সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

 


ঘুম 

অহনা মুখার্জী 

রাত সাড়ে বারোটা, অ্যালার্ম ক্লকের বুকে নিওন লাইটে লেখা জ্বলজ্বলে সময়টা আর একবার পড়ে নেয় দিয়া, আজ নিয়ে প্রায় পাঁচ দিন হল কিছুতেই ঘুম আসছে না ,বলা ভালো ঘুমোতে পারছেনা নিশ্চিন্তে, দুচোখের পাতা এক করলেই সেই বিদঘুটে স্বপ্নটা ভেসে আসছে বারে বারে, অন্ধকার রাত্রি ,পিচ বাঁধানো প্রশস্ত নিঝুম রাস্তা দিয়ে একা হাঁটছে দিয়া, মাঝে মাঝে ভুতুড়ে কুয়াশার দল উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক, ভারি চেনা রাস্তাটা ,কিন্তু কিছুতেই চিনতে পারছে না যেন, কোথায় যে দেখেছে !আরে, রাস্তার ঠিক মাঝখানেই কি যেন একটা পড়ে আছে না উল্টে ,দৌড়ে দেখতে যায় দিয়া ,একি! এ যে দিয়ার সাধের বাইসাইকেলটা ডি লেখা কি চেনটা পর্যন্ত লাগানো রয়েছে যথাস্থানে। ইস! কিরকম মুখ থুবড়ে পড়ে আছে মাটিতে, হ্যান্ডেলের কাছটা সামান্য তুবড়ানো বলেও মনে হল যেন ।যাই হোক, সাইকেলটাকে তুলে দাঁড় করাতে যায় দিয়া, হাতে কিছু একটা ভেজা ভেজা ঠেকছে না ,চাঁদের আলোয় ভালো করে নিজের হাত দুটো মেলে ধরে ,হাতে লেগে থাকা কালচে লাল তরল পদার্থটা আসলে কি? সামান্য থমকালেও চিনতে ভুল হয় না দিয়ার, রক্ত! দৌড় ,দৌড়, দৌড় প্রাণপণে দৌড় লাগায় দিয়া, যেই হোক কিছুতেই ধরতে পারবে না দিয়াকে। আজ অবধি কেইবা দৌড়ে ধরতে পেরেছে দিয়াকে! যাক, এবার মনে হয় আর কেউ পিছু ধরছে না, কোনরকমে পায়ের ব্রেক কষলো দিয়া।নিঃশ্বাস নিল জোরে জোরে,রীতিমত হাফাচ্ছে !উফ, ফুসফুস ফুটো মনে হয় এবার ফেটে যাবে! দিয়ার ঠিক মাথার উপরেই একখানা ঝাঁকড়া নিম গাছ চারিধার অন্ধকার করে রেখেছে ।

সামান্য ইতস্তত করল দিয়া,  একটু বসতে পারলে ভালো হতো, হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে, কেমন যেন দমবন্ধ লাগছে, সামনের দিকে তাকাতেই শিরদাঁড়া দিয়ে এক ঝলক হিমেল স্রোত বয়ে গেল দিয়ার। গ্রেভইয়ার্ড !কবরখানা! সম্মোহিতের মত কবরখানার দিকে এগিয়ে গেল দিয়া, হাত পা মুখ কোন কিছুই আর বসে নেই ,ভেতর থেকে একটা চাপা কন্ঠের গোঙ্গানিও যেন শোনা যায় না ?সামনে একটা আধভাঙ্গা শ্বেতপাথরের টোম্ব স্টোন পড়ে আছে, গোঙ্গানির আওয়াজটাও যেন ওই দিক থেকেই আসছে বলে মনে হয়। পায়ে পায়ে এগোলো দিয়া, টোম্ব স্টোনের সামনে এক রহস্যময়ী পুরুষ মূর্তি বসে রয়েছে মাথা নিচু করে ।চেহারার গড়ণ আর পরনের সাজ পোশাক দেখে দিয়ার বয়সী কোন কিশোর বলেই মনে হয়। ওই রহস্যময় মূর্তি কি দিয়ার উপস্থিতি টের পেয়েছে? গোঙানির শব্দ বন্ধ হল যেন, ধীরে ধীরে মাথা তুলছে ওই মূর্তি, গলায় ধারালো কোন কিছু দিয়ে আঘাত করার রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্নটা এখনো দগদগ করছে !ভারী কষ্ট করে হাতটা তুলল ছেলেটা, ফ্যাকাশে ঠোঁটে সামান্য হাসির রেখা ,অঙ্গুলি নির্দেশ করে কি বোঝাতে চাইছে দিয়াকে? কোনরকমে এগিয়ে যায় দিয়া, সামনে একটা বড় টোম্ব স্টোন ,দেখে নতুন বলে মনে হয় !কবর ফলকের ওপর বড় বড় আদ্যক্ষরে মৃত ব্যক্তির নাম লেখা ,ভালো করে খুঁটিয়ে পড়ে দিয়া, নাম দিয়া গোমস, জন্ম 2003 ,মৃত্যু 2021, বয়স ষোলো বছর! তারপরেই ঘুমটা ভেঙে যায় দিয়ার, ধড়মড় করে উঠে বসে বিছানায়, সারা রাত্রি আতঙ্কে কিছুতেই দুচোখের পাতা এক হয় না ।উফফ! কি যে বিপদে পড়েছে দিয়া, মাম এর সঙ্গে এসব কথা শেয়ার করার কোন মানেই হয়না, এমনিতেই বাপির ট্রান্সফার হওয়ার পর থেকেই বেশ প্রেসারে আছে মাম। হাজার হোক ঘরের সব কাজকর্ম এখন বেচারীর একার ঘাড়ে, এখন এই ধরনের কমপ্লেন নিয়ে মাম এর কাছে গেলে হয়তো রেগেমেগে বলে উঠবে 'রাত জেগে হোল নাইট হরর মুভিস দেখলে আর ব্লাড ভায়োলেন্স এর গেম খেললে ওই রকমই হয়'। পাশের বেডে ডেভিড অঘোরে ঘুমোচ্ছে, নাঃ, ডেভিডকেও বলে কোন লাভ নেই, কাজের কাজ তো কিছু করবেই না উল্টে হয়তো দিয়াকেই সাইকো  ঘোস্ট ফোবিক আরো কি কি সব বলে বেড়াবে। কি দরকার বাবা! কিন্তু ব্যাপারটা যে আর ইগনোর করার পর্যায়ে নেই সেটা বোঝার ক্ষমতা দিয়া আছে ।এইরকমই একটানা চলতে থাকলে হয়তো  এবার সত্যিই মাথা খারাপ হয়ে যাবে দিয়ার ।উফ, সেদিন কি কুক্ষণেই যে দিয়া গ্রেভ ইয়ার্ড এর ভেতর দিয়ে সাইকেল চালানোর চ্যালেঞ্জটা একসেপ্ট করেছিল !

আসল ঘটনার সূত্রপাত, প্রায় এক সপ্তাহ আগে, সাইকেল চালিয়ে স্কুল থেকে ফিরছিল ওরা তিনজন, দিয়া, মোনালিসা আর শিরিন। মনটা বেজায় খুশি খুশি, ওদের প্রধান রাইভ্যাল স্কুল সেন্ড থমাস এর ডাকসাইটে ফুটবল টিমকে প্রায় তিন গোলে হারিয়েছে আজ, তার মধ্যে দিয়ার মেজাজ আরো ফুরফুরে ,কারণ আজকে বেস্ট প্লেয়ার এর খেতাবটি সেই জিতেছে। তিন বান্ধবীর সাইকেল দিব্যি  চলছে গড়গড়িয়ে ,হঠাৎই শিরিন ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। যথারীতি তার দেখাদেখি দিয়া আর মোনালিসাও দাঁড়িয়ে পড়েছে, 'কিরে শিরিন, কি হলো?' প্রশ্নের উত্তর দেয় না শিরিন, কোমর সমান চুলের বেনি দুটো দুলিয়ে বেশ নাটকীয় ভাবে বলে ওঠে, 'আচ্ছা, আমাদের দিয়া তো শুনেছি এক্সপার্ট সাইক্লিস্ট, আমার দেওয়া একটা একটা টাফ চ্যালেঞ্জ একসেপ্ট করতে পারবি? গ্রেভ ইয়ার্ড এর ভেতর দিয়ে সাইকেল চালাতে পারবি ?'গ্রেভ ইয়ার্ড এর ভেতর দিয়ে সাইকেল চালানো,  হুম, কবরখানার ভেতরে প্রত্যেকটা কবরফলকের মধ্যে মাত্র ইঞ্চিখানেকের অন্তর  ,শ্বেতপাথরের ঢাউস সাইজের কবরফলক গুলোর কোনোটাতে সাইকেল শুদ্ধ ধাক্কা মারলেই কেলেঙ্কারি! 

নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ, তবে বন্ধুর চ্যালেঞ্জ একসেপ্ট না করাটা রীতিমতো অপমানজনক! তাই শেষমেষ রাজি হয়ে যায় দিয়া। এমনিতেই দিয়াদের স্কুল থেকে ফেরার সময় বেশ ফাঁকাই থাকে এ রাস্তাটা, তবুও সাবধানের মার নেই, ভালো করে দেখে নেয় চারপাশ, যাক্, কেউ নেই! নয়তো বড়দের কেউ তাদের এই কান্ড ঘটাতে দেখলে যাচ্ছেতাই কেস হয়ে যাবে! কবরখানার গেট খুলে আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকলো দিয়া, ফাঁকিবাজ সিকিউরিটি গার্ডটা এখন নেই, এই সুযোগ, সাবধানে সাইকেলটার ওপর ব্যালেন্স নেয় সে, আগের দিন রাতের বৃষ্টিতে কাদামাটি বেজায় পিচ্ছিল হয়ে আছে, সামান্য অসাবধান হলেই ব্যালেন্স হারিয়ে মাটিতে পড়ে বেকায়দায় হাত পা ভাঙতে আর কতক্ষণ! একটু ডানদিক, একটু বাঁ দিক, ব্যাস ব্যাস আরেকটু, এমন সময় ছন্দপতন! একটা টোম্ব স্টোনের সঙ্গে জোরে ধাক্কা খেয়ে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে দিয়া !সেই ধাক্কায় দিয়ার বিশেষ ক্ষতি না হলেও পুরনো শ্বেতপাথরের ফলকটা লোহার সাইকেলের গোঁত্তা ত্সামলাতে না পেরে ভেঙে পড়েছে হুড়মুড়িয়ে, যাই হোক সেদিনের মত তিনজনেই সুবোধ বালিকার মত যে যার বাড়ি ফিরে গেল চুপচাপ, কি দরকার বাবা, বেশী ঝামেলা করে তারচেয়ে ঘরের মেয়েদের ভালোয় ভালোয় ঘরে ফিরে যাওয়াই কি উচিত নয় !তবে ঘরে ফিরে আসলেও ,সমস্যা যে তার পিছু ছাড়েনি সেটা বেশ ভালোমতোই মালুম হচ্ছে দিয়ার ।ভূত-প্রেতে তার বিশ্বাস নেই কোনোকালেই ,তবুও আজকাল কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে, উফ ,এখন যে কি করে দিয়া!


 মেয়ের মতিগতি আজ কাল কিছুই বুঝতে পারছে না নাতালিয়া, এমনিতে দিয়া খুবই চিয়ারফুল আর ইন্টালিজেন্ট গার্ল তাতে কোন সন্দেহ নেই।কিন্তু, আজকাল যে কি হয়েছে মেয়েটার ,কোনই কিছুতেই মন নেই না পড়াশোনা না খেলাধুলা ।চেহারাটারও অবনতি হয়েছে খুব ,চোখের নিচে ঘন কালি, চুল সবসময় উস্কোখুস্কো, ইদানিং ক্লাসে বসে ঢোলা শুরু করেছে বলে খবর এসেছে! প্রথমে অবশ্য নাতালিয়া এসবে বিশেষ পাত্তা দেয়নি, ভেবেছিলো বাপি ট্রান্সফার হয়ে দূরে চলে যাওয়ার আফটার এফেক্টএ ভুগছে মেয়ে ,সেইমতো ফোনে স্কাইপে রেগুলার এড্রিক এর সঙ্গে কথাও বলিয়েছে দিয়ার, লাভ হয়নি কিছু ,সবথেকে অবাক ব্যাপার ইদানিং দিয়ার ফেভারিট মুচমুচে আলুরপরোটাগুলো পর্যন্ত ব্রেকফাস্ট টেবিলে নেতিয়ে পড়ে থাকে, টক-ঝাল-মিষ্টি তেঁতুলের চাটনিটাও আর মন ভালো করতে পারে না দিয়ার! ঝাল ঝাল চিকেন পকোড়া কিংবা মিষ্টি মিষ্টি চকলেট কুকিজের ভাগ নিয়ে আর মারপিটও করে না ডেভিডের সঙ্গে! দিয়ার মনের হাল জানতে অবশ্য কম কসুর করেনি নাতালিয়া। দিয়ার স্কুলের টিচার, ফুটবল কোচ, মায় বন্ধুদের সঙ্গেও আলাদা করে কথা বলেছে ফোনে, নিট ফল জিরো ,কেউ কিছুই বলতে পারেনা। অনেকে তো উল্টে নাতালিয়াকেই ব্যাক কোয়েশ্চেন করে, যে কি হয়েছে দিয়ার। এমনকি দিয় র সঙ্গেও আলাদা করে কথা বলার চেষ্টা করেছে নাতালিয়া, কোন উত্তর দেয়নি মেয়ে হাসিমুখে এড়িয়ে গেছে মায়ের প্রশ্ন! ওফ, হাসিখুশি মেয়েটার মাথায় যে হঠাৎ কিসের ভূত ঢুকলো, কে জানে!

 নিজের রুমে অস্থির ভাবেই পায়চারি করছিল দিয়া, কপালে গোটাকয়েক চিন্তার ভাঁজ। দু সপ্তাহ বাদেই ইন্টার স্কুল গার্লস ফুটবল টিমের জন্য সিলেকশন শুরু হয়ে যাবে স্কুলে, তাছাড়া ফাইনাল এক্সামএর বেশি দেরি নেই ,কিন্তু কয়েকদিন যাবত্ কোন কিছুতেই ভালো করে মন দিতে পারছে না দিয়া!

ইদানিং মাম বেশ টেনশনে থাকছে দিয়াকে নিয়ে, ঠারেঠারে প্রশ্নও করেছে কয়েকবার, বন্ধুমহলেও গুজগুজ ফিসফাস, মোনালিসা শিরিন থেকে ক্লাসের সকলেই বেশ অবাক দিয়ার আচরণে! ডেভিড মুখে কিছু না বললেও সেও যে দিয়াকে নিয়ে বেশ ওয়ারিড, সেটা তার চোখ মুখ দেখলেই বোঝা যায়। আসলে ওই বিদঘুটে স্বপ্নটার জন্যই, কি করে দিয়া সবাইকে বোঝায় যে রাতের পর রাত তার ঘুম হচ্ছে না! নাঃ! এর একটা বিহিত করতেই হবে দিয়াকে,চটজলদি,  দেওয়ালে লাগানো ওয়াল ক্লক্এ সময়টা দেখে নেয় দিয়া, ঠিক সাড়ে এগারোটা, এমনিতেই মাম আজ বাড়িতে নেই জিয়া আন্টির বাড়ি সিল্প ওভার করতে গেছে। ডেভিডও গেছে সঙ্গে, এই সুযোগ, আর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই রাস্তাঘাট একেবারে ফাঁকা হয়ে যাবে ,তখনই বেরিয়ে পড়বে দিয়া।

 দেখাই যাক না ওই বিশ্রী দুঃস্বপ্নটা র কোন ওষুধ বের করতে পারা যায় কিনা! রাত সাড়ে বারোটা ,ফাঁকা পিচ রাস্তা দিয়ে তুফান গতিতে সাইকেল চালিয়ে চলেছে দিয়া, সোয়েটার মাফলার জিনসে আপাদমস্তক মুড়ে বেরোলেও, হিমেল হাওয়া যেন শরীরে সুঁচ ফুটিয়ে যায়, দলা দলা কুয়াশার জন্য কিছুই ভাল করে ঠাহর করা যায় না !সামনে কি আছে ঠিক  বোঝা যাচ্ছে না! ভাবতে না ভাবতেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে দিয়া, আসলে হিম্এ ভেজা রাস্তাটা এমন বিশ্রী রকমের পিচ্ছিল হয়ে আছে না, বেকায়দায় স্লিপ কেটে গেছে। মাথাটা শক্ত কোন কিছুতে মনে হয় ঠুকে গেল, জোর লেগেছে দিয়ার। কেমন যেন একটা ঘোর-ঘোর লাগছে, মাথাটা ফাটলো বুঝি? কতকটা জোর করেই উঠে দাঁড়াল দিয়া, কেমন যেন একটা নেশার মত লাগছে, গন্তব্যস্থল অবধি পৌঁছতেই হবে যেমন করেই হোক। 

শরীরটা যেন ভারী হালকা, বারকয়েক সাইকেলটা তোলার চেষ্টা করল দিয়া সাইকেলটা যেন বড্ড ভারী বলে মনে হচ্ছে আজ যাগ্গে আপাতত পড়ে থাকুক এখানে, যাবার সময় না হয় তুলে নেওয়া যাবে। কতকটা সম্মোহিতের মত এগিয়ে চলেছে দিয়া, একেবারে দিগ্বিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে, তবে কি সত্যিই কেউ হিপনোটাইজ পড়ছে দিয়াকে? রাস্তার ওপরে নিস্তব্ধ কবরখানাটা ভূতের মত দাঁড়িয়ে আছে, জং ধরা লোহার গেটটা টপকে ভেতরে ঢুকলো দিয়া, তখন ধরে কি একটা রাতচরা পাখি ক্যায়া ক্যায়া করে ডেকে চলেছে, কারও উপস্থিতি টের পেয়েছে কি? গাটা কেমন যেন ছমছম করে উঠল দিয়ার, কোনরকমে টর্চটা বের করল পকেট হাতড়ে, নাঃ! সামনের কাঁচটায় সামান্য ফাটল ধরা ছাড়া বিশেষ কোন ক্ষতি হয় নি টর্চটার। মোটামুটি ঠিকঠাকই কাজ করছে। 

দিয়া সুইচ টিপে আলো জালাল, টর্চের গোলাকার আলো কবরখানার এক খাবলা জমিতে ছড়িয়ে আছে।উঁহু , এদিকে নয় টর্চের ফোকাস অন্যদিকে ঘোরায় দিয়া। একটা তীব্র টান অনুভব করছে দিয়া, একটা অদ্ভুত আকর্ষণ কোন এক অদ্ভুত শক্তি যেন দিয়াকে টেনে নিয়ে চলেছে তার গন্তব্যের দিকে। সহসা দাঁড়িয়ে পড়ে দিয়া সেই টোম্ব স্টোনটা এখনো পড়ে রয়েছে আধভাঙ্গা অবস্থায়। মাটিতেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে দিয়া, কতকটা জিগ্স পাজল খেলার মত করে শ্বেতপাথরের ভাঙ্গা টুকরোগুলোকে জোড়া দিচ্ছে একে অপরের সঙ্গে, এইতো এবার মনে হয় মোটামুটি পড়া যাবে, টর্চটার ফোকাসটা আরেকটু বাড়িয়ে নেয় দিয়া, শ্বেত পাথরের কবর ফলকে বড় বড় আদ্যক্ষরে মৃত ব্যক্তির নাম ঠিকানা লেখা, কেবিন মেকামিস্টার, জন্ম 1968, মৃত্যু1984। ইস! মাত্র ষোলো বছর, মানে প্রায় দিয়ার সমবয়সী, মনে মনে এক হাসিখুশি কিশোরকে কল্পনা করে দিয়া। কবর ফলকের ওপর বড় বড় আদ্যক্ষরে লেখা আর আই পি শব্দটাও নজর এড়ায়নি দিয়ার। আর আই পি অর্থাৎ রেস্ট ইন পিস সত্যি তো মাটির নিচে যে বহু বছর ধরে ঘুমিয়ে আছে তার শান্তিভঙ্গ করাটা কি আদৌ ঠিক কাজ হয়েছে? 

