সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

 আর ভুল নয় 

মানসী গাঙ্গুলী 


      শান্ত, নম্র, সুশীলা মেয়েটি পড়াশোনা শেষে যখন চাকরি করতে রাজ্যের বাইরে পা রাখল, বাড়ির সকলে খুব চিন্তায় পড়ে গেল। এমন নরম-সরম মেয়ে একাকী কি করে বাইরে থাকবে? কোম্পানি একমাস থাকার ব্যবস্থা করবে, তার মধ্যে নিজের ঠিকানা খুঁজে নিতে হবে। মেয়েটির নাম সুনন্দা। নরমসরম হলেও দৃঢ়চেতা এই মেয়েটি কিন্তু বিশেষ চিন্তিত নয়। তার আত্মবিশ্বাস আছে, পিছিয়ে আসার মেয়ে সে নয়। এত ভালো স্টার্ট কলকাতায় ও পেত না। আর দাঁড়াতে গেলে ঘরের খেয়ে অফিস যাব বললে তো চলবে না, পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে যেতে সে রাজি। সে তো রাজি, মায়ের শুরু হল হাজার চিন্তা। চিন্তা না বলে দুশ্চিন্তা বলাই ভালো।

        যাই হোক, নির্দিষ্ট দিনে মেয়ে চলল তার গন্তব্যে। প্রথমবার বলে বাবা গেলেন সঙ্গে। বাবা তো দেখেই তাজ্জব, কী এলাহি ব্যবস্থা কোম্পানির তাদের কর্মীদের জন্য। ১৪টি ছেলেমেয়ের একই দিনে জয়েনিং ছিল। একমাস ট্রেনিং পিরিয়ড, ততদিন কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় থাকবে ওরা, তারপর যার যার নিজের দায়িত্ব। বাবা সব দেখে শুনে খুশি মনে ফিরে এলেন। বাড়ি ফিরে স্ত্রীর কাছে সেসব গল্প করলে তিনিও খানিক নিশ্চিন্ত হলেন। আর মুম্বাই মেয়েদের জন্য অন্যান্য জায়গার তুলনায় অনেক নিরাপদও বটে। কিছু পরিচিত, বন্ধুও আছে মুম্বাইতে। কাজেই প্রয়োজনে তাদের সাহায্য পাবে। কিন্তু একমাত্র মেয়ে, বাড়ির বাইরে প্রথম পা রাখল, মায়ের মনে শান্তি নেই। সুনন্দা অবশ্য প্রতি রাতেই ফোন করে সারাদিনের সব খবরাখবর জানায় মাকে। কিন্তু এর মধ্যে থাকবার একটা ব্যবস্থা তো করে নিতে হবে। বিদেশ-বিভুঁইয়ে মেয়ে কি করে কি করবে মা ভেবেই কূলকিনারা পান না। একসপ্তাহ পার হয়ে গেল, কয়েকটা লেডিস হোস্টেলের খোঁজ পেয়ে ওরা তিনজন মেয়ে গিয়েছিল দেখতে। প্রথমতঃ কোথাও জায়গা নেই, সব সাত-আট মাস, একবছর আগে থেকে বুক করে রাখতে হয়। আর দ্বিতীয়তঃ,  মেয়ের কথায়, "মা জায়গা পেলেও ওইসব জায়গায় থাকতে পারব না। কতরকমের মহিলা কত বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন পেশার, পরিবেশটা আমার একদম ভালো লাগল না।" মায়ের চিন্তার শেষ নেই। একসপ্তাহ পার হয়ে গেল, এর মধ্যে ঠিক না হলে কোথায় থাকবে মেয়েটা? যদিও মেয়েকে বলেন না এসব কিছু। নিজের টেনশন মেয়ের ওপর চাপাতে চান না তিনি। মনে মনে নিজেই ধ্বংস হন আর কিছুটা স্বামীর সঙ্গে শেয়ার করেন। এর দিন তিনেক পর সুনন্দা মাকে বলে, "জানো মা, আমার সঙ্গেই জয়েন করেছে একটা পাঞ্জাবী মেয়ে, ওর নাম বাণী, ও বলছিল, 'আমরা দুজনে মিলে একটা ঘর নিই শেয়ারে'। এখানে মুম্বাইতে ঘরভাড়া খুব বেশি, তো, একজনের পক্ষে নেওয়া চাপ হয়ে যাবে, তাই।" মা বলেন, "সে তো ভালো কথা, কিন্তু তোমরা দুটো মেয়ে থাকবে, ভালো জায়গা, ভালো বাড়ি দেখে নিতে হবে তো। নিরাপত্তার ব্যাপারটাও তো ভাবা দরকার। আমি বরং তোমার বাবাকে যেতে বলি, জায়গাটা দেখেশুনে আসুক।" "মা তুমি খেপেছো নাকি? আমরা একটা করে ঘর দেখব আর বাবা ছুটে ছুটে আসবে? তুমি চিন্তা কোরো না, ও আমি ঠিক সামলে নেবো। আমরা এখন অফিসের কাজের পর সবাই একসঙ্গে ঘুরতে যাই। মুম্বাইতে থাকতে হবে যখন, চিনতে হবে তো? এরপর আবার সবাই ছিটকে যাবে, অফিসে কাজের চাপও বাড়বে। এরমধ্যেই আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেবো।" ম্যানেজ তো করে নেবে, কিন্তু মায়ের যে শান্তি নেই।

        নাঃ, সত্যিই মেয়ে ম্যানেজ করে নিল। অফিসের কাছাকাছি ভালো পরিবেশে ভালো একটা ঘর পেল ওরা। ভাড়াটা যথেষ্টই বেশি। মুম্বাইতে ওরকমই, কিছু করার নেই। কিন্তু কিছুদিন পর থেকে মেয়ে মায়ের কাছে প্যানপ্যান করতে লাগল, "মা বাণী খুব নোংরা, এখানে একটা ডাবল-বেড খাটে একসঙ্গে শুতে হয়, একই বাথরুম শেয়ার করতে হয়, আমার খুব ঘেন্না করে"। মা এর কি সান্ত্বনা দেবে! কাজেই চুপ করেই শোনে। মুম্বাইতে ওর থাকতে একদম ভাল লাগছে না। কোনও বন্ধু নেই। ছুটির দিনগুলো খুব খারাপ কাটে। বসের কাছে সে কথা জানায়, কলকাতায় পাঠিয়ে দিতে বলে তাকে। বস অবাক হয়ে যান সুনন্দার কথা শুনে। বলেন, "চাকরিতে ঢুকেই হেড অফিসে জয়েন করেছ, আর তুমি কলকাতায় চলে যেতে চাইছ? এখানে কত সুযোগ। পরিশ্রম করবে, কাজ দেবে, উঁচুতে উঠবে। কলকাতায় তো স্কোপ লিমিটেড।" "ঠিকই তো", সুনন্দা ভাবে, "কিন্তু এই স্বজন-বন্ধু বর্জিত জায়গায় কি করে কাটাবো, বিশেষ করে ছুটির দিনগুলো?" এরমধ্যে হঠাৎ শনি-রবি মিলিয়ে মোট পাঁচদিনের ছুটির কথা জানতে পারে সুনন্দা। "কী করবে এই পাঁচদিন? অফিস থাকে, কেটে যায় একরকম কিন্তু ঘরে বসে কী করে কাটাবো?" আর ওই বাণীর সঙ্গে ওর মোটেই খাপ খাচ্ছে না, কেবল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, বন্ধুত্ব মোটেই দানা বাঁধছে না। বাবা জানতে পেরে বললেন, "বাড়ি চলে আয়"। সুনন্দা বলে, " টিকিটের অনেক দাম বাবা এখন, আমার দেখা হয়ে গেছে"। বাবা আর কিছু না বলে টিকিট কেটে মেইল করে দিলেন মেয়েকে। নিজে রোজগার করতে শিখে টাকার মূল্যটা বেশ বোঝে এখন। বাবাকে বলে, "মাত্র পাঁচদিনের জন্য এতগুলো টাকা কেন খরচ করলে বাবা?" কিন্তু মনে বেশ আনন্দ বাড়ি আসছে বলে। বাড়ি এলে বাবা বলেন, "একটু টাকা বেশি খরচ হলো হয়তো, কিন্তু তোর আনন্দটা কিনলাম, সেটা আরও অনেক দামী, টাকার থেকেও দামী"। সুনন্দা বাবাকে জড়িয়ে ধরল। ক'দিন তার পছন্দের রান্না করে খাইয়েও মায়ের শান্তি নেই, ফেরার দিনে সঙ্গে নানারকম যতটা পারেন করে ব্যাগে গুছিয়ে দিলেন। যাওয়ার সময় মেয়ের চোখ ছলছল।

       এভাবে দুটো বছর কাটল, চাকরিতে ইনক্রিমেন্ট হল সুনন্দার। বাণীকে অন্য অফিসে পাঠিয়ে দেওয়ায় সে অন্যত্র চলে গেল। সুনন্দাও বাড়ি চেঞ্জ করল। এখন ও অনেক খোঁজখবর রাখে। নিজের পছন্দমত একটা এককামরার ফ্ল্যাট জোগাড় করে ফেলল। আগে ওরা অফিসে লাঞ্চ আর রাতে বাইরে থেকে খাবার এনে খেত, এবার ও নিজের মত একজন রান্নার লোক ও একজন কাজের লোক রাখল। একা থাকার ব্যবস্থা করে মাকে বলল, "দেখে যাও, তোমার মেয়ে কোথায় রয়েছে"। বাবার ছুটি দেখে মা-বাবা দুজনে গেল মেয়ের কাছে।  সাততলার ওপর ফ্ল্যাট, নতুন ঝকঝকে, লিফট রয়েছে, ঘরে প্রয়োজনীয় সবরকম ফার্নিচার রয়েছে। এছাড়া এসি, টিভি, ফ্রিজ, একোয়া গার্ড সব রয়েছে। দেখেশুনে মায়ের শান্তি হল। মেয়ে অনেক জায়গায় ঘোরাতে নিয়ে গেল, দামী রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে খাওয়ালো।

           ফিরে এসে মা উঠে পড়ে লাগলেন মেয়ের বিয়ের জন্য। ম্যাট্রিমনি সাইটে মেয়ের প্রোফাইল দিয়ে পাত্রের খোঁজ করে চলেন তিনি অবসর পেলেই। মেয়ে নানান অছিলায় সেসব সম্বন্ধ নাকচ করে দিতে লাগল। মা ভালো ভালো সম্বন্ধ দেখেছেন অথচ মেয়ে কোনো না কোনো কিছু বলে বাতিল করে দেওয়ায় মা চেপে ধরলেন, "কী ব্যাপার বলতো? আমি এতো ভালো ভালো সম্বন্ধ খুঁজে বার করছি, সারাদিন ল্যাপটপ নিয়ে পড়ে আছি, আর তুই সব বাতিল করে দিচ্ছিস?" মেয়ে বলে, "মা প্লিজ, আমায় একটু সময় দাও, আমার কেরিয়ারটা একটু গুছিয়ে নিতে দাও প্লিজ"। মায়ের তবু শান্তি নেই, খবরের কাগজে অ্যাড দেওয়া, ম্যাট্রিমনিতে প্রোফাইল দেখা চলতেই লাগল নিজের মত। মেয়েকে আর ডিস্টার্ব করেন না। দু'টোবছর কেটে গেলে মা আবার কথা তোলেন। সুনন্দা মাকে জানাল, "আমার জন্য কষ্ট করে তোমায় ছেলে দেখতে হবে না, আমি দেখে রেখেছি"। মা এই উত্তরে একটু থতমত খেয়ে বলেন, "সে কী? কে সে? তা আমায় আগে জানাসনি কেন এতদিন? আমি যে ল্যাপটপে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখের পাওয়ার বাড়িয়ে ফেললাম।" "আমি তো তোমায় বারণ করেছিলাম মা এখন দেখাদেখি করতে।" "হ্যাঁ বলেছিস তুই সে কথা কিন্তু একথা তো বলিসনি যে তুই ঠিক করে রেখেছিস। আমি তো মা, মেয়ের বয়স বাড়ছে, কী করে আমি চুপ করে বসে থাকি বল তো?" "বেশ যা দেখেছো, দেখেছো আর তোমায় দেখতে হবে না।"

           এরপর সুনন্দা মাকে যা জানালো, মা তো তাতে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। সে একটি অবাঙালি ছেলের প্রেমে পড়েছে। মা বলেন, "আমাদের সঙ্গে ওদের কালচারের কত তফাৎ, মিলেমিশে থাকবি কী করে?" সুনন্দার জবাব, "মা ছোট থেকে মিশনারি স্কুলে পড়েছি, অবাঙালি বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে মেলামেশা করেছি, এখনও করছি, এতে আমার কোনো প্রবলেম হবে না"। মা বোঝাবার চেষ্টা করেন, " ওরে, বাইরে মেলামেশা করা আর তাদের সঙ্গে এক পরিবারে বাস করার মধ্যে অনেক ফারাক"। কিন্তু সে মেয়ে বুঝলে তো?

        কী আর করা যাবে। মেয়ের পছন্দকেই মেনে নিতে হলো শেষমেশ। মেয়ের বাবা বলে সুনন্দার বাবা রমেশবাবুকেই প্রথম ফোন করতে হয় ছেলেটির বাড়ি। ছেলের নাম বিজয়। ওরা উত্তরপ্রদেশের লোক। ওরা চায় রমেশবাবু ওদের বাড়ি গিয়ে কথা বলুন বিয়ের ব্যাপারে। অগত্যা। রমেশবাবু ও মিতাদেবী চললেন উত্তরপ্রদেশের গোরখপুরে, বিজয়ের বাড়িতে বিয়ের  কথাবার্তায় এগিয়ে নিয়ে যেতে। সেই প্রথম থেকে, ফোনে কথা বলার পর থেকেই রমেশবাবুর একটুও ভালো লাগে না পরিবারটিকে। যেখানে একটা বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে চলেছে সেখানে নেই কোনো আন্তরিকতা। তবু মেয়ের কথা ভেবে যেতে হয় ওঁদের। অনলাইনে একটি হোটেল বুক করে চলেন ওরা পাত্রের বাড়ি কথাবার্তা বলতে। বাড়ি খোঁজার সময় টের পেলেন পরিবারটি বেশ ধনী। মোটামুটি একডাকেই  তল্লাটের সবাই চেনে। পৌঁছে দেখলেন বাড়িটি বেশ বড়, আর বাড়িতে সদস্য অনেক। একান্নবর্তী পরিবার। পরিবারের মাথায় রয়েছেন বাড়ির গিন্নী-মা, তাঁর কথাতেই চলে পরিবার, তাঁকে কেউ অমান্য করে না। তাঁর চার ছেলে, চার বৌমা ও তাদের ছেলেমেয়েরা অর্থাৎ গিন্নী-মার নাতি-নাতনীদের নিয়ে জমজমাট সংসার। বিজয় ওনার নাতি।

          এক এক করে সবার সঙ্গে আলাপ পরিচয় হল, কিন্তু রমেশবাবু ও মিতাদেবী পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। দুজনেরই একই চিন্তা, তাঁদের স্বাধীনচেতা মেয়ে এই পরিবারের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে তো? মনে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ। এরপর যখন দেনা-পাওনার কথা এলো তখন তো রীতিমতো মাথায় হাত। ধনবান লোক হলেও মেয়ের বাড়ি থেকে দহেজ তো দিতেই হবে। আর সেই পরিমাণটা এতটাই যে রমেশবাবুর তা শুনে চক্ষু চড়কগাছ। তার ওপর  বাড়ির বউয়ের চাকরি করা তাঁদের পরিবারের দস্তুর নয়। অতএব সুনন্দাকে চাকরি ছাড়তে হবে বিয়ের আগেই।  রমেশবাবু কিন্তু এবার কঠোর হলেন। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, "দেখুন আমি ছোট থেকে মেয়ের পড়াশোনার পিছনে অনেক খরচ করেছি। বরাবর ওকে বিভিন্ন নামী ইনস্টিটিউটে পড়িয়েছি, চাকরি আমি ওকে ছাড়তে দেবো না"। গিন্নী-মা বললেন, " বিজয় নিশ্চয়ই আপনার মেয়েকে একথা জানিয়ে দিয়েছে। মেয়ের সঙ্গে কথা বলবেন আপনারা। সে চাকরি ছাড়তে রাজি আছে বলেই জানিয়েছে বিজয় আমাদের।" রমোশবাবু, মিতাদেবী তো শুনে হাঁ। চুপচাপ চলে এলেন সেখান থেকে। হোটেলে ফিরেই মেয়েকে ফোন করে জানতে চাইলেন চাকরি ছাড়ার ব্যাপারটা। আর মেয়ের কথা শুনে তাজ্জব হয়ে গেলেন তাঁরা। সে বলল, "বিজয় আমায় সব বলেছে বাবা। আমিও ভেবে দেখলাম ওদের পারিবারিক অত বড় ব্যবসা, তাতেই সংসার চলে। বিজয় নিজে ভালো চাকরি করছে, একপয়সাও সংসারে দিতে হয় না, এরপর নাই বা আমি আর চাকরি করলাম। টাকার প্রয়োজন যখন নেই শুধু শুধু খেটে মরি কেন?" বাবা-মা মেয়ের এমন বক্তব্যে রীতিমতো হতবাক। ভাবতে পারেননি, মেয়ে চাকরি ছাড়ার ব্যাপারে এতো সহজে রাজি হয়ে যাবে। ব্যাপারটা তাদের ভাল লাগল না মোটেই। কিন্তু মেয়ে বড় হয়েছে তার ওপর তো জোর খাটানো যায় না। অতএব বাবা-মা চুপচাপ মেনে নিলেন সব। মেয়ের ওপর তাঁদের অনেক আশা-ভরসা ছিল। সেসব জলাঞ্জলি দিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা করতে শুরু করলেন তাঁরা।

             ইতিমধ্যে মেয়েও চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বাড়ি চলে এল। অফিসে সিনিয়ররাও হতবাক ওর এই সিদ্ধান্তে। তাঁরা তখনই চাকরি ছাড়তে নিষেধ করেছিলেন। পরে ভেবেচিন্তে দেখার কথা বলেছিলেন। কিন্তু মেয়ে তখন বিজয়কে পাবার আনন্দে মশগুল। মহানন্দে বাবা-মা, পিসি, মাসি সবার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বিয়ের বাজার করতে লাগল। শ্বশুরবাড়ির সবার জন্য সেরা জিনিস পছন্দ করে কিনতে লাগল। বিয়ে হল হইহই করে। দিল্লিতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে বিয়ে দিতে হল রমেশবাবুকে। প্রচুর খরচ হল আত্মীয়-স্বজনদের নিজের খরচে দিল্লি নিয়ে  যাওয়া ও তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থায়। তার ওপর বিয়ের খরচ। মান রাখতে হবে তো।

             বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে মেয়ে খুব আনন্দ রয়েছে সবার সঙ্গে। রোজ ফোন করে বাবা-মাকে নানান কথা জানায়। সে যে খুব খুশি বাবা-মা তা বোঝেন। তাঁরা শান্তি পান শুনে। এবার বিজয়ের ছুটি শেষ হলে মুম্বাইতে কর্মস্থলে যাওয়ার তোড়জোর করতেই সুনন্দা বলে, "আমাদের তো একটা ফ্লাট দেখতে হবে ওখানে। নাহলে আমি গিয়ে থাকব কোথায়?" বিজয় আকাশ থেকে পড়ে, "তুমি কোথায় যাবে? তুমি  তো এখানেই থাকবে।" "তার মানে?" সুনন্দার চোখে জল এসে যায় এই কথা তো তার জানা ছিল না! কেবল চাকরি ছাড়ার কথাই বলা হয়েছিল তাকে। তাহলে কেবল চাকরি ছাড়া নয়, সে বিজয়ের সঙ্গে মুম্বাইতে থাকতেও পারবে না? তাকে থাকতে হবে গোরখপুরে শ্বশুরবাড়িতে সবার সঙ্গে? বিজয় চলে গেলে সুনন্দা মায়ের কাছে ফোন করে খুব কান্নাকাটি করে। ওর চাকরি ছাড়ার সময়েই মা প্রমাদ গুনেছিলেন। কিন্তু তা আর মেয়েকে বলেন কী করে? তাকে সান্ত্বনা দেন, বলেন, "বিজয় তো আসবে ছুটি পেলে। আর বাড়িতে কতজন মানুষ, দেখবি সুন্দর সময় কেটে যাবে।" মেয়ে তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে মাকে বলে,"মা আমি বিজয়কে বিয়ে করেছি, ওর পরিবারকে নয়। চাকরি ছাড়তে বলেছে ছেড়েছি, তাই বলে বিজয়ের সঙ্গে না থেকে এই গোরখপুরে আমায় পচে মরতে হবে?" মা আর কী-ই বা বলবেন, মেয়ের অশান্তিতে কষ্টভোগ করা ছাড়া। বুঝতেই তো পেরেছিলেন মেয়ের ডিসিশন ঠিক নয়, তবু এখন সেসব বলে ওর মনোবেদনা বাড়াতে চান না তিনি।

           বিজয় ওদিকে অফিসে গিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বিয়ের সময় অনেকগুলো ছুটি নেওয়ায় এরপর তিনমাস আর ছুটি নিতে পারে না সে। ফোনে কথা বলার সময়ও কম। বিজয় যখন ফ্রী হয় তখন সুনন্দা একগলা ঘোমটা দিয়ে হয় রান্নাঘরে কিছু সাহায্য করে অথবা সবার খাবার ব্যবস্থা করে, নাহলে গিন্নী-মার পা টিপে দেয়। দু'জনের মধ্যে যোগাযোগই হয় না প্রায়। অভিমান দানা বাঁধে ওর মনের মাঝে। ভাবে, মা বলেছিল, "বাইরে মেলামেশা একরকম, আর বিয়ের পর বউ করে নিয়ে যাবার পর শুধু তো স্বামী নয়, তাদের পরিবারের মতই চলতে হবে।" এখন দেখে সুনন্দা মা-ই ঠিক। বিজয়ের কাছে ফোনে কোনো অভিযোগ করলে সেও বলে, "আমি কী করব? মানিয়ে নাও। নানির মুখের ওপর কথা বলার ক্ষমতা পরিবারে কারোর নেই। সুনন্দার মুখে আর হাসি নেই, শ্বশুরবাড়ি নিয়ে সে উচ্ছ্বাসও নেই। কলের পুতুলের মত ঘোরেফেরে, কাজকর্ম করে। সাতবছর চাকরি করার পর বিয়ের আনন্দে যে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল তার জন্য তার আপশোস হতে থাকে। বিজয়ের দিক থেকে কোনোরকম সহানুভূতিও মেলে না তার। ভেতরে ভেতরে তিক্ততা জমা হতে থাকে। প্রথম যখন তিনমাস পরে বিজয় বাড়ি এল, খুব কেঁদেছিল ও বিজয়ের বুকে মুখ গুঁজে। বিজয় ওকে অনেক আদর করেছিল, তাতে ও খানিক শান্ত হয়েছিল। কিন্তু ছোট থেকে একা মানুষ হয়ে ঐ ১৫-১৬জনের সংসারে সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলতে ওর বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। ওর জগৎটা ছিল একেবারেই আলাদা। চাকরিতে ধাপে ধাপে উন্নতি করছিল, উজ্জল ভবিষ্যত ওর। সে  চাকরি ছেড়ে কোনো আফশোস ওর ছিল না। বিয়ের পর বিজয় যখন ছিল বাড়িতে, সবার সঙ্গে খুব আনন্দে ছিল ও। কিন্তু বিজয়কে ছেড়ে থাকতে থাকতে অভিমান জড়ো হচ্ছিল ওর মনের মধ্যে। সারাদিন সংসার ওর ভাল লাগছিল না। ও বিজয়কে বলে, "আমি আবার চাকরি করব"। বিজয়ের যেন মাথায় বজ্রাঘাত হল। সুনন্দা কোনো কথা না শুনে চাকরির জন্য অ্যাপ্লাই করল। চাকরিতে ওর খুব সুনাম ছিল, তাই বেগ পেতে হল না। নিজের সেই পুরনো অফিসেই ওর আবার চাকরি হয়ে গেল। সেটা বিজয়কে এবং বাড়িতে জানালে অশান্তির ঝড় বইল। কিন্তু ও তখন এককাট্টা, চাকরি ও করবেই। সারাদিন এর জল, ওর ভাত ওসব ও পারবে না। এই নিয়ে বিজয়ের সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে ঠেকল। ওর বাবা-মা কিছুদিনের জন্য মেয়েকে আনতে চাইলে তারা বিজয়ের ছোট কাকা ধনঞ্জয়বাবুর সঙ্গে ওকে পাঠিয়ে দেয়। তিনি এসে ওকে পৌঁছে দিয়েই চলে যান এক কাপ চা-ও না খেয়ে।

          সুনন্দা এরপর আর শ্বশুরবাড়ি ফেরে না। সে ডিভোর্স চায়। বিজয়কেও বাড়ির কাছে কথা শুনতে হয় এমন মেয়ে বউ করে আনার জন্য। তাই সে-ও সহজেই ডিভোর্স দিয়ে দেয়। সুনন্দার শরীরটা যেন পাখির মতো হালকা লাগে। ও যেন ডানা মেলে উড়তে পারবে এবার। চাকরি জয়েন করে আবার আগের মতো মুম্বাইতে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করে। আাঃ কী শান্তি। জীবনে এমন ভুল আর সে করবে না, বাবা-মায়ের কথা না শুনে যে ভুল সে করেছিল।

0 comments: