সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.



মৈত্রী

 সুব্রত দত্ত



    পার্কের কোণে একটা বেঞ্চে ওরা দু'জন বসে আছে। মেয়েটি নতমুখে, ছেলেটি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে। ঘর বাঁধার স্বপ্ন ওদের। মেয়েটি কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। উদগ্রীব হয়ে ছেলেটি জিজ্ঞেস করে, 

---"কি হল, চুপ করে আছ কেন? কথা বলো! কি হয়েছে তোমার?" 

মেয়েটির দু'চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে এল। বললো -

---"তোমায় কতবার বলেছি, একটা ব্যবস্থা করো। তুমি গুরুত্বই দিচ্ছো না। কাল আমায় দেখতে আসবে। এখন কি করবো?"

---"কি? কেন, এখনই কেন? তোমার তো মাস্টার্স কমপ্লিট হয় নি। তাহলে?"

---"আমায় বলে কি হবে? বাড়ি থেকে বলেছে, বিয়ের পরেও পড়াশুনা করা যায়। ভাল ঘর।পছন্দ করলে কোনও অসুবিধে হবে না।"

---"ওঃ, কি যাতা বলছো। এই মুহূর্তে আমি কি যে করি!" 

---"আমি কিন্তু অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারবো না।"

---"জানি, আমিই কি পারবো?"


    সন্ধ্যে গড়ায়। পার্কের আলোয় আলোকিত হয় চারিদিক। কিন্তু ওদের বুকে নিরাশার গভীর আঁধার নেমে আসে। অবশেষে ওরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, দু'জনের বাড়িতেই ওদের সম্পর্কের কথা জানিয়ে দেবে। হয়তো বিয়েটা স্থগিত রাখা যেতে পারে। অজানা আশঙ্কায় তারা বাড়ি ফেরে।


    শবনম বাড়িতে একথা জানাতেই ঝড় বয়ে যায়। ওর আব্বা তো রাগে ফেটে পড়েন। হিন্দু ছেলের সাথে কিছুতেই মেয়ের বিয়ে হতে পারে না। শবনম তার আম্মুকেও বোঝানোর চেষ্টা করে। বলে অন্য কাউকে সে বিয়ে করতে পারবে না। এরপর শুরু হলো শবনমের ওপর অকথ্য নির্যাতন। বাড়ির বাইরে বেরোনো বন্ধ হয়ে গেলো।


    ওদিকে রাজীবের বাড়িতেও চরম অশান্তি। ওর বাবা-মা মেনে নেয় না এই সম্পর্ক। একটা মুসলমানের মেয়েকে ঘরের বউ করে আনা অসম্ভব। বাবার সাথে রাজীবের সম্পর্কটা বন্ধুর মত। কিন্তু এক্ষেত্রে বাবাও নিমরাজি। অথৈ জলে পড়ে সে। পাড়ার বন্ধুদের সব জানায়। বন্ধুরা ওকে আশ্বাস দেয়, একটা সমাধান সূত্র ঠিক বেরিয়ে আসবে।


    পরের দিন শবনমকে দেখতে এসেছে। হবু শ্বশুরমশাই-এর এতই পছন্দ যে পাকা কথা দিয়েই দিলেন। শবনম প্রমাদ গোনে। হায়রে নারী-স্বাধীনতা! এই বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য যে থাকতে পারে, সেটা কারো ভাবনাতেই আসে না। মিষ্টিমুখ করার পর হবু বর-কনেকে নিভৃতে আলাপচারিতার সুযোগ দিতে সবাই বেরিয়ে যায়। শ্বশুর বাড়ির লোকেদের বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখায়। আসিফ এতক্ষণ উতলা হয়ে উঠেছিল সুন্দরী হবু বউয়ের সাথে কথা বলার জন্য। এবার সেই সুযোগ পাওয়া গেলো। সে বলে - "আমাকে বিয়ে করতে আপত্তি নেই তো? আমার সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞাসা করার আছে?" শবনম বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শেষে বলেই ফেলে, - "আপনাকে দেখে, আপনার কথা শুনে যথেষ্ট ভদ্র মানুষ বলেই মনে হচ্ছে। পাত্র হিসেবে আপনাকে সবাই পছন্দ করবে। কিন্তু , কিছু মনে করবেন না। আপনি এই বিয়েটা ভেঙে দিয়ে আমাকে বাঁচান, প্লিজ। আমি একজনকে ভালবাসি। আমার পরিস্থিতিটা বুঝতে চেষ্টা করুন, প্লিজ।" আসিফের মুখটা হাওয়া ছেড়ে দেয়া বেলুনের মত চুপসে যায়। বড্ড অপমানিত বোধ করে। তবু মুখে কৃত্রিম হাসি বজায় রেখে সে বলে, - "ধন্যবাদ সত্যিটা বলার জন্য। চিন্তা করবেন না। আমি আপনার কথা রাখবো।" দম বন্ধ করে ছিলো শবনম। আসিফের কথা শুনে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো! ওরা চলে গেলো। যাওয়ার আগে আসিফ নিজেই নাকচ করে দিয়ে গেছে। সুযোগ পেয়ে শবনম ফোনে রাজীবকেও সুখবরটা জানিয়ে দেয়।


    ওদিকে রাজীব কি করবে ভেবে কুল কিনারা পায় না। ইলেকট্রনিক্স এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার সে। সবে চাকরি পেয়েছে। পালিয়ে বিয়ে করাও সম্ভব নয়। আত্মসম্মানে বাঁধে। আর কিছুটা সময় দরকার নিজেকে গুছিয়ে নিতে।


    এ পর্যন্ত যা ঘটলো, তা গল্প, উপন্যাস বা চলচ্চিত্রে হামেশাই দেখা যায়। কিন্তু এরপরের ঘটনাবলী অন্যদিকে মোড় নেয়। দুই সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়ের সম্পর্কের কাহিনী 'রটি গেল ক্রমে'। দীর্ঘদিন ধরে ওঁৎ পেতে থাকা দুই ধর্মের মৌলবাদীরা যেন হাতে অস্ত্র পেয়ে গেলো। "বিচার চাই" - চিৎকারে সরগরম হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। একদল শবনমদের বাড়িতে, অন্যদল রাজীবদের বাড়িতে হুমকি, এমনকি হামলাও শুরু করে। সমাজের ভদ্র - শিক্ষিত মুখোশধারী কিছু সাম্প্রদায়িক মানুষও ওদের মদত দেয়। অন্যদিকে বেশকিছু মানুষ আছে, যারা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী। ওরা মৌলবাদীদের শত্রু।পবন, লক্ষণ, তসলিমরা শবনম আর রাজীবদের পাশে এসে দাঁড়ায়। যদিও শবনম বা রাজীবদের বাড়ির কেউ তাদেরকে পাত্তা দেয় নি মোটে।


    মৌলবাদীরাও সহজে ছাড়বার পাত্র নয়। জনসমর্থন আদায়ে নানা কৌশল আর গুজবের আশ্রয় নেয়। ধর্মকে হাতিয়ার করে জেহাদ ঘোষণা করে ওরা। দু'জনেই নাকি ধর্মে আঘাত দিয়েছে। তাই ওদের শাস্তি দিতেই হবে। কেউ কেউ দাবি তোলে, ওদেরকে পুড়িয়ে মারা হোক। অদ্ভুত একটা অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। দুই বাড়ির কেউ বাইরে বেরোতে সাহস পায় না। কারণ, যত্রতত্ৰ দাঙ্গাবাজরা লাঠি-সোটা সহ নানা অস্ত্রে ভূষিত হয়ে আঘাত হানতে প্রস্তুত।


    তবু এর মাঝেই পবন, তসলিমদের দুই দল দুই বাড়ির সামনে কড়া নজর রাখে। পবন আর তসলিমের নেতৃত্বে বিরাট মিছিলে আওয়াজ ওঠে, -  "দাঙ্গাবাজরা হাত গোটাও।" মিছিল দেখে ওরা একটু হতভম্ব হয়ে যায়। তবুও তাদের অপচেষ্টা অব্যাহত রাখে। লাঠি-সোটা নিয়ে তেড়ে যায় মিছিলের দিকে। ওদের আসল উদ্দেশ্যই হলো - যে করেই হোক, একটা দাঙ্গা বাঁধিয়ে কিছু মানুষের জীবন ধ্বংস করে ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে রাজনীতি করা। হিন্দু - মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের বেশ কিছু মানুষ (?) সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ। ওরা শবনম আর রাজীবের বাড়িতে ইঁট পাটকেল ছুঁড়তে থাকে। সাধারণ মানুষ ভয়ে উদ্ভ্রান্তের মত ছোটাছুটি করতে থাকে। এলাকার বাড়িগুলোর সব দরজা জানালা বন্ধ হয়ে যায়। চরম বিশৃঙ্খলার আবহ তৈরি হয়। পুলিশকে খবর দেয়া হয়েছে অনেক আগেই। তাঁরা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছেন।


    এবার মিছিলের নেতৃত্বে থাকা পবন আর তসলিম উন্মত্ত পশুদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তসলিম বলে, - "আগে আমাদের খতম করো, তারপর ওদের গায়ে হাত দেবে।" দু'পক্ষের শয়তানরা রে রে করে ওঠে! মিছিলের মানুষগুলো তখন প্রতিরোধে এগিয়ে আসে। পবনদের কর্মকান্ডে অনুপ্রাণিত হয়ে শবনম আর রাজীবও বেরিয়ে আসে। ওরা এখন ভয়কে জয় করেছে। মিছিলের গা ঘেঁষে দাঙ্গাবাজদের সামনে এসে দাঁড়ায় ওরা। শবনম ওদের চোখে চোখ রেখে বলে, - "এইতো আমরা এসেছি। কি করতে চাও তোমরা?" এক মৌলবাদী পান্ডা, কাজী নিজামুদ্দিন মোল্লা বলে, - "মুসলমান হয়ে বিধর্মীর সঙ্গে সম্পর্ক আমরা মানছি না। বিয়ে করতে হলে ওকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে।" যোগী সত্যানন্দ বলে, - "না, মেয়েটিকেই ধর্মান্তরিত করতে হবে।" যোগী আর কাজীর মধ্যে বিতণ্ডা চরম আকার নেয়। মিছিল গর্জে উঠতেই তসলিম থামিয়ে দেয়। বলে, - "আজ যা বলার রাজীব আর শবনমই বলবে।" তখন রাজীব বলে, "শুনুন, ধর্মীয় অন্ধ মানুষ আপনারা। আপনাদের এই বিষ ছড়ানো বন্ধ করুন। যুগ পাল্টে গেছে। আপনারা আমাদের আবার মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান? না, আর পারবেন না। মানুষ আর পেছনে নয়, সামনে এগিয়ে যাবে। ধর্মের ব্যবসা এবার বন্ধ হোক। আমরা কেউই ধর্ম পরিবর্তন করবো না। দু'জনেই নিজেদের ধর্ম পালন করবো। আইন জানেন? স্পেশাল ম্যারেজ আইনে এরকম বিয়ের ব্যবস্থা আছে। আর এত ধর্ম ধর্ম যে করছেন, মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস জানেন? মানুষ তো আগে ছিলো বনমানুষ। আমরা তো সেই বনমানুষের বংশধর! আচ্ছা বলুন তো, বনমানুষের কোন ধর্ম ছিল?" 


    নিস্তব্ধ চারিদিক। ইতিমধ্যে ওদের বাবা - মায়েরাও এসে রাজীবের কথাগুলো শুনে নির্বাক হয়ে যান। তাঁরাও উপলব্ধি করেন যে তাঁদের ছেলে মেয়েরা কোনও ভুল করে নি। যোগী - কাজীরা পালাবার পথ খোঁজে। রাজীব আর শবনম মুখোমুখি দাঁড়ায়। রাজীব বলে, "আর চিন্তা নেই। তসলিমদা, পবনদারা পাশে ছিলেন, তাই আজ ভালবাসার কাছে মনুষ্যসৃষ্ট ধর্মীয় গোঁড়ামী হেরে গেলো।" মিছিলের গর্জনে যেন অশান্তি আবহ দূর হয়ে সহাবস্থানের সুরাহা হয়ে গেলো।

0 comments: