সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

 এইতো জীবন  

                                   সুব্রত নন্দী মজুমদার 

আমি অনু বলছি, বাবা, একটা সুখবর আছে , মেয়ে অনুর ফোনের জন্যই উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিলেন বিকাশ বাবু। তিনি বলেন, বল মা সুখবরটা। 
আমার রেজাল্ট বেরিয়েছে, অনু বলে, আমি খুব ভাল ভাবে পাশ করেছি। 
খুব ভাল খবর দিলি, আমরা জানতাম তুই ভাল রেজাল্ট করবি। 
এই শেষ নয়, অনু উত্তেজিত হয়ে বলে, আমাদের এখানে যে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ হয়েছিল, রেজাল্ট বেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি একটা খুব ভাল অফার পেয়ে গেছি। 
ঈশ্বর তোর মঙ্গল করুন, বিকাশবাবু বলেন, দাঁড়া, আমি তোর মাকে ডেকে দিচ্ছি, বলে তিনি চেঁচিয়ে ডাকেন, কইগো শিগগিরই এস, অনুর ফোন। 
অনুর মা সুমিতা দেবী তখন রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। স্বামীর ডাক শুনে তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ছুটে আসেন, কই দাও ফোনটা। বিকাশ বাবুর হাত থেকে ফোন নিয়ে তিনি বলেন, কি রে কি খবর? কবে আসছিস? 
অনু বলে, আগে ভাল খবরটা শোন, আমি খুব ভালভাবে পাশ করেছি আর সঙ্গে সঙ্গেই একটা ভাল চাকরি পেয়ে গেছি।  শুনে ফোনটা হাতে নিয়েই তিনি দুহাত ল্কপালে ছুঁইয়ে বলেন, বাবা ভোলানাথ তোর সহায়। তিনি  শিব ভক্ত। তিনি আবার বলেন, আসছিস কবে? 
সেই কথাই তো বলব, তুমি বাবাকে ফোনটা দাও, অনু বলে। 
ফোন ধরে বিকাশবাবু বলেন, বল, কবে আসছিস? 
বাবা, অনু অপেক্ষাকৃত শান্তস্বরে বলে, এক্ষুনি আসতে পারছি না বাবা। আজ মাসের আটাশ তারিখ, সামনের মাসের পয়লা  তারিখেই জয়েন করতে হবে। মাকে একটু বুঝেয়ে বল, কিছুদিন পড়ে অবস্থা বুঝে ছুটি নিয়ে আসব। 
মেয়ের কথা শুনে বিকাশবাবু দমে যান, খুব আশা করেছিলেন রেজাল্ট বেরোবার পর সে এসে কয়েকটা দিন থাকবে। কিন্তু তিনি তাঁর সমস্যাটার কথা ও বুঝতে পারেন।  একটু চুপ করে থেকে তিনি বলেন, তা এখন তো তোকে হোস্টেল ছেড়ে দিতে হবে, থাকার ব্যবস্থা কি হবে। 
সেজন্য তুমি একটুও ভেব না বাবা, অনু বলে, সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে, আমি তোমাকে রাত্তিরবেলা ফোন করে ডিটেলস বলব। 
তুই যদি বলিস তো আমি আসতে পারি তোকে হেল্প করতে, আমতা আমতা করে তিনি বলেন, কারণ তাঁর এখন বেশি চলাফেরা করা ডাক্তারের বারণ। 
একদম না, অনু জোর গলায় বলে, তোমার হার্টের অবস্থা ভাল নয় আমি জানি, তোমরা একটুও চিন্তা করবে না, সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি মাকে বল, এখন ছাড়ছি, রাত্রে ফোন করব। 
সুমিতা দেবী জিজ্ঞেস করেন, অনু কি বলল। 
একটা দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে বিকাসবাবু বলেন, মেয়েকে পয়লা তারিখ জয়েন করতে হবে, তাই এখুনি আসতে পারছে না। পরে  ছুটি নিয়ে আসবে। সুমিতা দেবী ও হতাশ হয়ে বলেন, তার মানে কবে আসবে কিছু ঠিক নেই। কোথায় থাকবে কিছু বলল? হোস্টেলে তো থাকতে পারবে না।  
বলল রাত্রে জানাবে, ব্যবস্থা হয়ে গেছে, ধীরকণ্ঠে বিকাশবাবু বলেন। মেয়েটা একা একা কি করবে কে জানে, সুমিতা দেবী বলেন। 
আমি ও তাই বলছিলাম, বিকাশবাবু বলেন, সে বলল ব্যবস্থা হয়ে গেছে, রাতে সব কথা বলবে। 
বিকাশবাবু উচ্চশিক্ষিত লোক, একটা বেসরকারী কলেজে ইংরাজীর হেড অফ দি ডিপার্ট্মেন্ট হয়ে রিটায়ার করেছেন কিছুদিন হল। তাঁর হার্টের প্রব্লেম আছে, ডাক্তারের পরামর্শে বেশি চলাফেরা করা নিষেধ, না হলে চলে যেতেন মেয়ের একটা ব্যবস্থা করে দিতে। 
তাঁদের ছেলে নেই, অনীতাই একমাত্র  সন্তান। মেয়েকে নিজের হাতে গড়েছেন। মেয়ের ইচ্ছেতে তাকে  ইঞ্জিনীয়ারিং পড়িয়েছেন, তারপর নিজে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে ব্যাঙ্গালোরে এম.বি.এ. কোর্সে ভর্তি করে দিয়ে এসেছেন। তখন ও তাঁর হার্টের সমস্যা ধরা পড়ে নি। এই ক’টা বছর স্বামী স্ত্রী বুক বেঁধে একা রয়েছেন মেয়ে পাশ করে এসে কলকাতায় কাজ করবে এই আশায়।  বিকাশবাবু অবশ্য আন্দাজ করেছিলেন এই রকম একটা কিছু হতে পারে, তবু আশায় আশায়….।           
সারাদিন স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বেশি কথা হয় নি। মেয়ে ভালভাবে পাশ করে ভাল চাকরি পেয়েছে, এই আনন্দ সংবাদের মধ্যেও মেয়ে এল না বলে একটা বিষণ্ণতার ছায়া। কথামত রাত আটটা নাগাদ অনু ফোন করে বলে যে ব্যাঙ্গালোরে বাড়ি ভাড়া অসম্ভব বেশি, একার পক্ষে ভাড়া করে থাকা যায় না বলে ও আর ওর একজন কলিগ মিলে একটা রুম ভাড়া করেছে, ছোট একটা কিচেন ও বাথরুম সমেত। রোজ রোজ বাইরে খেতে ভাল লাগে না, তাই কিচেন সমেত ঘর নিয়েছে। দুপুরের লাঞ্চটা অফিসেই হবে, রাতের খাবার নিজেরা ইচ্ছেমত রান্না করে নেবে। 
যাক, খানিকটা স্বস্তি, থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। বিকাশবাবু কিম্বা সুমিতা দেবী কিছু জিজ্ঞেস করেন নি, অনু নিজে থেকেই বলল যে অন্ততঃ এক বছর হলে ছুটি পাবে। তখন বাড়ি আসবে। এ এ এ ক বছর আরো এক বছর অপেক্ষা করতে হবে মেয়েকে দেখার জন্য? বিকাশবাবুর শরীরটা ঠিক থাকলে তাঁরাই একবার গিয়ে মেয়েকে দেখে আসতেন। 
মেয়ের কথা ভেবে ভেবেই তাঁরা স্বামী স্ত্রী দিন কাটান। অনু অবশ্য রোজ না হোক দু’তিন দিন পর পর ফোন করে মা বাবার সঙ্গে কথা বলে। সুমিতা দেবীর মাথায় আর এক চিন্তা খেলে বেড়াচ্ছে,  মেয়ে বড় হচ্ছে, তার বিয়ের কথাটাও ভাবতে হবে। 
সময় বসে থাকে না, দেখতে দেখতে এক বছর কেটে গেল। মা বাবা দু’জনেই আশায় আশায় দিন গোণেন মেয়ে কবে আসবে। সুমিতা দেবী একদিন ফোনে জিজ্ঞেস করেন, হ্যাঁ রে, এক বছরতো হয়ে এল। তোকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে, কবে আসবি। তাঁদের ও বয়স হচ্ছে।  
অনীতা বলে, আমি অফিসে কথা বলে রেখেছি, হয়তো সামনের মাসে পনেরো দিনের ছুটি পাব। দিন ঠিক হলে তোমায় জানাব। 
শেষ পর্যন্ত একদিন অনু ফোন করে মাকে জানালো যে সামনের মাসের দশ তারিখ থেকে পনেরো দিনের ছুটি  পেয়েছে। সে দশ তারিখের প্লেনের টিকেট কেটে রেখেছে। সুমিতা দেবীর আনন্দের সীমা নেই। 
মেয়ে বারবার বারণ করা সত্ত্বেও এবং স্ত্রীর অনিচ্ছায় বিকাশ বাবু অনুর  আসার দিন একটা ট্যাক্সি করে এয়ারপোর্ট চলে এলেন।  অনুকে দেখে বিকাশ বাবুর বুক আনন্দে ভরে গেল, মেয়েকে কি ঝকঝকে দেখাচ্ছে, বোঝা যায় ও সুখেই আছে।  বাবাকে দেখে অনুর আনন্দ মিশ্রিত রাগ, তোমার শরীর খারাপ নিয়ে তুমি কেন এলে? আমি তো একটা ট্যাক্সি করে চলে যেতে পারতাম।  বিকাশ বাবু হেসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তোকে দেখে আমার সব অসুখ সেড়ে গেছে। 
অনু কতদিন পর বাড়ি ফিরে এল। পাড়া পড়শীদের মধ্যেও কেউ কেউ ঘনিষ্ঠ তাকে দেখতে এসেছে। সুমিতা দেবীর ব্যাস্ততার অন্ত নেই।  প্রথম কয়েকটা দিন কেটে গেল এর তার সাথে দেখা করতে করতে। সুমিতা দেবী রোজ বেছে বেছে মেয়ের ভাল লাগা সব খাবার তৈরি করেন। 
ক’টা দিন কেটে যাবার পর একরাতে স্বামী ও মেয়েকে খেতে দিয়ে সুমিতা দেবী মেয়েকে  জিজ্ঞেস করেন, হ্যাঁ রে, তোর সাথে তো কোন কথাই হল না, তারপর হুট করে একদিন চলে যাবি। আসল কথাটা চেপে রেখে তিনি বলেন, তোর একটা ব্যবস্থা তো করতে হবে? 
অনু মুখ তুলে বলে, তুমি কিচ্ছু ভেব না মা, আমি সেখানে খুব ভাল আছি। 
মেয়ের পাতে আর একটা মাছের বড় টুকরো দিয়ে মা বলেন, ওখানে এরকম মাছ নিশ্চয় পাওয়া যায় না, নে আর একটা খা। 
অনু মাছের কাটা চুষতে চুষতে বলে, পাওয়া যায় মা, তবে মাছের বাজার অনেক দূরে বলে যাওয়া হয় না। তুমি ও বসে পড় মা।  বিকাশ বাবু চুপচাপ বসে খেতে থাকেন, তাঁর মাথায় অজস্র চিন্তা। 
সুমিতা দেবী নিজের খাবার প্লেটটা নিয়ে বসে বলেন, তোর বাবার শরীর বিশেষ ভাল নেই, আমার ও বয়স বাড়ছে যত শরীর ভেঙ্গে পড়ছে, তাই ভাবছিলাম সময় থাকতে থাকতেই …. ….., মাকে বাধা দিয়ে অনু বলে, তুমি কি বলতে চাইছ মা? 
বিকাশ বাবু কথাটা ঘুরয়ে দিয়ে বলেন, তোর রুমমেট কি রকম, সে কোন দেশীয়, বাঙ্গালী নয় নিশ্চয়।  সুমিতা দেবী মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।  
অনীতা একটু ভেবে বলে, তুমি ঠিকই ধরেছ বাবা, সে বাঙ্গালী নয়, হায়দ্রাবাদের, খুব ভাল বিরিয়ানী রান্না করতে পারে, আমায় বেশ কয়েকদিন করে খাইয়েছে।  সরোজ আর আমি একই সঙ্গে পড়তাম, তারপর একই অফিসে কাজ পেয়ে দুজনে মিলে ঘরটা ভাড়া করেছি। 
সরোজ নামটা খট করে সুমিতা দেবীর কানে লাগে। ঐ দেশীয় লোক, ছেলে না মেয়ে বুঝতে তাঁর একটু  সময় লাগে। বিকাশ বাবু ও মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ব্যাপারটা উপলব্ধি করে অনীতা বলে, সরোজ রেড্ডি খুব বড় বাড়ির ছেলে বাবা, খুব ভাল। একবার উইক এন্ডে আমাকে ওদের বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। ওর মা বাবা ও খুব ভাল। 
মেয়ের কোন কথা সুমিতা দেবীর কানে যায় না, তাঁর মাথা বনবন করে ঘুরতে থাকে, মেয়ে একটি ছেলের সাথে একঘরে থাকে?  একথা যে তিনি কল্পনাও করতে পারেন নি। বিকাশ বাবু বুদ্ধিমান লোক, ব্যাপারটা বুঝতে তাঁর মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। 
অনীতা বুঝতে পারে যে মা বাবা, বিশেষ করে মা এটা চট করে হজম করতে পারছেন না। সে একটু হেসে বলে, আমরা নিজেদের মধ্যে এটা নিয়ে আলোচনা করেছি, আরো বছর খানেক লিভ টুগেদার করব। ততদিনে আমাদের ক্যারিয়ার ও স্থায়ী হয়ে যাবে। তখন আমরা বিয়ের কথা ভাবব।  সুমিতা দেবী না জানলেও বিকাশবাবু কথাটার অর্থ বোঝেন।  
সুমিতা দেবী চোখ বন্ধ করে মনে মনে তাঁর ইষ্ট দেবতা বাবা ভোলানাথকে স্মরণ করেন, আর বিকাশ বাবু ভাবেন, এই হবার ছিল, এই তো জীবন।  

0 comments: