সম্পাদকের কলমে
নারায়ণ দেবনাথ-
সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম ।
ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম ।
নমস্কার সহ
অঙ্কুর রায়
সংখ্যার সম্পাদক
অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী
প্রধান সম্পাদক
লেখা পাঠানোর জন্য
আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com
Total Pageviews
By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.
জীবন্ত সারের কারখানা
রানা সেনগুপ্তভোলাদার কথা শুনে আমি যে ব্যাগগুলো বয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম, সে গুলোকে ‘ব্যাগ’ বললে অপমান করা হয়। সেগুলো আসলে মিনি সাইজের বস্তা। ভেতরে ঠুসে ঠুসে ঢুকিয়েছিলাম শেষ বেলার বাজারে যে সব সবজি পাওয়া যায়। মানে শুকনো পুঁই, পালং, ছেতরে যাওয়া কুমড়ে, কানা বেগুন, কুঁচকে যাওয়া চিচিঙ্গে আর পটল— এই সব দিয়ে ভরিয়েছিলাম ওই মিনি বস্তা দুটোকে। আজ ভোলাদার বিবাহবর্ষিকী। আমার আর মঞ্জরীর সারা দিনের নেমন্তন্ন। দশটা নাগাদ স্নান সেরে দুজনে যখন উঠে বসেছি বাইকে, ঠিক তখনই আমার মোবাইলে এলো ভোলাদার ল্যান্ড লাইন থেকে ফোনো, ‘ অন্তু! তোরা কি বেরিয়ে পড়েছিস ? যদি না পড়ে থাকিস তো বাজারে একবার যা। হাতের সামনে যত বাসি–পচা তরিতরকারি পাবি, নিয়ে আয়। মানে, যত বেশি সম্ভব পারিস। নিয়ে আয়!’ কিন্তু বাসিপচা তরিতরকারি কোন হোমে বা যজ্ঞে লাগবে? জিজ্ঞাসা করবার আগেই ভোলাদা লাইন কেটে দিল। তারপর যতবার ফোন করি ততবারই একটা কোঁ কোঁকোঁকোঁ শব্দ ওঠে। তার মানে, অন্তুদা ফোনটা রিসিভারের খাপে খাপ বসিয়ে রাখেনি।নেমন্তন্ন বাড়িতে যাবার মুখে কোনও অতিথির কাছে এ আবার কোনদেশি আব্দার! উপহার তো আমরা নিয়েছি। বৌদির জন্য শাড়ি, ভোলাদার জন্য আদ্দির পাঞ্জাবির ছিট। মঞ্জরী আবার এতে সন্তুষ্ট না হয়ে মোড়ের ফুলের দোকান থেকে বিশাল এক রজনীগন্ধার তোড়া বানিয়েছে। মঞ্জরীকে জিঞ্জাসা করলাম, ‘ কিছু কি বুঝতে পারলে? এই ভরদুপুরে বাসি পচা তরিতরকারি দিয়ে কি হবে?’ মঞ্জরী বলল, ‘ দ্যাখো, গ্রামের মানু্ষেরা রাখালটাখালশ্রনীর লোকেরা হয়তো ঝেঁটিয়ে এসেছে। হাজার হলে জমিদার বাড়ি বলে কথা! গ্রামের লোকেদের তো তুমি জানো না। পাঁচজনকে বললে তিরিশজন আসে। ভোলাদার হয়তো ভাঁড়ারে টান পড়েছে। তাই—’ আসলে ভোলাদা, মঞ্জরীর দূরসম্পর্কের দাদা। তাদের পড়তি অবস্থা। কিন্তু , ওই একবার যে ঘি খেয়েছিল, তার গন্ধ বড়াই করে সকলকে শুঁকিয়ে না রাখলে শান্তি হয় না মানুষের। তাই তালপুকুরে ঘটি না ডুবলেও বিশাল বিশাল রুই কাতলা মৃগেল জালে তোলবার গল্প আমাকে প্রায়ই মঞ্জরী শুনিয়ে থাকে। ছেলেবেলায় একবার একটা বিশাল মাছের সঙ্গে নাকি দাড়িপাল্লায় ওকেও তুলে দেখা হয়েছিল, মাছটা কতটা বেশি ভারি। সে সব প্রায় বিশ–তিরিশ বছর আগের কথা। এখন সে পুকুর নাকি গ্রামের মানুষদের শৌচের কাজে লাগে। আজও তাই মঞ্জরী সে সব দিনের গল্প বলতে শুরু করেছে কি করেনি, আমি বললাম, ‘ কিন্তু এই ব্যাগগুলো তোমাকেই সারাটা রাস্তা বইতে হবে। সামনে অত ওজন নিয়ে তো আর বাইক চালানো সম্ভব নয়।’ আমার বৌ মুখ কালো করে ব্যাগগুলো কোলে নিয়ে কোনমতে ব্যালান্স করে বসলো। আমিও ধীর গতিতে বাইক চালাতে লাগলাম। ভোলাদাদের গ্রামটা এমন কিছু দূর নয়। তাই আমরা আধঘণ্টার ভেতরই ভোলাদাদের বাড়ির সদর পেরিয়ে দরজায় কারাঘাত করতে না করতে শশব্যস্ত ভোলাদা বেরিয়ে এসে আমাদের হেফাজত থেকে ব্যাগদুটোকে একরকম ছিনিয়ে নিলো। তারপর জোরকদমে হেঁটে অদৃশ্য হয়ে গেল ভেতরে। পিছন পিছন গিয়ে আমরা ওই বাড়ির বিশাল উঠোনে পড়তে না পড়তেই দেখি, সাদা, কালো একগাদা কোন প্রাণী সেখানে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। তাদের সামনে ব্যাগ থেকে সবজিগুলো বের করে ফেলে ভোলাদা অদ্ভুত স্নেহ মাখা গলায় বললো, ‘এই নে। তোরা খা খা খা—’ অমনি প্রাণীগুলো সেই সবজির পাহাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাঁচসাত মিনিটের ভেতর সেগুলো সাফ করে ফেলল! ততক্ষণে মঞ্জরী ভয় পেয়ে আমার শার্টের পিছনটা খামচে ধরেছে। বেশ বুঝতে পারছি, আমার কপালেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। কিন্তু প্রাণীগুলো কি? আর এরা এমন বুভুক্ষ হয়েছে কি করে! এদের সঙ্গে আমাজন নদীর পিরানহা মাছের সঙ্গে তুলনা হয়। তবে এরা নিরামিষভোজী পিরানহা। গুনে দেখি প্রাণীগুলের সংখ্যা কমপক্ষে ষাট কি সত্তর। এরা কেন এই বাড়ির উঠোনে? এদের দিয়ে কি হবে? সব চেয়ে বড় কথা এগুলো কি ধরণের প্রাণী? পিছন থেকে আর্তস্বরে মঞ্জরী জানতে চাইলো, ‘ ছোড়দা, এগুলো কি ? এদের এখানে পুষছো কেন?’ ভোলাদা মুখটাকে উদাস করে বললো,‘ সত্যিই মঞ্জু, তুই গোল্লায় গিয়েছিস। অন্তু শহুরে মাল। সে না হয় ভেড়া চিনতে পারে না। তা বলে তুইও পারবি না। ছি:!’ তারপর আমার দিকে ফিরে ভোলাদা উদ্বাসিত মুখে বললো, ‘ ভেড়ার দুটো ইংরেজি নাম আছে। বল্ দেখি!’ আমি হতচকিত হয়ে মাথা চুলকোচ্ছি দেখে ফের সে বললো, ‘ যাহ্! তুইও দেখছি লেখাপড়া সব ভুলে মেরে দিয়েছিস। ভেড়ার একটা ইংরেজি নাম ল্যাম্ব, আর একটা শিপ।’ তারপর গলা নামিয়ে বললো, ‘ কিছু মনে করিস না বাবা। আমিও কি ছাই জানতাম! আজ সকালে যদু মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলে দিলে। ল্যাম্ব মানে ভেড়া। আবার শিপ মানেও ভেড়া! বুঝলি? আমি বেশ কিন্তু কিন্তু করেই জিজ্ঞাসা না করে পারলাম না, ‘কিন্তু এতোগুলো ল্যাব আর শিপ দিয়ে তুমি কি করবে ভোলাদা?’ ভোলাদা ফের মুখটাতে একটা গর্বের হাসি ঝুলিয়ে বললো, ‘ কি করবো মানে? এই ল্যাম্বশিপের দল আসলে কি জানিস? এরা হলো জীবন্ত সারের কারখানা! কি বুঝলি! জী— বন্ত— সারে— রের্র কারখানা, হ্যাঁ একদম কারখানাই।’ আমাদের ভেতর যাদের ছেলেবেলা গ্রামট্রামের দিকে কেটেছে, তাদের তুলনায় বড়রা একটা ধাঁধা জিজ্ঞাসা করতো— হরেকরকম বা জিওবা জিতৈরি রকার খানা! এর মানে কি? কয়েকবার ঠকতে ঠকতে শেষে আমরা জানতাম, ওটা আসলে ‘হরেকরকম বাজি ও বাজি তৈরির কারখানা’। কথাটার নানা বেজায়গায় স্পেশ দিয়ে সেটাকে বোধগম্যতার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভোলাদার শেষের কথাটাও সেরকমই। যেহেতু আসল কথাটা আগেই বলে দিয়েছে, তা না হলে ওই ‘জী— বন্ত— সারে— রের্র কারখানা’— কথাটা গোড়ায় বললে বুঝতে খুব অসুবিধে হতো। কিন্তু এরা কি করে জীবন্ত সারের কারখানা হলো? ভোলাদাকে প্রশ্নটা করতেই সে রীতিমত চটে গেল। বললো,‘ তোরা না দিনদিন গবেট হয়ে যাচ্ছিস। সামান্য ব্যাপারটা ধরতে এত সময় লাগছে? ওই ল্যাম্ব আর শিপ, যাই বলিস না কেন, আমার এখানে টানা সাতদিন ধরে গিলেকুটে চলেছে। মানে গিলছে পাহাড়প্রমানই। সেই খাবার, ঘাসপাতালতা আলুকপিমুলোটমেটো এমনকি তোর আনা এই সব শাকপাতা ওদের পেটে গিয়েছে। বোঝা যাচ্ছে তো? গিয়ে তৈরি হচ্ছে দামী সার। এখন ওরা দয়া করে আমার জমিতে গিয়ে পটি করলেই কেল্লা ফতে! এই জৈব ম্যানুয়্যার জমিতে পড়লে ফসফসরাস কে ফসফরাস, নাইট্রোজেন কে নাইট্রোজেন, পটাশ কে পটাশ— মানে জমিতে যা যা লাগে ফসল ফলাতে, সব তৈরি হয়ে যাবে। আর তারপরই সোনার ফসল।’ পিছনে বৌদি কখন এসে দাঁড়িয়েছেন, গোলমালে খেয়ালই করিনি। তাঁর কণ্ঠস্বর বোমার মত ফেটে পড়লো—‘ ভেড়ারা না হয় গিলছেকুটছে। তারা, তার বিনিময়ে কিছু একটা দেবে। কিন্তু ওদের মালিক রামস্বরূপ? সে তো ভেড়াদের চেয়েও বেশি গেলাকোটা করছে। সে কি দেবে তোমাকে যে লোকটাকে চারবেলা খাবার দিতে হবে, ঘণ্টায় ঘণ্টায় চা । এবার তো দেখছি আমাদের ধারকর্জের দায়ে ভিটে ছেড়ে পালাতে হবে!’ ভোলদা বেশ বিব্রত হয়ে বলল, ‘ আহা সতু, তুমি এমন করে চটে যাচ্ছো কেন? বিশ–তিরিশটা তো নয়, একটামাত্র লোক আমাদের বাড়িতে অতিথি। ছোটতরফের কি এত দূরবস্তা, যে একটা অতিথিকে পেট ভরে খেতে দিতে পারবো না? অতিথি নারায়ণ। সে একটু বেশি খেতেই পারে। কতদিন দানাপানি জোটেনি। চেহারাটা দেখে বুঝতে পারছো না। দেখো দেখো, তুমি চোট না। তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে বলো? এবার ধানটা তুলেই সবার আগে তোমার সেই সীতেহারটা...’ বৌদি ততধিক রেগে বললেন, ‘ এই নিয়ে সাতাত্তরবার শুনেছি, এবারই সেই সীতেহার। কিন্তু সাতমন তেল পুড়ো কই আর রাধাই বা নাচলো কই? আমার সীতেহার চাই না। বাপ বিয়ের সময় তিরিশ ভরি সোনা দিয়েছিল। সেগুলো সব জলাঞ্জলি গিয়েছে। ফিরিয়ে আনতে পেরেছো? জমিদারবাড়ি! ছোট তরফ!’ ভোলাদা রীতিমত অপ্রস্তুতে পড়ে মাথা চুলকোতে লাগলেন। বৌদি আর অসহায় লোকটিকে কিছু বললেন না। তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ নাও, তোমাদের আর ল্যাম্ব না শিপ, নাকি সার, তাদের মাহাত্ম্য বুঝতে হবে না। দোতলায় চল। তোমাদের জলখাবার দিয়েছি।’ নির্লজ্জের মত ভোলাদা বললো, ‘ আর রামস্বরূপের জলখাবার? সেটা দিয়েছো নাকি? ওকে দোতলায় পাঠিয়ে দেব?’ বৌদি এমন একটা চোখে ভোলাদার দিকে চাইলেন, সত্যযুগ হলে ভোলাদার জায়গায় কয়েকমুঠো ছাই–ই পড়ে থাকতো। তারপর তিনি মঞ্জরীর হাত ধরে টানলেন, ‘ এসো’। ২ মোটামুটি সব মিটে যাচ্ছিলো। আমরা জলখাবার খেয়ে গল্পগুজব করতাম। বৌদি আমাদের কাছে এর আগেও ভোলাদার নামে প্রচুর অভিযোগ করেছেন। সে সংসারের প্রতি উদাসীন। চাষবাসেও মন নেই। অথচ প্রচুর দানধ্যানের দিকে ঝোঁক। ওদের কোনও সন্তান নেই। আর হবে বলে মনেও হয় না। ভোলাদা এই অজুহাতে স্থাবরঅস্থাবর সবই ফুঁকে দিতে চায়। বৌদি আপত্তি করলে বলে, ‘ কি হবে সতু! এত সব কে খাবে? তুমি আমি চোখ বুঁজলেই তো বিষয়আশয় সাতভূতে লুটেপুটে খাবে। তাই তার আগেই বরং চল, আমরা বিলিয়ে দিই। লোকে আমাদের মরবার পরে নাম করবে— ভোলাবাবু, সতু বৌদি কত ভালমানুষ ছিলেন।’ কিন্তু বিলোতে বিলোতে যে ঘটি উজাড়, তা তিনি মানতে চান না। মাসখানেক আগে বৌদিকে লুকিয়ে ভোলাদা মাঝের মাঠের মাছে ভরা পুকুরটা বেচে একজন ক্যান্সার পেশেন্টকে চিকিৎসার খরচ জোগায়। ধান বেচে টাকা নিয়ে আসতে আসতেও ভোলাদা এত দানদক্ষিণা চালায় যে বৌদির হাতে সামান্য টাকাই শেষে পৌঁছায়। সে দিক থেকে দেখতে গেলে ভোলাদার চাষবাসে যে মতি হয়েছে, ভেড়ার পাল বাড়িতে পোষা আর তাদের পটি দিয়ে সার বানাতে যাওয়াই তার প্রমাণ। সেটাই বৌদিকে বলে স্বান্তনা দেব, ভাবছিলাম। কিন্তু বাদ সাধলো মঞ্জরী! আসলে মঞ্জরীর বেশ রাগ হয়েছিল। কারণ, সে বৌদির জন্য যে রজনীগন্ধার তোড়াটা বিশাল খরচ করে কিনেছিল, সেটাকে পিছনে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কোন ফাঁকে কোন খোক্কস ভেড়া সেটা চুপি চুপি খেয়ে ফেলেছে। বৌদিকে তোড়াটা দিতে গিয়ে সে দেখে, ফুল নয়। মাত্র কয়েকটা ডাঁটাই ধরা রয়েছে মুঠোয়। মঞ্জরী তাই রাগ রাগ গলায় বললো, ‘ ছোড়দা! তুমি খুব শিওর যে এগুলো ভেড়া। মানে এই প্রাণীগুলো ভেড়াই? শিপ বা ল্যাম্ব? কেউ তোমাকে ভেড়া বলে অন্য কিছু গছিয়ে দেয়নি তো?’ এমন চ্যালেঞ্জ ঘর বা পরিবারের একজনের থেকে আসায় ভোলাদা রীতিমত হকচকিয়ে গেল। বললো, ‘ ক্যাক্যা... খ্যানো? এগুলো তো ভেড়াই। ভেড়া রে। আমি কি ভেড়া চিনি না রে?’ মঞ্জরী বললো, ‘ মনে হচ্ছে তোমার কোথাও মস্ত ভুল হয়েছে! এগুলো ভেড়া নয়! অন্য কিছু।’ বিপন্ন ভোলাদা এবার সাক্ষীসাবুত জোগাড়ের চেষ্টা করে হাঁক পড়লো, ‘ আরে রামস্বরূপ না আমস্বরূপ— কোথায় তুই? এখুনি বাইরে আয়। আমার বোনকে বুঝিয়ে বল, এগুলো ভেড়াই। কই? কোথায় গেলি!’ উঠোনময় খাবার খুঁজে বেড়ানো ভেড়াগুলোর চেহারাও কেমন যেন। ওদের গা থেকে লোম এমন করে চেঁছে নেওয়া হয়েছে যে কয়েকটার শরীরে রক্তার্ত ক্ষত। তাদের ফাঁক গলে একটা কালো লম্বা আর রোগা লোক বেরিয়ে এল। বলল, ‘খ্যি হয়েশে বাবুজি? ইতনা হল্লা হলে হামর জানবার ঘবড়ে যাবে। তো তাহলে উদের লাদতে সময় ঔর জাদা লাগবে। সাতদিন সে সাতমাহিনা ভি লাগতে পারে।’ দাওয়ায় দাঁড়ানো বৌদির এই কথা শুনে মুর্ছা যাবার উপক্রম। সাতদিন ভেড়ার পাল পুষতে গিয়ে বাগানের সব গাছপালা গিয়েছে। গোটা গ্রামের খড়বিচুলি খেয়ে সাফা করে দিয়েছে তারা। ফলে ভোলাদাকে ভিনগাঁ থেকে মোটা ভ্যানভাড়া গুনে খড়টড় আনাতে হচ্ছে। ধরা গলায় বললেন, ‘ তোমরা সাক্ষী রইলে। এরপর যদি আমি আত্মহত্যা করি তো সব দোষ ওই লোকটার।’ আমি কণ্ঠস্বর যতটা পারলাম ভারি করে রামস্বরূপের দিকে জ্বলন্ত চাহুনি ছুঁড়ে বললাম, ‘ তুমি হল্লার কি দেখলে হে? ইচ্ছে করলে আমরা এমন হল্লা করবো না, তোমার ইয়েটাও বন্ধ হয়ে যাবে। যা জানতে চাওয়া হয়েছে, তার জবাব দাও। এগুলো কি সত্যিই ভেড়া?’ মঞ্জরী যোগ করলো, ‘ আমি একবার বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার মুখে এই রকমের কিছু প্রাণীকে চরতে দেখেছিলাম। তাদের সঙ্গে যে ছেলেটি ছিল, সে আমাকে বলেছিল, এগুলোর নাম গাঁড়োল। বুঝলে, গাঁ–ড়ো–ল।’ রামস্বরূপের গলায় দেখি এবার কথা বলে উঠলেন খোদ সেক্সপিয়র! সে বলল, ‘ নাম সে কুছু দরকার নাই মাইজি। উরা হামার জানবার আসে। খুব খায়, খুব লাদে। তাই তো রাহিসদের ঘরে ঘরে হামাদের বহুত জরুরত। উশসে ভালো ভালো সার, মতলব কি ফসলের জান বাড়ে। তা যদি হাপনাদের সক্, মতলব সন্দেহ্ হোয় তো হামি আভি উদের লিয়ে নিকলিয়ে যাচ্ছি।’ ভোলাদা এমন চিল চিৎকার করে উঠলেন যে, মনে হলো আকাশই ভেঙে পড়েছে। চিৎকার করে মঞ্জরীকে তিরষ্কার করতে করতে, রামস্বরূপের যেন পায়ে পড়ে গেল—‘ না না না! তুমি কিছু মনে করো না হে রামস্বরূপ। আমার বোন ছেলেমানুষ । কি বলতে কি বলে ফেলেছে। তুমি চল, চল তোমার ঘরে। আমি আসছি। আর তোকেও বলি মঞ্জু। ওরা কি, ওদের আসল নাম কি, তাতে কার কি এসে গেলো? ওরা এখন খাচ্ছে। পরে ঠিক পটিটটি করে নেবে। তুমি চুপ করে থাক না বাপু।’ বলতে বলতে রামস্বরূপের দিকে বাড়িয়ে দিল দামি সিগারেটের প্যাকেট। আর রামস্বরূপ সেটা থেকে একখানা সিগারেট ধরিয়ে হুস হুস করে ধোঁয়া ছাড়তে লাগলো। দৃশ্যটার মধ্যে দিয়ে যেন সে আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিল রাশি রাশি অপমান। আমি ঠিক করলাম, দুপুরের খাওয়া শেষ করেই ফের বাইকে উঠবো আমরা। মঞ্জরীর কয়েকদিন থাকবার কথা ছিল ভোলাদার বাড়িতে। সেটা মনে হয়, আর হবে না। আর জীবনে কোনদিনই ভোলাদার বাড়িতে আসবো না। এমনি করে ডেকে ডেকে অপমান করায় বাইরের লোকেদের দিয়ে। আমি মনে মনে রাগে গরগর করছিলাম। ৩ দুপুরের খাওয়া সেরেই চলে আসবো বলে ভেবেছিলাম ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে সেটা ঘটলো না। কারন বৌদি আমাদের ছাড়লেন না। মুখে বললেন, ‘ তোমরা অনেকদিন পরে এলে। দু–চারদিন না থাকলে আমি বড় কষ্ট পাবো ভাই।’ তবে যা বুঝলাম, বৌদি আসলে ভেড়াতঙ্কে ভুগছেন। ভেড়াদের পাশাপাশি তার মালিকেরও। নিজেদের চোখে দেখলাম, রান্না না হতে হতে ভোলাদা রামস্বরূপকে খেতে দেবার জন্য তাড়া দিতে লাগলেন। বারবার বলতে লাগলেন,‘ ওর খাবার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। সবার আগে ওকে খেতে দাও। বেচারা কতদিন ভাল করে খায়নি। ছোটতরফের জমিদারিতে অতিথি হয়ে একটু যত্নআত্তি যদি না জোটে তো লোকে আমাদের যে দোষ দেবে!’ বৌদি দেখলাম হিরণ্ময় নিরবতা পালন করছেন। দাদার হাজার কথাতেও তিনি রা’টিও পাড়ছেন না। মঞ্জরীকে ইতিমধ্যে বলে দিয়েছেন, ‘ একটা অজানা অচেনা লোকেকে সাতদিন ধরে পাহাড়প্রমান ভাত বেড়ে দিচ্ছি। তারপরও লোকটার পেটে যেন আগুন জ্বলছে। সাতজনের রান্না সাবাড় করে ফের ভাত–তরকারি চাইছে। মাঝেমঝে তো দুপুরে আমারই ভাত জোটে না। চিঁড়ে–মুড়ি খেয়ে থাকতে হয়। তোমার দাদা নিজের ফসল ফসল করে পাগল হয়েছে। আমাকে না খাইয়ে মেরে তবেই বোধহয় শান্তু হবে।’ আরও খবর পেলাম, সবকিছু ঠিকমতই চলছিল। যা জমিজমা রয়েছে, তাতে ভাগচাষিরাই চাষ করে। দাদা চাষের খরচ দেয়। ধান উঠলে আধা–আধা হিসেবে বস্তা ভরে দিয়ে যায় ওরা। হঠাৎ একদিন গ্রামে বসলো কৃষি উন্নয়ণের আসর। জেলা সদর থেকে কৃষিকর্তা এসে গালভরা ভাষণ দিলেন। বললেন, ক্রমাগত রসায়ণিক সার বোঝা ঢেলে ঢেলে জমির উর্বরাশক্তি ক্রমে কমে যাচ্ছে। মাঝেমাঝে জমিতে রসায়ণিক সারের পরিমান কমিয়ে জৈব সার দিতে হবে। কর্তা তো ভাষণ দিয়ে চলে গেলেন। গ্রামের অন্য চাষিরা নির্বাকার হয়ে পুরনো পথে রসায়ণিক সার দিয়েই চাষ শুরু করলেন। কিন্তু ভোলাদা নেচে উঠলেন। খোঁজ নিতে লাগলেন, কোন জৈব সার দিলে মাটির স্বাস্থ্য পুনর্রুদ্ধার হয়। এমন চলতে চলতে কে তাঁকে খবর দিল ভেড়াওয়ালা রামস্বরূপের। ব্যস! দাদা রীতিমত খুঁজে খুঁজে তাকে বাড়িতে এনে তুললেন ভেড়ার পাল সমেত। এবার যতদিন না ওরা খেতে সার মানে পটি ঢলবে, ততদিন চাষআবাদ বন্ধ। এদিকে আমন ধান চাষের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। সেচের জল দেবার সময়ও ফুরিয়ে যাবার পথে। দাদা কেবল ভেড়াদের দিকে তাকিয়ে বসে রয়েছেন। রামস্বরূপকে আস্কারা দিয়ে এতটাই মাথায় তুলেছেন যে সে এখন মোটা জলখাবার, লাঞ্চ, ডিনার উড়িয়ে দিয়ে বলে, তার খাওয়াদাওয়া নাকি ঠিকমত হচ্ছে না। আস্কারা পেয়ে রামস্বরূপ যে কোথায় উঠেছে, তা নিজের চোখেও দেখলাম। শহর থেকে ভোলাদা আর আমার জন্য দামি সিগারেট এনেছিলাম পাঁচ প্যাকেট। আমরা দু–একটা টেনেছি কি টানিনি, রামস্বরূপ খইনি বিড়ি বন্ধ করে সেই সিগারেট ঘণ্টায় ঘণ্টায় পোড়াচ্ছে। দু’দিনে সিগারেট ফুরিয়ে যেতে আমাকে বাইক চালিয়ে গঞ্জ থেকে নিয়ে আসতে হয়েছে মোটামুটি দামি সিগারেট। আর অনেকটা গাঁজা। রামস্বরূপের আবার গাঁজা না টানলে ঘুম আসে না। তার সঙ্গে ভেড়ার পল্টনের পাহাড়প্রমান আহার্য তো আছেই। একদিন দেখলাম, দাদার কাছে বসে বসে রামস্বরূপ বলছে, ‘ এহিসে ভেয় পেইয়ে গেলেন সোটাবাবু। পাটনার ইখ রহিসের বাড়িতে হামার জানবারেরা পুরো ছে’ মাহিনা লাদলো না। উরা কবে লাদবে, তা কি হামি বুলতে পারি? কিষণ ভগমানও বুলতে পারবে না।’ দাদা দেখলাম মিনমিন করে বলছেন, ‘ তাহলে তো আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে! ছ’মাসের খরচ টানা তো আমার সাদ্যের বাইরে!’ নির্বিকার লোকটা বলল, ‘ তা হাপনি ভগমানকে ডাকুন সোটাবাবু্। কিষণজিকে পুজা দিন। ইখন আপনি যদি হামকে আর জানবারদের খিলাতে না পারেন, তো বোলেন, আমি দুসরা জাগহা চলো যাই।হাপনার লুকসান হবে সোচে আমি তো বৈঠে আসি।’ ৪ আমি, মঞ্জরী অসহায় হয়ে দেখছি তো দেখছি, ভোলাদা ভেড়াদের খাওয়াতে খাওয়াতে সর্বশান্ত হয়ে যাচ্ছেন। আমার আর মঞ্জরীর কাছে সামান্য যে টাকা ছিল, তাও উনি একরকম কেড়ে নিয়েছেন। মহাজনদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে কত টাকা যে ধরা করেছেন এই সামান্য কয়েক দিনে, হিসেব নেই। তারাও এখন আর ধার দিতে চাইছে না। বাদবাকি জমিজমাটুকুর দিকে নজর পড়েছে কিছু লোকের। ভোলাদাকে শালীনতা বজায় রেখে যতটা বকতে পারি, আমরা দুজন মিলে বকেছি। কিন্তু দাদা কেমন যেন উন্মাদের মত হয়ে গিয়েছেন। সাতটি কথা বললে একটার উত্তর দেন। তাও হুঁ–হ্যা– না–র বেশি নয়। দুশ্চিন্তায় রাত জেগে জেগে চোখের কোনে কালি পড়েছে। বৌদি যেন কারাগারে বন্দি আত্মা। বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত। তাঁর মুখেও কথা নেই। এক রাতে আমি আর মঞ্জরী মিলে ঠিক করলাম, এই অবস্থা বসে বসে দেখে লাভ নেই। ভোলাদার পালগামির মূল্য আর কত যে দিতে হবে কে জানে। কাল আমরা বাড়ি ফিরে যাবো। দরকার পড়লে সাধ্যমত টাকাকড়ি নিয়ে ফিরে আসবো। বৌদিকে বলতেই, তিনি আমার হাতদুটে চেপে ধরে নিরবে কাঁদতে লাগলেন। সে এক অদ্ভুত কান্না। শব্দ নেই। বিলাপ নেই। বুক ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে। আমি সহ্য করতে পারলাম না। হাত ছাড়িয়ে উঠে পড়লাম। সকালে উঠে দুধ ছাড়া চা খাচ্ছি, কারণ দুধ কিনবার মত দু–পাঁচ টাকাও আর ভোলাদার হাতে নেই, হঠাৎ শুনলাম ওই শিপ, ল্যাম্ব, ভেড়া, মেষ, যে নামেই তাদের ডাকা হোক না কেন, কেমন যেন অদ্ভুত শব্দ করছে— গুরগুবগুরগুব! রামস্বরূপ চিৎকার করে উঠলো, ‘ও সোটাবাবু, সোটাবাবু । জানবারেরা ইবার লাদবে। সলুন সলুন আপনাম খেতিউতিতে।’ ভোলাদা লাফিয়ে উঠলো। রামস্বরূপকে বুকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেললে। তারপর ছুটলো খেতের দিকে। পিছন পিছন ভাড়াওয়ালা। শৃঙ্খলাবন্ধ সৈনিকের মত ভেড়ারা তাদের পিছনে পিছনে চলতে লাগলো। সকলের পিছনে ছুটলাম আমি। তারপর অতগুলো ভেড়া মিলে অদ্ভুত ডাক ‘ভুতভুতভুতভুত’ ছাড়তে ছাড়তে খেতের চারিপাশে ছড়িয়ে পড়ে এক সঙ্গে ডেলিভারি দিতে শুরু করলো জৈব সার। ভোলাদার লোকজন সেই পটির ওপর মাটি চাপা দিয়ে দিতে শুরু করলো তৎক্ষণাৎ। এই জীবন্ত সারের কারখানা থেকে সার ডেলিভারি দিয়ে রামস্বরূপের পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করলো। এবার তাদের গন্তব্য কাটোয়ার কোন গ্রাম। সেখানে নাকি সম্পন্ন কোন চাষি তাদের অপেক্ষায় দিন গুনছে। দাদার খেতে সেবার এত ধান ফলেছিল যে জেলা কৃষি দপ্তর থেকে লোকজন এসে দেখে গিয়ে ভোলাদাকে কি একটা পুরস্কার দিয়েছিল। সেই ধান কিনতে নাকি আমারিকার কোন লোক জলন্ধরের এজেন্টের মারফত টাকা পাঠিয়েছিল। তাতে ভোলাদা নাকি হৃতগৌরব ফিরে পেয়েছিল। গ্রামের মানুষেরা নাকি চাষআবাদ শিখতে ভোলাদার বাড়ি যাতায়াত শুরু করেও ছিল। এই গল্পের এখানেই শেষ। তবে রামস্বরূপের সঙ্গে আমার আরও একবার দেখা হয়েছিল। এই ঘটনার প্রায় পনেরো বছর পর, কলেজস্ট্রিটের লাগোয়া বেনিয়াটোলা লেনের মুখে দাঁড়িয়ে আছি বাসের অপেক্ষায়। প্রকাশকের ঘর থেকে আজ রয়্যালটি মত দুর্লভ বস্তুটি হাতে এসেছে। লেখক হিসেবে একটু আধটু নামডাকও হয়েছে। মনটা বেশ ফুরফুরে। হঠাৎ দেখি, দশ–বারোটা ভেড়া কফিহাউসের গলিটা দিয়ে বেরিয়ে এসে ঠেলাঠেলি করতে করতে সেই গলিতে ঢুকছে। তাদের অতর্কিত আগমনে আর এটাওটায় মুখ দিতে শুরু করায় চারিদিকে হল্লা শুরু হয়েছে, এমন সময় আমার ভেড়াদের খেদিয়ে নিয়ে আসা লোকটির দিকে নজর পড়লো। আরে, এতো সেই রামস্বরূপ! কিন্তু কলকাতা শহরের বুকে কোথায় জীবন্ত সার ডেলিভারির কাজ উপস্থিত হলো? কৌতুহল সামলাতে না পেরে ডাকলাম, ‘ রামস্বরূপ, ও ভাই রামস্বরুপ। চললে কোথায়? এখানে কোন খেতে সার ঢালবে?’ রামস্বরূপের চেহারাটা দেখলাম বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছে। অনেকটা যেন বুড়ো হয়েছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে চিনতে পেরে বললে, ‘ রামরাম বাবু? সোটাবাবু, বহুদিদি সব ভাল আসেন তো?’ তাঁদের কুশলসংবাদ দিয়ে ফের প্রশ্নটা করলাম, ‘ এখানে কোথায় খেত পেলে যে ভেড়াদের নিয়ে যাচ্ছো?’ রামস্বরূপের দাঁড়াবার উপায় ছিল না। লোকে ততক্ষণে মার মার করে তেড়ে আসছে। ভেড়াদের নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘ আগলা জমানা বিত গ্যয়া বাবুজি। আভভি কেউ আর হামার জানবারদের লাদাতে ডাকে না। কঁহি ভি না। জানবারলোককে খানে নহি দে সকতে। মরে পেটভি ভুখা। তাই ইগুলো লিয়ে কসাইখানায় বেচতে যাস্সে বাবু। কুছু রুপইয়া যদি মিলে।’ জীবন্ত সারের কারখানার এই মর্মান্তিক পরিনতিতে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
Subscribe to:
Posts (Atom)
0 comments:
Post a Comment