সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

 ২৪ থেকে ৪২ এর পথে


অরিন্দম ঘোষ


সালটা ১৯৮৩। কালো ঘোড়া ভারত কয়েক মাস আগেই জোড়া পায়ের লাথি মেরে ভূপাতিত করেছে ক্রিকেট জগতের অঘোষিত ভূপতি ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। শ্রীকান্তের হাঁটু গেড়ে মারা কভার ড্রাইভ, সান্ধুর গ্ৰিনিজ-ঠকানো ইনসুইঙ, কপিল দেবের দৌড়ে গিয়ে তালুবন্দী করা আকাশছোঁয়া ক্যাচ, আর মহিন্দর অমরনাথের স্টাম্প উপড়ে নিয়ে দৌড়ানো… সাদাকালো সোনোডাইন টিভিতে দেখা সবকিছু তখনও চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে আছে। সদ্য সদ্য  অমিতাভ বচ্চন, মিঠুনদা, সঞ্জয় দত্, কুমার গৌরবের পোস্টারের পাশাপাশি সেলুনগুলোর দেওয়ালে স্থান পেতে শুরু করেছে ‘খেলার আসর’ বা ‘খেলার কথা'র মলাট থেকে কাটা কপিল দেব, গাভাসকারের ছবিও। 

বছর পনেরো-ষোলোর ছেলেটা মফস্বল শহরের মেন মার্কেটে অভিনব টেইলার্সের বাপিদার সামনে হাজির এক-কুড়ি কাটপিস থেকে প্যান্ট বানানোর জন্য। তখন রেডিমেড প্যান্ট-শার্টের চল ছিল না। কলার দেওয়া হাফ হাতার দু’তিন রঙের আড়াআড়ি টানা বর্ডার‌ওয়ালা বা এক রঙের টি-শার্ট অবশ্য পাওয়া যেত শহরের হাতে গোনা কয়েকটা দোকানে। পাতলা কার্ডবোর্ড ভেতরে দিয়ে স্বচ্ছ প্লাস্টিকের প্যাকেটে শক্ত করে মোড়া থাকত সেই সব টি-শার্ট। তখন প্যাকেটটাকে সবাই বলত কাচ-কাগজ আর টি-শার্টকে বলা হত গেঞ্জি। বন্ধুমহলে দু-একজনের বরাতেই  পুজোয় জুটত ওই গেঞ্জি। বেশিরভাগই থান থেকে কাটা ছিট কিনে দর্জির কাছে বানাতে দিত পুজোর জামা-প্যান্ট।

“ঘের কত রাখব রে? ছাব্বিশ না আঠাশ?” বাপিদার প্রশ্ন। 

“তিরিশ রাখো বাপিদা।” 

“তোর যা হাইট তিরিশ বেশি হয়ে যাবে তো!" 

“তবুও তিরিশ‌ই থাক। আমি তো লম্বা হচ্ছি এখন‌ও।” দর-কষাকষি চলতেই থাকে। 

“লম্বা হলে তো তোর প্যান্ট ঠ্যাংঠ্যাং করবে রে!” বাপিদা হেসে বলত। 

“নীচে চেন লাগাব?  পাঁচ টাকা বেশি লাগবে কিন্তু।” তখন প্যান্টের ঝুল হত মাটি ছোঁয়া, মাটির ঘষা খেয়ে যাতে ছিঁড়ে না যায় সে জন্য পায়ের একদম নীচে পিতলের চেন লাগানো থাকত, যাতে নীচটা মাটির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে পারে।

“তোর বাবা কিছু বললে জানি না কিন্তু!” 

ছোট শহরে সবাই সবাইকে চিনত। বাপিদার ভয় ছেলেটার রাশভারী বাবাকে নিয়ে। বাবা অবশ্য ততদিনে একটু রাশ ছাড়তে শিখেছে। বাবাকে ছাড়া একা একা সেই প্রথম প্যান্ট বানাতে যাওয়া ছেলেটার। “কবে ডেলিভারি? ঝুলিও না কিন্তু। মহালয়ার আগে পাব তো?” 

“তুই কি মহালায়া থেকে নতুন জামা-প্যান্ট পরতে শুরু করবি নাকি? মহালয়ার আগের দিন ট্রায়াল দিয়ে যাস। পুজোর আগে পেয়ে যাবি।” 

তখন জামা-প্যান্ট ট্রায়াল দেওয়ার একটা ব্যাপার ছিল। কিছু কিছু জায়গা বড় বড় করে টাঁক সেলাই দিয়ে আটকানো থাকত, আর কিছু জায়গা পাকা সেলাই করে রাখা হত। এত ট্রায়াল, ফাইনাল, তবু ডেলিভারি নেওয়ার পর বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনটা খুঁতখুঁত। কোমরটা একটু লুজ লাগছে যেন, বাঁদিকের পকেটের কাছটা কেমন কুঁচকে রয়েছে! বাপিদার ওখানে না গিয়ে মডার্ণ টেলার্সে গেলেই ভাল হত। বাপ্পা, বুকাই সবাই এবার মডার্ণ থেকেই করতে দিয়েছে। কিন্তু ওই যে ওখানে মজুরি কুড়ি টাকা বেশি নেয়, তাই বাবা রাজি হল না। 

তবু মোল্লা দর্জির দোকান থেকে অভিনব টেলার্সে পৌঁছানোটাও একটা উত্তরণ ছাড়া কিছু নয়। আগের বছর পর্যন্ত ছেলেটা পুজোর জামা কাপড় বানাত পাড়ার দর্জির কাজ থেকে। ‘বানাত’ মানে বানাতে হত। মোল্লা দর্জির নাম ঠিক কী ছিল জানা নেই। বাবাও মোল্লা বলেই ডাকত, পাড়ার অনেকে অবশ্য মাস্টার বলেও অভিহিত করত তাকে। জামা প্যান্ট বানানোর জন্য মোল্লার মাস্টারি আর্ট নিয়ে বাবা খুশি থাকলেও ছেলেটা খুশি ছিল না মোটেই। মোল্লা মাস্টারের কাছে গিয়ে মাপ দিতে হত না। গলায় ইঞ্চি-টেপ ঝুলিয়ে সন্ধ্যের দিকে সাইকেল চালিয়ে বাড়িতে চলে আসত। ঠোঁট থেকে বিড়ির শেষ অংশটা রাস্তার নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলে “বড়দাআআআআ…” বলে ডাক পাড়ত রাস্তা থেকে। বাইরের ঘরে ঢুকে পকেট থেকে একটা ছোট্ট নোটবই বার করত। তার দু’দিকের মলাট এবং প্রথম আর শেষ কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে গুটিয়ে থাকত দীর্ঘদিন পকেট থেকে বার করা আর ঢোকানোর ফলে। একটা টেপা ডটপেন বার করে নোটবইয়ের সামনের পাতার ওপর একটু ঘষে নিয়ে সচল করে নিত, আর তারপর শুরু হত মাপ নেওয়া। গলার কাছে মাপ নিত যখন মোল্লা মাস্টারের হাত থেকে খৈনির বিটকেল গন্ধ ছাড়ত, আর মুখ থেকে আসত বিড়ির পোড়া গন্ধ। বাবা বলত, “মার্জিন রেখে সেলাই করবি মোল্লা, আর কাপড় মারবি না কিন্তু।” ছেলেটার মনে সন্দেহ হত, তার জামা-প্যান্টের থেকে কাপড় সরিয়ে মোল্লা মাস্টার কি নিজের ছেলের জন্য একটা জামা-প্যান্ট বানিয়ে নিতে পারবে? এত কাপড় বেশি কেনা হয়েছে? হবেও বা  হয়তো!

এরপর একদিন সাহাবাবুদের গ্যারেজ ঘরে মোল্লা মাস্টারের দোকানে যেতে হত ট্রায়াল দিতে। দুটো পা দিয়ে চালানো সেলাই মেশিন, বড় একটা টেবিলের ওপর হলুদ রঙের একটা বাঁকা লম্বা স্কেল, কয়েকটা আকাশী নীল, ফিকে হলুদ, কমলা, ক্ষয়ে যাওয়া সাবানের মতো চক, আর একটা আধখানা কাটা টান করে পাতা কাপড়ের টুকরো… পাশে পিতলের হ্যান্ডেলওয়ালা একটা ভারী কাঁচি আর একটা ইস্তিরি। দেওয়ালে নাইলনের দড়ি খাটানো, তাতে হ্যাঙ্গার থেকে কিছু তৈরি হওয়া জামা প্যান্ট ঝুলছে। বছরের পর বছর একই ছবি দেখতে পাওয়া যেত মাস্টারের দোকানে।

“চলে এসো বাবু এদিকে, চট করে এটা পরে নাও তো।” জামা আর প্যান্টগুলো বাড়িয়ে দিয়ে বলত মোল্লা। ছেলেটার ইতস্তত এদিক ওদিক চাওয়া দেখে একটা ময়লা টাওয়েল বাড়িয়ে দিয়ে বলত,  “এই নাও। এবার আর কেউ দেখতে পাবে না।” তারপর কোমরে চেপে ধরে চকের দাগ দেওয়া,  “এদিক ঘোরো ওদিক ঘোরো” করে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখা, পায়ের নীচে চকের দাগ দিয়ে লম্বার মাপ ঠিক করা। এই সময় মাঝেমধ্যে দেখা যেত চেক শার্টের বা স্ট্রাইপড্ শার্টের পকেটের লাইন মেলেনি। ছেলেটা রেগে যেত। 

“ঠিক আছে, খুলে মিলিয়ে দেব পরে। আসলে এই রকমই চলছে আজকাল।” ছেলেটা শুনত না, বলত, “আমার মেলানোই চাই।” 

একবার এক কাণ্ড ঘটেছিল। সেবার জামার কাপড়টায় এবিসিডি লেখা আর তার সঙ্গে আপেল কলা ইত্যাদির ছবি দেওয়া ছিল। ট্রায়াল দিতে এসে ছেলেটা প্রায় কেঁদে ফেলে আর কি। একটা হাতায় এবিসিডিগুলো উল্টো। 

“ও কেউ এত খেয়াল করে দেখবে না।” 

মোল্লা ব্যাপারটা ম্যানেজ করার চেষ্টা করে। বিষয়টাতে বাবাও নাক গলায়, মোল্লার পক্ষ না নিয়ে ছেলের পাশে দাঁড়ায় এবার। মোল্লা বোঝাতে থাকে, এটা হবেই, দুটো হাতার কাপড় এভাবেই বাঁকা করে কাটতে হয়। ছেলেটা না বুঝলেও বাবা বোঝে, তবু দল বদলায় না। বলে, “তাহলে আর কতটা কাপড় লাগবে বল, আমি এনে দেব। তুই ডান হাতাটা বদলে দিস।” 

মোল্লা মাস্টার অর্ডার নেওয়ার সময় যেমন হোম সার্ভিস দিত, হোম ডেলিভারিটা এত সহজভাবে হত না। পুজোর মুখে তার মেলা কাজ। 

“খেতে যাবার সময় নেই বড়দা, কাল রাতে বাড়ি ফেরার সময় ঠিক দিয়ে আসব।” 

সেদিন রাতে অপেক্ষা করে করে দেরি করে তালা পড়ল গেটে। পরদিন অফিস যাবার সময় ছেলেটির বাবা খোঁজ করত আবার। 

“এই তো বড়দা, বোতাম বসানো খালি বাকি। আজ দিয়ে আসব ঠিক।” 

এই চলতে থাকে। কখনও বোতাম বসানো বাকি, কখনও বা ইস্তিরি করা বাকি। ওদিকে ঠাকুর গড়া প্রায় শেষের পথে, গোলাপি রং লাগানো হয়ে গেছে হাতে মুখে, বুক আর গলা তখনও সাদা, মহালয়ায় চোখ আঁকাও শেষ, ঢাকিরা আসতে শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যেই। মোল্লার বোতাম বসানোটুকু তখনও হয়ে ওঠেনি। তবে পঞ্চমী বা ষষ্ঠীর দিন অবশ্য ঠিক পাওয়া যেত, এর অন্যথা হয়নি কোন‌ও বার। মা-ও শেষটায় বিরক্ত হয়ে বলত, “এই মোল্লাটাকে তুমি বদলাও তো এবার। সারাদিন ছেলেটার এই আমসির মতো শুকনো মুখটা দেখতে ভালো লাগে না বাপু পুজোর সময়।” 

বদল হল অনেক কিছু। দাদা না পারলেও ক্যাপ্টেন কুল এর হাত ধরে আবার ফিরে এল সেই গর্বের ওয়ার্ল্ড কাপ। ছেলেটার কোমর চব্বিশ, ছাব্বিশ, আঠাশ থেকে বাড়তে বাড়তে চল্লিশ, বিয়াল্লিশে পৌঁছে গেল, ঘের তিরিশ থেকে কমতে কমতে আঠারো, কুড়ি। মোল্লা মাস্টারের দোকান এখন আর নেই। সাহাবাবুদের বাড়িটা ভেঙে কবেই ছয়তলা ফ্ল্যাট হয়ে গেছে। সেই বিল্ডিংয়ের একতলায় এখন একটা নামী ব্র্যান্ডের রেডিমেড জামা কাপড়ের শোরুম। তার ভারী কাচের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা দমদেওয়া পুতুলের মতো হাতজোড় করে নমস্কার করে অভ্যাগত সকল সম্ভাব্য খদ্দেরকে, মেটাল ডিটেক্টর গায়ে বুলিয়ে দেখে নেয় কোন‌ও টেররিস্ট পুজোর জামা-প্যান্ট কিনতে এল কিনা, আর সবার ব্যাগগুলো হাঁটকে হাঁটকে কী যে খুঁজতে থাকে তা ছেলেটা আজ‌ও বোঝেনি।

0 comments: