন শুরুই হয়ে গেল তখন……….বলে এবার চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সে। প্রতিক্রিয়া বুঝতে চায়।

প্রতিমা শুনে থমকে যায়। উথলে আসা কান্নাটা তার চমকে যায়। -“কোথায় যাবে...... মুম্বাই!? মানে…..মানে…..তোমার সেই কাজের জায়গা। …….খুলে গেছে সব?” চোখ মুখ স্বাভাবিক হতে থাকে তার।

ভরসা পায় সুদাম। বলে –“এখানে কিছু হবার নয় বৌ। কদ্দিন এ’ ভাবে আর…….. ম্যানেজারবাবুকে কাল ফোন করতে বল্লেন যেতে। এট্টু এট্টু করে সেখানে কাজকাম চালু হয়েছে। আগেভাগে গেলেই ভালো।” এবার থামে সে। প্রতিমার জন্য অপেক্ষা করে।

-“কই, এত কিছু বল নি তো” প্রতিমা অনেক স্বাভাবিক এখন। -“সে যাক, ওই ম্যাঞ্জার ঠিক যেতে বলেছে? কাজ হবে?” আঁচলে মুখটা ভালো করে সাপ্টে নেয় সে –“যাবে কি করে? টেরেন চালু হয়ে গেছে?”

সুদাম মৃদু হাসে।–“ক’দিন হল মুম্বাই-ট্রেন চালু হয়েছে।”

- “কবে যাবে ভাবছ?”

-“কালই” তড়িঘড়ি উত্তর দেয় সুদাম, - “কাল শেষরাতে রওনা হয়ে যাবো, পরের রাতে হাওড়া থেকে ট্রেন।”

- “ওমা, কাল! তা’লে তো এট্টুও সময় নেই গো।” প্রতিমা ছটফটিয়ে ওঠে। ঘরে ঢুকে চট করে আলোটা জ্বালে।তার চোখেমুখেও তখন আলো। ছেলেরাও এসে পড়ে আশপাশ থেকে।-“হ্যাঁগো, মুড়ি মাখি? তেল-লংকা দিয়ে—সোনা হীরু, হাতমুখ ধুয়ে খাবি আয়।” তার নিজেরও যেন এখন ক্ষিদে ক্ষিদে পায়।

 সুদাম বউকে চনমনে দেখে খুশি হয়। মনে আশংকা ছিল, তার যাওয়ার খবরে কান্নাকাটি, নানান ঝামেলা হবে। ওদিকার রোগবালাই-এর খবর খুব একটা ভালো না। জানতে চাইলে মুশকিল হত। বউটা তার বুঝদার। এতগুলো বছর কেটে গেল তার বাইরে বাইরে। ওই তো সামলেছে সংসার, ঝক্কি-ঝামেলা। এই তো যখন এবার ফিরল সে, তার আগে থেকেই, কি আকুলিবিকুলি। ফোনের পর ফোন। খারাপ খবর তখন উড়তে শুরু করেছে। তারপর ফেরা। সেদিন তো সব বন্ধ। হাওড়া থেকে ধুবুলিয়া আসতে সে কি কষ্ট। খানিক হেঁটে, খানিক মোটর-সাইকেলে আর বাকিটা ঝরঝরে এক সাইকেলে, দু’হাজার টাকা গচ্চা দিয়ে ফেরা। সেদিন ফিরতে বউটা ভেঙে পড়েছিল বুকে। -“তোমার কি মন বলে কিছু নেই গো!” ছেলেদুটো গায়ে লেপ্টে গেছিল।  সুদামের গলার কাছে ঢেলা পাকালো বুঝি।

মায়ের পাশে গিয়ে খানিক বসে এল সুদাম। হাতে পিঠে আলগোছে স্নেহের বিলিকুসি। ফিসফিসিয়ে বলে এল তাকে। জানানোই তো শুধু। অনুমতির কিছু নেই। মাথা পাতে সে। - “এট্টু জপ করে দাও!” দীর্ঘশ্বাস পড়তে নেই মায়ের। ছেলের মাথায় ফুঁ দিয়ে বুড়ি কি যে জপমন্ত্র আওড়ায়, সেই জানে।

রাতে মাংস-ভাতের শেষে হাত চাটলো সবাই। ছেলেদুটো একটু একটু চেয়ে নিয়ে খেল। সকালের জন্য একটু তোলা রইল। গল্পগাছা, হাসিঠাট্টায় সব মশগুল হলো, শুধু সুদাম একটু চুপচাপ। অন্যবার যাবার আগে সেই বেশি হইচই করে, প্রতিমাকে সামলায়। এবার সেই ঝক্কি এক্কেবারে নেই।

সোনা বলল-“বাবু কালই যাচ্ছ?” 

-“হ্যাঁ বাপ, শেষরাতে বেরাবো। সব্জি গাড়ি যাবে কলকাতায়। ওদের সাথে কথা হয়েছে, বড়রাস্তায় দাঁড়াবে।”

-“তাপ্পর?” হীরুটা গায়ে সেঁটে বসে।

-“তাপ্পর আর কি? হাওড়ায় বওড়ো এক ইস্টিশন আছে। রাতের ট্রেনে ভোঁ ভোঁ করে চলে যাব।”

-“বাবু, এবার পুজোয় নতুন জামাপ্যান্ট হবে তাইলে?” সোনার আগ্রহ।

- “আমরা এবার রোজ ডিম খাবো বাবু, ডিমভাজা!” হীরুর গলায় ঘুমঘুম ভাব।

-“আচ্ছা সব হবে বাপধন। তোমরা এবার ঘুমাও। তোমাদের বাবুকে একটু ঘুমাতে দাও।” একফাঁকে প্রতিমার তক্তাপোষে বিছানা পাতা সারা। সুদামের ব্যগও গুছিয়ে দিয়েছে সে।

হীরু বলল, -“মা ঘুমাতে যাই, ঘুম পায়।…………… কাল আবার মাংসভাত খাব। …………………. বাবু”

-“হুঁ?”

-“তোমার কাল মাংসভাত খাওয়া হবে না।”

এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল সুদাম রওনা হওয়ার আগে। যাবার সময় ছেলেদের মাথায় চুমা খেলো, বউকে বুকে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে স্বান্ত্বনা দিল। প্রতিমা এবার অনেক শান্ত, স্থির।

সুদাম রওনা হল। উঠোনবেড়া টপকে ক’টা পা এগিয়ে গেল প্রতিমা। চারদিকে ঝিঁঝিঁডাক, ভিজে বাতাসে তখন অচেনা  ফুলের গন্ধ । সুদাম বলে -“বউ, আর থাক, অন্ধকারে আগিয়ে কাজ নেই। আমি ঠিক চলে যাব, ভেবো না। সাবধানে থেকো সব, দেখেশুনে রেখো। খবর দিও।”

অন্ধকারে মিশে যায় সুদাম, যেন এই ছিল, এই নেই। দাঁড়িয়ে থাকে প্রতিমা, দেখতে চায় চলে যাওয়া মানুষটাকে কিন্তু দেখা যায় না। হাওয়া বয়, যদি তার শরীরী গন্ধটুকু আসে। সেই অপেক্ষায় হঠাত ভীষণ শীত করে ওঠে তার। আঁচলটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নেয়। তারপর অন্ধকারে পিঠ দিয়ে  ঘরে ফিরে আসে।

এক ফোঁটা, দু’ফোঁটা, চার ফোঁটায়, সেই অন্ধকার ধুয়ে দিতে চেয়ে, বৃষ্টি নামে।

 

0 comments: