সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.


 

হারানো সুর

দীপঙ্কর সাহা


আমি একজন অবসর প্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। বিশাখাপত্তনম বেড়াতে গেছি, আমি একা মানুষ, একাই গেছি। দোকা আমি পাবো কোথায়! বসে আছি রামকৃষ্ণ বীচে, শান্ত সমুদ্রের অশান্ত হাওয়া জামা কাপড় ওলটপালট করে দিচ্ছে। সমুদ্রের উত্তাল হাওয়ায় ধুতি পাঞ্জাবি পড়ে এখানে বসা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে।


বীচের অদুরেই ভবতারিণী মন্দির থেকে বেড়িয়ে এলেন এক বৃদ্ধা, সাথে এক কিশোর। দুজনে কথা বলতে বলতে আমার কাছেই এসে বসলেন। 


ভদ্রমহিলার গলার স্বরটা কেমন চেনা চেনা লাগছিল, খানিকক্ষণ শোনার পর সন্দেহ নিরসন করতে, আমি বলি, - মনীষা নাকি! 

ভদ্রমহিলা চমকে চাইলেন আমার পানে। চোখের দৃষ্টি দেখে একদম নিঃসন্দেহ হয়ে বললাম, - মনীষা, তুই আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি সুবিমল। 


সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বৎসর পর এইরকম ভাবে হঠাৎ করে দেখা, চেনা তো কঠিন হবেই। দুজনেই অনেক পাল্টে গেছি। মনীষার সুন্দর ফিগার আর নেই, গোলগাল চেহারা হয়েছে, চোখে চশমা যুক্ত হয়েছে, লাল পাড় সাদা শাড়ি পরণে। শুধু মাত্র চোখের দৃষ্টি আর গলার স্বরটি পাল্টায় নি। 


কলেজে পড়াকালীন আমি বেশ মোটাসোটাই ছিলাম, গ্রামে ফিরে স্কুল মাস্টারী করতে করতে শুকিয়ে পাটকাঠি হয়ে গেছি। কলেজ জীবনের মতো কেতাদুরস্ত প্যান্ট শার্ট এখন আর পড়াই হয় না। সেই সব পোষাক ছেড়ে এখন পরনে থাকে শুধুই ধুতি পাঞ্জাবি। 


-কে সুবিমল? আমি কোনও সুবিমল টুবিমলকে চিনি না। চলো দাদুভাই, আমরা ওই দিকটায় বসি গিয়ে। 


-প্লিজ মনীষা, আমার একটা কথা শুনে যা। মানছি, তোর রাগ থাকা স্বাভাবিক আমার উপর, কিন্তু আমার দিকটা একটু শুনে দেখবি না? আমি কি কম জ্বলেছি এত বছর ধরে!


-আচ্ছা কি বলবি বল, তারাতারি। আমাকে একটু পরেই যেতে হবে। কাজ আছে। 


-তোর সাথে রেজিস্ট্রেশন বিয়ে হওয়ার কথা যেদিন ছিল, তার ঠিক দুদিন আগেকার কথা। তোদের বাড়ি থেকে হস্টেল ফিরেছি, সন্ধ্যা বেলা। এমন সময় ট্রাঙ্ককল এলো বাড়ি থেকে হস্টেলে, বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, ব্রেইনে ইন্টারন্যাল হেমারেজ, বাঁচার আশা নেই। কি করি, সেই মূহুর্তে ছুটতে হলো হাওড়া স্টেশন। 


তোকে কিভাবে খবর দেবো বল! তখন তো এত টেলিফোনের সুবিধা নেই। তোর বাড়ি গিয়ে খবর দিতে হলে হাওড়া থেকে লাস্ট ট্রেনটা মিস হয়ে যেত। গেলাম বাড়ি, কুড়ি দিন যমে মানুষে টানাটানি হলো। তুই তো জানিস, আমার মা নেই, চারটে ছোট ছোট ভাই বোন। 


ওদের একা ফেলে কি করে কলকাতা ফিরবো! তখন বি-এস-সি পাশ করে বসে আছি। এম-এস-সি করতে ভর্তি হবো সব ঠিকঠাক ছিল, মাঝখান থেকে এক তুমুল ঝড় এসে সব উল্টোপাল্টা হয়ে গেল। বাবা যে স্কুলের হেড মাষ্টার ছিলো, সেই স্কুলে একটা চাকরিও হয়ে গেল। আমি সাতদিন সময় চেয়েছিলাম। কিন্তু ওদের ইমিডিয়েটলি শিক্ষকের দরকার, আমি সময় চাইলে নাকি অন্য লোক নিয়ে নেবে, তারপর আবার যখন ভেকেন্সী হবে, তখন আসবে আমার চান্স। 


ফলে, বাবার শেষ কাজ যেদিন সম্পন্ন হলো, তারপর দিনই আমাকে স্কুল জয়েন করতে হয়। তোর বাড়ি যাই আসি, ঠিকানার কোনও দিন দরকার পড়ে নি, জানিও না। তাই চিঠিও লিখতে পারিনি। 


আমাকে থামিয়ে মহিলা বলে, - চিঠি লিখলেও কোনও লাভ হতো না। আমাদের ঠিকানা ততোদিনে পাল্টে গেছে। 


মাস ছয়েক পর পার্মানেন্ট হয়েই জবরদস্তি ছুটি নিয়ে কলকাতা এসেছিলাম। কিন্তু তোদের বাড়ি গিয়ে দেখি, সেখানে অন্য ভাড়াটে বাস করছে। তারা বা ওই বাড়িওয়ালা কেউই তোদের হদিস দিতে পারলো না। 


-হ্যাঁ, আমরা তার মাস তিনেক পর বালিগঞ্জ ছেড়ে হাতিবাগান চলে আসি, তুই তো জানিস, ওই বাড়িওয়ালা লোক ভালো ছিলেন না। নতুন ভাড়াটে বসালে বেশি ভাড়া পাবেন। তাই নানান ভাবে আমাদের হেনস্থা করছিলেন। 


বাধ্য হয়ে আমাদের বাড়ি ছেড়ে দিতে হয়। হাতিবাগানে কয়েক বছর থেকে  তখন নতুন গড়ে ওঠা সল্টলেকে একটা জমি হয়, তারপর বাড়ি। কিন্তু হাতিবাগান থেকে আমি চলে যাই গিরিডি। সে আর এক কাহিনী। 


-আমার কথা তো সব শুনলি, তোর কথা কিছু খুলে বলবি না! এখনও আমার উপর রাগ করে আছিস? 


-তুই চলে যাবার মাস খানেক পরে আমি জানতে পারি, তোর সন্তান আমার গর্ভে। কি করি, তোর হস্টেলে গিয়ে কোনও খবর পেলাম না। তখন আমার পাগল পাগল অবস্থা। শেষ পর্যন্ত সব খুলে বললাম পরাগের কাছে। তুই তো জানিস পরাগ আমাকে ভালোবাসতো। ও আমাকে বিয়ে করতে চাইলো। আমি বলি, - কি বলছিস তুই! আমার সন্তান তার বাবার পরিচয়ে বড় হবে না? তাই হয়? 


পরাগ বলে, - তাহলে কি করতে চাস তুই? আমি বললাম, - সুবিমলের সাথে রেজস্ট্রী বিয়ের নোটিশ দেওয়া আছে, তুই যদি আমায় বাঁচাতে চাস, তাহলে সুবিমল রায়ের নামে তুই সই করবি। তারপর আমি মাসির বাড়ি গিরিডিতে চলে যাবো, সেখানে বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হবে, তারপর দেখা যাবে কি হয়। 


সে আমলে তো আঁধার কার্ডের ব্যাপারই ছিল না। তোর কলেজ আইডেন্টিটি কার্ডটা লাকিলি আমার কাছে ছিল, তাতে তোর ছবিটা অস্পষ্ট ছিল, পরাগের ফেসকাটিংটা তোর সাথে একটু মিলতো। যাইহোক সে আমলে এইসব ব্যাপার নিয়ে অতটা কড়াকড়ি ছিল না, অসুবিধা হয়ও নি। 


যাইহোক বকলেমে হলেও তোর সাথে আমার রেজিস্ট্রী বিয়েটা হয়ে গেল। তারপর আমি সত্যিই মাসির বাড়ি গিরিডিতে চলে যাই, সেখানে মেসোমশাই নিজেই ডাক্তার। কাজেই কোন অসুবিধা হলো না। সেখানে আমার পুত্রসন্তান ভূমিষ্ঠ হলো। 


-গিরিডিতে চলে যাওয়ায় আমিও এম-এস-সি করতে পারিনি। তারপর একটা কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে চাকরি পেয়ে রাঁচি চলে যাই। ছেলে সুবিনয়কে বড় করে তুলি। নিজের ছেলে বলে বলছি না, সুবিনয় পড়াশুনায় দারুণ ছিল, তোর আর আমার যুগ্ম মেধা নিয়ে হয়তো জন্মেছিল। 


স্কুল শেষ হলে রাঁচির বি-আই-টি মেসরাতে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পেতেই ওখানে ভর্তি করে দেই। হস্টেলে থাকতো। সেই প্রথম আমার থেকে দুরে গেল। কেমন যেন পাগল পাগল লাগতো। সপ্তাহান্তে বাড়ি আসতো, আমিও মাঝে মাঝেই যেতাম। 


ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর, ওর একটা চাকরি হয় পাত্রাতু পাওয়ার প্ল্যান্টে। তারপর ওর বিয়ে দেই, দেড় বৎসর বাদে এই দাদুভাই এর জন্ম হয়।


এর পরের ঘটনা খুব মর্মান্তিক। একবার শনিবার রবিবার রাঁচিতে ছুটি কাটিয়ে সোমবার ভোরে পাত্রাতুতে ফিরে যাচ্ছে ওরা তিন জন, পাহাড়ি রাস্তায় মোটরবাইক স্লিপ করে একদম নিচে খাদে পড়ে যায়। সুবিনয় আর ওর স্ত্রী সুমনা দুজনেই শেষ, দাদুভাই তখন কোলের শিশু, একটা গাছের ডাল পাতায় আটকে ছিল বলে ভাগ্যক্রমে ও বেঁচে যায়। পরে লোকজন ওকে উদ্ধার করে। 


-এখন ওকে নিয়েই আমার জীবন। ওকে মানুষ করে তোলা আমার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। যাক, তোর কথা বল, তারপরে কি হলো? 


ইতিমধ্যে আমরা দুজনে দুজনের মোবাইল নাম্বার নিয়ে নিয়েছি, অর্থাৎ মনীষার রাগ পড়েছে, ভুল বোঝাবুঝির এখানেই ইতি। মনীষার কথার উত্তরে আমি বললাম, 


-আর কি, ছোট ভাই দুটোকে মানুষ করলাম, ওরা দুজনে চাকরি করছে হায়দ্রাবাদ আর ব্যাঙ্গালোরে। বোন দুটিকে পড়াশোনা শিখিয়ে বিয়ে দিলাম, একজন থাকে দিল্লিতে, আর একজন কোটায়। যে যার কর্মক্ষেত্রে চলে গেল, আমি পড়ে রইলাম একা। 


-বিয়ে করলি না কেন? 


-হলো না রে, ভাইবোনদের দাড় করাতে করাতে বয়স গেল পেরিয়ে। অবশ্য বয়স থাকলেই বা কি হতো! মনের তাগিদ তো থাকা চাই! 


-মনীষা একটা কথা বলি, তোর কাঁধে এখন যে দায়িত্ব, তার একটুখানি ভাগ আমাকে নিতে দিবি? আমি বড় একা! 


-আজ আর তা হয় না সুবিমল! আমি লোকের কাছে কি বলবো? একটা সময় সুবিনয়ের মর্যাদার কথা ভেবে আমায় লোকজনের কাছে তার বাবার গল্প অনেক রকম কাল্পনিক কাহিনী মিশিয়ে বলতে হয়েছে। 


আজ তাই মন চাইলেও আমি তোকে সাথে নিয়ে যেতে পারবো না। তুই ভালো থাকিস, ফোন নাম্বার তো রইলো দুজনের কাছেই, যোগাযোগ রাখিস। চলি।… . 


মনীষা নাতির হাত ধরে চলে যেতে থাকে, ওদের অপসৃয়মান দেহের দিকে নিস্পলক ভাবে চেয়ে থাকি আমি, আমার চোখদুটি ভিজে উঠেছে….!!

0 comments: