সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
সেলুলয়েডে স্বদেশ
অভিষেক ঘোষ
“সারেগামাপাধানি
বোম ফেলেছে জাপানি
বোমের ভেতর কেউটে সাপ
ব্রিটিশ বলে বাপরে বাপ ।”
পার্ল হারবারের ঘটনার পর উত্তর কোলকাতার রকে গলিতে মুখে মুখে ফিরত এই ছড়া । এই ঘটনার পরপরই হাতিবাগান বাজার অঞ্চলেই বোমা পড়েছিল । তখন ব্ল্যাকআউটের সময় । সূর্যের আলো অপসৃত হলেই চতুর্দিকে অন্ধকার । রাস্তার আলোকস্তম্ভ কালো কাপড়ে আচ্ছাদিত, বাড়ি-ঘর, দোকান-পাঠ কপাট বন্ধ, জানালাও খোলা বারণ । অন্ন ও বস্ত্র সংকট এতটাই তীব্র আকার ধারণ করেছিল, যা আজকের প্রজন্ম বোধহয় কোনোভাবেই কল্পনাও করতে পারবে না । বিভূতিভূষণের ‘অশনি সংকেত’, বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুঃশাসনীয়’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘ফ্যান’ তার দলিল । সেকালেই প্রথম সিভিল গার্ডের উৎপত্তি এবং পথের ধারে নিয়ন্ত্রিত রেশন বিলি-র সময় কোনো বৃদ্ধা-কে ঠেলে সরিয়ে দিলে পুলিশের তুলনায় অপেক্ষাকৃত হীনবল সিভিল গার্ডদের শুনতে হতো, ‘‘ব্যাটা শিমূল কাঠ” (নামের সাযুজ্যে) । তারপর সেই কুখ্যাত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা । সমরেশ বসুর ‘আদাব’ পড়লে আজও যার বিবরণ বুকে হাহাকার তোলে । ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ সংঘটন ও নোয়াখালির ঘটনা সামলাতে গান্ধীজির বেলেঘাটায় অবস্থান । গোটা চিৎপুর জুড়ে মানুষের লাশ আর লাশের পাহাড় — অন্যত্রও অল্পবিস্তর তাই । সেসময় এই কলকাতার মানুষই দেখেছে লাখ লাখ জীবন্ত কঙ্কাল হেঁটে চলেছে, দেখেছে অসংখ্য মৃতের স্তূপ । আর এতকিছু পেরিয়ে এসে তবেই আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীনতা, তা-ও দ্বিখন্ডিত । বাংলা আর পাঞ্জাব ভাগ হয়ে গেল । মান্টো-র তোবা টেক সিং -এর মতো কত লোক সীমান্তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো । আর তারপরে এলো আরো কঠিন চ্যালেঞ্জ । যে ভারত আমরা পেলাম, তাকে ধ্বংসস্তূপ থেকে ফের গড়ে নিতে পারবো তো ! কতটা সফল আমরা হয়েছি, তার প্রমাণ আজ আমাদের সামনে । আজকের স্কুল পড়ুয়াদের অনেকেই স্বাধীনতা দিবস বললেই ১৯৪৭ সালটা প্রথম সুযোগে বলে ফেলতে পারলেও ১৫ই আগস্ট-টা চট করে বলতে পারে না । স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মরণ করা তো দূর অস্ত । এই প্রজন্ম-কে স্বদেশি যুগ ও সংগ্রামীদের সম্বন্ধে সচেতন করে তুলতে বড়ো হাতিয়ার হয়ে উঠতে যেমন পারে সাহিত্য, তেমনি পারে সিনেমা ।
সাতচল্লিশে ভারত স্বাধীন হল । কিন্তু সেই স্বাধীনতা উদযাপন করতে হলো অগণিত স্বজনহারা, ভিটেছাড়া, ছিন্নমূল মানুষের মাঝে । চোখে তখনো ভাসছে ভয়াবহ দাঙ্গার স্মৃতি, বহু পরিচিত মুখের সহসা অপরিচিত হয়ে ওঠার বেদনা, চরম আত্মগ্লানি, অপরাধবোধ আর গৃহে গৃহে তখন নিদারুণ অর্থনৈতিক সংকট । এই বিপন্নতার মধ্যেও মানুষ স্বাধীনতা উদযাপন করল, স্বপ্ন দেখল একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও প্রজাতান্ত্রিক দেশ গঠনের । সামনে তখন মহাত্মা, নেতাজি, বল্লভভাই প্যাটেল, নেহেরু, সাভারকরের আদর্শ । এবং এই নবগঠিত দেশের চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও এল অবশ্যম্ভাবী দিনবদল । স্টুডিও সিস্টেম বিদায় নিল । জন্ম হলো স্টার সিস্টেমের । কেন ? কারণ, আদর্শ চাই যে । দেশবাসীদের ‘নতুন ভারত’-এর স্বপ্ন দেখাতে হবে যে । তৈরি করতে হবে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে একটা দ্বিধাহীন সম্যক ধারণা । সেল্যুলয়েড ছাড়া যা দ্রুত সম্ভবপর হতো না । কিন্তু তার মধ্যেও কেউ কেউ ছিলেন যাঁরা যন্ত্রণার স্মৃতিগুলো অত সহজে ভুলে যেতে পারলেন না । নাড়ি ছিঁড়ে যাওয়ার বেদনা মন থেকে মুছে ফেলার গড্ডলিকাপ্রবাহে মিশে যেতে তীব্র অনীহা প্রকাশ করলেন তাঁরা । এই গুটিকয়েক একগুঁয়ে মানুষের মধ্যে অগ্রগণ্য বাংলার ঋত্বিক ঘটক, দেশভাগের ছবি বললেই যাঁর কথা সর্বাগ্রে মনে আগে । সেটাই সেল্যুলয়েডে উঠে এল ‘কোমল গান্ধার’ বা ‘নাগরিক’ ছবির মাধ্যমে । ‘মেঘে ঢাকা তারা’-ও আসলে ওই দুঃসময়ের মেঘলা আকাশের সাথে একসূত্রে গ্রথিত । মানুষ যখন ভুলতে চাইছে, তিনি ভুলতে দিচ্ছেন না — তাই তিনি জনপ্রিয় হতে পারলেন না । সাধারণ মানুষই ট্রমা ভুলে থাকতে রূপালি পর্দায় বিনোদন-কে বেছে নিল । বিপুল ভাবেই সেটা হলো । তাই কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া দেশভাগের যন্ত্রণা আর উঠে এল না । মুম্বাইতে ১৯৭৪ সালে মুক্তি পেল ‘গরম হাওয়া’ । অসামান্য ছবি, কিন্তু তখনকার প্রজন্ম, দেশভাগ আসলে কি — ততদিনে ভুলতে বসেছে । বাস্তব অভিজ্ঞতা ইতিহাস বইতে তথ্য হয়ে ঢুকে পড়েছে । স্বাধীনতা সংগ্রাম বা, বিপ্লবী শহিদদের জীবন-ভিত্তিক ছবি তার আগে এবং পরেও বহু তৈরি হয়েছে । কারণ সাধারণ মানুষ জাতিয়তাবাদী আবেগ সবসময়েই পছন্দ করেন ।
দেশভাগের সাথে সাথেই পশ্চিমে পাকিস্তান ও পূর্বে পূর্ব পাকিস্তানে চলে গেলেন বহু শিল্পী ও কলাকুশলী । আবার এলেনও অনেকে । যেমন রাজ কাপুর সাহেবের জন্ম পেশোয়ারে । ভারতে আগমনের পর রাজ কাপুর হয়ে উঠলেন সহজপাচ্য, আবেগতাড়িত, সঙ্গীতমুখর জমজমাট এক চিত্রভাষার প্রবক্তা । তাঁর বানিজ্যিক হিন্দি ছবি ভারত ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্য, চিন, আফ্রিকা অবধি ছড়িয়ে পড়ল । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সিনেমার কাঁচামাল ও বিশেষত ‘raw film stock’ -এর সরবরাহে ঘাটতি তৈরি করেছিল । এর সঙ্গে প্রাক্ স্বাধীনতা ঔপনিবেশিক সেন্সরশিপ, মন্বন্তর, দেশভাগ তো ছিলই । ফলে স্টুডিও যুগের রমরমা শেষ হয়ে যায় । ক্ষমতায় এসে জওহরলাল নেহেরু উৎসাহ দিলেন স্বাধীন প্রযোজকদের । এবং গুরু দত্ত (১৯২৫-১৯৬৪), মহবুব খান (১৯০৭ - ১৯৬৪), বিমল রায় (১৯০৯ - ১৯৬৬), রাজ কাপুর (১৯২৫ - ১৯৬৪) হিন্দি ছবিকে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে দিলেন । ঠান্ডা যুদ্ধের পর নেহেরু মুক্ত অর্থনীতি ও নতুন সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখালেন । তৈরি হলো ব্র্যান্ড । সিপ্পি এবং বরজাতিয়া গোষ্ঠীর সঙ্গে এলেন বি আর ও যশ চোপড়া, সামাজিক ভাষা ও বিনোদন হাত মেলাল । ১৯৩৬ সালে যে Progressive Writer's Association (PWA) -র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, লক্ষ্ণৌ শহরে তার সভাপতিত্ব করেন মুন্সী প্রেমচন্দ্র । ১৯৪৩ সালে Indian People's Theatre Association (IPTA) প্রতিষ্ঠিত হয় । স্বাধীনতার পর সদস্যদের অনেকেই চলচ্চিত্র জগতে সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়েন । ফলে যখন ‘Nation Building’ ও নব্য আশাবাদের ভিত গঠন চলছে, তখনই ‘New Indian Cinema’-র বীজ-ও বোনা শুরু হয়েছে । একদিকে মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায় সরকারি অর্থানুকূল্যে নান্দনিক চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিশ্ববন্দিত হলেন, অন্যদিকে ‘হিন্দি ছবি’ সর্বভারতীয় স্তরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়ে হয়ে উঠল ‘ভারতীয় ছবি’-র চরিত্র । কেন এসব কথা আসছে ! কারণ এই অবধি না বুঝে নিলে, বোঝা যাবে না যে এই পর্যায়ে এসেই ভারতীয় চলচ্চিত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম, জাতিয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের প্রতিফলন পর্দায় কেমন হবে, তার নির্দিষ্ট রূপরেখা পেয়ে যায় । স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর ভিত্তি করে সর্বভারতীয় স্তরে অসংখ্য ছবি হয়েছে । এর মধ্যে কিছু ঐতিহাসিক সত্য অবলম্বনে — ‘বিয়াল্লিশ’ (১৯৫১), ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন’, ‘সুভাষচন্দ্র’ (১৯৬৬), ‘১৮৫৭’ (১৯৪৬), ‘আল্লুরি সীতারামা রাজু’ (১৯৭৪), ‘ত্যাগভূমি’(১৯৩৯), ‘ভীরাপান্ডিয়া কাট্টাবোম্মান’(১৯৫৯), ‘কালাপানি’, ‘মানা দেশম্’ এই জাতীয় ছবি । দাদাসাহেব ফালকে সেই ১৯১৯ সালেই ‘কালীয়মর্দন’ বা, ‘ভক্ত বিদুর’-ছবিতে পৌরাণিক চরিত্রকে খদ্দর ও গান্ধী-টুপি পরিয়ে হইচই ফেলেছিলেন ।
আবার সামান্য ঐতিহাসিক তথ্য ও মূলত কল্পনার মিশেলে তৈরি ছবিও কম নয় — ‘আবার আসিব ফিরে’ (২০০৪) তেমনই একটি বাংলা ছবি । প্রেমের প্রেক্ষাপটে ছবিতে দেখানো হয়, পরাধীন ভারতের একজন শঠ স্বাধীনতা সংগ্রামী-কে, যিনি আদতে চক্রান্তকারী দেশদ্রোহী খলনায়ক । স্বাধীন ভারতে বড়ো নেতা হয়ে উঠে নীচ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও ছদ্ম-দেশপ্রেমিক রূপে যিনি কলঙ্কিত অতীত গোপন করে রাখেন । আবার প্রেক্ষিত হিসাবে অশান্ত সময় ও কাহিনি হিসাবে নর-নারীর সম্পর্কের টানাপোড়েনের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে বেশ কিছু ছবি — ‘1942: A Love Story’ (১৯৯৪), ‘হে রাম ! (২০০০)’, ‘পুকার’, ‘জুনুন’ (১৯৭৮), ‘ক্রান্তি’, ‘মঙ্গল পান্ডে : দ্যা রাইজিং’ - এই ধরনের ছদ্ম-দেশপ্রেমমূলক ছবি । স্বাধীন ভারতের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির মানুষের জাতিয়তাবাদী আবেগ-কে হাতিয়ার করেই এই ছবিগুলি বানিজ্যিক সাফল্যের বৈতরণী পেরোতে চেয়েছে । ‘গদর’ বা, অস্কারে শোরগোল তোলা ‘লগান’-ও তার ব্যতিক্রম নয় । মনিরত্নমের সিনেমাতেও এমন উদাহরণ মেলে কিঞ্চিত রোমান্টিক উদ্দীপক হিসেবে ।
এই ছবিগুলির থেকে স্বতন্ত্র একটি সংরূপ হলো জীবনীভিত্তিক ছবি বা, ‘বায়ো-পিক’ । শুধু ভগৎ সিং-কে নিয়েই তৈরি হয়েছে একগুচ্ছ ছবি । মহাপুরুষদের জন্মজয়ন্তী বা, স্বাধীনতা দিবস বা, প্রজাতন্ত্র দিবসের রজত জয়ন্তী বা, সুবর্ণ জয়ন্তী এলেই এই মূর্তি পূজার দেশে বায়ো-পিক তৈরির ধূম পড়ে যায় । ২০০২ সালে ভগৎ সিং-কে নিয়ে পাঁচখানি ছবি তৈরি হয় — কোথাও তাঁর দেশপ্রেম আবার কোথাও পাঞ্জাবের রত্ন হিসেবে তাঁকে তুলে ধরার চেষ্টা । ‘দ্য লেজেন্ড অব ভগৎ সিং’ এরই মধ্যে গুণগতভাবে সবচেয়ে ভালো ছবি । এই ছবিতে ভগৎ যেন সমাজবাদ, নৈরাজ্যবাদ ও সাম্যবাদের মিলিত আদর্শে বিশ্বাসী । হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন-এর অন্যতম যুবনেতা তিনি, তাঁর চেতনায় আর্য সমাজের গভীর প্রভাব স্পষ্ট । লালা লাজপত রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর ভূমিকা তাঁকে যুবসমাজের আইকনে পরিণত করে, শিখ কৃষক ও সাধারণ যুবহৃদয়ে তাঁর নায়কোচিত দখল যেন গান্ধীকেও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পিছনে ফেলে দিতে পারে । ১৯৪৮ সালে দিলীপ কুমার ‘শহিদ’ ছবিতে ভগৎ সিং -এর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন । ১৯৬৩ সালে শাম্মি কাপুর, ১৯৬৫ সালে মনোজকুমার-ও ভগৎ সিং-এর চরিত্রে অভিনয় করেন । ১৯৬৫ -র ‘শহিদ’ ছবিটির বিশেষত্ব হলো, প্রত্যক্ষদর্শী বটুকেশ্বর দত্তর কাছ থেকে সংগৃহীত অজস্র তথ্যের উপর ভিত্তি করে এই ক্লাসিক ছবিটি নির্মিত হয় । কিন্তু লক্ষনীয় আলোচিত ছবিগুলি চলচ্চিত্র হিসেবে তেমন অভিনব নয় — এদের কাহিনির বয়ন সহজ । বক্তব্যও ন্যূনতম । চিত্রভাষার আঙ্গিক নিয়েও পরীক্ষা করা হয়নি । ওমপ্রকাশ মেহরা পরিচালিত ‘রং দে বসন্তী’ (২০০৬) ছবিটি সেদিক থেকে অভিনব । এই ছবিতে আশ্চর্যভাবে লালা লাজপত রাওয়ের মৃত্যুতে ভগৎ সিং-দের প্রতিবাদী মিছিল আর ভোগবাদী আধুনিক রাজধানী-শহরে ‘মিগ’ বিমান দুর্ঘটনায় নিহত এক তরুণের অপমৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ — দুই যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় । উদাসীন, আত্মকেন্দ্রিক, সদাচঞ্চল যুবক মন-ও একটি ঘটনায় কীভাবে সংগঠিত প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠতে পারে এবং ভগৎ সিং-চন্দ্রশেখর আজাদ-সুখদেব-দের জীবন তাদের মনে কতটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে, তাই দেখায় এই ছবি । অবশ্য এমন ছবি নির্মানের জন্যও অনেকটা পথ পেরোতে হয় । দক্ষিণে জন আব্রাহামের কালজয়ী ছবি ‘আম্মা আরিয়ান’ — সেও তো স্বাধীনতারই গল্প বলে, হয়তো তার বেশিই কিছু বলে । লড়াইটা তো থেকেই যায় । ১৯৪৭ একটা জংশন স্টেশন মাত্র । কিন্তু শেষ স্টেশন কখনোই নয় ।
বাংলা ছবির ক্ষেত্রে যে ছবিগুলি আজ স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে অথচ স্মরণীয় কাজ, তেমন কিছু ছবির কথা বলা যাক । প্রদীপ কুমার, মঞ্জু দে, বিকাশ রায়, শম্ভু মিত্র, বঙ্কিম ঘোষ অভিনীত, হেমেন গুপ্ত পরিচালিত ‘বিয়াল্লিশ’ (১৯৫১) এমনই একটি স্মরণীয় কাজ । ছবিটির শেষে ছিল শিহরণ সৃষ্টিকারী সুবিখ্যাত সেই দৃশ্য — কংগ্রেস বাহিনীর উপর গুলি চালাচ্ছে পুলিশ । অহিংসার আদর্শে উদ্বুদ্ধ গ্রামবাসীরা মাতঙ্গিনী হাজরার নেতৃত্বে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ছে । তবু থামছে না । বৃদ্ধার হাত থেকে পতাকা তুলে নিচ্ছে বালিকা, তার হাত থেকে পতাকা চলে যাচ্ছে ধর্ষিতা অন্তঃসত্ত্বার হাতে । দীর্ঘ দুবছর সেন্সর বোর্ড ও রাজনৈতিক সমস্যার সাথে লড়াই করে অবশেষে ছবিটি এই বাংলায় মুক্তি পায় । এই ছবিতে গান্ধীর আদর্শ ও ভাবমূর্তি একটি স্পষ্ট অবয়ব লাভ করে । ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের হুজুগ ও সেই পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিপ্লবী সংগঠনের আন্দোলন — হেমেন গুপ্তেরই ‘ভুলি নাই’ (১৯৪৮) ছবিতেও দেশপ্রেমের কাহিনি আবারো রূপালি পর্দায় রসঘন হয়ে উঠেছে । জাতি হিসেবে বাঙালির প্রতিরোধ ও সংহতি হেমেন বাবু দরদ দিয়ে তুলে ধরেছিলেন পর্দায় । পরের বছর ১৯৪৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন’ ছবিতে মাস্টারদার নেতৃত্বে একঝাঁক ছেলে-মেয়ের ট্রাজিক লড়াই পর্দায় তুলে ধরেছিলেন পরিচালক নির্মল চৌধুরী । ছবিতে গোটা জাতি কীভাব মাস্টারদার মহৎ আত্মদানে শোকে মূহ্যমান, তারও বিশ্বস্ত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে । স্বাধীনতার অধিকার যেন আমাদের দায়িত্ববোধে জীবিত থাকে — সেই আর্তি যেন চোখে পড়ে আজ এই ছবিগুলি ফিরে দেখলে ।
১৯৮২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘গান্ধী’ বিদেশের মানুষের কাছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে তুলে ধরেছে বলে অনেকেই মনে করেন । কিন্তু, বেন কিংসলের গান্ধী যেন আদতে পশ্চিমী দুনিয়ার ফ্যান্টাসিরই প্রতীক হয়ে উঠেছেন । জনহূ বড়ুয়ার ‘ম্যায়নে গান্ধী কো নেহি মারা’ (২০০৫) সেদিক থেকে অভিনব — একটি স্মৃতিভ্রমের গল্প হয়ে ওঠে এক আশ্চর্য জার্নি । ‘গান্ধী মাই ফাদার’ (২০০৭) -এ দেশনেতা হিসেবে নয়, পুত্র হরিলালের আশৈশব অভিযোগের সম্মুখে কাঠগড়ায় দন্ডায়মান গান্ধী ছবিতে এক অভিযুক্ত পিতা । ২০০৬ সালের ‘লাগে রহো মুন্নাভাই’ এর সম্পূর্ণ বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে — প্রতি দৃশ্যে গদগদ আবেগ তৈরি করতে গান্ধীর দর্শনকে অতিসরলীকৃত করে দর্শক-মনে তাঁর জনপ্রিয় ভাবমূর্তি সুপার ইম্পোজ করে এই ছবি । ২০১০ সালের ‘খেলে হাম জি জান সে’ পিরিয়ড ছবি তৈরির ক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচায়ক । পরিচালক আশুতোষ গোয়ারিকর আবেগ ও সংকল্পকে নিয়ন্ত্রিত দক্ষতায় তুলে ধরেছিলেন । আবার ‘নাসা’-য় চাকুরিরত বেদব্রত পাইন কীভাবে তাঁর কিশোর পুত্র ঈশানের অকাল মৃত্যু থেকে তাড়িত হয়ে প্রথম ছবিতেই বেছে নিলেন সূর্য সেনের কাহিনি, সেও এক বিস্ময়কর ঘটনা । বেদব্রত-র ‘চিটাগঙ্’ (২০১২) চৌদ্দ বছরের ঝুনকু অর্থাৎ সুবোধ রায়ের এশিয়ার সর্বকনিষ্ঠ বিপ্লবী হয়ে ওঠার গল্পও বলে । কেতন মেহতার ‘সর্দার’ (১৯৯৩) ছবিতে পর্দায় ভারতের ‘আয়রন ম্যান’ বল্লভভাই প্যাটেলের চারিত্রিক দৃঢ়তা-কে সুন্দর ফুটিয়েছিলেন অভিনেতা পরেশ রাওয়াল । শ্যাম বেনেগালের ‘বোস : দ্য ফরগটেন হিরো’ আবার বাণিজ্য ও ইতিহাস-প্রীতি এই দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করে গেছে আপ্রাণ । পরিচালক পীযূষ বসু ‘সুভাষচন্দ্র’ (১৯৬৬) ছবির জন্য সেকালে দুটি জাতীয় পুরস্কার জিতেছিলেন । তাঁর ছবিতে সুভাষের বিকাশ ও শৈশব থেকে কৈশোরে মানসিক গঠনের দিনগুলি চমৎকার তুলে ধরা হয়েছে । ২০০১ সালে বেদ রাহি-র ‘বীর সাভারকার’ ছবিটির নামও এখানে উল্লেখ করা চলে ।
এছাড়া সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র তো আছেই । প্রথমেই সবার মনে পড়বে, সত্যজিৎ রায়ের ‘ঘরে বাইরে’-র কথা । রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’ অবলম্বনেও নির্মিত হয়েছে একগুচ্ছ ছবি । সবচেয়ে উল্লেখ্য ১৯৯৭ সালে হিন্দিতে কুমার সাহানি নির্মিত ছবিটি, কে কে মহাজন ক্যামেরা করেছিলেন । কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিপ্রদাস’ অবলম্বনে এল. ভি. প্রসাদ ১৯৪৯ সালে তেলেগু ভাষায় নির্মাণ করেছিলেন ‘মানা দেশম্’ ছবিটি । পীযূষ বসু পরিচালিত উত্তমকুমার অভিনীত ‘সব্যসাচী’ (১৯৭৭) ছবিটিও শরৎ বাবুর ‘পথের দাবী’ উপন্যাসের কাহিনি অবলম্বনে তৈরি । দেশপ্রেম অন্তত এই ছবিতে উচ্চকিত নয় । আবার ‘জুনুন’ (১৯৭৮) রাস্কিন বন্ডের গল্প থেকে নির্মিত । দূরদর্শণের জন্য নির্মিত হলেও ভীষ্ম সাহানির ‘তমস্’ (১৯৮৮) উপন্যাস অবলম্বনে গোবিন্দ নিহালনির ছবিটি একটি স্মরণীয় কাজ — অমরেশ পুরি, ওম পুরি, দীপা শাহি, এ. কে. হাঙ্গাল সাহেবের অনবদ্য অভিনয়ে সমৃদ্ধ ছবিটি । এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য রাজা সেন পরিচালিত টেলি-সিরিজ ‘দেশ আমার দেশ’-ও । ‘বর্ডার’, থেকে ‘উরি’ বা, ‘রাজি’-র কথা সবাই জানলেও ভুলতে বসেছি উপরোক্ত সৃষ্টিগুলিকে । খেলাধূলার পরিসরে দেশাত্মবোধক ছবিও অনেক হয়েছে । ‘লগান’ তো সকলেই দেখেছেন । কিন্তু ২৯ শে জুলাই, ১৯১১-তে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্ট-কে ফুটবলে হারিয়ে মোহনবাগান ক্লাবের শীল্ড জয়ের গল্প নিয়ে তৈরি ‘এগারো’ (২০১১) ছবি-টির কথা না বললেই নয় । প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপনে সঙ্গী হোক এসব চলচ্চিত্রও, যা অপরূপ চিত্রভাষায় আমাদের সামনে উপস্থিত করে দেশপ্রেম ও দেশপ্রেমিক শহিদদের অমলিন স্মৃতিগুলি , আমাদের স্বদেশকে নতুন আলোয় দেখতে শেখায়।
0 comments:
Post a Comment