সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

 বকুলদের বনভোজন

তনুজা চক্রবর্তী


ঘড়ির কাঁটা তখনও ছয়ের ঘর ছুঁতে মিনিট দশেক বাকি আছে, বকুল কোনোরকমে খুব ধীরেসুস্থে গায়ের লেপটা সরিয়ে মায়ের পাশ থেকে উঠে সোজা জানলার কাছে পৌঁছে গেল। কোনো আওয়াজ না করে জানলার একটা পাল্লা খুলে দেখার চেষ্টা করল বাইরেটা ঠিক কতটা পরিষ্কার হয়েছে।  এমনিতেই শীতের সকাল রহস্যময়,কুয়াশা সরিয়ে মুখ বার করতে সূর্যিমামারও বেশ কষ্ট হয়। যাইহোক শেষপর্যন্ত পৌনে সাতটা নাগাদ কুয়াশার চাদর সরিয়ে তিনি মুখটা দেখাতেই বকুল একছুটে পৌঁছে গেল বাড়ির পেছনের মাঠের পোড়ো ঘরটায়।

সারারাত উত্তেজনায় ঘুম হয়নি তার। উত্তেজনার যথেষ্ট কারণ আছে, একে তো বনভোজনের আনন্দ; তারসঙ্গে নিজেরা রান্না করবে বড়োদের সাহায্য না নিয়েই। 

কেবল ভাবনা একটাই, তাদের দলে একটা খ্যাপা ছেলে আছে , যার মাথার পোকা গুলো এই ঠিক থাকে তো পরক্ষণেই বিগড়ে যায়। সম্পূর্ণ গোছানো একটা কাজ নিমেষের মধ্যে ভেস্তে দেওয়ার ব্যাপারে সে একাই একশো। প্রতিবছর বনভোজনে কিছুনা কিছু অকাজ তাকে করতেই হবে। তারপর আবার নিজেই দায় স্বীকার করে নিয়ে পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেবে সবকিছু। কেউ বুঝতেই পারবেনা কী করে কী ঘটল!

বকুল যা ভেবেছিল ঠিক তাই। প্যাঙা সূর্যি মামারও আগে ঘুম থেকে উঠে সেই পোড়ো ঘরটায় ঢুকে তার নিজের হাতে তৈরি করা উনুনটা ভেঙে রেখে গেছে। 

বকুলের তো মাথায় হাত, কী হবে এবার? তাদের মধ্যে একমাত্র প্যাঙাই পারে মাটির উনুন তৈরি করতে । তাকে যদি গতবারের মত আর খুঁজে না পাওয়া যায় তখন কী হবে!একা একা ভেবে কিছুই করতে পারবে না সে, সবাই আগে আসুক একটা সমাধান ঠিক হয়ে যাবে। তার ভাবনার মাঝে হঠাৎই একটা পায়ের শব্দ পেয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই সে দেখতে পেল প্যাঙা তার কালো পাথরে খোদাই করা শরীরটা নিয়ে সেখানে হাজির । দূর থেকে তাকে হাসতে দেখে বকুলের খুব রাগ হল।  সে জানতে চাইল, “ উনুনটা ভাঙলি কেন?এখন কী করে রান্না হবে? তোর এইসব পাগলামো আমার একদম ভালো লাগে না।“

কথাগুলো শুনেও তারমধ্যে কোনোরকম হেলদোল না দেখে বকুল নিজেই কেঁদে ফেলল। কাল থেকে তারা কত কষ্ট করেছে, সেটা তো প্যাঙা জানে। বালু, পচা, নিমকি, ঘটা,পুঁটি, ঝুমুর, নুপুর, ইয়া, নন্দে সবার বাড়ি ঘুরে ঘুরে রাজি করাতে হয়েছে তাদের বাবা-মায়েদের। চাল, আলু,তেল,সবজি জোগাড় করতে হয়েছে সবার কাছে চেয়ে চিন্তে। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়েছে ডিমের জন্য টাকা আদায় করতে। পুঁটির পিসি পাঁচ টাকা দিতে এত কথা শোনাল যেন তার পুরো সম্পত্তিটাই চেয়েছিলাম আমরা। এতসব কিছু হবার পরেও এমন একটা কান্ড ঘটানোর কথা কী করে মনে হল তার!

বকুল আর কিছুই বলল না, নিজের মনে গজগজ করতে করতে বাড়িতে ফিরে সোজা তার ঠাকুমার কাছে গিয়ে বলল, “তুমি তো উনুন তৈরি করতে জানো , এখনই আমার সঙ্গে মাঠে চলো উনুন বানাতে হবে।“ ঠাকুমা তখনও কাঁথার বাইরে বেরোতে পারেনি, সাত সকালে নাতনির আব্দার শুনে বলল,”যতক্ষণ না রোদের তেজ বাড়বে ততক্ষণ অবধি আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়, আমার বয়সটা কী তোর থেকেও কম মনে হচ্ছে নাকি রে দিদিভাই?তারপর ঠান্ডা লেগে হাঁফানির টানটা যদি বেড়ে যায় তখন কে সামলাবে?

” সত্যিই তো, বকুল তো জানে টান বাড়লে ঠাকুমার কত কষ্ট হয়, মনে হয়ে এইবুঝি  প্রাণ পাখিটা খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে গেল। “ তুমি কাঁথার মধ্যেই থাকো ঠাকুমা,দেখি ছোটো পিসি যদি এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে পারে।“

কেউ ঠান্ডায় মাটি ঘাঁটতে রাজি হল না,উল্টে সকালের কুয়াশার মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর জন্য খুব বকুনি খেল সে মায়ের কাছে। বকুল মনে মনে স্থির করেই নিল সবাইকে জানিয়ে দেবে , “আমাদের আজকের বনভোজনটা আর হবে না, অপেক্ষা করতে হবে পরের রবিবারের জন্য।“ পরক্ষণেই তার মনে হল, কিন্তু ততদিন এই চেয়েচিন্তে আনা জিনিসপত্র গুলো কী কেউ রাখতে চাইবে? সবারই অভাবের সংসার, যদি কেউ খরচ করে ফেলে। হয়তো কেউই সেটা করবে না, কিন্তু একসপ্তাহ ধরে পালং শাক, মূলো, বেগুন, কড়াইশুটি, আলুগুলো কী আর এখনকার মত অবস্থাতে থাকবে? নিজের মনে বকতে লাগল সে।

বকুলের মা রান্নাঘরে ঢুকেছে চায়ের জল চাপাতে। বকুল একটা নিমের ডাল নিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে কী মনে করে আবার গিয়ে হাজির হল মাঠে। কেউ কোথাও নেই অথচ উনুনটা ঠিক তার আগের অবস্থা ফিরে পেয়েছে। বকুল অবাক হয়ে গেল, এমন ম্যাজিক কী করে হল, কে করল এসব? তবে কী সে ঘুমের ঘোরে সবটাই ভুল দেখেছিল! ওই তো প্যাঙা আসছে ওদের বাঁশবাগান থেকে শুকনো কঞ্চির বোঝা বগলদাবা করে। তাকে দেখে যা বোঝার বুঝে গেল সে। প্যাঙা যেন দেখেও দেখল না তাকে , কেবল কঞ্চির বোঝাটা উনুনের ঠিক পাশেই ঝপাৎ করে ফেলে দিয়ে  সেখান থেকে চলে গেল। 

উনুনের পাশেই গোল করে বসে সবাই হাত-পা সেঁকছে যে যার মত করে। কেবল প্যাঙার মুখে কোনো কথা নেই। একটার পর একটা কঞ্চি ঢুকিয়ে চলেছে উনুনের মুখে। এখনও সবজি কাটা হয়নি, চাল ডাল পড়ে আছে একটা কলাপাতার ওপর।  হাঁড়ি-করা পাশাপাশি বসে একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচায়ি করছে। কেবল হাতা খুন্তি হাতে পচা আর নিমকি পুরানো দিনের রাজাদের মত অসিযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। তাদের ওই অবস্থাতে দেখে বকুলের খুব রাগ হল , একবার যদি তাদের এই যুদ্ধ ঘটার মায়ের চোখে পড়ে তাহলে রাজাদের অস্ত্র হাত থেকে সোজা নিজেদের জায়গায় ফিরে যেতে খুব বেশি সময় নেবেনা। কেবল বকুল সেগুলোর দায়িত্ব নিয়েছে বলেই কাকিমা দিতে রাজি হয়েছে।

বেগুন ভাজা আর তরকারি তৈরি হয়ে গেছে, খিচুড়ি চড়ানো হয়েছে উনুনের ওপর। অতবড় হাঁড়ি সামলাতে পারছিল না বকুলরা তাই বকুলের ছোটো পিসি সেটাকে উনুনের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার পরেও খিচুড়িটা মাঝেমাঝে নেড়ে দিচ্ছিল । বাকি রান্না গুলো বকুল আর প্যাঙাই ভাগাভাগি করে তৈরি করে ফেলেছে। বাকিরা যে যেমন পারে সবাই তাদের সাহায্য করেছে। এতকিছুর পরেও বকুলের মনটা এত খারাপ কেন, সে নিজেই বুঝতে পারছে না। তারপরেই হঠাৎই মন খারাপের কারণটা সে আবিষ্কার করে ফেলল উকিল জেঠুর বড়ো ছেলের হাতে মোয়া দেখে। ছেলেটা সবসময়ই বড়োলোকি চাল দেখাতে ওস্তাদ, অথচ কেউ কিছু চাইলে ‘না’ বলতে চোখের পাতা পড়ার থেকেও কম সময় নেয়। কালকেই তো, বকুল তাকে তাদের ফিস্টির কথা জানাতেই এমন করে ঠোঁট উল্টে “না” বলল যেন তাকে কথাটা জানিয়ে অপরাধ করে ফেলেছে বকুল!

যাই,’দাদুকে গিয়ে একবার বলি, মোটে পনেরটা নতুন গুড়ের রসগোল্লা লাগবে। আমি জানি দাদু আমার কথা ফেলতে পারবে না । বকুল এক ছুটে তাদের বাড়ির দাওয়ায় উঠেই দেখতে পেল তার মেজ কাকা মুড়ি আরা আলু ভাজা খাচ্ছে। একমুঠো তুলে মুখে পুরেই সে জানতে চাইল, “ দাদু কী ঘরে আছে কাকা, তুমি জানো?” “ জানি তো, তুই জানিস না দাদুর আজ সকালেই বড়ো পিসির বাড়িতে যাবার কথা। জামাইবাবু খুব অসুস্থ। “  বকুলের মনে পড়ে গেল, সত্যিই তো কাল রাতে খেতে বসেই তো বাবাকে বড়ো পিসেমশাইয়ের অসুস্থতার কথা বলেছিল দাদু। হ্যাঁ আজ ভোরেই তো বাবা আর দাদুর বড়ো পিসির বাড়ি যাবার কথা।

পোষমাসের উজ্জ্বল আকাশটা হঠাৎই একফালি কালো মেঘে ঢেকে গেল। বকুল জানে একমাত্র দাদু ছাড়া তার এই আবদার রাখার মত কেউ তাদের বাড়িতে নেই। মাকে বললে কেবল কষ্ট দেওয়াই হবে, মাকে কেউ টাকা পয়সা দেয়না।  তাদের যা যা লাগে মা বললে বাবাই সব এনে দেয় । বাবা খুব রাগি মানুষ, তার কাছে কিছু চাওয়ার সাহস বকুলের নেই। একবারেই তার শিক্ষা হয়ে গেছে। কাঠি বরফ খাবে বলে দুটাকা চেয়েছিল সে তার বাবার কাছে। এক ডজন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তার বরফ খাবার ইচ্ছেটাই উবে গেছিল। ভাগ্যিস ঠাকুমা বাঁচিয়ে ছিল সেদিন, চুপিচুপি পয়সাও দিয়েছিল বরফ খাবার জন্য।

“কই গো সবাই কোথায় গেলে? আজ আমার হাতে বেশি সময় নেই,তাড়াতাড়ি কোটোগুলো নিয়ে এসো। ও বকুল, আজ যে মুড়ি না নিয়েই চলে যাচ্ছো? আজ আমাদের ফিস্ট হচ্ছে পিছনের মাঠে, এখন মুড়ি খাবার সময় নেই। আচ্ছা খেতে হবে না, কিন্তু কী কী রান্না হচ্ছে সেটা তো বলে যাবে ! তেমন কিছুই নয়,” খিচুড়ি, পালংশাকের তরকারি, বেগুন ভাজা, ডিম ভাজা আর টমেটোর চাটনি।“ চাটনি শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে বকুলের গলাটা কেমন যেন শোনাল, একটা চাপা কষ্ট ফুটে উঠল তার মুখে। সে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করেও করতে পারল না।

মুড়ি পিসি জানতে চাইল, “ মিষ্টি নেই? এসময় শেষ পাতে নলেন গুড়ের রসগোল্লা না থাকলে ফিষ্টি জমে নাকি?”  বকুল কোনো উত্তর দিতে পারল না কেবল মাথা নীচু করে নিল। মুড়ি পিসি হঠাৎই তার আঁচলের গেঁট খুলে একটা কুড়ি টাকার নোট তারদিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এটা কাউকে দিয়ে একটু বোঁদে আনিয়ে নাও। পরের বছর নলেন গুড়ের রসগোল্লাটা আমি দেব আর তোমাদের সঙ্গে বনভোজনে আমিও থাকব। 

তোমাদের সঙ্গে নেবে তো আমাকে?”

বকুল একবার টাকার দিকে আর একবার তার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে,সাহস করে তার হাতটা বাড়াতে পারছে না।“ কেউ কিছুই বলবে না, আমি তো তোমার পিসি বকুল। টাকাটা ধরো আর কোঁচড় পাতো, নতুন চালের মিষ্টি মুড়ি নিয়ে যাও তোমার বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে খাও । আমি সবাইকে মুড়ি দেওয়া শেষ করে যাচ্ছি তোমাদের  ফিস্টি দেখতে।“ মুড়ি পিসির মিষ্টি মুড়ি দিয়েই শুরু হোক তোমাদের বনভোজনের প্রথম খাওয়া। মা বলল, “ পিসি ভালোবেসে দিচ্ছে তো, নিয়ে নাও ।“ অনুমতি পেয়ে কোঁচড়ে মুড়ি আর হাতে বোঁদের টাকা ,দু- দুটো অমূল্য সম্পদ সামলাতে সামলাতে বকুল ফিরে যাচ্ছে তার বন্ধুদের কাছে ,পেছনে না তাকিয়েই বলছে “ আমি গেলাম, মুড়ি পিসি তুমি এস---"।

বকুল আবার ফিরিয়ে দিল মুড়ি পিসির ভালোলাগার পুরনো সেই দিন। সেই বকুল গাছ, যার তলায় প্রতিবছর শীতে বন্ধুদের সঙ্গে সে’ও ঠিক এমন করেই বনভোজনে মেতে উঠতো । এখনও আছে সেই বকুল গাছটা, কেবল মুড়ি পিসির বন্ধুরা আজ তার কাছ থেকে অনেকদূরে চলে গেছে।

5 comments:

Mita ghosh said...

খুব মিষ্টি গল্প। শেষে একটু মন খারাপ হয়ে গেল। দিনগুলো কিভাবে যে অতীত হয়ে যায়!!😢

Subhasis Ghosh said...

ভালো লাগলো। খুব সুন্দর গল্প।

Prabir Bhattacherjee said...

খুব ভালো লাগল।

Unknown said...

বেশ নস্টালজিক গল্প। এক ঝলক টাটকা বাতাস।

ANKUR ROY said...

কী মিষ্টি যে গল্পটা। রূপকথা জীবনেও মাঝেসাঝে ঘটে।
তাই তো জীবন অনন্য। গল্প জীবনের এই জাদু ধরে রাখে। গল্পও তাই অনন্য। মন ভরে গেল পড়ে।