সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

 স্বপ্নময় লাক্ষাদ্বীপ

তনুশ্রী গড়াই

বেড়াতে যেতে কারই না ভাল লাগে। পাহাড়, সমুদ্র, মরুভুমি সব জায়গার নিজস্ব সৌন্দর্য আছে। তবে ভ্রমণ পিপাসু হিসেবে বরাবর পাহাড় আমার কাছে প্রাধান্য পেতো কারণ কারণ তার বৈচিত্র্যের জন্য। তুষারাবৃত পাহাড় বা ঘন বনসমৃদ্ধ পাহাড় যাই হোক তাই আমায় ভীষণ আকর্ষণ করত। কিন্তু কয়েক বছর আগে যখন আমরা যখন লাক্ষাদ্বীপ বেড়াতে গেলাম তখন আমার এই ধারণা পুরো বদলে যায়। জলজীবন যে এত রঙিন, আকর্ষনীয় আর রহস্যময় হতে পারে তা আমার কল্পনাতীত ছিল। আরব সাগরের তীরে অবস্থিত এই দ্বীপপুঞ্জের নৈসর্গিক সৌন্দর্য আমার মনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাস। আমরা আর আমাদের একটি বন্ধু পরিবার মিলে লাক্ষাদ্বীপ গেছিলাম। ভারতীয়দের লাক্ষাদ্বীপের ৩৬ টি দ্বীপে বেড়ানোর অনুমতি আছে,তবে বিদেশীদের ৩ টি দ্বীপে যাওয়ারই অনুমতি আছে। লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমনের  জন্য লাক্ষাদ্বীপ ট্যুরিজ্‌ম এর “সমুদ্রম” প্যাকেজ বুক করেছিলাম। এই পাকেজ এর “এম ভি কাভারাত্তি” জলজাহাজ করে লাক্ষাদ্বীপের দ্বীপগুলি ঘুরেছিলাম। এটা আমার জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা। 

যাওয়ার দিন মুম্বাই থেকে ভোরবেলাই ৫ টার সময়  এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট করে কোচির উদ্দেশ্যে রওনা হই। সেই দিনটা কোচিতে কাটিয়ে পরের দিন  আমরা কোচির ওয়েল্লিংডন দ্বীপ থেকে জলজাহাজ করে লাক্ষাদ্বীপ এর উদ্দ্যেশে রওনা দিয়েছিলাম । ফ্লাইটের মত এখানেও আমাদের সিকিউরিটি চেক করতে হয় আর লাগেজ ও দিয়ে দিতে হয় । তারপর বাসে করে আমাদের জাহাজের কাছে পৌঁছে দেয়। 



এম ভি কাভারাত্তি

বিশাল বড় জাহাজ। সাত তলা জাহাজের পাঁচ তলায় আমাদের কেবিন ছিল। সাত তলায় জাহাজের সামনে ও পিছনে দুটি ডেক । পিছনের ডেকে হেলিপ্যাড আছে। জাহাজে চেপে দেখি আমাদের কেবিনের সামনে আমাদের লাগেজ  পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। কেবিন এ লাগেজ রেখেই আমরা জাহাজ ঘুরতে বেরোলাম । ঘণ্টা খানেক ধরে জাহাজ  ঘুরলাম। অসাধারণ সেই অভিজ্ঞতা । কি নেই সেখানে!!! মনে হল ছোট খাটো এক শহর। সুইমিং পুল ,হাসপাতাল, ষ্টেশনারী শপ সবই। আলাদা করে ঘরে বিলিয়ার্ড, ক্যারাম, লুডো আরও কত কিছু খেলার বন্দোবস্ত আছে। বিশাল ডাইনিং হল এ সেখানে অন্তত শ‘দুয়েক লোক বসে একবারে খেতে পারবে। 

বিকেল ৩ টে নাগাদ আমাদের জাহাজ যাত্রা শুরু করল। আমাদের প্রথম উদ্দেশ্য কাভারাত্তি । মনে মনে এক অজানা রোমাঞ্চ অনুভব করছিলাম। খানিকক্ষণের মধ্যেই জাহাজ কোচি বন্দর ছেড়ে মাঝসমুদ্রের দিকে ভাসতে শুরু করল । জাহাজের আশেপাশে প্রচুর ডলফিন হঠাৎ করে যেন জলের মধ্যে লাফিয়ে লাফিয়ে আমাদের বিদায় জানাতে শুরু করল। রাতের বেলায় ডেকে বসে মনে হচ্ছিল বুঝি এই বিশাল গভীর সমুদ্র আর অন্তহীন আকাশ যেন মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। প্রকৃতি বোধ হয় আমাদের আনন্দে সামিল হয়ে পড়েছে । বিশালাকার ডেকে বাচ্চারা খেলায় মেতে উঠেছে, বড়রা গল্পে মেতে আছে আর জাহাজ নিজ গতিতে ভেসে চলেছে কাভারাত্তির উদ্দ্যেশে । 

লাক্ষাদ্বীপ এর অনেকগুলি দ্বীপের মধ্যে আমরা তিনটি দ্বীপই ঘুরেছিলাম-কাভারাত্তি, কাল্পেনি আর মিনিকয়। কাভারাত্তি হল লাক্ষাদ্বীপ এর রাজধানী। দ্বীপের প্রশাসনিক কার্যালয় রয়েছে কাভারাত্তিতে। এখানের লাগুন আর সবুজায়নের মিশেল ভীষণ আকর্ষণীয় । পরের দিন জাহাজ সকাল আটটা নাগাদ কাভারাত্তি পৌঁছল। জাহাজ দ্বীপ থেকে কিছুটা দূরেই থামল। বাকি দূরত্বটা ছোট লঞ্চ করে আসতে হয়। তার কারণ  হল এখানকার কোরাল রিফ। বড় জাহাজ যদি দ্বীপ পর্যন্ত যায় তো এই কোরাল রিফ যা এখানকার প্রধান আকর্ষণ সব নষ্ট হয়ে যাবে । দ্বীপে পৌঁছনোর পর ওখানকার কতৄপক্ষ আমাদের ডাবের সুস্বাদু পানীয় দিয়ে স্বাগত করল। নীল সমুদ্রতট ভীষণ সুন্দর। এখানে সমুদ্রের  কোন ঢেউ  নেই। পরিষ্কার কাঁচের মতো নীল স্বচ্ছ জল। লাক্ষাদ্বীপ বেড়াতে গিয়ে আমাদের সব থেকে বেশী যেটা ভাল লেগেছে সেটা হল এখানে কোনরকম কোন দূষণের  চিহ্নমাত্র নেই। অসম্ভব পরিষ্কার । এখানকার অধিবাসীরা অধিকাংশই মুসলিম আর ভীষণ সৎ ও অতিথিপরায়ণ । কাভারাত্তিতে আমরা গ্লাসসবট্টম বোট করে প্রথমে খানিকক্ষণ ঘুরলাম। ফ্রগফিল, স্টারফিস, জেলিফিস, অক্টোপাস, কোরাল  আর ও কত কিছু দেখলাম। কত রঙের মাছ দেখলাম। অপূর্ব লাগছিল । তারপর শুরু হল সমুদ্রস্নান। এখানে লাইফ জ্যাকেট বাধ্যতামূলক । এখানে বিভিন্ন ধরনের ওয়াটার স্পোর্টস হয় যেমন স্নরকেলিং , স্কুবা ডাইভিং , কায়াকিং ইত্যাদি।



কাভারাত্তির সমুদ্র সৈকত

 স্নান করে লাঞ্চ করতে করতে ওখানকার অধিবাসীরা নিজস্ব ভাষায় নাচ ও গানের অনুষ্ঠান করল। মন ভরে গেল আমাদের। লাঞ্চ সেরে কাভারাত্তি দ্বীপ ঘুরতে বেরোলাম । এখানে ৫২ টা মসজিদ আছে। এখানে একটি মেরিন অ্যাকুয়ারিয়াম আছে যেখানে শার্কের বাচ্চা , ডলফিন,আর বিভিন্ন বিরল প্রজাতির রঙ্গিন জলজ প্রাণী রয়েছে। বিকেলবেলায় চা আর পকোড়া সমুদ্র  তীরেই  বসে খেলাম । তারপর আবার জাহাজ এ ফিরে এলাম সন্ধ্যাবেলায় । দারুন কাটল দিন টা। রাতের ডিনার সেরে ডেকে উঠে সমুদ্রের বিশালতা উপভোগ করতে করতে সমুদ্রের ঠাণ্ডা হাওয়া মনপ্রান ভরিয়ে দিচ্ছিল । 



স্থানীয় অধিবাসিদের নৃত্য

পরের দিন ভোরবেলায় আমরা সবাই জাহাজের ডেকে পৌঁছেছি “সূর্যোদয়“ দেখবো বলে। মাঝ সমুদ্রে দাঁড়িয়ে  সূর্যোদয় দেখার সে এক অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতা । মনে হল সমুদ্রের ভিতর থেকে বুঝি একটা লাল বল টুপ করে জলের উপর কেউ ছুঁড়ে দিল। তারপর সেটা ধীরে ধীরে আকাশের দিকে ধেয়ে চলল। অসাধারণলাগছিল। একটু পরেই আমাদের জাহাজ কাল্পেনি পৌঁছল। কাভারাত্তি থেকে কাল্পেনি এর দূরত্ব ১২৩ কিমি। এখানেও জাহাজ মাঝ সমুদ্রে থামলো। বাকি দূরত্বটা ছোট নৌকো করে কাল্পেনি দ্বীপে পৌঁছলাম । অসম্ভব সুন্দর এই দ্বীপটি নারকোল গাছের সারি দিয়ে ঘেরা। কাঁচের মত পরিষ্কার জলের নীচে প্রচুর “সি কিউকাম্বার” দেখা যাচ্ছিল। তিনটি দ্বীপ মিলে কাল্পেনি দ্বীপটি গঠিত- চেরিয়াম, পিট্টি, তিলাক্কাম। বিভিন্ন  ধরনের ওয়াটার স্পোর্টস এর জন্য পিট্টি দ্বীপে নিয়ে গেল আমাদের । যেতে যেতে বিশাল বড় আকারের সামুদ্রিক কচ্ছপ  দেখতে পাই । প্রচণ্ড ক্ষিপ্র গতিতে সেই কচ্ছপটা আমাদের সামনে দিয়ে  চলে গেল । পিট্টি দ্বীপে পৌঁছে আমরা স্নোরকেলিং আর কায়াকিং করলাম । এখানে স্নোরকেলিং করার সময় “সি হর্স“ দেখলাম । শুধু তাই নয় পার্ল ওয়েস্টারও দেখতে পেলাম যেটা ক্রমাগত খুলছিল আর বন্ধ হচ্ছিল । এটা আমার দারুণ অভিজ্ঞতা । এই পার্ল ওয়েস্টার এর মধ্যেই পার্ল বা মুক্তর সৃষ্টি হয়। কাল্পেনির সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা সবাই নিজেদের  জীবনের ব্যস্ত তা ভুলে গিয়ে অদ্ভূত এক শান্তি  অনুভব করছিলাম। 



ওয়াটার স্পোর্টস এর জন্য পিট্টি দ্বীপ

কাভারাত্তি ও কাল্পেনির পর আমরা পরের দিন মিনিকয় দ্বীপে গেলাম। কল্পেনির ও মিনিকয় এর দূরত্ব ২১০ কিমি। স্থানীয় ভাষায় মিনিকয় এর অর্থ “মালু” যার অর্থ “ওমেনস আইল্যান্ড“। এখানকার প্রধান ভাষা  মাহল। এখানে আমরা প্রথমে  লাইট হাউস ঘুরেছিলাম । লাইট হাউস এর উপরে উঠে গোটা মিনিকয় দ্বীপ টাই দেখা যাচ্ছিল। এই মিনিকয় দ্বীপ এর সাথে মালদ্বীপ এর  অনেকটা মিল আছে। প্রায় আধা কিমি পর্যন্ত  সমুদ্রের জলের গভীরতা হল  ২ ফিট। কোন ঢেউ নেই জলে। অসম্ভব পরিষ্কার  জল।মনে হচ্ছিল আমরা বুঝি অন্য কোন জগতে চলে এসেছি যেখানে কোনরকম কোনও কোলাহল নেই, কোন প্রকারের দূষণ নেই- আছে শুধুই শান্তি। আমরা এখানে  স্থানীয় নৌকা যার নাম “যাহাধোনী” দেখলাম। নৌকা প্রতিযোগিতাই এই নৌকা ব্যাবহার হয়। এই দ্বীপের ৮৫% এলাকা নারকোল গাছ দিয়ে ঘেরা। সমুদ্র তীরের কাছে জলের রঙ হাল্কা নীল আর যত গভীর সমুদ্রের দিকে যাওয়া যায় জলের রঙ ক্রমশ গাঢ়  নীল হতে থাকে। এর কারণ হল কোরাল রিফ এর তারতম্য। এই মিনিকয় দ্বীপটি দৈর্ঘ্যে ১০ কিমি আর অর্ধবৃত্তাকার। এখানকার টুনা মাছ খুব সুস্বাদু। কত রকমের সামুদ্রিক শামুক দেখলাম আমরা। সারাদিন মিনিকয় দ্বীপে কাটিয়ে আবার জাহাজে ফেরার সময় হয়। তার সাথে লাক্ষাদ্বীপ ঘোরাও শেষের মুখে । 



মিনিকয় দ্বীপ এর লাইট হাউস

মিনিকয় দ্বীপ থেকে ছোট বোট করে ফেরার সময় আমরা সামুদ্রিক ঝড়ের মুখে পড়ি । সমুদ্র তখন উত্তাল আর সমুদ্রের ঢেউ বিশালাকার ধারণ করেছে। আসলে ঐ দিন তামিলনাডুতে প্রচন্ড ঝড় ওঠে। বঙ্গোপসাগরের সাথে সাথে আরবসাগরও তখন অশান্ত। আমাদের ছোট নৌকো তখন ঢেউ এর জেরে টালমাটাল করছে। নৌকায় বসেও আমরা পুরো ভিজে গিয়েছিলাম। ঢেউ কেটে নৌকো তখন আর এগোতেই পারছিল না। সমুদ্রের জল তখন আমাদের ছোট নৌকায় ঢুকে যাচ্ছিল। যাই হোক বেশ সময় নিয়েই ছোট্ট নৌকাটা ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। আমরা কোনভাবে বড় জাহাজে উঠে প্রাণে বাঁচি। সেদিন আরবসাগরের ঐ রূপ দেখে রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আর অনেক দিনের একটা ভুল ধারণা যে আরবসাগর শান্ত তাও ভাঙল । যাই হোক জীবনের সেরা অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা আবার কোচি মুখী হই। সাগরের বিশালতা আর লাক্ষাদ্বীপ এর নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে চোখেমুখে মেখে মুম্বাই ফিরে এলাম, বলা যেতে পারে স্বপ্নময় জগত থেকে কর্মময় বাস্তব জগতে ফিরে এলাম আর আশায় রইলাম যদি এমন অভিজ্ঞতা আরও একবার পাই ।

0 comments: