সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

 লোনাজল 

 কৌশিকী ঘোষ 

বিকেলের আধডোবা সূর্যটা নীল জলরাশি উপর থেকে নিজের অস্তিত্বের শেষ অহংটুকু নিয়ে সময়ের আঁধারে গা ডোবাচ্ছে। আজ সমুদ্রের জল টা কেমন ঘোলাটে লাগছে। বাতাস নেই কোন দিকে। যে পর্যটকরা খোলা হওয়ার জন্য বহুদূর থেকে সমুদ্রের টানে ছুটে আসে, তারাও যেন একটু মনঃক্ষুণ্ণ। জলের ধার দিয়ে মাথায় পাত্র নিয়ে কেউবা হেঁকে যাচ্ছে - ' মনোমোহনো খাবা গো....... গরমো গরমো....'। আবার কেউ লাল-নীল লাইট হাতে করে, মাথায় আলোর সিং লাগিয়ে 'লাইট লিবা গো' বলতে বলতে হেঁকে যাচ্ছে।
রাজু তার সরু সরু হাতটায় সলতে ভর্তি চটের ব্যাগ ঝুলিয়ে একবার এই চায়ের দোকানে আর একবার বালির উপর বসে থাকা কোন পরিবারের কাছে বিক্রির জন্য যাচ্ছে..." ভালো সলতে আছে গো মা... পূজা দিবে...লিয়ে যাও...সলতে লিবে গো...'। 
কিছু দূর হাটতে হাটতে একটা ফাঁকা জায়গায় ধপ করে বসে পড়লো ও। সরু সরু পা দুটো আর বালি কেঁটে এগিয়ে যেতে পারছে না যেনো। বুকের ভেতরে ধুকপুক  করা যন্ত্র টা যেন বেরিয়ে আসবে এবার। রাজু চুপ করে এভাবে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। আকাশে একটাও তাঁরা নেই, ঢেউটাও যেন কেমন উথালপাথাল করছে। আজ কি ভরাকোটাল! বুকটা ধুক করে উঠলো ওর।

সেদিনো তো এমনই ঢেউ ছিল, মাথার উপর নিকষ অন্ধকার। কিন্তু বাবাতো বলেছিল - ' মোর জগন্নাথ মোরে রক্ষা করিবে।' - কই হলো কই? চোখ দুটো  টলটল করে উঠলো রাজুর।
মাকে সে কখোনো দেখেনি। সে হতে গিয়ে নাকি মা মারা গেছিল। মামা বলেছিল ও নাকি অপয়া। সেই থেকে মামাবাড়ির পাট ও তার চুকে গেল।  এক ওর বাবা ই ছিলো তার সব। বাবাকেও খুব যে কাছে পেতো তা বলা চলে না। বাবার নাম ছিল জটাধারী। মাছ ধরতে  চলে যেত কখোনো এক মাসের জন্য কখোনো বা পনেরো দিন। এমনই চলতো। বাড়ির পাশে এক মাসী ছিল , পুরির হোটেলে ঘর মোছা - বাসন ধোয়ার কাজ করতো। বাবা যখন থাকতো না ওর কাছেই থাকতো রাজু।
গেল বারের আগের বার। জটাধারীরা যখন মাছ ধরতে গেল একমাসের জন্য,  ঝড় উঠেছিল খুব। রেডিও তে খবর পেয়ে ওরা ফিরছিলো, কিন্তু মাঝ সমুদ্রে ওদের একটা নৌকা তলিয়ে যায়। ওদের পাঁচজন সঙ্গীর খোঁজ আর মেলেনি। জটাধারীরা বাড়ি ফিরলে রাজু ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো,' তোমাকে মাছ ধরতে যেতে দিবো নাই গো আর...  আমায় ছেড়ে আর কোথাও যাবে নাগো তুমি..''। বাবাও ওকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিল। কিন্তু মাছ ধরা আদতেই থামেনি।‌‌ যাত্রা আবারও চলতে থাকে।কখোনো সাতদিন, কখোনো বা পনেরো দিন আবার কখোনো বা একমাস।বাবা যখন থাকতো না, রাজু সমুদ্রের পাড়ে বসে থাকতো কীসের যেন প্রতীক্ষায়। যদি বাবার ট্রলারের দেখা মেলে।
বাবা বলতো - ' লোনা জল মোরে খুব টানে, মাঝ দরিয়ার পবনের সাথেই মোর বহুকালের জানাশোনা....'।
তারপর বছর ঘুরলো সেই নৌকাডুবির কথা মুছে গেল রাজুর মন থেকেও।

এবার বাবারা গেল একমাসের জন্য। এমনই এক ভরাকোটালের রাত।হাওয়া অফিস থেকে খবর এলো- সতর্কবার্তা। যাদের পরিবার সমুদ্রে ছিল সবার মুখে ঘনিয়ে এলো এক অদৃশ্য বিষাদের ছায়া।দুদিন ওদের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না, রাজু সারাদিন সমুদ্রের পাড় ধরে একবার এদিক একবার ওদিক করতে লাগলো। তার মন যেন কিছুতেই বাঁধ মানতে চাইছে না।রাতের বেলা মাসী জোর করে খুঁজে  ঘরে নিয়ে যেত ওকে।
দুদিন পর জটাধারীর দলের দুটো নৌকা ফিরে এলো। কিন্তু, রাজুর বাবা আর ফিরল না।

দিন কাটতে লাগলো, বছর গেল,রাজুর অপেক্ষা তাও যেন শেষ হয় না, সারা রাত ও সমুদ্রের পাড় ধরে ঘুরে বেড়ায়। আচ্ছা সমুদ্রের জলে তো কতকিছু ভেসে আসে, তার বাবা কেন আসতে পারে না! মাসী বলতো সমুদ্র নাকি কোনো কিছুই নেয় না, ঠিক ফিরিয়ে দেয়। কিই তার বাবাকে তো ফেরালো না। বাবা বলেছিলো লোনা জলে কি যেন এক নেশা আছে, দুদন্ড বসতে দেয় না,শুধু টানে। রাজুরও ইচ্ছে করে এতে ঢেউগুলোর ওপারে শান্ত জল, তার ওপাশে যেতে, সেখানে যদি বাবার  দেখা মেলে। অনেক সময় ঐ মাঝসমুদ্রে একভাবে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় কে যেন ডাকছে তাকে।
কত পরিচিত যেন ঐ গভীর জল, কত জন্ম যেন ওখানে বাস! ওখানে  ওর বাবা , শিবাস কাকা, মতি কাকা সবাই ... সবাই আছে।

চোখের জল মুছে রাজু উঠে দাঁড়ায়। সলতের ব্যাগটা তুলে নিয়ে এগিয়ে যায় সামনের চায়ের দোকানের দিকে। " সলতে লেবে গো মাই...সলতে...দুপ্যাকেট পাঁচ ট্যাকা লিবা... লাও না মা..."।
সমুদ্রের ওপর থেকে হালকা বাতাস ভেসে আসে। ঢেউগুলো কিসের টানে যেন আছড়ে পড়ছে পায়ে। আদি অনন্ত এই চলা...এই সম্পর্ক।

1 comments:

রাজদ্বীপ said...

খুব সুন্দর।