সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

 গোত্রান্তর

রেদওয়ান খান


নিবারণের ঘরটি নিতান্ত ক্ষুদ্র।মহাদেবপুর গাছতলা গাঁয়ের বিখ্যাত দালালদীঘির পশ্চিম পাড়ের এ বাড়িটিতে অন্যান্য যারা,বর্তমানকালে বসতি করে,তাদের ঘরগুলো পরস্পর ঘনিষ্ঠ,টুংটাং শব্দমূখর।তাঁর ঘরটি তাঁরই মতো দীঘির এক কোণে,গাছগাছড়ার আবরণে নিঃসঙ্গ,স্তব্ধ।

শীতকালের গভীর রাত্রির ঘন কুয়াশায় ঢাকা উঠান।পাশেই,পূর্বপুরুষদের কীর্তি- অতি প্রাচীন বয়স্ক,জলগম্ভীর বিশালাকার দীঘিটির কারণে এ বাড়িতে শীতটা একটু বেশিই।রাত্রি গভীর হলে কি হবে,নিবারণের ঘুম নাই।বয়সের ভারে যতোটা না তার চেয়ে রসুই ঘরে কখন আগুন জ্বালাবেন- এই চিন্তার খোঁচানিতে তাঁর তন্দ্রাভাব বার বার বাধাগ্রস্ত হয়।মশার ভনভনানিতেও শরীরের যৎসামান্য,নেংটিপ্রায় ধুতিখানি হাঁটুর উপরে উঠে এসেও ঊরুর ধ্বসে পড়া,জীর্ণ চামড়ালগ্ন থাকতে চায় না।

রাত্রি গভীরতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হুজুরবাড়ির অর্থাৎ পীরবাড়ির  মাদ্রাসাতুল দারুল উলুম-এর মহাপবিত্র বার্ষিক ওরস ও ওয়াজ মহফিলের মাইক বাজানির কানফাটা শব্দ।বড়ো পীর সাহেবের মৃত্যুবার্ষিকীতে,প্রতিবছরই এই ওরস-ওয়াজ-জলসা-জশনে-জুলুশ-মাহফিল হয়।শীতকাল যেন অপেক্ষায় থাকে তিন দিনের এই বিশেষ নসিহতনামার।দলে দলে লোক আসে।কখনও গজল কখনও বা কোরআন-হাদিসের সহী বিচার-বিশ্লেষণ।যদিও নিবারণের কানে ওয়াজের মর্মকথা ঠন্নর ঠন্নর বেজে ওঠার পর স্তব্ধ নিঝুম একটা বিকারহীন অনুভতি- তিনি টের পান কি পান না,অন্ধকারে কারো সাধ্য নাই যে অনুমান করে।ভোরেই হুজুরবাড়ির লোকসমাগমে মুড়ির মোয়াটা ভালোই বিক্রি হবে- এমন আশায় তাঁর রাত্রিপ্রহর দীর্ঘতর।

মুড়ির মোয়া বানানো ব্যতীত নিবারণের আর কোনও জাগতিক বিলাসিতা আছে বলে কেউ জানে নাই।

পাশেই শুয়েছিলো তাঁর ভাগ্নেঘরের নাতিটি,অল্প বয়সী- কতোই বা বয়স,তের-চোদ্দ,সুকুমার কিংবা যার আদুরে নাম কালা- ছেলেটা কালো বটে,মেয়েদের বেলা কুঁচবরণ,ছেলেরা ঘোরতর কৃষ্ণ। কালা-ই নিবারণের একমাত্র সঙ্গী,পরমাত্মীয়।সে তাঁকে খেজুরের রস,কখনও বা আখের গুড় জ্বাল দিতে,মোয়া বানাতে সাহায্য করে।বন-বাদাড় থেকে শুকনো পাতা কুড়িয়ে আনে,দুটি চাল-ডাল-লতা-পাতাও রান্না করে,সামলাতে না পারা অবাধ্য ঘন ধোঁয়া ওড়া উনুনে।মাঝে মধ্যে মন চাইলে,স্বভাবে উড়ুক্কু কালা,দীঘি-ঈদগাঁ-চৌরাস্তার বিশাল বট-অশ্বত্থ-বনপথ হেঁটে,পার্শ্ববর্তী গ্রাম বাগাদী উচ্চ বিদ্যালয়েও যায়।মহাদেবপুরে কোনও বিদ্যালয় নাই।হাজিরা খাতায় অনুপস্থিতির লাল দাগ বেশি,পড়ালেখাও ভালো লাগে না কালার।সে চৌরাস্তার মোড়ে সাপখোপে ভরা যেন-জন্মকালের জোড় ভাই- বট-অশ্বত্থের শাখায় বসে দূরবর্তী ডাকাতিয়া নদীতে চলা বিস্ময়কর লঞ্চ দেখে।বইখাতাও কিনে দিতে পারেন না ঠাকুর্দ্দা।

আর নিবারণও কোনও দিন জানেন না,কালা এবার কোন ছেনিতে উঠলো!

চিরকুমার নিবারণের এই নাতিকে তিনি একটা নির্লিপ্ত মায়ায় আটকে রেখেছেন,ছেলেটা তার বাবা-মার কাছে যেতে চায় না।তার মা-বাপ ভাই-বোন থাকে ফরিদগঞ্জের গোয়ালভর বাজারের কাছে,নিজেদের অভাব-দুঃখু-কষ্ট-পুজা-আচ্চা নিয়ে।

কিন্তু নিবারণের জীবন কেটেছে মোয়া বিক্রি করে।কতোটাই বা পারবেন।বিদ্যালয় সম্পর্কে তাঁর মতিগতি স্তব্ধ।

নিবারণের ভাষাহীন জাদুমায়া,চঞ্চল কিশোর কালার জন্য বেশ খানিকটা সুবিধারই হয়েছে।সে দাললবাড়ির বিশাল দীঘিতে সমবয়সীদের সঙ্গে সাঁতরে বেড়ায়।জমাদার বাড়ির ভৌতিক বাঁশবাগানের ভেতর দিয়ে গিয়ে কাউফল অথবা হলুদ গাব অনুসন্ধান করে।হুজুরবাড়ির রহস্যময় প্রাচীন দালাল-কোঠা,অন্ধরবাড়ি-বাহিরবাড়ি,পোড়া ইটের মোটা চওড়া শান বাধানো ঘাট,মাদ্রাসা-এতিমখানা দেখে।অন্ধরবাড়ির মেয়েরা নাকি কঠোর পর্দানশীন,তাই অন্ধরবাড়িতে পুরুষলোক এমনকী গোঁফ উঁকি দেয়া বালকদেরও ঢোকা নিষেধ।

বাঁশবাগানের ভূতের চেয়ে পীরবাড়ির রহস্যই কালার মাথায় খানিক চক্কর দেয় কখনও সখনও।

হুনছেন ঠাউদ্দা,মাইকে কয় গেরামের নামটা নাকি বদলান দরকার?মহাদেবপুর গাছতলা নাকি হিন্দু নাম?

ঘুম তখনও চোখ জুড়ে নেমে আসেনি,কালা এমনি ঢুলুঢুলু,তথাপি মেঝের শক্ত বিছানাতে একটু নড়েচড়ে কথাটা জিজ্ঞেস করে।কাঁথার নিচে সে এতোক্ষণ কান পেতেছিলো মাইকে।

নিবারণের মুখ,কুপি নিবানো ঘরে দেখতে পায় না কালা।সে অনুমান করে তার ঠাকুর্দ্দা আজকাল বেশি ঘুমায়।

রাতদিন বলে কথা নয়,নিবারণ চিরকালই স্বল্পবাক মহাস্থবির।তিনি নিজের ভেতরে ডুব মেরে থাকা এক মহাকাল।মুখে উত্তর দেন- এরকম সচরাচর ঘটনা দুর্লভ।সুতরাং পীর বাড়ির মাইকের আওয়াজ কানসহা হয়ে এলে কালার চোখে রাজ্যের ঘুম নামে।

নিবারণ জেগেই আছেন।মুড়ির মোয়া বানানোর অমোঘ কর্তব্য স্মরণে রাত্রিকালীন ঘুমের নিমিত্তে জেগে থাকা অভ্যেস।এই বয়সে এসে মানুষ ঘুমায় কম,ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি-জাবর কাটাই মূলত নিয়তি।

কালের যাত্রাকে শরীর ও অধরা অন্তঃকরণে ধারণপূর্বক নিবারণের জীবন যাপন- এমনই,আপেক্ষিক।

 

উত্থান পতন কম দেখেন নাই।ভূ-ভারত ভাইঙ্গা পাকিস্তান অইলো,কাঠাকাঠ লোক এইপার-ওইপার অইলো।তার পূর্বে মহত্মা গান্ধী নোয়াখালি গেলেন চৌরাস্তার পথটি ধরে,সঙ্গে কতো লোক- গান্ধীজিকে নিজ চোক্ষে দেখার সেই স্মৃতি-স্মরণ আজ  ধূসর কিন্তু করোটির কোণে লেপ্টে আছেন লাঠি হাতে,খালি পা,তীক্ষ্ণ নাকের ডগায় গোল চশমা- এক কালো বর্ণের সন্যাসী।

চাঁনতারা জিন্নাটুপীর পর শেখ সাহেবের জয়বাংলা।তখনও কাঠাকাঠ লোক পিঁপড়া-পঙ্গপালের মতো ঘরবাড়ি ছেড়ে শূন্যহাতে চলে গেলো,আবার ফিরেও এলো। কেউ কেউ মায়া ত্যাগ করেছিলো,আর ফিরে নাই।পীরবাড়িতে মাইক তো কম বাজে নাই।শেখ মুজিবররে মাইরা ফালানোর পরও,অনেকেই মহাদেবপুর গাছতলা ছেড়েছে।

কালার প্রশ্নের উত্তরে এতাক্ষণ নিরবতার ঝিঁঝিঁপোকা তাঁর,নিবারণের- কানে বেজেছিলো।তিনি এইসব ইতিকথার নিজস্ব পাঠের ভেতর মগ্ন ছিলেন।

নিবারণ,তাঁদের বাড়ির নামের মতোই এককালের অহংকার এই  দালালদীঘির যেন এক চকিদার।মাটি কামড়ে আছেন।কথাটি বছর কয়েক ধরেই শুনছেন,মাইকে অথবা গাঙপাড়ে,তবির বাপের ভাঙা চা দোকানে- চায়ে ভিজিয়ে টোবা বিস্কুট খেতে খেতে- গেরামের নাম নাকি নতুন কইরা রাখবো!

দাঁত না মাজার কুফলে অকাল-দন্তহীন,কতোকাল ধরে নিজের তৈরি করা মোয়া খেতে পারেন না নিজেই।কালা মাঝে মাঝে তবু,মোয়া গুঁড়া করে দিলে থবরথবর করেন,তখন দুগালের ঝুলে-পড়া চামড়ার অভ্যন্তরে,মুখগহ্বরের প্রাচীন মাড়িসর্বস্ব শক্ত চোয়াল- যেন সময়কেও চিবায়।

ফলে কালার কথাটি নিবারণ শুনেছেন,তবে হু ছাড়া অন্য কোনও শব্দ বের হয় নাই দেখে কালা মনে মনে বিরক্ত।মানুষ হিন্দু মোচলমান হয়,গেরামের নামও হিন্দু মোচলমান হয় কিনা- এই চিন্তার ভেতর সে ভেবেছে,জীবনের কতই নিয়ম!তারপর রাজ্যের ঘুমটি নেমে আসায় সে আর ওয়াজ শুনতে পায় নাই।

ঘুমে মৃত ছেলেটাকে তার ঠাকুর্দ্দা একটু পরই ডাকাডাকি শুরু করেন,ও কালা রে.কালু,ওঠ ভাই,আগুনটা জ্বালা।

উনুনে বড় চারকোণা টিনের ঢাকনাহীন উন্মুক্ত হাঁড়িতে খেজুরের রস বা আখের গুড় জ্বাল দেয়া হলে,রসটা ঘন আঠাআঠা হয়ে এলে তাতে কয়রা ধানের চালের মুড়ি ঢালা হবে।মূলত,মোয়া তৈরির সময় হয়ে এসেছে,রাত পোহাবার দেরি নাই- এই চিন্তাতেই নিবারণ বুড়ার ঘুম হয় না পুরোটা শীতকাল।গ্রীষ্ম-বর্ষা অপেক্ষা কারে শীতের।

 

 

 

দালালবাড়ির বিশাল দীঘিটির এক পাড়ে,সামান্য ঠাঁই- এ ঘরখানি,পাটকাঠি-গোবর লেপা বেড়া,মাথার উপর প্রায় উদাম চাল- বহুকাল নতুন চকচকে বাদামী রঙের গোলপাতা দেয়া হয় নাই।বৈশাখ-আষাঢ়ে ঝড়-বাদলে কম্পিত,এসব করবেই বা কে- জগতে নিবারণ বুড়ার কেউ নাই।নিকটাত্মীয়দের কিছু গেছে দেশভাগের সময়,কিছু বা যুদ্ধের বছর- সে কখনও ভারতে যায় নাই।যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এলে পোলাপানগুলো কুমির কুমির খেলার মতো দীঘির পাড়ে দল বেঁধে গান গাওয়ার খেলায় মেতে উঠতো,আজও  মনে গেঁথে আছেঃ

কে কে যাবি হিন্দুস্তান..ত্যানাতুনা গাঁট্টি বান’…বালক-বালিকাদের আনন্দ-সঙ্গীত,তাই সেখানে জগতের কোনও বিয়োগ ব্যথা ছিলো না।

তাঁদের কেউ কেউবা জন্মভূমির টানে পরবাসী কাক হয়ে কখনও স্বদেশ-গাঁয়ে,মহাদেবপুর গাছতলায় এলে,দীঘিটির শোকার্ত জল-ঢেউ অশ্রুসাগর- দুদণ্ড অশ্রুপাতের পর তাহারা আবার হারিয়ে যায়।ভারত নিবারণের অন্তরে অস্পষ্ট এক জমিনের আবছা কল্পনা।নিবারণ কখনও দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথাটি কল্পনা করতে পারে নাই।

দালালবাড়িতে ক্রমশঃ ঘরের শূন্য ভিটের সংখ্যা বাড়ে,অদ্যাবধি দক্ষিণকানির বটুও দ্যাশ ছাড়ে নাই।বটুদের হাতেটানা সুতাকলের করর্..করর্..শব্দ বড়ো বেশি শোকাবহ আজকাল।তবে নিবারণের অন্তরে সেই সব স্মৃতি বাজনা নিশব্দে বেজে যায়।

গাঁয়ের হিন্দু-মুসলমানের শীতকালীন বেঁচে থাকার সবিশেষ মাহাত্ম্য- নিবারণের মুড়ির মোয়ার জন্য তাহারা মসজিদে ফজরের নামাজের পর অথবা সান্ধ্য-কীর্তন শোনার পূর্বে,চাতক পাখি।তাঁর মোয়ার কিংবদন্তী মহাদেবপুর গাছতলা গ্রাম ছাড়িয়ে নানুপুর,বাগাদি,ইচলী গুদারাঘাট,চৌরাস্তার বটতল এমনকী দূরতম চান্দ্রাবাজার কি ডাকাতিয়ার চরের শেষ কোণ পেরিয়ে সাহেববাজার পর্য্ন্ত বিস্তৃত।নিবারণ নাই,মোয়াও নাই- একথা কখনও কারও চিন্তায় নাই।ছিলও না।

নিবারণের মোয়া জনপদটির নিরস জীবনে টিকে থাকা একমাত্র কালজয়ী বৈচিত্র্য।

তাঁর বর্তমান বয়স কত - সে এক লোকশ্লোক- এর উত্তর বুড়া-জোয়ান-বালক কারও কাছেই নাই।সকলেই নাকি তাদের নিজ নিজ জন্মের পর থেকে নিবারণকে,বিশেষত পুরো শীতকালটি মাথায় মোয়ার টুকরি,খালি পা,নেংটি ধুতিতেই দেখে আসছে।

শীতকাল আছে,খেজুরগাছে রস আছে,শিমুলফুল ফুটি ফুটি করছে অথচ নিবারণ তাঁর মোয়া নিয়ে কাউয়াকুলি ডেকে ওঠার আগেই ওয়াপদা রাস্তা দিয়ে,প্রায়ান্ধকারে কুয়াশা পরত ভেঙ্গে,খালি পায়ে হেঁটে আসছেন না-দালালদীঘির পাড় ও তার আশপাশের কোনও গাঁয়ের বৃক্ষ-পাখি-জীর্ণ স্থাপনাও কখনও কল্পনা করে নাই।

 

রাতভর হুজুরবাড়িতে ওয়াজ চলছে।সকালবেলা ‍মুনাজাত।বড় বড় পিতলের ডেকচিতে খিচুড়ি,মানুষের মানতের গরু-ছাগলের মাংস রান্না হচ্ছে- এইসব ভুরভুর গন্ধ কালা তার সঙ্গীদের নিয়ে দেখে আসে প্রতিবছর।কাল বিকালেও দেখে এসেছে।গতবছর বা তার আগের,সকালের মুনাজাতের পর,মোচলমান বন্ধুদের সঙ্গে লুকিয়ে সেও কয়েক টুকরা গরুর মাংস খিচুড়িসহ খেয়েছিলো।খেতে দারুণ,তবে ঠাকুর্দ্দা বা দালালবাড়ির অন্যদের সে কথা বলে দেয়ার মতো বোকা সে ছিলো না।

হুজুরবাড়ির পরলোকগত পীর ছাহেবের ওয়ারিশ দুইপুত্র।আহাম্মদী হুজুর।মোহম্মদী হুজুর।ধর্মীয় তরিকা নিয়ে এই দুই উত্তরসুরির মধ্যে বিরোধ মাঝেমধ্যে দা-ছেনি-খন্তা-কুড়াল নিয়ে মারামারির পর্যায়ে যায় আজকাল।মিলাদ পড়ানোর কোন রীতিটি সঠিক,ছহী- এ নিয়ে দুই পীরপুত্র আহাম্মদী-মোহম্মদী ও তাঁদের অনুগামীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব।ফলে দুই নব্য-পীরের ওরস এখন বছরের দুই ভিন্ন সময়ে হয়ে থাকে।এক পক্ষ আরেক পক্ষের ওরস বর্জন করে।নিজ নিজ সম্পদ রক্ষায় লাঠিয়াল-মাস্তান দুধে ভাতে লালন করে।গুঞ্জন উঠেছে,এদেরই কোনও এক পক্ষের লোক,শুক্কুর গাজী রক্তজবা চক্ষু বের করে নিবারণকে পথরোধ করে শাসিয়েছে,তাড়াতাড়ি ওপারে চইলা যান ঠাউর!

ইঙ্গিতটা পাশের দেশ ভারত।

দালালদের দীঘিটি দখলের স্বপ্ন শুধু পীরপুত্রগণের নয়,আরো অনেকেরই সুদৃষ্টি আছে।এতোবড়ো জলাধার এতদঞ্চলে আজকের দিনে অকল্পনীয়।প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায়,আসে অনেকেই,দীঘিপাড়ে দাঁড়িয়ে কী এক গম্ভীর ষড়যন্ত্র অনুভবে তারা জঙ্গলে প্রস্রাব করে ঢিলাকুলুপ নিতে বিলম্ব করে।লিঙ্গের অগ্রভাগে মাটির ঢেলা লাগিয়ে,পবিত্রতার মানসে দীর্ঘ্ক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তারা দীঘির জল মাপার চেষ্টা করে যেন।কূল পায় না।

নিবারণ শুক্কুর গাজীকে কিছু বলেন নাই।তাঁর মাথায় মোয়ার টুকরিটি ভিরমি খাওয়ার মতো একবার নড়ে উঠে যথাস্থানে স্থির হয়েছিলো।

পূর্বকালে নাকি এমন ছিলো না,শুনেছে কালা।তার ঠাকুর্দ্দা নিবারণ বুড়াই বলেছেন।এঁদের পিতা,আসল বড়ো পীর ছাহেবের মুখে নাকি দেবতাদের মতোই বিরাট রহস্যময় জ্যোতি ছিলো- একথা কিংবদন্তী।হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে লোকেরা পীর সাহেবের ভক্ত ছিলেন,তিনি সম্মানিত বুজর্গ ছিলেন।বয়স্ক হিন্দুরা,চলতি পথে,হুজুরবাড়ির শ্রদ্ধাযোগ্য মসজিদকে দেখে কপালে হাত ঠেকায়- এ দৃশ্য আজও  বিরল নয়।সে বড়ো পীরেরই স্মরণে-মহাদেবপুর গাছতলার বড়ো পীরসাব।

তাহলে মাইকে যে বললো,গেরামের নাম মহাদেবপুর গাছতলা আর রাখা যাইবো না,বেশরীয়তি হিন্দু নাম বাংলাদেশে চলবো না- রসুইঘরে মোয়া বানাতে বানাতে একথা চিন্তা করে কালা।আগুনের আঁচে সে তার ঠাকুর্দ্দা নিবারণ বুড়ার কাছে কোনওরূপ উত্তর আশা করে নাই।তবে ভাবে,তার বিদ্যালয়ের মনির স্যারের কথাটি,ক্লাশে পড়াতে পড়াতে তিনি প্রায়ই আচনক সব কথাবার্তা বলেন-

বুঝছো পোলাপান,হুজুরবাড়ির পীরেরা আর পীর নাই- তারা এখন হালুম-হুলুম মাদ্রাসা,মারামারি আর দালালবাড়িটি দখল নিয়া ব্যস্ত।তারা গ্রামের নামও বদলে দিতে চায়- এভাবে একটা দেশ চলে না।এই জন্য এতো রক্ত দিয়া দেশ স্বাধীন করি নাই বুঝলা?শেখ মুজিবরে মাইরা নতুন জিন্নাটুপীতে ভইরা যাইতেছে দেশটা।আহ হা! রে সোনার বাংলা রে..!

ছাত্ররা হা করে তাঁর ভারী নিঃশ্বাসটি অনুভব করে।কিছুক্ষণ দম নেয়ার পর মনির স্যার কালার চোখে চোখ রেখে বলেছিলেন,এ্যাই তুমি বলো আত্মপরিচয় কি জিনিস! গভীর চিন্তাণ্বিত,হঠাৎ প্রশ্নে,ক্লাশে অনিয়মিত ভ্যাবাচেকা-খাওয়া কালা আত্মপরিচয় মানে কি- বুঝে নাই।

পান-চুন-খয়ের খাওয়া মনির স্যারের দাঁতগুলো যেন পোড়া ঝিঙার দানা,তবু স্যারের মুখে মন-ভালো-করা একটা উদাস হাসিটি লেগে থাকে কিন্তু কালা তাঁর রহস্যময় কথাবার্তা শুনে এসে,বালকসুলভতায়,রাত্রিকালের এই উনুনের আগুনের পাশে,বৃদ্ধ নিবারণকে পুনরায় প্রশ্ন করে,ও ঠাউর্দ্দা,গেরামের নাম কি বদলানো যায়!

এরপর আর কথা এগোয় না।ভোর হয়ে এসেছে।ফজরের নামাজের পরই মানুষ নিবারণের মোয়ার আকাঙ্খায় মাদ্রাসা মাঠের কোণে জবুথবু ঘুরতে থাকবে।মুখে ঠিকমতো কথা ফোটে নাই-পিচ্চিরাও তাদের বৃদ্ধ দাদাকে বলে,নিঁবা মোঁয়া কাঁমু!দাদা,দাদা,নিঁবা মোঁয়া কাঁমু!

বৈচিত্র্যহীন মহাদেবপুর গাছতলা গাঁয়ে নিবারণের নাম এমনি করেই বহমান- নিবা ও তাঁর বানানো মুড়ির মোয়া সমার্থক।সম্প্রতি উত্তেজনাকর একটা আলোচ্য বিষয় লোকসমাজে জোয়ার-ভাটার মতো-গাঁয়ের মহাদেবপুর নামটি এতোকাল পর হিন্দু হয়ে উঠেছে।এই আলোচ্যসূচিতে,তবির বাপের চা দোকানটিতে বিক্রি বাড়তি।

গ্রামটির ‍উত্তর পূর্ব কোণে এসে ডাকাতিয়া নদীটি দুইভাগ হয়ে দূরবর্তী দেবীরচর নামের একটি দ্বীপগ্রাম,চারপাশে ছড়ানো ছিটানো নানুপুর,বাগাদী,চান্দ্রাবাজার,ইচলি-প্রতিবেশী এইসব গ্রামে নিবারণের পদচারণা যুগ যুগ ধরে।সেই সব ছোট্ট গাঁয়ে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ শেষে,কখনও বা কালাও নিবারণের সঙ্গে মোয়া বিক্রি করতে যায়।

ওয়াজ-নসিহত হয় বাৎসরিক নিয়মে।বিদ্যাপীঠগুলো,ওরস-জলসায় বন্ধ থাকার সরকারি নিয়ম নাই বিধায়,যেহেতু কখনও বা মন চায়,কালা সকাল বেলাকার মোয়া বিক্রির ঝক্কি-ঝামেলা শেষ করে দীঘিতে স্নান সেরে বিদ্যালয়ে যায়।নিবারণকে স্মরণ করিয়ে দিতে ভুল করে না যে,গাইটি নদীর পাড়েই সরিষা ক্ষেতের কাছে বাঁধা আছে,ঘাস খাচ্ছে-ঠাকুর্দ্দা যেন একবার গিয়ে নিয়ে আসে।

কালা সম্প্রতি পাশেরই,গাজীবাড়ির বুলুর মার কাছ থেকে গাইটি বর্গা নিয়েছিলো।এখন গাভীন।বিলাতি মানুষের মতো ফকফকা শাদা শরীরের রঙ,হাড় কিপ্টা বুলুর মার অনেক গরু-ছাগল।জমিজমাও আছে।বুলুর মা কিছু জমি দালালদের কাছ থেকেই কিনেছে।মরণচাঁদেরা চলে যাবার সময় টিনের ঘরটিও কম দামেই কিনে রেখেছিলো বুলুর মা।

মাতৃজ্ঞানে নিবারণ বুড়ো কালার গাইটিকে নিরবে ভালোবেসে যান।ভাতের ফেন,খড়-নাড়া-সরিষার খৈল খেতে দেন।মোয়া বিক্রির অবসরে চোনা লাগা দড়িটি ধরে ক্ষেতের আইলে নিয়ে পেট ভরিয়ে ঘাস খাওয়ান।পেটটি ঘাসে ভরে এলে,খুশিতে কেমন একটা সোন্দর তেলতেলে ভাব চলে আসে গাইটির শরীরে।তাছাড়া সে গাভীন।

বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথেই কালা পুনরায় মাইকিং শোনে।বিচিত্র নয় যে,মহাদেবপুর গাছতলার দালাল দীঘি,কালার গাই,বট-অশ্বত্থ,তালগাছে নিজেদের শিল্পকলায় ঝুলে থাকা বাবুই পাখি- সকলেই মাইকের ঘোষণা শুনেছিলো।মাইক কর্ণবিদারী উৎকট উত্তেজনাকর।

ভা-ই সব,ভা-ই সব,আসসালামুআলায়কুম..এতদ্বারা সকলের অবগতির জন্য জানানো যাইতেছে যে,গ্রামবাসীর সম্মতিক্রমে আমাদের গ্রামের বর্তমান নাম মহাদেবপুর গাছতলা হিন্দু নাম বিধায় উহা  পরিবর্তন করিয়া শরীয়ত মোতাবেক ইসলামপুর গাছতলা রাখিবার উদ্দেশ্যে,হুজুর বাড়ির মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হইবে।উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করিবেন গদিনশীন পীরে কামেল মহাশয়।আপনারা সকলে আমন্ত্রিত।ভা-ই সব

কালার মনে যে প্রশ্ন ছিলো,ক্লাশে সাহস করে সে আজ  মনির স্যারকে জিজ্ঞেসও করে বসে।স্যার, গ্রামের নাম কি হিন্দু মোচলমান হয়!

হয়না।তবে বাংলাদেশে এখন থেকে হইবে! টেনে টেনে ঝিঙাচিচি দাঁতগুলো ক্লাশটাকে দেখিয়ে বললেন মনির স্যার।তবে শ্রেণীকক্ষে উপস্থিতি কম।ছাত্ররা ওয়াজ শুনতে গেছে।অন্যরা কালার দিকে গোল গোল চোখে তাকায়।কালার প্রশ্নটি তাদেরকে তেমন তাড়া করে না।তারা পরস্পর চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে হাসে।

ক্লাশে অনিয়মিত,নিবারণের নাতি নিবারণের মতোই বোবা- তবু কালার হঠাৎ প্রশ্নে খুশি হন মনির স্যার।তিরিশ বছর তিনি শিক্ষকতা করছেন।প্রশ্ন করে- এই রকম ছাত্র হাতে গোণা।

বুঝলি তোরা,আত্মপরিচয়হীন মানুষ চিনস?- যারা জানে না কী তার জন্ম ইতিহাস কী তার সংস্কৃতি,কী তার ঐতিহ্য ও আত্মত্যাগ- তারা অহংকার করার মতো কোনও বস্তু খুঁজে পায় না।জোয়ারে ভাসা কচুরি পানা তারা।তাদের সংখ্যাই বেশী.তারা গোখাদ্য।বুঝলা?অহংকার অবশ্যই থাকবে।সেটাই তো বেঁচে থাকবার একটা অবলম্বন।নিজের নাম কে কে না ভালোবাসো তোমরা!আহা রে শিকড় রে আমার বাংলার!

তাঁর এইসব দার্শনিক কথাবার্তা নিয়ে শিক্ষকমহলে গুঞ্জন আছে।কী দরকার বাপু এতো পণ্ডিতি কথাবার্তার?সিলেবাস পড়াও পরীক্ষা নাও।খাতায় নম্বর দাও,পাস ফেল করাও।এতো বেশি কথার কি দরকার।আত্মপরিচয় আত্ম-অহংকার- এইরকম টিপ্পনী কাটা হয়।

 

আত্মপরিচয় আত্মঅহংকার- শব্দ দুটি মাথায় নিয়ে নদীপাড়ে ঘাস খেতে রেখে আসা গাইটির চিন্তায় বিকেলে ক্ষুধার্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছিলো কালা।সে ভেবেছে,সন্ধ্যাকালে হুজুরবাড়ির সভা দেখতে যাবে।

বিকেল থেকে নিবারণ বুড়োর খুব জ্বর এলো।জ্বরের ঘোরে গোঙাচ্ছেন।গলায় ভারী কফ ।বিড়বিড়টাও বেড়েছে।তিনি কখন এসে অন্ধকারে শুয়ে আছেন,মোয়া বিক্রিতে যান নাই।কালাকে পাঠিয়েছেন একা।সে এখন একা একা মোয়া বিক্রিটা পারে।

মনির স্যার তাঁর কয়েকজন সহগামী নিয়ে সভা শুনছিলেন।মোয়া বিক্রি শেষে,কালাও ভিড়ের ভেতর উঁকি মেরেছিলো।

উপস্থিত পিয়ারে হাজেরিন!আপনেরা জানেন,আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি লে.জে.হো.মো.এরশাদ সাহেব আমাদের পবিত্র ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে অত্যন্ত ছোওয়াবের একটা কাম করেছেন,ছোবহাল্লাহ!।তাঁর জন্য দোয়া খায়রা হবে।আপনারা থাকবেন।এই গ্রামে এত বড়ো পীরের জন্ম,এতোবেড়ো ওরস- বাংলাদেশে আর কয়টা হয়!প্রত্যেক বছর আপনেরা আমাকে দাওয়াত করেন,সম্মান করেন,আপনাদের মান-সম্মানের কথা আমারও ভাবতে হয়।

এই বলে তিনি কিছুক্ষণ থামেন,যেনবা,সকলের মুখের ভাষাটি আবছা অন্ধকারেই বুঝার চেষ্টা করেন।মাইক্রোফোনটি হঠাৎ থামার কারণে,একটা সুদীর্ঘ টোঁ-ও-ও-ও শব্দ করে স্রোতাদের কান বিমূঢ় করে দেয়।

তারপর ধাতস্ত হয়ে পুনরায় চিৎকার করে ওঠে মাইকঃ এতো বড়ো ইসলামী মাদ্রাসা-এতিমখানা.জশনে-জুলুশ- যেখানে ইসলামের এতো ব্যাপক-বিশাল আয়োজন,সেই গ্রামের নাম এখনও  মহাদেবপুর গাছতলা? নাউজুবিল্লাহ!কী মিঞারা,ভেবেছেন একবারও!ঈমানের জোর নাই আপনেগো? বাংলাদেশে গ্রামের নাম মহাদেবপুর,মহামায়া,দেওভোগ,দেবীরচর ইত্যাদি ইত্যাদি এখনও থাকবো?

পারলৌকিক ছোওয়াবের আকাঙ্খাপ্রার্থীরা সমস্বরে না না না করে ওঠে।এতে শীতের রাতের কনকনে হিম বাতাসটা সহসা যেন ওম্ -এ আরামদায়ক বোধ করেন মঞ্চোপবিষ্ট বক্তাটি।তার বয়স কম,শরীরে তাকদ আছে,মাথার পাগড়ীটি ঝিলিক মারে হ্যাজাকের জাদুমোহন আলোয়,কথার ঝলকে।

স্রোতা-দর্শকরা চুপ।এরা নিতান্ত আবেগী চাষার দল।কীর্তন শুনে,ওয়াজ শুনে কেঁদে বুক ভাসানোর দল।কদিন আগেই জয়বাংলা বলে যে গর্জে উঠে,খেয়ে না খেয়ে ঘড়া ঘড়া রক্ত ঢেলে দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলো- সেসব আত্ম-ইতিকথা বেমালুম ভুলে গিয়ে হিম শুষ্ক এখন তারা।মরা গাছের ডাল।

একদা মুজিব বাইয়া যাও রে অকুল দরিয়ার মাঝে আমার ভাঙা নাও…’ বলে কেঁদেছিলো।আবেগ কালবৈশাখী ঝড়ের মতোই- আচম্বিতে সব কিছু তছনছ করার পর- এখন স্তব্ধ।

স্কুল মাষ্টার মনির হোসেন যুদ্ধের সময়কার সংগঠক,দার্শনিক- দুকথা প্রতিবাদ করতে ইচ্ছা,রক্ত টগবগ করে তাঁর।দেশটা তো সোনাপুরের হাট না যে যার যখন যা ইচ্ছা করবে,তা-ই করে বেড়াবে!কিন্তু সহযোদ্ধারা কেউ এগিয়ে আসে না।তারা ভুলে গেছে,এই তো মাত্র সেদিন,কান খাড়া করলে এখনও পাকিস্তানিদের গুলি ও মানুষের আর্তনাদ শোনা যায়- কুখ্যাত রাজাকার আয়াতুল্লাহকে তারাই চাঁদপুরে,পালপাড়ার বটবৃক্ষে ঝুলিয়ে বলাকা ব্লেড দিয়ে শরীর কেটে কুচি কুচি করে লবন ছিটিয়ে জন্মভূমির প্রতি দায়িত্ব পালনে পিছ পা হয় নাই।

বেঈমানের ঠাঁই স্বয়ং জননীবক্ষেও হয় না।একদিন নিবারণের বঙ্গবালা জেগে উঠে এখন শীতনিদ্রায় কাহিল।

মনির মাষ্টারের ইচ্ছা করতেছে,মাইক কেড়ে নিয়ে এই হুজুরটাকে একটা ছেঁচা দেয়।মাইকের সিঙায় তার কল্লাটা ঢুকিয়ে দিয়ে গাঁয়ের নাম বদলের বদলা নেয়।মনির হোসেন অসহায়ত্বে কেঁপে ওঠেন একবার।যুদ্ধকালের সঙ্ঘ ভেঙ্গে কবেই গেছে।জনতা এখন বিভক্ত,বিচ্ছিন্ন,বিবদমান।

মনির হোসেনের মনোভব বুঝেছিলো মান্নান মাষ্টারও।তাঁর সহকর্মী।বললেন,ভাই,এখন তো আমরা সংগঠিত না।প্রতিবাদ করবেন ক্যামনে!মাওলানাদের বিরাট লাইঠ্যাল বাহিনী।প্রশাসনও তাদের হাতে।স্বয়ং রাষ্ট্রপতিই ইসলাম নিয়া রাজনীতি করছেন।মানুষের ধর্মীয় আবেগ পুঁজি করে দেশ চালাচ্ছেন।আপনি থামেন।সময় হোক। তাঁদের টুকটাক কথাবার্তা কেউ কেউ শুনে থাকবে।

মহাদেবপুর গাছতলা গাঁয়ের আকাশে কাল বৈশাখীর মেঘ সহসা জমে নাই।

দুই মাষ্টারের একজনের বাড়িও মহাদেবপুর গাছতলায় না।মনির স্যারের বাড়ি হাজিগঞ্জের মহামায়া,মান্নান স্যারের বাড়ি পাশেই- ইচলি।তবু তাঁরা সেনা শাসনে বোবা- ফাঁসির রজ্জুতে চুপ।সরব হওয়ার আত্ম-বেদনায় বন্দী।একটি গাঁয়ের নাম মুছে ফেলার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে রাষ্ট্র।

জমিন বার কয়েক টুকরো টুকরো করার সাফল্যের পর,গাঁয়ের মহান নামও এখন বিপণ্ন প্রজাতি।

আল্লাহর নূরানী নামের আকাল পড়েছে,মিঞারা!ধমকে ওঠেন বক্তা।প্রত্যেক বছর আপনেরা আমারে ডাকেন,ওয়াজ-নসিহত করি।তবে মনে বড়ো কষ্ট আফসোস!এই গ্রামের নামে হিন্দুয়ানী-ক্বাফেরী-পৌত্তলিকতার গন্ধ  আপনাদের পাপ হইতেছে।আমি প্রস্তাব করছি এই সোন্দর গ্রামের নাম মহাদেবপুর গাছতলা পাল্টে ইসলামপুর গাছতলা রাখা হোউক!বলেন,আলহামদুলিল্লাহ!

টুপী ও শীতের চাদরে মোড়া সমাগত নিরীহ স্রোতা ও গ্রাম্য বুজর্গবৃন্দ সংক্রমণের আবেগে কেঁপে উঠে একবার আলহামদুলিল্লাহ বলে তারপর অন্তরে স্থবির এবং প্রশ্নহীন নিরীহ আমজনতা ছোওয়াব-গুনাহ্ সম্পর্কে নির্বিকার।কারণ,নিবারণের সান্ধ্যকালীন অমৃত মোয়ার স্বাদ এখনও তাদের মুখ থেকে মুছে যায় নাই- তারা কিছুটা বিস্মিত-এ কারণে যে,মহাদেবপুর গাছতলা নাম তাদের অন্তরে এতোকাল কোনও পাপের অনুভূতি জাগায় নাই।

নিবারণও,পূর্বে প্রশস্তস্কন্ধ হুজুরটির ওয়াজ শুনেছে।ছোটো দাঁড়িপাল্লায় মোয়া মেপে দিতে সে কোনওদিন মোছলমানদের ঘিন্না করে নাই।মোছলমানরাও তাঁর মাপে কস্মিনকালেও ফাঁকি দেখে নাই।

কালা লক্ষ্য করেছে আজকাল,সহসা তার ঠাকুর্দ্দার দড়ি,টুকরো পাথুরে কণায় তালি দেয়া দাঁড়িপাল্লাটি কেঁপে কেঁপে উঠছে।নিবারণ যেন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছেন না।

মাইক হাতে বকবক করা হুজুরটিকে একটা ঢিল ছুঁড়ে মারার ইচ্ছে মনের ভেতর চেপে রেখে কালা বাড়ি ফেরে।ঠাকুর্দ্দার শইলডা ভালা না।

রাতে সম্ভবত,নিবারণ ঠাকুরের জ্বর উঠেছে একথা ভাবে কালা।আজকাল বুড়ার শরীর আর চলতে চায় না।এখন হোগলাপাতার বিছানাটিতে তিনি কুণ্ডলী পাকিয়ে দিনের রোদ সঞ্চয় করা ভারী কাঁথায় মুড়ি দিয়ে আছেন।কালা বার কয়েক ডেকেছে,ও ঠাউর্দ্দা,ভাত খাইবেন না?

বুড়া যে দম বন্ধ করে আছেন-একথা কালার জানা আছে।সে কুপিটি জ্বালিয়ে টিনের থালে ভাত বাড়ে।কানসা-উঁচা থালা দুটি ভাত বুকে নিয়ে অপেক্ষায় নিরব।নিবারণ বুড়া নড়াচড়া করেন না।

হুনছেন ঠাউর্দ্দা,মিটিং শ্যাষ।গেরামের নতুন নাম হইছে।ইসলামপুর গাছতলা।ঘটনা কি সত্যই অইবো ঠাউর্দ্দা?

স্বভাবসুলভ হু হা জাতীয় কোনো সাড়া না পেয়ে কালার শরীরের রোমকূপ খাড়া হয়ে ওঠে।তবু ভয় কমাতে যথাসাধ্য শব্দ করেই বলে,ও ঠাউর্দ্দা,ভাত বাড়ছি ত।ওডেন।

সহসা কালার ব্যাকুল অশ্রুপাত ও বিলাপের শব্দে সমাগত লোকেরা,ওয়াজ মাহফিল থেকে বেরিয়ে এসে নিবারণের মোয়ার জন্য শোকার্ত।তারা মূলত,একটু আগেই পীর বাড়ির ওয়াজ শুনে বাড়ি ফিরছিলো।পথেই,কেউ কেউ মাদ্রাসা মাঠে খবরটা পেয়েছিলো,নিবারণ মারা গেছে।

টিমটিমে কুপির আলোয় নিবারণের মৃতদেহটি দেখে,দালালদের দীঘির পাড় দিয়ে ফিরে যেতে যেতে তাহারা দুঃখু ভাগাভাগি করতে ভুল করে নাই।চিতায় ওঠার পূর্বে নিবারণ গাঁয়ের নাম পরিবর্তনটা দেখে যেতে পারলো না এই হতাশা কারো করো মনে জাগরুক।

0 comments: