সম্পাদকের কলমে
নারায়ণ দেবনাথ-
সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম ।
ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম ।
নমস্কার সহ
অঙ্কুর রায়
সংখ্যার সম্পাদক
অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী
প্রধান সম্পাদক
লেখা পাঠানোর জন্য
আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com
Total Pageviews
By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.
উড়ানশর্মিষ্ঠা গঙ্গোপাধ্যায়"জ্যোৎস্না..........."মা এর গলার স্বর শুনে জ্যোৎস্নার মুখ শুকিয়ে গেলো। এতক্ষণে তার খেয়াল হলো আরও তিনটে বাড়ি কাজ করা তার বাকি আছে।আজ দুপুরে সরলার মাথা টা একটু ধরেছিল,গা টাও ম্যাজম্যাজ করছিল,তাই জ্যোৎস্না স্কুল থেকে ফিরতেই বিকেলের কটা বাড়ি শুধু বাসনাটুকু জ্যোৎস্নাকে বলেছিল মেজে দিয়ে আসতে।সেই কথা মতোই জ্যোৎস্না ঠিক সময়েই বেরিয়েও ছিল। কিন্তু ওই বোস জেঠিমার বাড়িতে কাজ শেষ হতেই দিদি আর বৌদিরা মিলে চেপে ধরলো গান শোনানোর জন্যে।আর ব্যস্, গান করতে করতে খেয়াল ই নেই জ্যোৎস্নার কখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেছে।সেই সময়ে ভরপুর আবেগ ধরেছে,"ষোলা বরস কি"শ্রোতৃমন্ডলী চুপ।আর ঠিক তখনই সেই ইন্দ্র সভার ছন্দপতন ঘটিয়ে সরালার প্রবেশ।আর এসেই গুদুম করে জ্যোৎস্নার পিঠে এক কিল।"তোর না এখনো আরও দুটো বাড়ি বাসন মাজা বাকি, আর এখানে বসে গান করছিস ?"বলেই সপাটে গালে এক চড়।"রাইদের বাড়ি থেকে আমায় ডাকতে গেছিলো।এই শরীর নিয়ে আগে আমি সব কাজগুলো সারলাম, তারপর..."একসাথে অনেকগুলো কথা অসুস্থ শরীরে বলে বেশ হাঁপিয়ে ওঠে সরলা। এবার বোস গিন্নি বলেন,"ওর কি দোষ বলো তো?এই এরাই ওকে জোর করে ধরলো একটা গান শোনানোর জন্য, মেয়েটা তোর খুব ভালো সরলা ওকে কিছু বলিস না।আর সত্যিই এতো সুন্দর মিষ্টি গলা ওর,এই আমায় দেখ না ওর গান শুনতে শুনতে খেয়াল ই নেই কখন সন্ধ্যে দিতে হবে!ভারী সুন্দর গানের গলা রে ওর।ঝাঁঝিয়ে ওঠে সরলা,"হুম্মাম্, গান গেয়ে কি হবে শুনি?টাকা আসবে?টাকা?ওই ওর বাপের মতোই অবস্থা হবে।এই গান ই আমার জীবনটা শেষ করলো।বের করাচ্ছি তোর গান" বলেই চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে মারতে মারতে মেয়ে কে নিয়ে যায় সরলা।একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বোসগিন্নি।সরলাকেও দোষ দেওয়া যায় না।ওর বর রতনকে ও জানেন তিনি। খুব ভালো বাঁশি বাজাতো রতন।একটা ছোট্ট ফলের দোকান ছিল। কিন্তু কখনো ই সেখানে রতনকে পাওয়া যেতো না, শ্বশুর আর সরলা মিলে ই ওই দোকান সামলাতো।বাঁশি, গান আর সুরেই মজে থাকতো রতন। সারাদিন স্টেশনে ই নানা মানুষকে গান শোনাতো, বাঁশি বাজাতো।কেউ কেউ কিছু টাকা ও হয়তো দিতো। মাঝে ক'দিন ট্রেনেও বাঁশি বাজালো। কিন্তু সংসার এর দিকে একদম মন ছিলো না। সারাদিন ওই ট্রেন নয়তো স্টেশনে বাঁশি বাজায়, গান গায় মনের আনন্দে,তাতেই যা কিছু রোজগার হয়।তাও যে কদিন শ্বশুর মশাই ছিলেন একরকম, তিনি মারা যাওয়ার পর সরলার পক্ষে একা ওই দোকান চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে,তার উপর একদিন রতনকে কিছু লোক অচেতন অবস্থায় বাড়ি নিয়ে আসে রাতে।সারা মুখে রক্ত মাখা।রক্ত বমি ও করছে।ডাক্তারি রিপোর্টে ধরা পড়ে গলায় ক্যান্সার।সেই চিকিৎসায় খরচ জোগাতে শেষ অবলম্বন ওই দোকান টুকুও বেঁচে দিয়েও রতনকে বাঁচিয়ে রাখা যায়না। শেষের দিনগুলোতে যখন আর গান গাইতে পারতো না, বাঁশি বাজাতপারতো না, তখন শুধু ই একটা ছোট্ট রেডিওতে সারাদিন এফ.এম শুনতো আর চোখ দিয়ে জল পড়তো। সরলার খুব কষ্ট হতো। মানুষ টা যে গান ছাড়া আর কিছুই বোঝে না।জ্যোৎস্না তখন মাত্র পাঁচ বছরের।ওই একরত্তি মেয়ে নিয়ে বিধবা হয় সরলা। মাথার ওপর কেউ নেই। তখন এই বোস গিন্নির কথাতেই কয়েক বাড়ি কাজ নেয়। এখন এভাবেই চলছে তার।তাই বোস গিন্নি জানেন কেন এতো রাগ সরলার ওই সুরের ওপরে।তাই তো প্রথম যেদিন স্কুলের বড়দি সাতবছরের জ্যোৎস্নার গলায়"সাত ভাই চম্পা জাগোরে"গান টা শুনে ওর ছোট্ট হাতে একটা চকলেট দিয়ছিলো, সরলা রাগের চোটে সেটা ছুঁড়ে ফেলে, রাস্তার মধ্যে ই ছোট্ট জ্যোৎস্নাকে মারতে থাকে। পাড়ার লোকেরা গিয়ে ওকে থামায়।বোস গিন্নির কাছে এসে ভয়ে সরলা বলে,"ও গিন্নি মা এ মেয়ে ও যে ওই রকমই গায়, আমার ভয় করে।"গিন্নি মা মাথায় হাত রাখেন আশ্বস্ত করেন।আজ ও সরলার জ্বর জ্বর ভাব।তাই জ্যোৎস্নার দায়িত্ব রাতের চারটে রুটি করার। কিন্তু বেশ অনেকটা সময় চলে গেছে। এখন ও রুটি হয়নি। রান্নাঘর থেকে গুনগুন আওয়াজ আসছে।প্রায় টলতে টলতে রান্নাঘরে গিয়ে দেখে স্টোভ জ্বলছে আর মেয়ে একমনে একটা গানের বই নিয়ে বসে আপনমনে গান করছে খুব আস্তে আস্তে। রাগের মাথায় মূহুর্তে বইটা নিয়ে জ্বলন্ত আগুনে ছুঁড়ে ফেলে, আর জ্যোৎস্না ঝাঁপিয়ে পড়ে ওই জ্বলন্ত আগুনে হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আধপোড়া গানের বইখানি উদ্ধার করে। মূহুর্তে জ্যোৎস্নার হাতের বেশ খানিকটা অংশ খুব বাজে ভাবে পুড়ে যায়।সরলার চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে আসে।ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।হাত ছাড়া ও গলা ও মুখ ও অল্প পুড়েছে।কাছের ই একটা হাসপাতালে ভর্তি হয় জ্যোৎস্না। বেশ কিছুদিন চিকিৎসার পর সুস্থ হয় সে।এখন অনেকটাই সুস্থ জ্যোৎস্না। দুদিন ধরে দুপুরে ভাত দেওয়া হয়েছে।আজ তো অনেকটাই সুস্থ দেখাচ্ছে ওকে। আজ সকালে ডাক্তারের ভিসিটিং আওয়ারে উঠে বসেছে।ডঃ চৌধুরী, বেশ প্রবীন ডাক্তার। হাসি মুখে এগিয়ে এলো ওর কাছে।"কি আজ তো অনেকটাই সুস্থ। উঠে বসেছো।তা এরকম টা ঘটলো কি করে। শুনতে পেলাম মা এর সাথে ঝগড়া!"লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি জ্যোৎস্না বলে,"না না আসলে আমি কাজ না করে গান গাইছিলাম,মা তাই রাগ করে গানের বই স্টোভে ছুঁড়ে ফেলে, আর ওটা তুলতে গিয়েই....."মাথা নিচু করে।ডাক্তার বাবু বলেন,"তুমি গান গাও, এত্তো গান ভালোবাসো?, তবে তো তোমার গান একদিন শুনতে ই হবে! বলে পাশে দাঁড়ানো নার্সের দিকে তাকায়,সে ও সম্মতি সূচক মাথা নাড়ায় হাসি মুখে। লজ্জায় মুখ নামিয়ে নেয় জ্যোৎস্না, যদিও মনে মনে খুব খুশী হয়।আরও দুদিন পরে যখন জ্যোৎস্নাকে রিলিজ করা হলো, সেদিন সবার অনুরোধে জ্যোৎস্না আবার গান গাইলো,"ও প্রজাপতি পাখনা মেলো"।ওর সুপ্ত প্রতিভা মুগ্ধ করে ডঃ চৌধুরী কে। তিনি নিজেই দেখা করেন সরলার সাথে।"ওকে আটকাবেন না,ও গান গেয়ে অনেক বড়ো হতে পারে। ওকে গাইতে দিন। আমি পাশে আছি। আমি সর্বতোভাবে ওকে সাহায্য করতে চাই।"জ্যোৎস্না বাড়ি আসে। আর প্রতিদিনের কাজের মধ্যে ও মনে পড়ে ডঃচৌধুরির শেষ কথাগুলো। কিন্তু আর কোন ই যোগাযোগ ছিল না। যদিও উনি ওদের বস্তির ঠিকানা টা নিয়েছিলেন। সরলা বলে,"বড়ো লোকেরা ওরকম ই হয়। অনেক কথা বলে,স্বপ্ন দেখায়। গরীবদের স্বপ্ন দেখতে নেই।কিন্তু, একদিন সত্যিই ডঃ চৌধুরীর গাড়ি এসে থামলো ওদের ঘরের সামনে। অবাক হয় সরলা। একটা বেসরকারি টিভি চ্যানেলে গানের কম্পিটিশন হচ্ছে।নামকরা সব গায়ক গায়িকারা বিচারক হয়ে আসছেন সেখানে।ডাক্তার চৌধুরীর ইচ্ছা জ্যোৎস্না ওই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করুক। বলেন,"আমি ওর গান শুনেছি,আমি ও গান শিখেছি ওটা আমার ও নেশা। যতটুকু বুঝেছি ও প্রতিভাময়ী। সঠিক তালিম আর সুযোগ পেলে ও নিজেকে মেলে ধরবেই। আমি শুধু ওকে সেটুকুই দিতে চাই।"প্রাথমিকভাবে সরলা আপত্তি করলেও পরে আর সকলের অনুরোধে রাজি হয়।অবশেষে একদিন সকলের আশীর্বাদ নিয়ে জ্যোৎস্না অডিশন দিতে গেলো। চান্স ও পেলো। ধীরে ধীরে প্রতিযোগিতার প্রতিটি স্তর পেরিয়ে অনেক কে পেছনে ফেলে এগিয়ে ও যেতে থাকলো।আর প্রতি পদক্ষেপে ওর সাথে এখন ভগবানের মতো রয়েছেন ডঃ চৌধুরী।এখন সরলার খুব আনন্দ। মেয়ে কে টিভি তে দেখাচ্ছে।আগের থেকে অনেক স্মার্ট ও হয়েছে। এখন ই একটু নাম ও হয়েছে।এই তো এখন ই এক পূজো কমিটি থেকে ওকে গান গাইতে বলেছে, আবার টাকা ও নাকি দেবে!অবশেষে সেই দিনটা এলো। প্রতিযোগিতার শেষ দিন, ফাইনাল।আজ স্বয়ং ডঃচৌধুরি নিজে গেছেন তাঁর "আবিষ্কার"এর গান শুনতে।সরালাকেও বলেছিলো,সে মেতে চায়নি। এতো দিন বহু বিচারকের প্রশংসা কুড়িয়েছে,আজ শেষ দিন।পাশের বাড়ির টিভি থেকে জ্যোৎস্নার গান ভেসে আসছে। আজ সরলা ওদের বাড়ি টিভি দেখতে ও যায়নি।ঠায় রতনের ছবির সামনে বসে আছে।আর দূর থেকে ভেসে আসছে জ্যোৎস্নার গানের সুর"এইবার স্বপ্নের বন্ধন খুললাম।"আজ সত্যিই প্রথম ওর মনে হলো কি সুন্দর ই না গান গায় তার মেয়ে! একবার দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে বললো,"হে ভগবান সেদিনের ওই আগুনে ওর জীবনের সব দুঃখ কে তুমি জ্বালিয়ে দাও। ওকে শুদ্ধ করে তোলো।আজ যেন এক নতুন জীবন শুরু হয় ওর।অবশেষে সবাইকে চমকে দিয়ে এক নামহীন স্বভাবগায়কের মেয়ে জ্যোৎস্না প্রথম স্থান অধিকার করে।একা ঘরে সরলা তখন। চমকে ওঠে বাজির শব্দে। বেরিয়ে এসে জানতে পারে, বস্তির মেয়ের এই সাফল্যে আজ সবাই আনন্দ উদযাপন করছে।সরলার দু চোখে জলের ধারা। একজন বিচারক তখন জ্যোৎস্নার মাথায় বিজয়ীনির শিরোপা পরিয়ে দিচ্ছেন।আর জ্যোৎস্না এগিয়ে এসে ডঃ চৌধুরী কে সবার আগে প্রণাম করছে।সরলা ধীরে ধীরে ফিরে আসে নিজের ঘরে।রতনের ফেলে যাওয়া বাঁশি টি নিয়ে ওঁর ফটোর সামনে দাঁড়ায়।এই সুর যে তাঁর ই রেখে যাওয়া,যা আজ তাঁর মেয়ে শোনাবে জগতকে।এ হলো এমন এক সম্পদ যা ফল্গুধারার মতো বয়ে চলে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। সমৃদ্ধ করে। সরলা চেয়ে আছে এক গায়কের ছবির দিকে।যার গোটা জীবনটাই ছিল সংগীতময়।আর বাইরে তখন শুধু ই বাড়ির মেয়ের সাফল্য উদযাপন করে বাজি ফাটছে।এক মিউজিক ডিরেক্টর তখন আগামী কাজের জন্য জ্যোৎস্নাকে দিয়ে সই করাচ্ছে। পাশে দাঁড়িয়ে ঈশ্বর স্বরূপ ডঃচৌধুরি।সারা বাংলা তখন হাততালি দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে তাদের নতুন সংগীত শিল্পী কে।
Subscribe to:
Posts (Atom)
0 comments:
Post a Comment