সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

28,049
By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

একটি জন্ম ও একটি মৃত্যুর গল্প 

 দেবাশিস রায় 


তখন এগারো ক্লাস পড়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা হতো ! কেউ বিজ্ঞান পড়বে না কলা না বানিজ‍্য, সে সব ক্লাস এইটের পরেই নির্ধারিত হয়ে যেত! এ সে সময়ের কথা!

   বনেদী, অবস্থাপন্ন ও শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে পাপিয়া'র মনে মনে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার ইচ্ছে ছিল। লেখাপড়ায় ভাল হলেও, অংকে আর বিজ্ঞানে সুবিধে করতে পারত না। ফলে, ক্লাস নাইন থেকে ও'কে কলা বিভাগেই পড়তে হল! সাহিত্যের প্রতিও ওর ভালবাসা ছিল। এবার তড়তড়িয়ে খুব ভালভাবেই উচ্চ মাধ‍্যমিক পাশ করে ফেলল! প্রেসিডেন্সি কলেজে বাংলায় অনার্স নিয়ে ভর্তি হতেও কোনো অসুবিধে হল না !

   কিন্তু ওর সমস্যা হচ্ছিল অন‍্য জায়গায় ! অত‍্যন্ত‍্য সুন্দর দেখতে হ‌ওয়ায়, ক্লাস নাইন/টেনে পড়ার সময় থেকেই ছেলেরা ওর প্রতি আগ্রহ ও দুর্বলতা দেখাতে শুরু করে দিয়েছিল! ভুল বানানে, উড়ে পড়া চিঠির স‌ংখ‍্যাও মন্দ হচ্ছিল না! ভাগ্যিস সেদিন স্মার্টফোন ছিল না ! না হলে, কে জানে, কি কি যে হতে পারত!

মেয়েদের এটা একটা মস্ত বড় সমস‍্যা! কুরূপা হলে কেউ ফিরেও তাকায় না আর সুন্দরী হলে, সবাই তা'কে নিজের করে পেতে চায় ! পাপিয়া ছিল, অতি বড় সুন্দরী! কাজেই ওর অবস্থাটাও অনুমেয়! তবে ওর মনে কার‌ও প্রতি অনুরাগ জন্মেছিল কিনা সেটা এ অধম কাহিনীকারের অজানা ! ওদের পরিবার‌ও ছিল রক্ষণশীল আর প্রাচীনপন্থী ঘরানার! ফলে, কারোও প্রতি অনুরাগ জন্মালেও, সেটা প্রকাশ করার সাহস ওর হত না! একালের কথা হলে, হয়তঃ ওর জীবন কথা, অন‍্য ভাবে লেখা যেত! কিন্তু এটা পুরনো দিনের কথা! কলেজে ভর্তি হবার আগেই  বাড়ি'র পছন্দ করা  সুপাত্রের সাথে ওর বিয়ে হয়ে গেল!

    তখন বাড়ি ভাড়া করে বিয়ের চল, কলকাতা শহরে ছিল না। নিজেদের বাসস্থানেই বিয়ে, বৌভাতের চল ছিল। আর ছিল এসব উৎসব উপলক্ষে বাড়ি ভর্তি করে আত্মীয়স্বজনের ঢল! কে কি খাবে আর কোথায় ঘুমোবে, সে সব ছিল গৌণ!দেখানো জাঁকজমক কম ছিল কিন্তু হৈ হুল্লোড় আর আন্তরিকতায়, অনুষ্ঠান বাড়িগুলো ভরে থাকত! বৌভাতের রাতে হত, ফুলসজ্জ‍্যা ! রাতে নবপরিনীত স্বামী স্ত্রী'র আদর আহ্লাদ দেখার চেষ্টা আর উঁকিঝুঁকি মারার কত রকম পরিকল্পনা যে তখন  হত, সে সব এখন কল্পনার‌ও অতীত! আর ছিল, ফুলসজ্জ‍্যার পরদিন, বাড়ির বড়দের বিশেষ করে মা, মাসি, কাকিমা, জ‍্যেঠিমাদের আগের রাতে কিছু হল কি না, সেটা কায়দা করে অনুচরদের থেকে জেনে নেবার এক আকূল গোপন আগ্রহ! এক‌ই আগ্রহ মেয়েদের বাড়িতেও থাকত! অষ্টমঙ্গলায় জোড়ে গেলে তখন এক‌ই ভাবে, সে বাড়িতেও মেয়ের থেকে জানার চেষ্টা থাকত! ভাবখানা থাকত এই যে কিছু হয়ে টয়ে গেলেই যেন সবার শান্তি! না হলে, একটা চাপা আতঙ্ক থাকত! ছেলে পারে তো? এটা নিয়ে একটা চাপা অশান্তি মেয়ের বাড়িতে থাকত‌ই! এ কালের পাঠক! একবর্ণ‌ও বাড়িয়ে বলছি না!

   জোড়ে এসে, পাপিয়ার মুখ থেকে এমন কোনও কথা শোনা যায়নি, যাতে ওর বাড়ির প্রমীলাবাহিনী কোনো স্বস্তির স্বাদ পেতে পারেন! পাপিয়ার মুখ দেখে ও তৃপ্ত না অতৃপ্ত, কিছুই বোঝা গেল না!

   কলেজ ক্লাস শুরু হল! নতুন বন্ধু অনেক হল! সুন্দরী হ‌ওয়ায় কলেজের সিনিয়রদের ও নজর পাপিয়ার দিকে র‌ইল!

    সেখানে এসে রথীনের সাথে পাপিয়ার সখ‍্যতা সবচেয়ে বেশী হল!

মধ‍্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী ছাত্র রথীন, পড়াশুনো ছাড়াও খেলাধূলোতেও বেশ ভালো ছিল! সাদামাটা চেহারার রথীনের গভীর, মায়াবী আর আয়ত একজোড়া চোখ ছিল। পাপিয়া'র মুখ দেখে মনের কথা রথীন বুঝতে পারত! বছরখানেকর মধ‍্যেই ওদের নিবিড় বন্ধুত্ব তৈরী হয়ে গেল! রথীন কোনো কারণে কলেজে না এলে, পাপিয়ার সেদিন ক্লাসে মন থাকত না! রথীন যেদিন সেটা ধরতে পারল, বলল, ' শোন্ , আমরা দু'জন কিন্তু একে অন‍্যের বেস্ট ফ্রেন্ড! আর অন‍্য কিছু না।'

- তুই আমায় ভালবাসিস না?

- সবচেয়ে বেশি ভালবাসি। কিন্তু সেটা বন্ধুত্বের, আর অন‍্য কিছু না।

- আমি বিবাহিতা না হলে, ভালবাসতি আমায় ?

- সে তো গোটা কলেজ তোকে ভালবাসে !

- জানিস, আমার কপালে ,সিঁথিতে সিঁদুর আছে। আমি বিবাহিতা কিন্তু এখনও কুমারী !

- এমন কি করে হলো ?

- একে ভাগ‍্য বলতে পারিস, দুর্ঘটনা বলতে পারিস! কিন্তু হয়েছে!

- তোর বর তো আগে থেকেই জানত! বিয়ে করতে গেল কেন ?

- ওর খুব একটা দোষ নেই! ওর বাবা মারা গেছেন, অনেক কাল আগেই। ও মায়ের একমাত্র সন্তান! এত বড় বাড়ি, নামী পরিবার। মা'কে খূশী করার জন‍্য, মায়ের ইচ্ছেতে বিয়ে করতে বাধ‍্য হয়েছে! জানিস , চন্দন কিন্তু খুব ভাল মানুষ। ওর এই অবস্থার কথা কেউ কিন্তু জানে না। আমার কাছে, ক্ষমা চেয়েছে। আর কি বলেছে, জানিস? বলেছে, নিজের পছন্দের কাউকে বেছে নিতে। ওর একটা সন্তান চাই। না হলে, পরিবারে সবাই আমাকেই কথা শোনাবে, সেটা ওর সহ‍্য হবে না।

- হুম! বুঝলুম! তুই এখন কি চাস?

- যা চাই, সব তোর থেকে চাই। তুই ই একমাত্র সবদিক থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারিস!

আর অন‍্যায় তো কিছু চাইছি না! তোকে ভালোবাসি। মনে মনে তুই‌ও আমাকে ভালবাসিস। বল, সত‍্যি কি না ?

- কিন্তু আমি তা পারব না। সন্তান হবে আমার কিন্তু আমি তা'কে কাছে পাব না, এটা হবে না!

- চন্দন ভাল মানুষ, খুব ভাল। আমার অনেক যত্ন করে। আমি ওকেও ভালবাসি। ছেড়ে আসতে পারব না! আর যদি ছেড়ে আসি, দু দুটো পরিবারের ভীষণ বদনাম হবে। সবার মুখ পুড়বে।

- আমি এ কাজ করতে পারব না রে! তুই সত‍্যিটাকে মেনে নে। কেউ জানতে চাইলে, চন্দনকে বল যেন সত‍্যিটা ও ই বলে দেয়! তোর তো কোনও দোষ নেই!

- আমি সারা জীবন এভাবে থাকব?  সিঁথিতে সিঁদুর থাকবে অথচ শরীরে কুমারী?

- কিন্তু আমি কি করতে পারি বল! এটাকে অদৃষ্ট বলে মেনে নে! এভাবে আমি কিছু পারব না রে !আর তোকে বিয়ে করার মত, যোগ‍্যতা বা পরিস্থিতি, কোনোটাই আমার নেই!

- আরে দূর বোকা! তোকে আমি একথা বলেছি নাকি?

- এইমাত্র‌ই তো বললি?

- না, এটা বলিনি আমি। শোন আমার বর চন্দন অত‍্যন্ত‍্য ভাল মানুষ। ও আমাকে যথেষ্ট ভালবাসে। কিন্তু ও যে আমার কাছে অপরাধী সেটা নিজেই কত বার যে বলতে থাকে, সে তোকে বোঝাতে পারব না! এমনকি আমার পা ধরেও কেঁদেছে, জানিস।ওর অবস্থাটা আমি বুঝি! ওর ওপর আমার কোনও অভিযোগ নেই। ভাল ও বাসি ওকে!

- কিন্তু তুই যা চাস, সেটা অন‍্যায়! হয়না। অন্তত আমি পারব না।

    এরপর দিন দুই রথীন কলেজে এল না! যেদিন এল, সেদিন থেকে পাপিয়া এল না। এভাবেই ভারাক্রান্ত মনে দুজনেরই দিন কয়েক কাটল! 

    সে সময়ে যোগাযোগের মাধ্যম বলতে ছিল ক‍্যালকাটা টেলিফোনস এর ওই কালো গাম্ভীর্যপূর্ণ ক্রিং ক্রিং আওয়াজ করা টেলিফোন , সেটাও সকলের বাড়িতে ছিল না! আর ছিল, চিঠি লেখা! পোস্টকার্ড, ইনল‍্যান্ড লেটার, এনভেলপ্ এসব! সেকালে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একের অন‍্যের বাড়ি যাবার চলটা যথেষ্ট‌ই ছিল। তবে , মেয়ে বন্ধু'র বাড়ি তায় সে যদি আবার বিবাহিতা হত, সেক্ষেত্রে অবশ‍্য‌ই যাতায়াতের সীমাবদ্ধতা থাকত! কিন্তু পাপিয়া'র শ্বশুরবাড়ির ব‍্যাপারটাই ছিল আলাদা! বিডন স্ট্রিটের ওই মস্ত বড় দোতলা বাড়িতে দুপুরে চন্দনের মা ছাড়া আর কেউ থাকতেন না। আর ছুটির দুপুরে তিনজন মাত্র! তাছাড়া চন্দন সন্তান চাইছিল। এটাও চাইছিল, পাপিয়া যেন একারণে, ওর মন মতো সঙ্গী বেছে নেয় আর সেটা যেন অত‍্যন্ত‍্য গোপন থাকে ! শুধু চাইছিল বললে, ভুল বলা হবে! বরং পাপিয়ার কাছে কাতর অনুরোধ করছিল! ফলে, বেহালার যে বাপের বাড়িতে ওর এত শাসন আর বিধিনিষেধ ছিল, সেগুলোর কোনোটাই বিডন স্ট্রীটের বাড়িতে ছিল না। আর, রথীন আর পাপিয়ার অন‍্য ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা সে বাড়িতে আগেও একবার গিয়ে ঘুরে এসেছিল!

    দিন কতক ধরে, পাপিয়া লজ্জায় কলেজে আসছে না! লজ্জা তা'র যতটা না প্রত‍্যাখ‍্যানের জন‍্য, তা'র থেকে কয়েক হাজার গুন বেশি যদি রথীন একথাগুলো অন‍্য বন্ধুদের বলে দেয়, সেজন‍্য আর এটা ভেবে ভেবে, মরমে মরছিল! 

  রথীন তার বয়সের তুলনায় অনেক বেশী পরিণত ছিল। সে একদিকে পাপিয়ার যন্ত্রণাটা অনুভব করছিল, আবার ন‍্যায় অন‍্যায়ের দোলাচলেও ভুগছিল! অথচ সে যে নিজের অজান্তেই পাপিয়া'কে কখন ভালবেসে ফেলেছে, অদেখায় বিমর্ষ হয়ে আছে, সেটাও এ কদিনে টের পাচ্ছিল! কিন্তু এটা এমন একটা কথা, যা কোন কাছের  বন্ধুকেও ও বলতে পারছিল না!

 একদিন কলেজ ছুটির পর, পায়ে পায়ে গিয়ে হাজির হল! বাড়ির বাইরের লোহার মস্ত গেটের কাছে গিয়ে চোখ তুলে তাকাতেই, পাপিয়াকে দোতলার জানলার সামনে দাঁডানো দেখতে পেল! চোখাচোখি হতেই ভুবনজয়ী হাসি দেখে রথীনের হৃদয় ভরে উঠল! কিশোরী বালিকার মতো একছুটে নেমে এসে দরজা খুলে, হাত ধরে টেনে ওপরে নিয়ে যেতে যেতে পাপিয়া বলে উঠল, 'জানতাম, তুমি আসবেই।'

  ওপরে উঠে, পাপিয়া'র শ্বাশুড়ী মা'কে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করল! উনি বললেন, ' ভাল আছ তো, বাবা! তোমার কথা রোজ যে কত শুনি! যাও বাবা, যাও, ভেতরে গিয়ে বস। চা টা খাও, তোমরা কথা বল!' উনি ভেতর ঘরে গেলেন!

 - তুমি কলেজে যাচ্ছ না কেন ?

- লজ্জায়।

- কিসের লজ্জায়? আমার কাছে লজ্জা?

- যদি তুমি একথা অন‍্য কাউকে বলে দাও, তাহলে আমি মুখ দেখাব কি করে?

- এটা বলতে পারি কি? বলার বিষয় নাকি ?

- সেটাও ভেবেছি! তাও ভয় পেয়েছি। দাঁড়ায় তোমাকে চা করে দিই।

- তোমার বর কখন আসবে? সন্ধ্যা হতে চলল!

- সময় হয়ে গেছে। দুপুরে এলে না কেন ?

- লজ্জায়!

    গালটা টিপে দিয়ে, দুহাতে রথীনকে জড়িয়ে ধরে পাপিয়া ওর বুকে মাথাটা রাখল!

  বাইরে কলিং বেলের শব্দ হল, চন্দন এলেন।  রথীনের সাথে পরিচয় হল! ভদ্রলোকটিকে রথীনের বেশ লাগল। চন্দন‌ও রথীনকে ভাল করে নজর করলেন। মনে হল, ওনার‌ও রথীনকে পছন্দ হয়েছে। বললেন,' আপনার কথা তো অনেক শুনি!আপনি কিন্তু ওকে একটু সাহায্য করবেন! এটুকু আশা করতে পারি তো ?' কথায় অন্তর্নিহিত অর্থ রথীনের কাছে, সম্পূর্ণ বোধগম্য না হলেও বলল,  'বন্ধুরা তো বন্ধুদের জন‍্যেই!'

ভদ্রলোক রথীনের পিঠে হাত রাখলেন।

প্রথমে চা এল! তারপর দুজনে মিলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগেরেট আর পরে নারকেল দিয়ে ছোলার ডাল সহযোগে খানকতক লুচি খেয়ে রথীন ফিরল! 

ফেরার পথে পাপিয়া এগিয়ে দিতে এসে বলল- কাল কিন্তু কলেজে যাব। ওখানে কিন্তু 'তুমি' না, আমরা 'তুই' করেই বলব। মনে থাকে যেন!'

সৃষ্টির নিয়ম মেনেই সময় এগোতে থাকে, সাথে চলতে থাকে পরিবর্তনের নানা পর্ব, নানান ধারায়!  আজ কত ধরণের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মানুষ সন্তান লাভ করতে পারে কিন্তু সেসময়ে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এসব, এতটা এগিয়ে ছিল না যে ইচ্ছে করলেই সন্তান লাভ করার একটা উপায় প্রতিবন্ধক নর নারী খূঁজে নিতে পারবে ! হ‍্যাঁ, সন্তান দত্তক নেবার চল অবশ‍্য‌ই ছিল কিন্তু চন্দন বা পাপিয়া সে পথে হাঁটেনি আর পাপিয়া'র ছিল অন‍্য এক অতৃপ্তি, যা রথীনের সান্নিধ্যে এসে দিন দিন আরোও তীব্র আকার নিচ্ছিল!

   পরদিন পাপিয়া কলেজে এল, অনেক সেজে আর অনেক উৎফুল্ল মন নিয়ে! রথীন জানতে চাইল: - তোমার বর'কে কি আমার কথা কিছু বলেছ? আমাকে উনি যে ভাবে জরিপ করলেন!

- তোমার কথা তো বলি ই!

- চন্দনের এই ব‍্যাপারটা, আর কে কে জানে?

- আমি,তুমি আর ও ছাড়া আর কেউ না!

- ওর মা ?

- না! 

- আচ্ছা, দত্তক নিচ্ছে না কেন ?

- জানো, রোজ স্নান করে উঠে যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সিঁদূর পরি, ওপারের মূর্তিটা যেন আমাকে ব‍্যাঙ্গ করে!

 পাপিয়া'র চোখের কোন ভিজে উঠল! ওই ছলছল চোখ রথীন'কে চিরদিন ই দূর্বল করে ! প্রতিরোধের শেষ শক্তিটুকু এই চোখের জলের কাছে হেরে যায় !

          কলেজে, এসেই আজ পাপিয়া বলল,

  'দুপুরের পর আজ মা বেরোবেন। আমাদের‌ও পরপর দুটো পিরিয়ড অফ্, পরের টা পাস এর, হিস্ট্রি ক্লাস! না করলেও চলবে। আমরা আজ একসাথে বাড়ি চলে যাব!'

     চলেও গেল, দুজনে একসাথে!

 তখন বিকেল হয় হয়! পাপিয়া বলল, ' কি দেখছ, এমন ভাবে?' 

- তোমাকে ! এত অপরূপ তুমি ! তোমাকে!

- আজ বিশ্বামিত্রের ধ‍্যান ভঙ্গ হল! এতদিন ধরে আমাকে এত কষ্ট দিলে কেন? জানো, মনে মনে  আমিও ঠিক করে রেখেছিলাম, অনাবৃত আমাকে, আমি ছাড়া আর কেউ যদি দেখে, সে হবে তুমি! স্পর্শ যদি করে, সে ও হবে তুমি!

    কোনো উত্তর না দিয়ে, রথীন পাপিয়া'র দিকে অপলকে তাকিয়ে র‌ইল। 

- কি দেখছ এমন ঢ‍্যাবঢ‍্যাব করে ?

- তোমাকে। শুধুই তোমাকে!

- এবার ওঠো। আমাকে ছাড়। ওরা এসে পড়বে এবার!

- চন্দন তো সব‌ই জানে, বাকিটাও জানবে।

- কিন্তু মা'কে কিছু জানতে দিলে চলবে না। আর, তোমরা পুরুষ জাতি! যতই এটা চাও না কেন, চোখের সামনে দেখলে, তোমরা নিতে পারবে না! ওঠো এবার ওঠো! জানো, আজ আমি সত‍্যিই বিবাহিতা হলাম! আহ্ , কি শান্তি, কত তৃপ্তি!

মাথার সিঁদুর আর আমাকে বিদ্রুপ করতে পারবে না! আর, তুমি ছাড়া অন‍্য কোনো পুরুষ আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। কথা দিলাম।

  পাপিয়া নারী হল আর রথীন আজ পুরুষ ! যখন  বাড়ির বাইরে বের হল, রথীনের চোখে মস্ত ঘোর !

   এভাবেই ওদের জীবন আরও কিছুদিন চলতে থাকল!

কয়েক মাসের মধ‍্যেই, পাপিয়া'র শরীরে যখন মাতৃত্বের প্রথম লক্ষণ ফুটল,জানল যে পাপিয়া সন্তান ধারন করেছে, চন্দন, ওর বিবাহিত জীবনে এই প্রথমবার গভীর আনন্দে ও অনুরাগে নিজের স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কপালে সোহাগ চিহৃ এঁকে দিল! 

   কলেজে এসে, রথীনকে এই খুশীর খবর জানিয়ে পাপিয়া বলল, 'এবার থেকে কলেজে খুব সাবধানে থাকবে। আস্তে আস্তে এখন থেকে দেখানো দূরত্ব তৈরি করতে থাক ! কিছুদিনের মধ‍্যেই সবাই বুঝবে যে আমি মা হতে চলেছি। কেউ যেন কিছু টের না পায়! দায়িত্ব দুজনের‌ই!'

- আমি বাবা হব?

- চুপ !

    রথীন একদিকে যেমন অত‍্যন্ত‍্য খুশি হল, অন‍্যদিকে ভেতরে ভেতরে অস্থির ও অশান্ত হতেও শুরু করল! সে নিজের স্বাভাবিক স্থিরতা হারাতে থাকল! কলেজে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে, দুপুরে বিকেলে মাঝে মধ‍্যেই পাপিয়া'র শ্বশুরবাড়িতে যায় কিন্তু ভেতরের অস্হিরতাটা কখনোই ওকে ছেড়ে যায় না! দিন যায়! এখন পাপিয়া'কে দেখলে, ও যে সন্তানসম্ভবা সেটাও বোঝা যায়! 

 কলেজে বি এ ক্লাসের পার্ট ওয়ান পরীক্ষা হয়ে গেল! পাপিয়া'র পরীক্ষা মন্দ হল না কিন্তু রথীনেরটা ভাল হল না! থার্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু হয়েছে, যদিও পার্ট ওয়ানের ফল প্রকাশ হয়নি! পাপিয়া আর এখন ক্লাস করতে পারে না! রথীন ওদের বাড়িতে যায়। পাপিয়ার পেটে হাত দিয়ে বাচ্চার নড়াচড়া টের পায়, কান পেতে কিছু শব্দ শোনার চেষ্টা করে। এটা একদিন চন্দনের চোখে পড়ে গেল। ও রথীনকে বলল, 'মেনি মেনি থ‍্যাঙ্কস!  আমরা দুজনেই, আপনার কাছে গ্রেটফুল! কিন্তু পাপিয়া'র আর এখন কলেজে যাওয়া বা পড়াশুনো করা সম্ভব হবে না! সব‌কিছু আপনি জানেন! আশা করি এটা বুঝবেন যে এখন আপনি বেশি এলে, সবাই সব কিছু বুঝে যেতে পারে! সবকিছু ঠিকমত রক্ষার দায়িত্ব কিন্তু আপনার ওপর‌ও বর্তায়!'

 চন্দন অতি বড় মনের সুন্দর মানুষ। আর একটা কথাও ও বেঠিক বলেনি, রথীন বোঝে সেটা! আবার পাপিয়া'কে ছেড়ে থাকে, বিশেষ করে আসন্ন সন্তানের বাবা যে সে নিজেই, এটা জেনেও দূরে থাকা, তা'র পক্ষেই বা কি করে সম্ভব! রথীন নিজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ আরও হারাতে থাকল!

    যথাসময়ে যথানিয়মে সন্তান ভূমিষ্ঠ হল! অতিথি, অভ‍্যাগত সমাগমে সে বাড়ি আনন্দে নেচে উঠল! কলেজের বন্ধুরা সব দলবেঁধে দেখতে গেল, নেমতন্ন খেল! 

   পাপিয়া এখন ওই একরত্তি সন্তান নিয়ে ব‍্যস্ত হয়ে থাকে। চন্দন, যতদূর সম্ভব বাড়িতে থেকে পাপিয়ার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়! রথীন যাওয়া কমিয়েছে! এ নিয়ে পাপিয়ার অনুযোগ করার অবকাশ নেই, করেও না। যেদিন ই যায়, চন্দনকে বাড়িতেই পায়! রথীন, পাপিয়া বা তার সন্তান কাউকেই কাছে পায় না! সে এখন প্রায় উদভ্রান্ত!কলেজেও তা'কে দেখা যাচ্ছে না! বেশ ক'দিন হয়ে গেল, পাপিয়ার কাছেও যায়নি! কেউ তা'র তেমন খোঁজ ও করনি!

      দিন কতক পরে কলেজে পুলিশ এল, রথীনের বাড়িতেও গেল!  খবর এল, শিয়ালদহ আর উল্টোডাঙ্গা রেল স্টেশনের মাঝে কোনও এক যায়গায় রথীন ট্রেনে কাটা পড়েছে!

   এটা আত্মহত্যা না দূর্ঘটনা সেটা জানা যায়নি! 

 হ‍্যাঁ, রথীন ট্রেনে করেই কলেজে যেত! ব্রেসব্রীজ স্টেশন থেকে সে যাতায়াত করত! কিন্তু সেটা তো দক্ষিণ শাখায়! শিয়ালদহে মেন লাইনে, যাতায়াত তো সে কখনও করেনি! তবে, ওখানে কি করে সে ট্রেনে কাটা পড়ল?  সে প্রশ্নের উত্তর কারোরই জানা নেই!

  সময়! সময় মানুষের জীবনে যে কি খেলা খেলে যায়, সেটা শুধু সময়‌ই জানে আর জানে যে মানুষ ভুক্তভোগী, শুধু তিনিই! কত হাসিখুশি উচ্ছ্বল মনের মানুষ কখন কিসের প্রভাবে পড়ে নিজের কাছ থেকেই নিজে পালিয়ে বাঁচতে চায়, সেটা কি ওপর থেকে দেখে বোঝা সম্ভব, না যায়? হয়তঃ নয়!

  আমি কাহিনীকার! আমার কাজ এখানেই শেষ! পাপিয়া, চন্দন বা তাদের সন্তানের কোনো খবর‌ই এ কাহিনীকারের আর জানা নেই!

0 comments: