সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
অপশন্
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
এই একঘন্টা ধরে দেখছি চোখের সামনে একটা অর্ধস্বচ্ছ আবরণ থেকে থেকেই একবার আসছে আর সরে যাচ্ছে। এখন বেশ বুঝছি এটা বোধহয় দুপুর গড়িয়ে বিকেল । 'বোধহয়'টা আবার কেন বললাম তার কারণ বসবার ঘরে দেখছি টিউবলাইট জ্বলছে আর এখন বাড়ীর সবাই অফিস - কাছারি থেকে এসে গোল হয়ে বসে ভীষণ চাপা গলায় কিছু একটা গভীর বিষয়ে কথা বলছে।
এরই মধ্যে নীপা মানে আমার পঁয়তাল্লিশ বছরের পুরনো ধর্মপত্নীটিকে দেখলাম মুখে আঁচল চাপা দিয়ে আগত কান্নাটাকে একবার আটকাল।
ছেলেরা, জামাইরা আর মেয়েরা যা বলাবলি করছে সে কথায় বোঝা গেল যে তপন ডাক্তার খানিক আগে এসে বলে গেছেন যে আমার আর ঠিক হবার কোন চান্স নেই। আমিও যেন ডাক্তারকে চলে যেতে যেতে একবার অস্ফূট স্বরে বলতে শুনেছিলাম যে " অ্যাম ভেরী স্যরি" !
দেখছি ওরাও সকলে এই সম্ভাব্য মৃত্যুর ব্যাপারটায় বোধহয় একটু বিচলিত হয়ে পড়েছে।
আর তাই এখন সবার মুখে এই নিয়ে গম্ভীর গম্ভীর সব আলোচনা।
......
টুটুন মানে বড়ছেলে একবার আমতা আমতা করে বলল " সবই তো বুঝলাম! কিন্তু আমি থাকি সেই পুনা'য়। বুটুন মানে ভাই তো আবার সেই সাউথে! আর বনি আর মণি যে যার সংসারে ব্যস্ত। একজন থাকে বিলাসপুর আর অন্যজন ভোপালে। মা ঠিক কার কার কাছে পালা করে বা কবে, কোথায় থাকবে এটা নিয়ে তোরা কিছু ভেবেছিস্ কি?"
বড়জামাই মণীশ গলা খাঁকড়িয়ে যেন বলল -
" দেখুন ! সেটা তো একটা প্রবলেম তো বটেই। তাই বলে আবার বাড়িটিও এভাবে ফাঁকা ছেড়ে দেওয়াটা কি ঠিক হবে !"
বনি আর মণি এসব কথার মধ্যেই দেখলাম একফাঁকে উঠে চুপচাপ ওদের মাকে খানিক আগে ধরে ধরে আমার ঘর থেকে এসে একটু ঘুরে গেল। তখন দেখলাম মা আর মেয়ে দুটোই ওদের চোখমুখ সব লাল করে বসে আছে।
তাহলে এখন আমি কি সত্যিই....
এবার শুনতে পেলাম যে বুটুন বলল,
" আরে!আমার সাউথে মানে ব্যাঙ্গালোরে ওইতো দেড়খানা মাত্র ঘর। তার ওপর প্রায়সই নাইট শিফট্ লেগেই থাকে। মা একা কি করে ওখানে থাকবে? আমার তো আর বউ নেই!"
......
ওর শেষের কথাটায় কাকলী মানে বড়বৌমার বোধহয় একটু আঁতে ঘা লাগল। ও তাৎক্ষণিক নিজের ঝাঁঝটাকে চট্ করে কান্নায় কনভার্ট করে নিয়ে বলল - " আসলে ঋভুও তো এখন বড় হচ্ছে! তাছাড়া আমার আবার স্কুলে পড়ানো আছে ! ওসব দিকে হুট করে আবার লোক টোক চট্ করে পাওয়া যায়না ! তা মা কে দেখবে কে ওখানে শুনি ? ওনারো তো আজকাল শুনছি আবার হাজারটা অসুখ!"
আমাদের ছোটজামাই সমীর আর্টিস্ট মানুষ। সে মার্জিত গলায় দাড়ি চুমড়ে বলল,- " এবারে মণি চাইলে আমরা না হয় এখানেই একটা আঁকার স্কুলটুল জাতীয় কিছু একটা খুলে চালাতে পারি। আর তাহলে মা এখানেই থাকলেন আর মণিরও একটা সাইড ইনকামের রাস্তা খোলা থাকল। কলকাতায় আমার নর্থে নেহাত জয়েন্ট ফ্যামিলি কাজেই মনে হয় এটাই বেটার অপশন্!"
ওদের সাহেবী উচ্চারণে ভোজবাজির মত ওই
" অপশন্" শব্দটা কেবল থেকে থেকে চারদিকে ঘুরপাক খেতে লাগল ।
.....
বুঝলাম তাহলে বাহাত্তর বছরে মরলে বা সবার ওপর কোন বিপর্যয় আসলে এতদিন আমি বা আমরা দুজন কেবল ওদের গা বাঁচানোর জন্য " অপশন" খুঁজতে হবে এটাই বোধহয় শিখিয়েছি!
এখন তাই ওদের কাছে শিখলাম জীবন কি মৃত্যুর বদলে ওদের জাস্ট একটা " অপশন" ! আনাটাই এখন দরকার।
খুব নিজের ওপর রাগ হল। আচ্ছা যদি নীপা এরকমভাবে অসুস্থ হত তাহলেও কি ওরা আমায় এই ধরণের এক বুদ্ধিই দিত?
কে জানে?
নীপা দেখলাম ঠাকুরঘর থেকে চুপ করে বেরোল। ওর মুখে এখন একটা আবেগহীন আর নির্মোহ গম্ভীর টাইপের ভাব। আমি জানি সবটা ওরও কানে গেছে বলেই এখন এরকম কঠিন হয়ে থাকছে।
আচ্ছা ওও কি আমায় এরজন্য এখন দোষারোপ করছে?
...............
ফড়িং ধরে ফিরছিলাম। একটু আগেই মাঠে উদ্দাম বল খেলা সেরে চাকলাদারদের গোয়ালে পাশ থেকে আসতে আসতে শুনলাম ফরিদপুর নাকি আর ভারতের মধ্যে থাকবেনা। নসু জ্যাঠা চাপা গলায় সবাইকে তল্পি তল্পা গোছাতে বলছেন। এবারে মুসলমানেরা নাকি সব এসে কেড়ে নেবে আমাদের। আমরা নাকি তাই ইন্ডিয়ায় চলে যাব। তাহলে এই ভিটে..নারকোল গাছ.. এগুলোও কিছু থাকবে না আর? কান্না পাচ্ছে।
সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে।
শুনতে পেলাম নসু জ্যাঠার গলাটায় বাষ্প জমে আছে। উনি আক্ষেপের সুরে বলছেন-
" জহরলাল এটা কি করল? আর মহাত্মাজীও কিছু বললেন না? সুভাষবাবুও যে কেন হঠাৎ এইসময় চলে গেলেন...."
..............
ওয়ালশ্ জুটমিলের সামনে জটলায় কয়েকটা সোডার বোতল ছুঁড়ল কেউ একটা। দুম্ দুম্ করে দু আবার একটা হাত বোমাও পড়ছে। আসলে লকআউটে তিনমাস ধরে কেউ মাইনে পায়নি। অর্থাভাব মানুষকে এখন মরিয়া করে তুলেছে। একদল লোক এর মধ্যে কোত্থেকে এসে লাল নিশান হাতে এসে " নকশালবাড়িইইইই লাল সেলাআআম" বলতে বলতেই শুনতে পেলাম পুলিশের ভ্যানের আসার আওয়াজ। এখন একটা কোত্থেকে ধোঁয়ার মত এসে যেন চারদিক ঢেকে দিচ্ছে চেতনার গভীর পর্যন্ত।
................
মনে মনে একটা চিঠি লিখতে ইচ্ছা করছে তোমাকে,
নীপা,
চলে যাচ্ছি। কি জানি! হয়তো এতক্ষণে মরেও যেতে পারি।কিছু বুঝতে পারছিনা। সবাইকে অচেনা ঠেকছে।
শুধু একমাত্র তোমায় চেনা লাগছে।
দেখ, মনকে শক্ত কর! দু'দিন আগে আর পরে কাউকে তো একটা যেতেই তো হত বল।
তুমি তাই বলে আবার মাছ টাছ খাওয়া ছেড়োনা যেন। নিরামিষ তোমার মুখে রোচেনা তা আর আমি জানি না কি! আচ্ছা আমার বদলে তুমি আগে চলে গেলে আমায় কি কেউ সাদা পোশাক আর মাছ -টাছ ছাড়াই কেউ খেতে বলত? জানি উত্তরটা 'না' তো!
আচ্ছা, তুমিও কি ওদের মত "অপশন" খুঁজবে গো?
আমায় ভুলে যাবে বল!
এই বাড়িটার এক একটা ইঁট তোমার স্থৈর্য্য আর আমার কষ্টের কথা মনে রেখে কিন্তু এখনো দাঁড়িয়ে আছে !
বল একবার,
সত্যি তুমি সেটাও আবার ভুলে যাবে কি না , বল?
শোন, এখন তাছাড়া তোমার জন্য যেটুকু রাখা আছে তাতে ভাতকাপড়টা ঠিকই জুটে যাবে।
তাই ওদের কারুর দয়ায় নয়, নিজের অহঙ্কারে বেঁচো......
আর শোন! বিয়ের প্রথম প্রথম আমায় আদর করে যেমন অরুউউউণ, অরুউউণ বলে যেমন ডাকতে... ডাকবে গো একবার..
জাস্ট আর একবাআআআআর !
আচ্ছা! তাহলে আসি...ভাল থেকো!
0 comments:
Post a Comment