সম্পাদকের কলমে
নারায়ণ দেবনাথ-
সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম ।
ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম ।
নমস্কার সহ
অঙ্কুর রায়
সংখ্যার সম্পাদক
অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী
প্রধান সম্পাদক
লেখা পাঠানোর জন্য
আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com
Total Pageviews
By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.
কালের সীমানায়
জনা বন্দ্যোপাধ্যায়
রাণী দুর্গাবতী আজ অনেক ভোরে উঠেছেন। দুর্গাবতী ও দলপৎ শাহর বালক পুত্র বীরনারায়ণের পিতার সিংহাসনে অভিষেক অনুষ্ঠান আসন্ন। দুর্গ সংলগ্ন প্রাসাদের বাগানে হাঁটতে হাঁটতে রাণী ভোরের রূপ দেখেন। মনে পড়ে রাজধানী গড়-কাটাঙ্গার প্রাসাদে অতিবাহিত দাম্পত্য জীবনের কিছু অমূল্য স্মৃতি। তরুণী রাণীর হলুদ সিল্কের শাড়িতে হাল্কা জরির কাজ। পিঠে এক ঢাল সুন্দর চুল, একটু এলোমেলো বিন্যস্ত। প্রসাধনহীন স্নিগ্ধ মুখে দুটি শ্বেত পদ্মের মতো চোখ। দূরের দিকে আনমনা দৃষ্টি--রাণীকে শিল্পীর তুলিতে আঁকা এক নারী মনে হচ্ছে!
দুর্গাবতী মাহবার চান্দেল্ল বংশীয় রাজপুত রাজা কিরাত রাই-এর একমাত্র আদরের কন্যা। অশ্বারোহণ, যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা তিনি করেছেন। দুর্গাবতী গণ্ডোয়ানার শাসক দলপৎ শাহ-র কয়েকটি বীরত্বপূর্ণ কাজে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু তাঁর পিতা কন্যাকে কোন নীচু বংশজাত রাজকুমারের সঙ্গে বিবাহ দিতে রাজী ছিলেননা। পরে অবশ্য দলপৎ শাহর বীরত্বে কিরাত রাই খুশী হয়ে কন্যার বিবাহের ব্যাপারে সম্মত হন। দলপৎ শাহ সিংহাসনে বসলে গণ্ডোয়ানার রাণী হন দুর্গাবতী। কয়েক বছরের মধ্যে রাজা দলপৎ শাহর অসুখে মৃত্যু হলে তাঁদের সুখী দাম্পত্য জীবনে নেমে আসে শোকের ছায়া। গণ্ডোয়ানা হারায় জনপ্রিয় রাজাকে।
গণ্ডোয়ানার রাজ্যের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। মধ্যপ্রদেশের সাগর,দামো, মণ্ডলা ও নর্মদা উপত্যকার কিছু অঞ্চল নিয়ে এই রাজ্যের অবস্থান। নতুন দিনের আহ্বানে আকাশে রক্তিমাভার প্রকাশ, বসন্তের শুরুতে মৃদু মন্দ হাওয়ায় স্বচ্ছ সতেজ আলিঙ্গনে ভরে ওঠে রাণীর মন। কিছু দূরে ওস্তাদজীর প্রাসাদ থেকে এস্রাজে ভেসে আসে ভৈরবীর সুর।
পাঁচ বছরের নাবালক পুত্রের সিংহাসনে অভিষেক হলে অভিভাবকা হিসাবে রাণী দুর্গাবতী শাসনকার্য পরিচালনা করবেন। সাহসী রাণীর রাষ্ট্রনীতি ও প্রশাসন দক্ষতা রাজ্যবাসী এবার দেখবে। প্রিয়তম স্বামীর মৃত্যুশোক ভুলে প্রজাদের স্বার্থে তিনি রাজকার্যে মনোনিবেশ করবেন। রাণীর মনে অতুলনীয় দেশপ্রেম।
পিতার সিংহাসনে বীরনারায়ণের অভিষেক হয়েছে মাস খানেক হল। দুর্গাবতী নিয়মিত ছেলের পাশে সিংহাসনে গিয়ে বসেন। প্রজাদের অভাব অভিযোগ শোনেন। রাজনীতির জ্ঞান রাণীর ভালোই। দেওয়ান বেওহর অধর সিমহ এবং দক্ষ মন্ত্রী মান ঠাকুরের সহায়তায় রাণীর রাজ্য সুপরিকল্পিত ভাবে চলতে থাকে। রাণী দুর্গাবতী এখন সাতপুরার পার্বত্য এলাকায় সিঙ্গোরগড় দুর্গে থাকেন।
সময়টা ষষ্ঠদশ শতক। মালওয়ার আফগান অধিপতি ক্ষমতাপ্ৰিয় বাজ বাহাদুর গণ্ডোয়ানা আক্রমণ করে বেশ কয়েকবার রাণী দুর্গাবতীর বাহিনীর কাছে পরাজিত হন। রাণী মন্ত্রী ও পারিষদদের নিয়ে জরুরী আলোচনা সভায় বসেন। তিনি সকলকে ব্যক্তিত্বপূর্ণ কণ্ঠে বলেন, "আপনারা বুঝতেই পারছেন বারংবার যুদ্ধে গণ্ডোয়ানার জয় হলেও প্রচুর পরিমাণ অর্থসম্পদ ব্যয় হয়ে গেছে। রাজকোশ কিভাবে পূরণ করব সেই চিন্তায় আমি ভাবিত।"
সকলেই রাণীর কথায় সায় দেন যে রাজকোশ প্রায় শূন্য। দুর্গাবতী দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভঙ্গিতে বলেন, " জোতদারদের থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। "
প্রবীণ মন্ত্রী মান ঠাকুর রাণীর ও রাজ্যের ভালো মন্দের ব্যাপারে সচেতন। তিনি বলেন, "ওরা যদি না দেয়?"
" না দিলে জোর করতে হবে। "
সকলে সম্মত হন এ ব্যাপারে। জোতদারদের রাণীর সভায় তলব করা হয়। দুর্গাবতীর দৃঢ় ব্যক্তিত্বের কাছে তাঁরা নত হন। এভাবেই রাজকোশ পূর্ণ করা হয় জনস্বার্থে।
রাতে শয়ন কক্ষের জানলা দিয়ে দূরে অন্ধকারে জনবসতিগুলোর বিন্দু বিন্দু আলোর দিকে তাকিয়ে ভাবেন তাঁর মৃত স্বামীর মাতৃভূমি এই রাজ্য এখন তাঁরও মাতৃভূমি। এই রাজ্যের প্রশাসন পরিচালনা তাঁর কাছে এক কঠিন শপথ। কতটা আত্মবিশ্বাস থাকলে এই দুর্গম পথ হাঁটা যায় কেউ হয়তো ভাবতেও পারবেনা! দুর্গাবতীর মুখে এক আত্মতৃপ্তির ছাপ লক্ষিত হয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি রাজকার্য সংক্রান্ত ব্যাপারে নিজের কর্মদক্ষতা প্রতিষ্ঠা করেছেন।
মোঘল সাম্রাজ্যের সীমানায় গণ্ডোয়ানার অবস্থান হলেও এতকাল মোঘলদের সঙ্গে এই রাজ্যের কোন বিরোধ ছিলনা। হঠাৎ-ই গণ্ডোয়ানা রাজ্যের অর্থসম্পদের প্রতি দিল্লীর সম্রাট আকবরের নজর পড়ে। পূর্ব প্রদেশের সাম্রাজ্যবাদী মোঘল সুবেদার আসফ খাঁ গণ্ডোয়ানা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। আসফ খাঁর চেহারার মধ্যেই এক ধরণের কুটিলতা লক্ষ্য করা যায়। ক্ষমতার লোভ তাঁর কথায় কথায় প্রকাশ পায়। আকবরকে তিনি আশ্বাস দেন যে মোঘলরা গণ্ডোয়ানার থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী। সামরিক দিক দিয়ে মোঘলদের থেকে গণ্ডোয়ানা অনেক দুর্বল। আসফ খাঁ বড় বন্দুকের ব্যবহার করতে জানেন। অহংকারী, ক্ষমতার দম্ভে গর্বিত আসফ খাঁ গণ্ডোয়ানা গ্রাস করতে পুরোপুরি প্রস্তুত হন।
দিনটা ছিল রাণী দুর্গাবতীর মোঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবার প্রথম দিন। রাণীর অন্দর মহলে দুজন পরিচারিকা রাণীকে যুদ্ধবেশে সাজতে সাহায্য করছে। রণভূমিতে যাওয়ার জন্য কিশোর বীরনারায়ণও প্রস্তুত। অন্দরমহলের বাইরে গণ্ডোয়ানার সেনাবাহিনী হস্তী সজ্জিত করে রাণীর জন্য অপেক্ষা করছে।
নাররাই যুদ্ধক্ষেত্রটির অবস্থান গৌর ও নর্মদা দুটি নদীর মধ্যবর্তী পার্বত্য অঞ্চলে। যুদ্ধে ফৌজদার অর্জুন দাসের নিহত হওয়ার সংবাদ রাণী দুর্গাবতী পূর্বেই পেয়েছেন। গণ্ডোয়ানার বাহিনীর তুলনায় মোঘলদের সামরিক অস্ত্রের সংখ্যা অনেক বেশী এবং সৈন্য সংখ্যাও অনেক বেশী এসব অবগত হয়েও রাণী হতোদ্যম হননি। যুদ্ধে তাঁর প্রাণ হানির আশংকা সত্ত্বেও রাণী বীরবিক্রমে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেননি।
হস্তী পৃষ্ঠে আরোহণ করার পূর্বে বীরনারায়ণ মাকে প্রণাম করে।দুর্গাবতী পুত্রের কপোল চুম্বন করেন। অন্যান্য উপস্থিত সেনাবাহিনী স্তব্ধ হয়ে মা ও পুত্রের স্নেহালিঙ্গনের প্রত্যক্ষদর্শী হয়। কে বলতে পারে এটাই হয়তো তাঁদের শেষ সাক্ষাৎ!
শক্তিশালী মোঘল বাহিনীর কাছে পরাজয় আসন্ন জেনেও দুর্গাবতী গণ্ডোয়ানার সেনাবাহিনীকে উৎসাহিত করতে নিজে যুদ্ধ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। আজ নাররাই যুদ্ধক্ষেত্রটি সাক্ষী থাকবে রাণী দুর্গাবতীর অসম সাহসিকতার ও বীরত্বের।
রাণী দুর্গাবতী পূর্বেই তাঁর সেনাপ্রধানের সঙ্গে আজকের যুদ্ধনীতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি রাত্রিতে মোঘলদের আক্রমণ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু গণ্ডোয়ানার সেনাপ্রধানরা নিষেধ করেন।
যুদ্ধ ক্ষেত্র তীরে তীরে ছেয়ে যায়। শোনা যায় সৈন্যদের আর্ত চিৎকার। বীরনারায়ণ বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে তিনবার মোঘলদের পশ্চাদপদ হতে বাধ্য করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এক মোঘল সেনাপ্রধানের ভীষণ আক্রমণে বিষাক্ত তীর দ্বারা শরীরের কিছু অংশ আহত হওয়ায় যুদ্ধ ক্ষেত্র ত্যাগ করে নিরাপদ আশ্রয় নেয়।
দুর্গাবতী হস্তীপৃষ্ঠে এগিয়ে চলেন সমরাঙ্গনে। গণ্ডোয়ানার রাণী বিপুল মোঘল বাহিনীর সামনে নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন । গোধূলি বেলায় গণ্ডোয়ানার মাটি ও আকাশ রক্তিম হয়ে ওঠে। তবু দুর্গাবতী পিছু হটতে রাজী নন। দিন শেষে যুদ্ধক্লান্ত রাণী শত্রু পক্ষের তীরে ভীষণ ভাবে আহত হন। একটি তীর তাঁর বাঁ কান ঘেঁষে চলে যায়। রাণী যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে ওঠেন। আর একটি তীর তাঁর কাঁধে এসে বিদ্ধ হলে রাণী জ্ঞান হারান। কয়েকজন সৈন্যের সহায়তায় জ্ঞান ফিরলে দুর্গাবতী বোঝেন যে তাঁর পরাজয় নিশ্চিত। শরীরে তীব্ৰ যন্ত্রণা নিয়ে রাণীর পক্ষে আর উঠে দাঁড়ানো সম্ভব হয়না। মাহুত তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দুর্গে ফিরে যেতে বলে। সামনেই নদী। গতকাল রাতের বৃষ্টিতে নর্মদা দ্বিগুন গতিতে বইছে। এই নদীই এক বড় প্রতিকূলতা। নদী পেরিয়ে দুর্গ পর্যন্ত যাওয়া আহত রাণীর পক্ষে তখন সম্ভব নয়। হস্তীর পৃষ্ঠ থেকে ভূমিতলে রাণীর অবতরণের জন্য তিনি মাহুতকে নির্দেশ দেন। রক্ষীরা দেখে দুর্গাবতী অসমান ভূমিতলে বসে গণ্ডোয়ানার মাটি মাথায় নিচ্ছেন। শত্রু পক্ষের জনকোলাহল ভেসে আসছে। এদিকেই ধেয়ে আসছে তারা। শেষ বারের মতো রাণী পেছন ফিরে একবার তাকান। বেশ কিছুটা রক্তপাত হয়েছে তাঁর কাঁধ থেকে ও কানের পাশ থেকে। যন্ত্রণা সহ্য করে দুর্গাবতী নীরব থাকেন। রাজ্য ও প্রজাদের প্রতি রাণীর বড় মায়া! তবু শত্রুদের হাতে ধরা পড়ার থেকে মৃত্যু শ্রেয় মনে করে কোমরবন্ধ থেকে ছুরিকা বের করে নিমেষে নিজের বুকে বিদ্ধ করেন তিনি। রক্ষীরা ছুটে আসে। নিজের মায়ের কোলে আশ্রয় নিলে মুখে যে পরিতৃপ্তি আসে, সেভাবেই রাণী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
গোধূলির আকাশ সেদিন করুণ ব্যথায় মথিত হয়। নর্মদার জলে নামে সন্ধ্যের কালো ছায়া। ইতিহাস কালের সীমানায় লিখে দেয় বীরাঙ্গনার দেশপ্রেমের পরিচয়!
Subscribe to:
Posts (Atom)
0 comments:
Post a Comment