আবারও গা টা ছমছম করে ওঠে দিয়ার, কারো যেন উপস্থিতি টের পাচ্ছে দিয়া, সে রয়েছে খুব কাছেই কোথাও, তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়াতে যায় দিয়া, গতিক ভালো ঠেকছে না মোটেই, তাড়াতাড়ি পালাতে হবে !আরে, তাড়াহুড়োতে দিয়া এতক্ষণ নাম খেয়ালই করেনি টোম্ব স্টোনের উপরের গোলাকার অংশটা মিসিং! কোথায় গেল টুকরোটা? যাক, দিয়ার কি দরকার অতশত ব্যাপারে মাথা ঘামিয়ে, এখন ভালোয় ভালোয় বাড়ির মেয়ে বাড়ি ফিরতে পারলে_ পিছন থেকে হঠাৎ কোনো কিছুর আঘাতে মাথাটা যেন একেবারে ঘুরে গেল দিয়ার ।একবারের জন্য যেন মনে হলো শ্বেত পাথরের টুকরো, ব্যাস, তারপরেই সব অন্ধকার! অনেকক্ষণ বাদে যেন ঘুম ভাঙলো দিয়ার, মাথাটা প্রচন্ড ভারী ভারী লাগছে বলে মনে হল যেন। একি আবার সেই কবর খানার পাশের রাস্তাটা, তারমানে আবার সেই বিদঘুটে নাইটমেয়ারটা !

 রাস্তা ধরে এলোপাথাড়ি দৌড় লাগায় দিয়া, ছুটতে ছুটতে নিজের রক্তমাখা সাইকেলটাও দেখতে পায় পড়ে রয়েছে যথাস্থানে, আর একটু বাদেই গ্রেভ ইয়ার্ড ,কেমন যেন একটা গোঙানির শব্দ শোনা যায় না? সেই রহস্যময় পুরুষ' মূর্তি ইশারায় কি বোঝাতে চাইছে দিয়াকে? পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে দিয়া, নির্দেশিত কবর ফলকের দিকে, দিয়ার নাম লেখা কবর ফলকটা অন্ধকারেও বেশ পড়া যায়, নাম দিয়া গোমস বয়স ষোলো বছর জন্ম বারোই নভেম্বর 2001,মৃত্যু দোসরা জানুয়ারি 2021। তার নিচেই বড় বড় অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে একটা শব্দ, আর আই পি রেস্ট ইন পিস অর্থাৎ শান্তিতে বিশ্রাম করো ।নিমেষের মধ্যে ব্যাপারটা দিয়ার কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায় ।চিরকালের জন্য ঘুমোতে যাওয়া মানুষের বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটানোর শাস্তি পেয়েছে সে, আসলে দোসরা জানুয়ারির রাত্রে শ্বেত পাথরের টুকরোর একটা আঘাতেই দিয়ার সমস্ত স্পর্ধা শেষ করে দেয় ওই রাতের বাসিন্দা! প্রাণপণে কান্না চাপার চেষ্টা করে দিয়া, ধীরে ধীরে নিজের কবরের দিকে এগিয়ে যায় সে, এখন তার ঘুমের সময় এসেছে নিশ্ছিদ্র বিশ্রাম।

0 comments: