সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
অমরেশবাবুর নাতি
অনন্যা অনুজা চট্টোপাধ্যায়
বছর ছয়েক হল অমরেশবাবু সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। অবসর নেওয়ার মাস দুই আগেই তাঁর স্ত্রীবিয়োগ হয়। তবু ছেলে-বউ-নাতিকে নিয়ে তাঁর অবসরজীবন একরকম ভালোই কেটে যাচ্ছিল।
অমরেশবাবুর এক ছেলে, দুই মেয়ে। দুই মেয়েরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে -- তারা যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। ছেলে সঞ্জয় ও তার বউ প্রমিতা চাকরি করে। সঞ্জয়, প্রমিতা দুজনেই তাই তাদের ছেলে রূপের দেখাশোনার জন্য কাজের লোক রাখতে চেয়েছিল -- শেষপর্যন্ত অমরেশবাবুর আপত্তিতে রাখতে পারেনি।
ছেলে-বৌমার প্রস্তাব এক কথাতেই নাকচ করে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, -- তোমাদের তো একটা মোটে ছেলে! আর আমাদের তিন ছেলেমেয়ে। তাদের সামলাতে আমরা কি হিমশিম খাইনি ভাবো? খেয়েছি, তবু কাজের লোক রাখিনি কখনো। কী জানো, মাইনে করা কাজের লোকের হাতে ছেলেমেয়ে যদি মানুষ হত, তাহলে আর আপনার জনের দরকার হত না!
প্রমিতা তবু শেষ চেষ্টা করতে বলেছিল, -- কথাটা আপনি ঠিকই বলেছেন বাবা। মা বেঁচে থাকলে আমরাও একথা কখনোই ভাবতাম না। কিন্তু একা হাতে আপনি এসব সামলে উঠতে কি আর পারবেন এখন? আপনার বয়স হয়েছে। তারপর . . . . . . .
প্রমিতার কথা শেষ হতে পায় না, তার আগেই অমরেশবাবু বলে ওঠেন, -- তারপর আমি পুরুষমানুষ! ছেলেমেয়ে মানুষ করার কী জানি? এই তো বলবে বৌমা?
প্রমিতা লজ্জা পেয়ে বলে, -- না বাবা, তা না . . . . . . .
-- জানো কি, তোমার শাশুড়ি যখন একবার সাংঘাতিক অসুখে পড়েন, বাঁচার আশা তার প্রায় ছিলই না, তখন অফিসে ছুটি নিয়ে রান্না করে তিন ছেলেমেয়েকে খাইয়ে ইস্কুলে পাঠিয়েছি। না জানো তো সঞ্জুর কাছে শুনো।
-- হ্যাঁ বাবা, আপনার ছেলে এখনও বলে সেকথা ।
-- তবে? আর এখন তো আমার অখণ্ড অবসর বৌমা! দাদুভাইকে নিয়ে সময় আমার ভালোই কেটে যাবে। এই নিয়ে তোমরা অযথা ভেবো না।
অমরেশবাবুর পরিবারে তাঁর মতামত সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মতোই চূড়ান্ত -- এই নিয়ে কোনো ডিভিশন বেঞ্চে আপিল করার কোনোরকম সুযোগই নেই! প্রমিতার তাই একতরফা হার স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া কিছু আর করার থাকে না।
এরপর দেখতে দেখতে নাতি রূপ হয়ে উঠল অমরেশবাবুর নিঃসঙ্গ জীবনের একমাত্র অবলম্বন। সাড়ে তিন বছরের রূপ যখন স্কুলে ভর্তি হল, অমরেশবাবু সকালে তাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে দুপুরে ছুটির পরে স্কুল থেকে নিয়ে আসেন।
অমরেশবাবুর বরাবর বাগান করার শখ। কিন্তু চাকরিজীবনে কর্মব্যস্ততার দরুন নিয়মিত করে উঠতে পারতেন না। ছুটির দিনে যেটুকু অলস্বল্প করতেন, তাতে তাঁর মন ভরত না।
অবসরজীবনে তাঁর সেই শখ তিনি ষোল আনার ওপর আঠারো আনা পূর্ণ করে নিতে বাড়ির সামনের পৌনে কাঠা জমিতে পূর্ণোদ্যমে বাগান করা শুরু করলেন। কিছু গাছ, যেমন -- আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, নিম, কদম, বকুল আগেই হয়েছে -- বোধহয় পাখিদের খাওয়া ফলের বীজ মাটিতে পড়ে তা থেকে আপনা-আপনিই তারা জন্মেছে।
অমরেশবাবু সেইসব গাছে রোজ দুবেলা নিয়ম করে জল দেন, সপ্তাহে একদিন আগাছা পরিষ্কার করেন, সময়মতো সার দেন। এই কাজে নাতি রূপ তার সঙ্গী। বাগান নিয়ে সঞ্জয়, প্রমিতার সেরকম কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু রূপের উৎসাহ দেখার মতো।
বাগানে নতুন কোনো গাছের চারা এনে বসালেই রূপের আনন্দ দেখে কে! -- দাদু এটা কী গাছ? দাদু ওটা কী ফুল? প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে অমরেশবাবুকে সে একেবারে অস্থির করে তোলে। অথচ অদ্ভুত ব্যাপার, নাতির প্রশ্নের উত্তর দিতে অমরেশবাবু কিন্তু কখনোই ক্লান্ত হন না! হাসিমুখে তার একটার পর একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলেন।
যদিও অস্তগামী সূর্য অমরেশবাবুর সঙ্গে নবোদিত সূর্য রূপের বয়সের ব্যবধান অনেক, তবু বয়স তাদের যাই হোক, মনের দিক থেকে তারা দুজনেই ছিল একেবারে একা। স্ত্রী ও চাকরি পরপর হারিয়ে অমরেশবাবু যেমন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন, রূপও তেমনি চাকরিজীবী বাবা-মায়ের সন্তান হওয়ার কারণে দিনের অনেকটা সময় তাদের সঙ্গ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হত।
জীবনের দুপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এই একান্ত নিঃসঙ্গ দুটো প্রাণ তাই যেন একাকিত্বের দৈত্যটাকে মেরে ফেলতে বয়সের বেড়া ডিঙিয়ে গাছের সঙ্গে, পরস্পরের সঙ্গে এক নিবিড় ভালবাসার অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে গিয়েছিল!
কিছুদিন ধরে অমরেশবাবুর শরীর তেমন ভালো যাচ্ছে না। তবু গাছের পরিচর্যা, নাতিকে স্কুল থেকে আনা-নেওয়া বন্ধ করেননি। কিন্তু একদিন আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারলেন না।
সেদিন রবিবার -- সকাল হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। অমরেশবাবু বিছানায় শুয়ে রয়েছেন, কানে এল ছেলে সঞ্জয়ের গলা। প্রমিতাকে ডেকে সঞ্জয় বলছে -- পম, দেখবে এস তোমার ছেলের কাণ্ড!
এই কথা শুনে অমরেশবাবু আর শুয়ে থাকতে পারলেন না। আস্তে আস্তে বিছানার ওপর উঠে বসলেন। কিন্তু দুর্বল শরীরে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে তাঁর মাথা ঘুরে গেল। কোনোরকমে দেওয়াল ধরে ফেলে তিনি টাল সামলালেন।
এরপর দেওয়াল ধরে ধরেই জানলার দিকে এগিয়ে গেলেন। জানলার সামনে দাঁড়িয়ে বাগানের দিকে তাকিয়ে অমরেশবাবু আশ্চর্য হয়ে যান -- তাঁর অনুপস্থিতিতে ছোট্ট রূপ বাগানে গিয়ে গাছেদের পরিচর্যার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছে!
এদিকে সঞ্জয়ের হাঁকডাক শুনে প্রমিতাও ততক্ষণে বাগানে চলে এসেছে। কিন্তু বাবা-মায়ের ধমক, বকাঝকাও রূপকে এদিন বাগান থেকে এক পাও কোথাও নড়াতে পারল না।
অমরেশবাবু জানলার সামনে থেকে ধীরে ধীরে সরে এসে আবারও বিছানায় বসলেন। তাঁর মনে পড়ে গেল, কদিন আগে তিনি আগাছা পরিষ্কার করতে করতে নাতিকে বলেছিলেন, -- দাদুভাই, আমি না থাকলে এদের যত্ন করতে পারবি তো?
-- খুব পারব দাদু।
রূপ তার কচি গলায় খুব জোর দিয়েই সেদিন কথাটা বলেছিল, অমরেশবাবুর তবু কেন যেন ঠিক বিশ্বাস হয়নি। এদিন তাই রূপকে দেখে তাঁর চোখে জল, মুখে হাসি -- তাঁর মতোই তাঁর দাদুভাইয়ের রক্তেও বৃক্ষপ্রেম এমনভাবে শিকড় গেড়ে বসেছে যে, এখন তিনি নিশ্চিন্তে চোখ বুজতে পারেন।
এতদিনে তাঁর বুকের থেকে যেন একটা পাষাণভার নেমে গেল। ধুতির খুঁটে চোখ মুছে তিনি তাই আবার শুয়ে পড়লেন। ক্লান্তিতে দুচোখে তাঁর ঘুম নেমে এল। অনেক দিন পরে নিশ্চিন্ত মনে অমরেশবাবু চোখ বুজলেন।
0 comments:
Post a Comment