সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.


 

ঝিনুকখালির বিল

শমীক রুদ্র  

                                                                         

 “এই পুলক শিগগির ওঠ!”

অমিতের ডাকে আমার চটকা ভেঙ্গে গেলো। ট্রেনের দুলুনির সাথে সাথে চোখটা কেমন লেগে গেছিলো  এই মুহূর্তে ট্রেনটা থেমেছে। চোখ খূলে একবা আড়চোখে চারিদিকটা দেখে সবে আবা চোখ বন্ধ করেছি। এমন সময়ে অমি চেঁচিয়ে উঠলো। ওর দিকে চেয়ে লে উঠলাম,

‘কেন কী হয়েছে?’

‘আরে ওঠ না!’

‘কেন বলবি তো?’

‘ওফওঠ বলছিএখানে নামব ।‘

‘নামবএখানে?’

‘আরে হ্যাঁ। ওঠ না ট্রেন ছেড়ে দেবে কখন! ‘

চট করে জানলার বাইরে একবার দেখে নিলাম। ট্রেন একটা ফাঁকা মত  স্টেশনে দাড়িয়ে আছে। এখানে কেন নামবচিনি না জানি নাঅজানা অচেনা জায়গাসাধ্য মত প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলাম বটে কিন্তু সব বেকার গেলো। অমিতের টানাটানির চোটে ওপরের লাগেজ র‍্যাক থেকে ব্যাকপ্যাকটা তুলে নিয়ে হুড়মুড়িয়ে নেমে এলাম। প্ল্যাটফর্মে পা রাখার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনটা ছেড়ে দিল। তারপর হুস হুস করে স্টেশনে ছেড়ে বেরিয়ে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেলোপিছনে পড়ে রইলো গ্রীষ্মের তপ্ত বিকেলে এক দগ্ধ নির্জন প্লাটফর্ম এবং মাত্র দুইটি মানুষ। একটা বড় ফলকে চোখে পড়ল হলুদের ওপর কালো দিয়ে লেখা স্টেশনে নামঝিনুকখালি।

ডাইনে বাঁয়ে তাকিয়ে দেখলাম। বাঁদিকে শুধু যতদূর দেখা যায় ধু ধু ফাঁকা মাঠ। মাটি ধূসর রঙের। একটাও গাছপালা চোখে পড়ে না। আর ডানদিক কিছুটা ঢালু হয়ে প্লাটফর্মের থেকে নেমে গেছে। ঘাস আর আগাছা ভরা এখানে সেখানে। দূরে কিছু গাছের সারিও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু জনমানুষের কোন চিহ্ন দেখতে পেলাম না।  ঘাড় ঘুরিয়ে অমিতের দিকে তাকিয়ে দেখি সে সেই বাঁদিকের ধুসর ফাঁকা দিকটার দিকে একমনে চেয়ে আছে। চোখের দৃষ্টি কেমন স্বপ্নালু। হঠাৎ করে ভীষণ রাগ হল। বেশ যাচ্ছিলাম ট্রেনে, হঠাৎ করে এরম একটা শুনশান জায়গায় নামিয়ে এনে এখন প্রকৃতি প্রেম জাগছে বাবুর! বেশ খানিকটা তেড়ে উঠে বললাম,

‘হতচ্ছাড়া! তোর ব্যাপার স্যাপার কিরে? অ্যাঁ? চ্যাংড়ামো হচ্ছে?’

‘কেন রে ?’

প্রায় মারমুখী হয়ে বললাম,

‘কেন রে? তুই বুঝতে পারছিস না, না? ন্যাকামো হচ্ছে?’

‘উফ! তুই দেখছি ভীষণ ক্ষেপে গেছিস!’

‘সেটা কি খুব অন্যায়?’

‘ওরে বাবা! আচ্ছা শোন! মাথাটা একটু ঠাণ্ডা কর!’

‘কি ঠান্ডা করব?’

‘আচ্ছা শোন। আমরা তো কোন নির্দিষ্ট জায়গায় যাব বলে বের হইনি। তাই না? কথা ছিল যেখানে ভাল লাগবে সেখানে নেমে যাব । তাহলে এত ক্ষেপে যাচ্ছিস কেন? ‘

কথাটা সত্যি। গতকাল সন্ধ্যায় হঠাৎ আমার বাড়িতে অমিত এসে উপস্থিত হয়ে এরম একটা অনিশ্চিত যাত্রার প্রস্তাব রাখে। ওর সাথে এরকম অনেক অচেনা জায়গায় অ্যাডভেনচারে বেরিয়েছি আমি। তবে প্রতিবারই আজানা হলেও গন্তব্য নির্দিষ্ট করেই গেছি আমরা। এবারই এরম ব্যাতিক্রম হোল। যাই হোক আমি নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে বললাম,

‘কোনবার তো আমরা এরকম মাঝরাস্তায় নেমে পড়িনি। যাকগে বাদ দে। তা নামলি যে, এবার কোথায় যাবি, কোথায় থাকবি সেগুলো ভাবছিস না কি? যা জায়গা দেখছি কেউ এখানে থাকে বলে তো মনে হয় না।’  

 ‘যাহ তাই কখনও হয়? স্টেশনে যখন আছে তখন লোকও থাকে নিশ্চয়ই। চল স্টেশনমাষ্টারের কাছে যাই। তাহলে একটা হদিশ মিলবে ঠিক।‘

ভালো করে এদিক ওদিক তাকালাম। খাঁ খাঁ প্লাটফর্মের মাঝামাঝি একটা ছোট ঘরের মতো নজরে পড়ল। বললাম,

‘ওই ঘরটাই হবে। চলতো দেখি!’

 ‘হ্যাঁ চল দেখি।‘

দুজনে পা চালালাম। সেই ঘরের কাছাকাছি পৌঁছে দেখি সেটা একটা টিকিট কাউনটার। সামনে জানলায় লোহার গ্রিল দেওয়া। আর জানলার নিচের দিকে হাত গলাবার গোল একটা গর্ত। উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখলাম। ভিতরটা কেমন অন্ধকার মত। প্রথমটায় কাউকে নজরে পড়ল না! আমার দেখাদেখি অমিতও উঁকি দিলো। ডাকবো কি ডাকবোনা ভাবছি এমন সময় একটা গম্ভীর ভারী স্বর ভেসে এলো,

‘আপনারা কি এই ট্রেনে এলেন?’

খানিক চমকে উঠে ভাবছি আওয়াজটা কোনদিক থেকে এলো। তখনই আবার শুনতে পেলাম সেই গলা,

‘খুঁজে পাচ্ছেন না বুঝি? এই যে এদিকে। আরে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে দেখো! আরে পিছনে, পিছনে তাকান না!’

পিছনে তাকিয়ে দেখি একজন গোলগাল বেঁটে মতো লোক। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। পরনে সাদা জামার ওপর কালো কোট এবং সাদা প্যান্ট । আর পায়ে কালো শু। বুঝলাম ইনি টিকিট চেকার। আমি সাত তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলাম,

‘হ্যাঁ এই ট্রেন এ নামলাম। টিকিট আছে। এই অমিত এনাকে টিকিট দেখা। আর শুনুন না, এই এলাকায় লোকজন ঘরবাড়ি কিছু নেই? ‘

ভদ্রলোক একটু হেসে দুহাত নেড়ে বললেন,

‘আপনারা আমাকে চেকার ভেবেছেন। ভাবুন! আপনারা কি করে বুঝবেন? আমি মশাই একেধারে চেকার, ক্লার্ক ও স্টেশন মাষ্টার। এটাই এই স্টেশনে একমাত্র রুম । আর এইটাই আমার অফিস।‘

আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। অমিতও আমাদের টিকিট দুটো হাতে ধরে বোকার মত দাঁড়িয়ে আছে। ভদ্রলোক হাত নেড়ে বোঝালেন যে ওনার টিকিট দেখার দরকার নেই। তারপর হেসে বললেন,

‘আরে মশাই দেখাতে হবে না। আপনারা কি আর বিনা টিকিটে আসবেন? তা আসুন না, ভিতরে আসুন, একটু বসে যাবেন আমার অফিসে।‘

আমি একটু ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,  

‘ধন্যবাদ দাদা। কিন্তু আমি জানতে চাইছিলাম যে………’

ভদ্রলোক আমায় ডান হাত তুলে থামিয় দিয়ে, ইশারায় তাঁর পিছনে আসতে বলে, শুট করে সেই ঘরে ঢুকে গেলেন! আমরা একবার মুখচাওয়াচায়ি করে সেই ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। কাঠের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখি একটা বড় টেবিলের ওপাশে ভদ্রলোক বসে আছেন। টেবিলে অনেক ফাইল্ পত্র, একটা টেলিফোন। আমাদের সামনে রাখা চারটে চেয়ার দেখিয়ে উনি বসতে ইঙ্গিত করলেন। আমরা দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম। উনি বললেন,

‘ আরে বসুন বসুন। পরিচয়টা করে নেওয়া যাক । আমার নাম তপন স্যান্যাল। আপনারা ?’

‘ আমি পুলক ঘোষ আর ও হল অমিত দত্ত। আমরা দুজন বন্ধু।‘

‘ সে আপনারা বন্ধু বুঝেছি। তা এখানে মানে ……?’

আমি সাততাড়াতাড়ি বলে উঠলাম,

‘আসলে আমার এই বন্ধুটি খুব খেয়ালী। হঠাৎ হঠাৎ এরম আজানা অচেনা জায়গায় বেড়িয়ে পড়ে। আর বুঝলেন কিনা আমাকেও সঙ্গী হতে হয়। হাজার হোক বন্ধু বলে কথা!’

‘বটেই তো! বটেই তো! হে হে অ্যাডভেঞ্চারের এটাই তো বয়স।‘

তারপর খানিক গম্ভীর হয়ে বললেন,

‘কিন্তু এখানে আপনারা যে অ্যাডভেঞ্চার করতে এসেছেন সেই ব্যাপারটা মোটেই ভালো করেননি, বুঝলেন কিনা? ‘

পুলক বলল,

‘ কেন বলুন তো! জায়গাটা তো বেশ নির্জন আর ভালই মনে হচ্ছে। কোন সমস্যা আছে নাকি?’

‘সমস্যা? না মানে সেরকম কিছু না আর কি। তা আপনারা এখানে যাবেন কোথায়?’

অমিত বলল,

‘সেভাবে কিছু ঠিক করা নেই। আমরা এই জায়গায় কোনোদিন আসিনি। কোথাও একটা যাব বলে ট্রেন এ চেপে বসেছিলাম। তারপর হঠাৎ করে জায়গাটা পছন্দ হওয়ায় নেমে পড়লাম!’

তপনবাবু কিছুক্ষণ হাঁ করে অমিতের দিকে চেয়ে রইলেন। আমি ব্যাপারটা সহজ করতে বললাম,

‘আসলে আমার বন্ধুটির প্যারানরমাল বিষয়ে বিশেষ উৎসাহ আছে। সেজন্য ও এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। আর মাঝে মাঝে আমি ওর সঙ্গী হই। এই আর কি! ’

তপনবাবুর হাঁ করা মুখ আরও যেন হাঁ হয়ে গেল! তারপর তিনি কিছুটা সামলে নিয়ে বললেন,

‘প্যারানরমাল? সেটা কি ব্যাপার?’

পুলক একটু হেসে বলল,

‘তেমন কিছু নয় বুঝলেন। ওই অতিপ্রাকৃত বিষয় আর কি।’

‘অতিপ্রাকৃত? মানে ভুত??’

‘তা এক রকম বলতে পারেন।‘

 ‘মশাই খেয়ে দেয়ে কাজ আছে? এটা একটা ঘাঁটাঘাঁটি করার জিনিস? আর কোন উৎসাহ জাগানোর জিনিস পেলেন না?’

‘মানুষের তো বিভিন্ন বিষয়ে জানার ইচ্ছে থাকেই।‘

‘সে থাকুক। কিন্তু এটা কোন ইয়ারকির বিষয় নয়। আপনাদের ধারনা নেই।‘

‘ কি বলছেন? আমি অনেক তথাকথিত ভৌতিক জায়গায় গিয়েছি। রাতেও থেকেছি। ‘

‘কিছু পান নি, তাইতো?’

‘পাইনি একেবারে তা বলা যাবে না। অনুভব করেছি। তবে ভয়ঙ্কর কোনও অভিজ্ঞতা সেরকম হয়নি।‘

‘বুঝতে পেরেছি। তবে আপনারা যেখানে এসে পড়েছেন, সেখানে আপনাদের আর কোন আফসোস থাকবে বলে মনে হয় না।‘

আমি চমকে উঠলাম! এ লোক বলে কি? তাড়াতাড়ি বললাম,

‘মানে এখানে কি ভুতের উপদ্রব আছে নাকি?’

তপন বাবু আমার দিকে চেয়ে একটু হাসলেন। তারপরে বললেন,

‘আপনাদের বয়স কম ,দেখার জানার অনেক কিছু বাকি আছে।‘

অমিত জোরে হেসে উঠে বলল,

‘বাঃ খুব ভালো। তা তেনাদের দেখা পাব তো এখানে?’

তপনবাবু একটু গম্ভীর মুখে তাকালেন অমিতের দিকে। তারপর বললেন,

‘হুম! আজ রাতে আমার ঘরে থাকুন! সব বলব আপনাদের। তারপর বুঝবেন।‘

আমি চারিদিকে তাকিয়ে বললাম,

‘কোথায় থাকব? এই ঘরে?’

তপন বাবু এবারে হাসলেন,

‘আরে না না! এই ঘরে কেন? আমার কোয়ার্টার আছে কাছেই। ঐযে ফাঁকা শুনশান দিকটা, ঐ দিকেই! তবে সে এমনই, যে তাকে কোয়ার্টার না বলে ঘর বলি আমি।‘

আমি বললাম,

‘রাতে  স্টেশনে থাকতে হয় না?’

‘তা হবে না কেন? আমার একজন সঙ্গী আছে। হীরা। দিনে আমার ওই ঘরে থাকে আর রাতে স্টেশনে থাকে। কোন জরুরী প্রয়োজন হলে আমায় ঘর থেকে ডেকে দেয়। রান্না বান্না ওই করে। খুবই ভালো হাত।‘  

‘আচ্ছা তপনবাবু একটা কথা, প্ল্যাটফর্মের দুটো দিক দুরকম কেন? একটা দিকে ঝোপঝাড়, গাছপালা আর একটা দিকে ফাঁকা শুনশান?’

‘ধৈর্য ধরুন ভাই। সব শুনবেন। আগে আমার ঘরে চলুন। আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসি। আপনারা বিশ্রাম করুন। তারপরে রাতে জমিয়ে আড্ডা মারা যাবে।‘ 

আমরা তপনবাবুর সাথে সেই ধূ ধূ ধূসর প্রান্তরের দিকে পা বাড়ালাম।

 

হাতে গড়া রুটি সহযোগে দেশী মুরগির ঝোল দিয়ে বেশ জমিয়ে ডিনার সারলাম। হীরার হাতের রান্নার সত্যিই তুলনা নেই! তবে হীরার হাতের গুণ যেমন, তেমনই উলটো তার স্বভাব। অমিতের বহু চেষ্টার পরও তার কাছ থেকে কোন খবর উদ্ধার করা গেল না। ঘটনা জানা গেল তপন বাবুর কাছ থেকে। তিনি মজলিশী লোক। খাওয়া দাওয়ার পরে একটা পান মুখে দিয়ে তিনি বিছানায় বালিশ ঠেসান দিয়ে বসলেন। আমরাও বসলাম তাঁর উলটো দিকে । পান তিনি আমাদেরও অফার করেছিলেন, তবে আমরা না করলাম। জর্দা পান খাওয়ার অভ্যাস নেই। আমরা একটা করে সিগারেট ধরালাম।

 ‘শুনুন তবে। আমার বয়স বাহাণ্ণ। রেলের চাকরীতে আমার চব্বিশ বছর হয়ে গেল। বহু জায়গা ঘুরলাম। এই শেষ বয়সে এসে বড়কর্তাদের কি দুর্মতি হল আমায় এই ধ্যাদ্ধারা ঝিনুকখালিতে এনে ফেলল। বাকি জীবনটা বোধহয় এখানেই কাটবে।‘

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন তিনি। তারপরে আবার বলতে শুরু করলেন,

‘যাক আমার কথা বাদ দিন। যেটা বলছিলাম সেটাই বলি। বছর দুই আড়াই আগে আমি এখানে বদলি হয়ে আসি। এসে আপনাদের মতই হতবাক হয়ে গেছিলাম। যাইহোক আগের যিনি স্টেশনমাস্টার ছিলেন, তিনিই সব বন্দোবস্ত করে দেন। যে ঘরে তিনি থাকতেন সে ঘরে এখন আমি থাকি। এই হীরা তাঁরই আবিষ্কার। বেশ মনে আছে সারাদিনে চার্জ বুঝে নিয়ে, রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে, এই খাটেই দুজনে বসেছিলাম। পরদিন সকালে উনি চলে যাবেন। ও হ্যাঁ ওনার নামটা বলা হয়নি। ওনার নাম ছিল সুভাষ দাস। আমরা দুজনে প্রায় সমবয়সী। উনি বোধহয় এক আধ বছরের বড়ো হবেন। যাই হোক আমরা বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছিলাম। পারিবারিক, সাংসারিক, কর্মক্ষেত্রের কথা। বেশ চলছিল আমাদের আড্ডা! বেশ জমাটি ভাব! সময় কোথা দিয়ে চলে যাচ্ছে, খেয়াল নেই। হঠাৎ করে একটা আর্ত চিৎকারে আমি চমকে, উঠে বসলাম। সুভাষদাও দেখলাম স্থির হয়ে বসেছেন। চোখে মুখে একরাশ উদ্বেগ! বললাম,

‘কী ব্যাপার সুভাষদা? এ কিসের চিৎকার?’

‘দাঁড়ান ভাই, এখন কোনও কোথা বলবেন না। কোনও শব্দ করবেন না। যাই ঘটুক না কেন।‘

আমি ব্যাপারটা ভালো বুঝতে না পেরে আবার জিজ্ঞেস করলাম,

‘কোনও সমস্যা নাকি দাদা?’

জবাবে তিনি মুখে আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন! তাঁর চোখ বিস্ফারিত! ওদিকে চিৎকারটা একবার হওয়ার পরে বাকি সব নিস্তব্ধ। আর কোনও আওয়াজ নেই। ঘরের মধ্যে পিন পড়লেও শোনা যাবে,এমন নিস্তব্ধতা। হঠাৎ খেয়াল করলাম যে একটানা একটা ঝি ঝির ডাক শোনা যাচ্ছিলো সেটাও আর শোনা যাচ্ছে না। নিজের হার্ট বিট যেন কানে শুনতে পাচ্ছিলাম। বাঁ হাতের কব্জির দিকে নজর করলাম রাত আড়াইটে। কতক্ষণ বসেছিলাম খেয়াল নেই , হঠাৎ একটা গুম গুম আওয়াজ কানে এলো! যেন একটা জলরাশি হঠাৎ বাঁধনহারা হয়ে ধেয়ে আসছে! আমি আবার সুভাষদার দিকে চোখ ফেরালাম। দেখলাম তাঁর মুখে চরম আতঙ্ক, আর চোখ বিস্ফারিত! সহজ কথায় বলতে গেলে, তিনি ভীষণ ভয় পেয়েছেন! তিনি এবারে একটা কাণ্ড করলেন! একলাফ দিয়ে উঠে ওই যে দেখছেন জানলাটা আপনাদের পিছনে, সেটা সশব্দে বন্ধ করলেন। আর ছিটকিনি লাগালেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঐ চিৎকারটা আরেকবার শোনা গেলো! তবে আগেরবারের থেকে অনেক বেশি জোরে ! আওয়াজটা কি আরও কাছে আসলো আগের থেকে? আর সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেলো জলের শব্দ। যেন জল ধেয়ে আসছে। আমি সভয়ে বসে রইলাম। সুভাষদা হঠাৎ করে ঘরের আলো নিভিয়ে দিলেন। আমি চিৎকার করে উঠলাম,

‘একি আলো নেভালেন কেন?’

সঙ্গে সঙ্গে কে যেন বন্ধ জানলাটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। জানলাটা মড়মড় করে উঠল! সুভাষদা প্রায় ফিস ফিস করে বললেন,

‘দোহাই আপনার, কথা বলবেন না! কোনও শব্দ করবেন না। যাই ঘটুক না কেন।‘  

বলতে বলতে জানলায় আবার ধাক্কা ! আবার মড় মড় শব্দ ! সাথে আরেকটা চিৎকার! এবার যেন চিৎকারটা একটু অন্যরকমের। একটা যেন চাপা নিষ্ফল আক্রোশ ! যেন কেউ ঘরে ঢুকতে চাইছে কিন্তু বিফল হয়ে ভীষণ আক্রোশে আস্ফালন করছে! আমি চুপ করে গেলাম। আর ভাবতে লাগলাম এসব কী হচ্ছে ? হঠাৎ কি ঝড় উঠলো ? এটা কি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নাকি অন্যকিছু? তবে সুভাষদার হাবভাব দেখেশুনে মনে হচ্ছিলো আর যাই হোক এটা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়! অন্ধকারে বসে আছি। অনুভব করতে পারছি কে যেন ঘরের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে! যেন ঢোকার পথ খুঁজছে। আর আমার কেবলই মনে হতে লাগলো যে ঐ বাইরের শক্তিটি যদি একবার ঘরে ঢুকতে পারে, তবে সমূহ সর্বনাশ! প্রাণ হাতে করে অন্ধকারে বসে রইলাম! কতক্ষণ এভাবে বসে রইলাম জানি না। সুভাষদাকে দেখতে পাচ্ছি না। শুধু মনে হচ্ছে যে তিনি ঘরের মধ্যে উপস্থিত আছেন ! হঠাৎ কানে তালা লাগানো শব্দে একটা বাজ পড়ল! পুরো বাড়ীটাই যেন কেঁপে উঠলো! মনে হল সবকিছু যেন ভেঙ্গে পড়বে! আর সহ্য করতে পারলাম না! সাবধান করে দেওয়া সত্ত্বেও আমার মুখ দিয়ে একটা আর্ত চিৎকার বেরিয়ে এলো! সঙ্গে সঙ্গে একটা বিকট শব্দে জানলা এবং দরজা দড়াম করে খুলে গেল! আর ঘরের ভিতরে একটা প্রবল শক্তি যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল! মনে হল হঠাৎ যেন আমি  জলের মধ্যে পড়ে গেলাম! গভীর শীতল সেই জলরাশি! সুভাষদার চিৎকার শোনা গেল;

 ‘কি করলেন! কেন চিৎকার করলেন? কেউ আর বাঁচবো না!’

আমি ততক্ষণ যেন গভীর জলে হাবুডুবু খাচ্ছি ! প্রাণপণে হাত পা ছুড়ছি! তবু কোনক্রমে বলে উঠলাম,

‘সুভাষদা ঘরের মধ্যে এতো জল কোথা দিয়ে এলো? দম আটকে আসছে! বাঁচান! আমি সাঁতার জানিনা!’

সুভাষদা সমানে চিৎকার করছেন,

‘ঝিনুকখালির বিল ! ঝিনুকখালির বিল ! জেগে উঠেছে! আর বাঁচব না। সবাই ডুবে যাব!’

আমি ঝাঁঝিয়ে উঠলাম,  

‘কি বলছেন? ঘরের মধ্যে এতো জল এলো কোথা থেকে? ‘

একটা চিৎকার করে উঠে সুভাষদা থেমে গেলেন! আর তাঁর কোন সাড়া পেলাম না! দু চারবার তাঁর নাম ধরে ডেকে, যখন তিনি সাড়া দিলেন না, তখন মরিয়া হয়ে আমি নিজেই বাঁচার চেষ্টা করতে লাগলাম। চারিদিকে জল যেন ফুঁসছে! আমার গলা অব্দি জল পৌঁছে গেছে! মাঝে মাঝে নাকে মুখে ঢুকছে! আমি যেন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। ঘরের আসবাবগুলো গেল কোথায়? খাটটাই বা কোথায়? কেমন দিশাহারা লাগতে লাগলো! হঠাৎ করে কি বন্যা এলো নাকি? শব্দ শুনে বুঝতে পারছি এখনো প্রবল বেগে ঘরের মধ্যে জল ঢুকছে! ক্রমেই জল আমার মাথা ছাড়িয়ে উঠল! প্রবল ঠাণ্ডায় আমার যেন হাতে পায়ে কাঁপুনি ধরে এলো! একটা আতঙ্ক আমার হৃদপিণ্ডটাকে চেপে ধরল। পাগলের মতো হাত পা ছুঁড়তে লাগলাম! মুখের মধ্যে জল ঢুকে গেল! ঠাণ্ডা, নোনতা, সেই জলের স্বাদ! একি সমুদ্রের জল নাকি? বার কতক লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করলাম! চিৎকার করলাম,

‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ 

কিন্তু কোথায় কি? আমার প্রতিটি চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে যেন প্রবল আক্রোশে জল আমায় ডুবিয়ে দিতে ধেয়ে এলো! এভাবে কতক্ষণ পারা যায়! আস্তে, আস্তে, যেন আমার হাত পা শিথিল হয়ে আসতে লাগল! বুঝতে পারছিলাম আমি এবারে ডুবে যাব! আর নিস্তার নেই! একবার শেষ শক্তিটুকু সঞ্চয় করে চিৎকার করে উঠলাম! প্রবল জলরাশি আরও প্রবল বেগে আমায় ধাক্কা মেরে নিচের দিকে চেপে ধরল! আমার বাহ্যজ্ঞা্ন যেন আস্তে আস্তে লোপ পেল! অনুভব করলাম আমি অতলে নামছি। ধীরে ধীরে। তারপরে আর কিছু মনে নেই!’

তপনবাবু চুপ করলেন। আমরাও যেন বাস্তবে ফিরে এলাম! অমিত একবার আমার দিকে তাকাল, আর আমি ওর দিকে। তারপরে অমিত তপনবাবুর দিকে ফিরে বলল,

‘তারপরে কি হল?’

তপনবাবু মুচকি হাসলেন। তারপর বললেন

‘সেটাই তো ক্লাইম্যাক্স ভাই! তাই পরে বলছি। আগে ঝিনুকখালির বিলের কথা শুনুন! বেশি সময় নেই!’

আমি বললাম,

‘সময় নেই? কেন?’

‘একটা ট্রেন আসবে শেষ রাতে। পাস করাতে হবে।‘

‘ওঃ আচ্ছা । বলুন তবে।‘

‘হ্যাঁ শুনুন বলি। এই এলাকায় একটা খুব বড় বিল আছে। ওটাকেই ঝিনুকখালির বিল বলে। এই ঘর থেকে বেরিয়ে আন্দাজ দুই কিলোমিটার পশ্চিমে গেলে ওই বিলের দেখা পাবেন। ষ্টেশনের এই দিকটা একেবারে ফাঁকা। শুনেছি অনেকদিন আগে এদিকে বেশ কিছু ঘরবাড়ি ছিল। তবে একটা ঘটনা ঘটার পরে আর কেউ নেই। এখানে একজন বিধবা মহিলা থাকত। একাই থাকত। কারও সাথে বিশেষ কথা বলত না। ঘর থেকেও বড় একটা বের হতো না। কিভাবে তাঁর চলত সেটাও লোকে জানত না। তার ঘর থেকে রাতে নাকি কিরকম সব অদ্ভুত আওয়াজ পাওয়া যেত। স্বভাবিকভাবেই  রটে গেল, সে নাকি ডাইনি। এই এলাকায় যারা থাকত তারা একদিন তাকে লাঠি, ইট নিয়ে তাড়া করল। মহিলা প্রাণভয়ে দৌড়োতে লাগল। পিছনে মেয়ে, পুরুষ সবাই দৌড়চ্ছে। দৌড়োতে দৌড়াতে মহিলা সেই বিলের একেবারে ধারে এসে থমকে দাঁড়াল। আর পালাবার পথ নেই। গ্রামবাসীরা তাকে চক্রাকারে ঘিরে ফেলেছে ! সে একবার পিছনে ফিরল। এই সময়ে দশ বারোটা ইট তার দিকে উড়ে এলো! একটা এসে লাগল তার কপালের ওপর। সে টাল খেয়ে বিলের জলে পড়ে গেল। বিলের জল আকাশে ছিটকে উঠল। সবাই হই হই করে উঠল! তবে আশ্চর্যর বিষয়, জলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে ডুবে গেল। আর উঠল না। লোকজন তাড়াতাড়ি বিলের ধারে এসে দাঁড়াল। প্রায় ঘণ্টা খানেক দাঁড়িয়েও যখন সে জলে ভেসে উঠল না, তখন সবাই বুঝল যে মহিলা ডুবে মরেছে! তারপর আপদ গেছে মনে করে যে যার ঘরে ফিরে গেল! তারপরে দুচার মাস নির্বিঘ্নে কেটে গেল। আশ্চর্যের কথা সেই মহিলার দেহ কিন্তু কোনোদিন ভেসে ওঠেনি! ঝিনুকখালির বিল যেন তাকে গ্রাস করেছিল! তারপরে হঠাৎ একদিন সকালে গ্রাম শুদ্ধ লোকজন অদৃশ্য হয়ে গেল!’

আমি আর পুলক চমকে উঠলাম!

‘অদৃশ্য হয়ে গেল মানে?’

 ‘অদৃশ্য হয়ে গেল মানে আবার কি? সকাল থেকে তাদের কাউকে আর আজ পর্যন্ত কেউ দেখেনি।‘

 ‘সেকি! তারা গেল কোথায়?’

‘সেটাই তো রহস্য! তবে তাদের পড়ে থাকা ঘরবাড়ির দেওয়ালে, জিনিসপত্রে জলের দাগ ছিল। ঘোলা, শ্যাওলা ধরা দাগ!’

‘অবিশ্বাস্য!’  

অমিত জোরের সাথে বলে উঠল!

‘তা বলতে পারেন ভাই! তবে কিনা যা ঘটেছিল তাই বলছি! আর শুধু তাই নয়।’

থামলেন তপনবাবু।

‘আবার কি?’

আমি বললাম।

‘আস্তে, আস্তে, গাছপালা সব মরে গেল! মানে ঘাস, আগাছা পর্যন্ত! পড়ে রইলো শুধু ধূসর একটা প্রান্তর!’

অমিত জিজ্ঞেস করল,

‘আর তাদের জিনিসপত্র গুলো?’

‘হাসালেন ভাই! রেললাইনের ওপার থেকে যারা এসেছিল তারা কি আর কিছু বাকি রেখেছে ভেবেছেন? ‘

‘ তা অবশ্য! তারপরে কি হল?’ 

‘তারপরে আর কি? ঘটনা এখানেই শেষ!’

‘শেষ! সেকি কথা! এখনো তো অনেক কিছু জানার বাকি রয়ে গেল!’

‘আচ্ছা বলুন কি জানতে চান।‘

‘সুভাষবাবুর কি হল?’

‘সেটা তো বললাম। তাকে আর দেখিনি কোনোদিন।‘

আমরা চুপ করে রইলাম! তারপরে অমিত বলল,

‘আচ্ছা আপনি বললেন সেদিন রাত আড়াইটে নাগাদ সেই অলৌকিক ঘটনার সুত্রপাত হয়েছিল!’

‘হ্যাঁ।‘

‘তা সেদিনের পরে ওরকম ঘটনা আর ঘটেনি?’

তপন বাবু হাসলেন।

‘কেন ঘটবে না? রোজ রাতেই ঘটে!’

‘রোজ রাতেই ঘটে?’

‘হ্যাঁ। একদিনও বাদ নেই!’

'একদিনও বাদ নেই?'

'না।'

‘আজও ঘটবে বলছেন?’

‘একশ শতাংশ!’

সঙ্গে সঙ্গে আমরা কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকালাম। আড়াইটে বাজতে দুচার মিনিট বাকি! এক অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠল! অমিতের নার্ভ বেশ শক্ত। সে মুখ তুলে প্রশ্ন করল,

‘আচ্ছা হীরা তো সে রাতে বাইরে ছিল, আর প্রতি রাতেই থাকে! ও কিছু দেখেনা, বা শোনে না?’

তপন বাবু মুখে একটা মৃদু হাসি ছড়িয়ে পড়ল! কিন্তু তিনি জবাব দেওয়ার আগেই আমাদের পিছন দিকের সেই জানলা দিয়ে একটা আর্ত চিৎকার ভেসে এলো! আমরা চমকে পিছন ফিরলাম! খোলা জানলার বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার! তারপর আমরা তপন বাবুর দিকে ফিরলাম! আর ফিরেই আমাদের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল! আমাদের সামনে কেউ নেই! আমরা তড়াক করে উঠে দাঁড়ালাম ! অমিত বলে উঠল,

‘ পুলক দৌড়ো!’

আমরা দরজার দিকে এগোতেই, ঘরের আলো নিভে গিয়ে অন্ধকার হয়ে গেল! হাত বাড়িয়ে অমিত ততক্ষণে দরজা খুলে ফেলেছে!

‘চলে আয় পুলক, তাড়াতাড়ি!’

আমরা ঘরের বাইরে পা রাখব, এমন সময় অন্ধকারে একটা অট্টহাসি শোনা গেল! আর একটা গলা ভেসে এল,

‘ঝিনুকখালির বিল ! ঝিনুকখালির বিল জেগে উঠেছে! কেউ বাঁচবে না। সবাই ডুবে যাবে!’

গলাটা নিশ্চিত ভাবেই তপনবাবুর! সাথে একটা প্রবল জলোচ্ছ্বাসের শব্দ শোনা গেল। আমরা আর দাঁড়ালাম না! প্রাণপণে দৌড় দিলাম! অমিত বলল,

 ‘যেদিক দিয়ে এসেছিলাম, সেদিকে দৌড়ো ! রেললাইনটা যে করেই হোক পার হতে হবে; কোনও অঘটন ঘটার আগে!’

কাছেই আবার সেই আর্ত চিৎকারটা শোনা গেল! কোনকিছু ভাবার আর সময় নেই! আমি দৌড়চ্ছি! জানি না অমিত কোনদিকে আছে! পিছনে এক অশান্ত জলরাশি আমায় ধাওয়া করছে! আমি শুনতে পাচ্ছি! আরও গতি বাড়ালাম! এই দৌড়ের ওপর জীবনের বাজি! কাছেই প্রচণ্ড শব্দে একটা বাজ পড়ল! পায়ের নিচের মাটি ভয়ঙ্কর ভাবে কেঁপে উঠলো! আমি ছিটকে পড়লাম! একঝলক আলোতে চারদিক আলোকিত হল! মাথা তুলে রেললাইনটা দেখতে পেলাম! তারপরে আবার অন্ধকার! জলোচ্ছ্বাসের শব্দ ভেদ করে আবার শোনা গেল তপনবাবুর গমগমে আওয়াজ,

 ‘ঝিনুকখালির বিল জেগে উঠেছে! কেউ বাঁচবে না। সবাই ডুবে যাবে! হা হা হা!’

সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে উঠে দাঁড়ালাম! রেললাইনে যে করেই হোক পৌঁছোতে হবে আমাকে। আমি ছূট লাগালাম। আমার সামনে ক্রমশ এগিয়ে আসছে রেললাইন আর পেছনে ছুটে আসছে অশান্ত ঝিনুকখালির বিল !   

0 comments: