সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

 লক্ষ্যহারা

আশা সাহু
গ্রামে ঘরে সে রকম কাজ পাট নেই। মাঝে মধ্যে টুকটাক কাজকর্ম পেলেও পারিশ্রমিক মনোপুতঃ হয় না সমীরের। বাড়িতে মা, বৃদ্ধ বাবা, অবিবাহিতা বোন, স্ত্রী ও আদরের ছেলে ছোট্টু রয়েছে। ছ'জনের পেট চালাতেই হিমশিম খেতে হয় সমীরকে - তার উপর রোগ জ্বালার বিপত্তি তো আছেই। পুরুলিয়ার মতো রুক্ষ সুষ্ক জায়গায় জীবনের রসদ যেন আর খুঁজে পায় না সমীর। বন্ধু বিজয় সেদিন ভালোই পরামর্শ দিয়েছিল, ওর সঙ্গে মুম্বই পাড়ি দিতে পারলে বেশ কিছু টাকা পয়সা আসতো সংসারে। চিন্তা একটা, পরিবারের এতো গুলো মানুষকে কার ভরসায় ছেড়ে যাবে সমীর? তাছাড়াও বড় কথা হলো, এতো দূর যাওয়ার ট্রেন ভাড়াও তো কম নয়! আর পৌঁছে গেলেই তো আর কেউ টাকা বা কাজ দিয়ে দেবে না। নানা রকম চিন্তা ভাবনার পর সমীর লক্ষ্য স্থির করে, সে বিজয়ের সঙ্গে মুম্বই যাবে।
বাড়িতে গোটা চারেক হাঁস, তিনটা মুরগি,
একটা ছাগল ছিল। সমীর সেগুলো বিক্রি করে কিছু টাকা জোগাড় করলো। ছোট্টুর অন্নপ্রাশনে তার মামা বাড়ি থেকে পাওয়া রূপোর বিছে টাও বেচে দিতে হলো বাধ্য হয়ে। যদিও মন তাতে সায় দেয় নি কিন্তু ছোট্টুর ভবিষ্যৎ ভালো  হবে ভেবেই সমীরের এই সিদ্ধান্ত। সমীরের মা ও স্ত্রী তাদের মালিকের কাছ থেকে আগাম কিছু টাকা ধার হিসেবে এনেছে, কাজ করে মাসে মাসে কিছু কিছু করে শোধ করে দেবে। এভাবেই কোনো রকমে সমীরের মুম্বই যাত্রার ব্যবস্থা হয়ে যায়।
নির্দিষ্ট দিনে সংসার পরিজনকে ফেলে রেখে, চোখের জলকে সঙ্গী করে সমীর বিজয়ের সাথে বেরিয়ে পড়ল। দু দিন পর অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছে গেল। বিজয় অবশ্য তার মালিকের সঙ্গে কথা বলে প্লাস্টিক কারখানাতে কাজে ঢুকিয়ে দিল। কষ্ট হলেও বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে উদ্যম নিয়ে সমীর সবার সঙ্গে মিলে মিশে কাজ করতে লাগলো। নিজের গ্রামের জন্য, পরিবারের জন্য, বিশেষ করে ছোট্টুর জন্য খুবই মন কেমন করে সমীরের। সারাদিন হাড় ভাঙ্গা খাটুনির পরও রাতে সে ঘুমোতে পারে না। মাঝে মাঝে বিজয়ের মোবাইল থেকে গ্রামের পাশের বাড়ির নকুলের ফোনে ফোন করে খবর নেয় বাড়ির সবার, নকুল যদি বাড়িতে থাকে - সেই সময় যদি ছোট্টু ও ছোট্টুর মা বাড়িতে থাকে তবেই ছেলে, বৌ এর কন্ঠস্বর শোনা হয় সমীরের। বৌ লক্ষ্মী টা লোকের বাড়ি থেকে লোকের ফোন থেকে স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে ভীষণ লজ্জা পায়। তবুও জড়িয়ে জড়িয়ে যতটুকু বলতে পারে তাতে সমীরের বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না যে তাকে ছাড়া ওরা ভালো নেই।
অন্য কোনো উপায় যেহেতু নেই সমীর তাই এই জীবনকে মেনে নিতে বাধ্য হয়। মনে দিয়ে কাজ করে সে, সুযোগ পেলেই ওভার টাইম করে, টুকটাক অসুস্থ্যতাকে গুরুত্ব না দিয়ে রোজ কাজ করে। এই সাত মাসে নিজের জন্য যতটুকু খরচ না করলেই নয় সেই টুকু করে বাকি টাকা জমা করেছে ছোট্টুর জন্য, পরিবারের জন্য। মুম্বইয়ের বস্তিতে থাকাটা সমীরের এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। বন্ধুদের নিয়ে, কাজ নিয়ে তার সময় বেশ কেটে যাচ্ছিল। এমন সময় সমীরের জীবনে নেমে এলো ঘোর বিপত্তি। করোনা ভাইরাস থাবা বসালো ভারতের বুকে। একে একে ভারতের সমস্ত রাজ্যকে সে গ্রাস করলো। মহারাষ্ট্র তথা মুম্বইয়ের অবস্থা দিন দিন দেশের মধ্যে শোচনীয় হয়ে উঠতে লাগলো। সমস্ত কল-কারখানার মতো সমীরের কর্মস্থান, প্লাস্টিক কারখানাও বন্ধ হলো। দেশ জুড়ে শুরু হলো লক ডাউননের পালা। সমীরের মাথায় হাত পড়ল। সে ভেবে উঠতে পারছে না এখন সে কী করবে? ফোনে বাড়ির খবর নেয়, ওরা ভালো আছে তবে প্রচন্ড অভাবে যে রয়েছে তা সমীর বোঝে। সমীরের জমানো টাকার বেশ কিছু খরচ হয়ে গেল এই দেড় মাসে। বাকি যত টুকু আছে সে ঠিক করে তা সে বাড়ি পৌঁছে দেবে। বিজয়ের সঙ্গে আলোচনা করে সে, কাজই যখন রইলো না তখন বিদেশ - বিভুঁয়ে পড়ে থেকে লাভ কী? মরতে হলে পরিবার - পরিজনের কাছে গিয়েই মরবে। সমীর, বিজয় মরিয়া হয়ে ওঠে নিজের গ্রামে - নিজের আত্মীয়দের কাছে ফেরার জন্য। অনেক খোঁজ খবর নেওয়ার পর অবশেষে জানতে পারে কয়েকটি ট্রাকের কথা যেগুলো কিনা মাল নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে যাবে। সমীর, বিজয় সেই ট্রাক ওয়ালাদের খোঁজ নিয়ে তাদের সাথে কথা বলে ঠিক করে ফেললো একটা ট্রাকে চড়ে আগামী পরশু তারা গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। সমীর বিজয় সহ ওদের আরো কিছু পশ্চিমবঙ্গের বন্ধু নির্দিষ্ট দিনে ট্রাকে চড়ে বসলো। সুন্দর সুন্দর জায়গা, মন্দির, পথ ঘাট দেখতে দেখতে আর নিজেদের মধ্যে গল্প গুজব করতে করতে সারাটা দিন কেটে গেল। সন্ধ্যা নামার পর এক জায়গায় ট্রাক দাঁড়ালো, জায়গাটা নাকি ঔরঙ্গাবাদ। যে সমস্ত ধাবা খোলা ছিল সেগুলোতে সবাই নিজেদের মতো করে খাওয়া দাওয়া করলো। সারারাত গাড়ি চলবে তাই ড্রাইভার কে পালা করে জাগিয়ে রাখতে হবে সেজন্য ওরা কিছু পান,কিছু চুইংগাম ও কিনে রাখলো। নির্বিঘ্নে রাত কাটলো, অনেকটা পথ পার হয়ে এলো ওরা। রাস্তার ধারের কোনো কোনো দোকান থেকে উনুন জ্বালানোর ধোঁয়াও দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ড্রাইভার রাস্তার একধারে ট্রাক দাঁড় করিয়ে চা খাওয়ার জন্য দোকানে যায়। বিজয় সমীর কে ডাকে চা খাওয়ার জন্য কিন্তু সমীর আর গাড়ি থেকে নামতে চায় না। বিজয় কয়েক জন বন্ধু কে নিয়ে দোকানে ঢোকে, সমীর আর কয়েক জন বন্ধু গাড়িতে থাকে।
সমীর মনে মনে হিসেব করে আর কত ঘন্টা পর সে ছেলেকে দেখতে পাবে, তাকে কোলে নিতে পারবে, তাকে বুকে জড়িয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দেবে। বৌ লক্ষ্মী টা তো একটু লাজুক, প্রথমে হয়তো ঘর থেকে বেরোবেই না! বোন হয়তো আব্দার করবে, তার দাদা তার জন্য কী নিয়ে এসেছে বলে। মা, বাবা হয়তো বারবার বলবেন, ছেলে কত রোগা হয়ে গেছে, আর বাইরে যেতে হবে না, নুন - ফ্যেন যা জোটে ঘরেই থাকুক। এই সমস্ত ভাবনা নিয়ে যখন সমীর আচ্ছন্ন হয়ে আছে ঠিক তখনই বিকট আওয়াজে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠল। কারো কিছু বোঝে ওঠার আগেই আর্ত চিৎকারে পরিবেশ আতঙ্কিত হয়ে উঠল। বিজয় কোনো রকমে চায়ের গ্লাস মাটিতে ফেলে দৌড়ে এলো ট্রাকের কাছে, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে শুধু দেখলো পেছন থেকে আসা একটা ট্রাক ধাক্কা মেরেছে তাদের ট্রাকে। ট্রাকের ভেতরের ছেলে গুলো রক্ত মাংসে দলা পাকানো অবস্থায় খুব ধীরে ধীরে হাত বা পা নাড়ছে। পেছনের ট্রাকের ড্রাইভারকে মানুষ বলে চেনা যাচ্ছে না। বিজয় আর তাকাতে পারে না কোনো রকমে শরীরটাকে কুঁকড়ে নিয়ে বমি করতে করতে রাস্তাতেই লুটিয়ে পড়ে।
দুদিন পর সমীরের প্রতিবেশী নকুলের ফোনে চূড়ান্ত মর্মান্তিক খবর আসে। সমীরের পরিবার ও আজ তার মতোই লক্ষ্যহারা। বেঁচে থেকেও আজ তারা মৃত।।

0 comments: