সম্পাদকের কলমে
নারায়ণ দেবনাথ-
সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম ।
ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম ।
নমস্কার সহ
অঙ্কুর রায়
সংখ্যার সম্পাদক
অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী
প্রধান সম্পাদক
লেখা পাঠানোর জন্য
আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com
Total Pageviews
By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.
ধন্না সিং
অঙ্কুর রায়
ছেলের ফোনটা রেখে ব্যাজার মুখে চায়ে চুমুক দিয়ে কাগজটা টেনে নিলেন দীপেনবাবু । সকাল সাড়ে সাতটা । বাইরেটা ঘন কুয়াশায় অদৃশ্য হয়ে আছে । ঠিক দিল্লির মত । ছেলে দিল্লিতে থাকে । কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার , ওএনজিসির উঁচু পদে চাকরি করে। প্রতি বছর ক্রিসমাসের সময় ছেলে , বৌমা , নাতি কলকাতায় আসে। কয়েকদিন হৈ হৈ করে আনন্দ , এদিক ওদিক ঘোরা এসব করে জানুয়ারিতে মা বাবাকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লি ফিরে যায়।
দিল্লিতে ঠাণ্ডাটা একটু বেশী , কুয়াশার দাপটও বেশী , কোন কোন দিন রোদের দেখাও পাওয়া যায় না। কিন্তু শীতের দিল্লি দীপেনবাবুর খুবই পছন্দের। শীতের রোদ পিঠে জড়িয়ে কুতুব কমপ্লেক্স , হুমায়ূন টম্ব এসব দেখতে তাঁর খুবই ভালো লাগে । আরো ভালো লাগে এইজন্য যে সঙ্গে থাকে নাতি । নাতিকে প্রতিটা জায়গার কাহিনী বলেন , বছর দশেকের বুমবুম মন দিয়ে শোনে ঠিক বাবুয়া যেমন করে ছোটবেলায় শুনতো । বছর কয়েক আগে ফেলে আসা কলেজের ছাত্রছাত্রীদের সামনে পুরোনো দিনকে ছবির মত ফুটিয়ে তুলতে পারার তাঁর বিরল গুণটা দিল্লীর ঐতিহাসিক পরিবেশে নাতিকেও মুগ্ধ করে দেয় । এর সাথেই ছেলে যে তিন চারদিনের ছুটি নিয়ে গাড়ি চালিয়ে কোনবার জয়পুর , কোনবার দেরাদুন বা হরিদ্বার থেকে ঘুরিয়ে আনে সেটাও তাঁর খুবই পছন্দের । কেতকী দিল্লীর শীতে একটু কাবু হলেও ছেলে আর নাতির সাথে থাকার লোভে প্রতিবছর শীতকালে দিল্লী যাওয়া নিয়ে আপত্তি করেন না ।
এবারও ছেলেদের সাথে দীপেনবাবুদের যাবার প্লেনের টিকিট অনেক আগে থেকেই কেটে রাখা আছে । আজকে সকালে ছেলে ফোন করে বলছে কৃষক আন্দোলন নিয়ে দিল্লী উত্তাল । কৃষকরা দিল্লীর ঢোকা বেরোনোর সব রাস্তা অবরোধ করে রেখেছে । এই প্রচণ্ড ঠাণ্ডাতেও ওরা রাস্তায়। ট্রাক্টর আর ট্রাকে করে কয়েক মাসের খাবার নিয়ে এসেছে , তার ওপরে তেরপল টানিয়ে অস্থায়ী ঘর করে ওরা আছে । স্থানীয় অনেক মানুষ নিজেদের বাড়ি , বাথরুম ওদের খুলে দিয়েছে , অনেক সংগঠন ওদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে । একমাত্র জয়পুরের দিকের রাস্তাটা এখনও খোলা আছে , সেটাও কয়েকদিনের মধ্যে রাজস্থান থেকে কৃষকরা এসে অবরুদ্ধ করে দেবে । তাই ছেলে বলছে এবার আর গাড়ি নিয়ে কোথাও ঘুরে আসা সম্ভব নয় । এলে শুধু দিল্লিতেই থাকতে হবে হয়তো দিল্লির মধ্যেও অত ঘোরাঘুরি করা যাবে না । ছেলে ভাবনাচিন্তা করে দেখতে বলেছে যে দীপেনবাবুদের আসাটা ক্যানসেল করে ছেলেই ছুটিটা একটু এক্সটেণ্ড করে কলকাতায় আসবে কিনা । কলকাতা থেকেই এবার না হয় পূরী বা অন্য কোথাও চার পাঁচদিনের জন্য ঘুরে আসা যাবে । ছেলে আবার রাত্রিবেলা ফোন করবে ।টিকিট ক্যানসেল করা , নতুন টিকিট কাটা এসব করতে হবে তো । নতুন কোথাও গেলে তার টিকিট , বুকিং এসবও করতে হবে । এইসব শুনে দীপেনবাবুর মেজাজটাই গেছে খিঁচড়ে । অন্য কোথাও তো বছরের যে কোন সময় যাওয়াই যায় , তিনি গিয়েও থাকেন । কিন্তু শীতকালে দিল্লিটাই তাঁকে ভীষণ টানে । গত কয়েক বছর ধরে গিয়ে গিয়ে একটা অভ্যাসও হয়ে গেছে ।
দিল্লিতে কৃষকদের আন্দোলনের কথা কিছু ভাসা ভাসা কানে এসেছে দীপেনবাবুর । কলকাতার কাগজে এ নিয়ে বিশেষ কিছু লিখছে না , নিউজ চ্যানেলও দেখাচ্ছে না । ইংরেজি কাগজ পড়েই যেটুকু উনি জেনেছেন । ছেলে বলছিল চাষীদের ভুল বুঝিয়ে নিয়ে এসেছে রাজনৈতিক দলগুলো । যে আইন নিয়ে ওদের এত আপত্তি তাতে নাকি ওদের লাভ বই ক্ষতি নেই । ইদানিং রাজনৈতিক কচকচি নিয়ে অত মাথা ঘামান না দীপেনবাবু । তেতো মুখে চায়ে আর একটা চুমুক দিয়ে কাগজটা খুললেন ।
প্রথম পাতার তলার দিকে একটা শিরোনামে চোখ আটকে গেল দীপেনবাবুর -'' কৃষক আন্দোলনের প্রথম শহীদ ধন্না সিং'' । সাথে ছবি । ছবিটার ওপর চোখ পড়তেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো দীপেনবাবুর । পাগড়ি পরা বছর পঞ্চাশেকের একটা মুখ । মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি । ঠিক তাঁর বাবার মত । তাঁদের গ্রামের বাড়িতে বাবার একটা ছবি ঝুলত। দীপেনবাবুর ছোটবেলাতেই তাঁর বাবা মারা গিয়েছিলেন । বাবাকে তাঁর ভালো মনে নেই । ঐ ছবিটাই তাঁর কাছে বাবা ।
তাঁদের দেশের বাড়ি বর্ধমানে । তাঁর বাবা স্কুলে পড়াতেন । তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। তখন কমিউনিস্ট পার্টি জোতদারদের থেকে সিলিং বহির্ভূত জমি কেড়ে নেবার জন্য আন্দোলন করছে। জোতদাররাও লেঠেল লেলিয়ে দিচ্ছে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে । গ্রামে মাঝেমাঝে পুলিশ আসে। গ্রামের জোতদার জীবন চৌধুরি একদিন তাঁদের বাড়ি বয়ে এসে উপদেশ দেবার নাম করে একরকম হুমকিই দিয়ে গেল । এর কিছুদিন পরে এক রাতে দীপেনবাবুর বাবা আর বাড়ি ফিরলেন না। পরের দিন সকালে একটা আলের রাস্তার পাশে তাঁকে পড়ে থাকতে দেখা যায় । পাশে তাঁর সাইকেলটা পড়ে আছে ।
দীপেনবাবু ভালো করে খবরটা পড়লেন । পাঞ্জাবের মনসা জেলায় ধন্না সিংয়ের বাড়ি ।আশেপাশের চল্লিশটা গ্রাম থেকে সঙ্গীসাথী জুটিয়ে একটা ট্রাক্টর চেপে দিল্লি আসছিলেন ধর্নায় যোগ দিতে । ট্রাক্টরের পিছনে লাগানো ট্রলিতে জনা পঞ্চাশ বসেছিলেন । ধন্না এবং আর একজন ট্রাক্টরের দুদিকে বসেছিলেন । ভিওয়ানি দিল্লি হাইওয়েতে একটা ট্রাক পিছন থেকে এসে ট্রলিতে ধাক্কা মারে । ধন্না সিং ছিটকে নিচে পড়ে নিজের ট্রাক্টরের চাকাতেই চাপা পড়েন ।
দীপেনবাবু ইন্টারনেট ঘেঁটে কৃষক আন্দোলন সম্বন্ধে সব খবর পড়লেন। কী নিয়ে চাষীদের আপত্তি , কতজন চাষী যোগ দিয়েছে , কোন কোন সংগঠন আছে সবকিছু । সংসদে পাশ করা আইনগুলোতেও কী বলা আছে সেসবও দেখলেন ।কৃষক সংগঠনগুলো অ্যাকাউণ্ট নম্বর দিয়ে সবার কাছে সাহায্য চেয়েছে সেটাও চোখে পড়লো তাঁর । কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে ছেলেকে ফোন করলেন দীপেনবাবু । বললেন - '' তোকে একটা অ্যাকাউণ্ট নম্বর দিচ্ছি । হাজার দশেক টাকা পাঠিয়ে দে । দেখা হলে তোকে আমি দিয়ে দিচ্ছি । '
- '' কার অ্যাকাউণ্ট ? '' ছেলে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো ।
- '' সারা ভারত কৃষক সভার । আর শোন টিকিট ক্যানসেল করতে হবে না। আমরা তোদের সাথে দিল্লি যাব । ''
ছেলে আরো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো - '' সে এসো। আর আমি টাকাও দিয়ে দিচ্ছি । কিন্তু তুমি হঠাৎ করে এসব বলছো যে ? একটু আগেইতো তোমার সাথে কথা বললাম ! ''
দীপেনবাবু বিড়বিড় করে বললেন - '' ধন্না সিং । ''
Subscribe to:
Posts (Atom)
0 comments:
Post a Comment