সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

 অন‍্য প্রতিশ্রুতি

সুতপা ব‍্যানার্জী(রায়)


"প্রথম প্রতিশ্রুতি"-র গল্প আমরা খুঁজে পাই আরো অনেক মানুষের জীবনের ইতিহাসে, এ সেইসব দিনের গল্প যখন নারী-জীবনে প্রগতির ধ্বজা উঁকি দিতে পারে নি।

ভাগলপুরের এক বর্ধিষ্ণু পরিবার, যেখানে নিত‍্য সান্ধ‍্য-সাহিত‍্যের আসর বসে, সাহিত‍্য-সভা আলো করে থাকে বনফুল, এ সেসব দিনের কথা। ভাগলপুরের স্বনামধন‍্য ব‍্যক্তি পটলবাবু, বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা, লাইব্রেরী স্থাপনা ও

স্থানীয় লেখকদের পৃষ্ঠপোষকতা করায় লোকের মুখে মুখে ফেরে ওনার নাম। পটলবাবুর আদরের কন‍্যা নলিনী,

সে অবশ‍্য বাংলা স্কুলে যাওয়ার সুযোগ অল্পবিস্তর পেয়েছে, ছোট থেকেই বাবার বই-এর সংসারে উপুড় হয়ে পড়ে থাকে, মায়ের অবশ‍্য বিস্তর চেষ্টা মেয়ে সংসারের কাজ, পূজো-পাষ্টা শেখে; সন্ধ‍্যেবেলায় ঠাকুর মন্দিরে সবকিছু হাতে ধরে শেখানোর চেষ্টা করে; মেয়ের নেশা বৈঠকখানা ঘরের দরজার আড়াল থেকে সান্ধ‍্য- সাহিত‍্য আসরের ভাগ নেওয়া, বিমুগ্ধ হয়ে শোনে সে। বয়োপ্রাপ্ত হলে বাইরেটা তো আর বিশেষ দ‍্যাখা হয় না, মনের রঙ মিশিয়ে লিখে চলে কবিতা, সেদিন এক মজার কান্ড ঘটল, সে একটা শব্দ "মুখশশী" জোরে উচ্চারণ করে ফেলেছিল, অমনি পোষা কাকাতুয়াটা বলে

উঠল-"মুখশশী,"-খেলাটা খেলতে নলিনীর বেশ ভাল লাগছিল, অমনি মায়ের ডাক শুনল, বার-বাড়িতে বাবার

জলখাবার পৌঁছে দিতে হবে। নিশ্চয়-ই বার-বাড়িতে এখন বাইরের কেউ নেই, নাহলে মা এই ফরমাস করত না। পর্দার আড়ালের অবসর যাপনে নলিনী একদিন মুগ্ধ

হয় এক নব‍্য কবির কবিতা পাঠে, কে ও? বাবার কাছে কথার ছলে জিজ্ঞাসা করায় জানতে পারে, ও সীতানাথ;

ডাক্তারীর ছাত্র আবার কাব‍্যচর্চাও করে, পটলবাবুর বিশেষ পছন্দের পাত্র। সীতানাথ-ও উপলব্ধি করল, পর্দার

ওপারের নীরব উপস্থিতি, নলিনীকে যে তার বিশেষ পছন্দ ঠারেঠোরে বোঝায় কয়েকজন সাহিত‍্যসভার বন্ধুকে, কথাটা কানে যায় পটলবাবুর; পাল্টি ঘর হওয়ায়

সেরকম আপত্তি করারও কিছু ছিল না। তিনি নিজে গেলেন সীতানাথের বাড়িতে; অমন মান‍্যিগন‍্যি লোকের

বাড়িতে বিবাহসম্পর্ক স্থাপনে তাদের না বলার কোন কারণ ছিল না, তবে মওকা পেয়ে ওনারা একটা প্রস্তাব দিলেন যে সীতানাথ ইংল‍্যান্ডে উচ্চশিক্ষা লাভ করতে যাবে, ওই ব‍্যয়ভার নলিনীর বাবা পটলবাবুকেই বহন করতে হবে। পটলবাবু অনেক দুস্থ ছাত্রকেই প্রতিপালন করেন, ভাবীজামাই-এর পড়ার খরচ বহন করবেন, এ

ওনার জন‍্য সামান‍্য ব‍্যাপার, উনি রাজী হয়ে গেলেন।


যথাসময় নলিনীকে বিষাদসাগরে ভাসিয়ে সীতানাথ চলে

গেল বিলেতে, প্রতিমাসে পড়ার খরচ আসে ভাবীশশুরের 

সেরেস্তা থেকে। ওদেশের জীবনে ধীরে ধীরে মজে যায় সীতানাথ, নলিনীর ওপর টান ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়, 

বাবার কোন পত্র এলেই নলিনী ভাবে তা সীতানাথের,

প্রত‍্যেকবারেই আশাভঙ্গের যন্ত্রণা সহ‍্য করতে হয়। ততদিনে সীতানাথ সহপাঠিনী অ‍্যানার মধ্যে খুঁজে পেয়েছে তার হৃদয় নন্দিনীকে, ওর হাঁটাচলা, আদবকায়দায় মুগ্ধ সীতানাথ, নলিনীকে তার এখন গাঁইয়া মনে হয়, যদিও পটলবাবুর পাঠানো টাকায় আপত্তি নেই। খবর আসে পাশ করেই সীতানাথ তার সহপাঠিনীটিকেই বিয়ে করেছে, এ দেশে আর ফিরবে না।

আঁধার নেমে আসে বন্দ‍‍্যোপাধ‍্যায় বাড়িতে, মেয়ের ঠিক হওয়া বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় খানিকটা সমাজচ‍্যূত হওয়ার ভয়। নলিনীর মনের খবর কে রাখে? হাতের কাছে হতদরিদ্র, মাঝারিশিক্ষিত একজনের সঙ্গে ঠিক হয় নলিনীর বিবাহ। সীতানাথের দ্বারা প্রতারিত হয়ে পটলবাবুর মন মেজাজও ভাল নেই, তাই মেয়ের মনের খবর রাখা আর হয়ে ওঠে না। এক বৈশাখে প্রতিমার ভাসান হয়ে যায়, চোখের জলে ভাসে নলিনী। রোজগারের জোর না থাকায়, দীনেন্দ্র মানে নলিনীর বর ঘরজামাই হয়, বাবাও দেখেন আজন্ম যত্নে লালিত কন‍্যাটি তার দারিদ্রের কষ্ট সহ‍্য করতে পারবে না, তাই নিজের কাছেতে চোখের সামনেই থাক; দীনেন্দ্র-র সঙ্গে মানাতে গিয়ে নলিনীর শিক্ষাদীক্ষা, রুচি হোঁচট খায়, অলস, নিশ্চেষ্ট, আকাঙ্খাহীন মানুষটি তার নিত‍্য অশান্তির কারণ হয়। এর-ই মধ্যে কোলে আসে হেমপ্রভা, সন্তানের পিতা হয়েও দীনেন্দ্র-র স্বভাবের কোন পরিবর্তন হয় না, সেরেস্তার কাজেও হাত লাগায় না, নলিনীর কোন কথাই কানে তোলে না। পটলবাবুও এরকম নিষ্কর্মা জামাই-এর জন‍্য আড়ালে দুঃখ প্রকাশ করেন, নলিনী ভাইরাও এখন বড় হয়েছে, তারাও দু-চার কথা বলে। এতসব অশান্তি নলিনী আর নিতে পারে না, সকালে ফুল তোলার সময় কলকের বীজ সংগ্রহ করে আনে আর সকলের চোখের আড়ালে তা খেয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়, পেছনে পড়ে থাকে তার আদরের হেমপ্রভা। আসতে

আসতে দাদু-ঠাকুমা হেমপ্রভাকে আঁকড়ে শোক ভোলে, আর সমস্ত বিধিনিষেধের বেড়া উঠে যায় নাতনির জন্য।

কোন মেয়েলি নিয়ম, অনুশাসন ওর ওপর আরোপিত হয় না, সে মনের সুখে গান গায়, কবিতা লেখে, তা আবার সকলকে শোনায়। দাদু ও মামাদের আদরে ও বেড়ে ওঠে,

ক্রমে তার হরেক বায়নায় সকলে অতিষ্ঠ হয়, তবু মাতৃহারা মেয়েটির কথা চিন্তা করে সবাই হাসিমুখে মেনে নেয়। হেমপ্রভার দাদুর বয়স বাড়ে, শরীর ভাঙে, চিন্তা হয়

নাতনির জন‍্য, নলিনীর স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে, আবার কোন ভুল হয়ে যাবে না তো; তাঁর অশক্ত শরীর আর কোন ঝাপটা সইতে পারবে না। হেমপ্রভা চোদ্দ পূর্ণ করলে পাত্রের সন্ধানে ঘটক লাগানো হয়, হেমপ্রভা যেহেতু শ‍্যামবর্ণা, ওর একটাই ইচ্ছে বর যেন ফর্সা হয়। নাতনির কোন আবদার-ই ফেলেন না, দাদু তাই এই আবদার-ও মেনে নিলেন, সেইভাবেই সন্ধান চলল।

কলকাতার নিমতা থেকে ভাল সম্বন্ধ এল, পাত্র বেঙ্গল

ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিপ্লোমাপ্রাপ্ত, তখন-ও সিভিলে ডিগ্রী চালু হয় নি; দেখতেও সুন্দর, স্বচ্ছল অবস্থা। নিমতা থেকে সপরিবারে

পাত্রী দেখতে এল পাত্র ভূদেবের পরিবার, আপ‍্যায়ন-আন্তরিকতায় এতটাই মুগ্ধ হল ভূদেবের বাবা, মা, যে তখনই পাকাকথা দিয়ে গেলেন। হেমপ্রভা নতুন জায়গায় যাওয়ার অজানা আশঙ্কায় ভুগতে রইল। এসব স্বাধীনতার-ও বছর পঁচিশ আগের ঘটনা, সেইসময় ভাগলপুর থেকে এক অন্তপুরিকার কলকাতা আসাও বিশাল ব‍্যাপার ছিল।

বিয়ের দিন লালবেনারসি আর লালচেলি পরা হেমপ্রভার মন তার মরে যাওয়া মায়ের জন‍্য উদ্বেল হয়ে উঠল। কবে ছোটবেলায় মা-কে হারিয়েছে, শুধু ছবিতেই মায়ের অবস্থান, তবু আজ হেমের মন মা-র জন‍্য বড় হুহু করছে। দিদুনের বুকে মুখ গুঁজে কেঁদেই চলেছে, ওদিকে আবার লগ্নের তাড়া আছে, মামা-মামীরা বুঝিয়ে শুনিয়ে বিবাহ মন্ডপে নিয়ে যায়। ভূদেব-ও তো সবে পাশ করে চাকরি পেয়েছে, নব‍্য যুবা, বর বেশে দারুন মানিয়েছে,

পাড়াপ্রতিবেশী হেমপ্রভার সৌভাগ্যের প্রশংসা করতে রইল। একমাত্র নাতনির বিয়েতে পটলবাবু আয়োজনেরও

কোন ত্রুটি রাখেন নি, নিমন্ত্রিত লোকও প্রচুর, বন্ধু-বান্ধবরা দাঁড়িয়ে থেকে সব কাজ দেখে দেওয়াতে বরযাত্রী আপ‍্যায়ন থেকে শুরু করে লোক খাওয়ানো কিছুতেই কোন অব‍্যবস্থা ছিল না। অবশেষে আসে বিদায়ের ক্ষণ, দাদু-দিদাকে চোখের জলে ভাসিয়ে, সকলের আদরের হেম মাতুলালয় ছাড়ে। রাস্তায় টুকটাক

কথাবার্তায় ভূদেবকে বেশ ভালমানুষ-ই মনে হয় হেমপ্রভার, মুশকিল তো তার নিজেকে নিয়েই, সামান‍্য অসুবিধেও সহ‍্য করার ক্ষমতা নেই তার।


শুরু হল হেমপ্রভার শশুরালয়ের জীবন, ভূদেব একমাত্র ছেলে হওয়ায় সংসার ছোট-ই, জ্ঞাতিরা সব আশেপাশেই থাকে, বউভাতের অনুষ্ঠানে অবশ‍্য দূরের আত্মীয়পরিজনদের সঙ্গেও আলাপ হয়েছে।পাকা ঘর-দালান হলেও, বাসন মাজার কাজটা পুকুর ঘাটেই সারতে হয়, বাড়ির ঠিকে-ঝি মানদা অবশ‍্য ওসব কাজ করে দেয়।

পুকুর ব‍্যবহারে হেমের ভারী ঘেন্না, এ ব‍্যবস্থায় সে অভ‍্যস্ত

নয়। শাশুড়ির হাতে হাতে সামান‍্য কাজ করলেই এলিয়ে পড়ে, অবশেষে ভূদেবের চেষ্টায় বাড়িতে পাকাপাকিভাবে

রাধুঁনি রাখা হল। টিটাগড়ে ব্রিটানিয়া কোম্পানি ভূদেবের কর্মস্থল, বাড়ি থেকেই কর্মস্থলে যাতায়াত, বাড়ি ফিরে ভারী ক্লান্ত থাকে সে; হেমপ্রভার অল্পেতেই খিটখিটে ভাব,

ওদিকে কারখানার পরিবেশের হাড়ভাঙা খাটুনি, এতটা নিতে পারে না ভূদেবের শরীর, ফুসফুসের জটিল রোগে আক্রান্ত হয় সে। ডাক্তার নিদান দেয় কর্মস্থল বদলের, সঙ্গে চলতে থাকে চিকিৎসা, হেমের এক তুতো দাদা তখন

পাটনার নাম করা ডাক্তার, তাকে দেখাতে ও পরামর্শ নিতে ভূদেব সপরিবারে পাটনায় যায়।ক্রমে চিকিৎসার সুবিধের জন‍্য পাটনা রাইটার্সে চাকরি নেয়, অফিস কোয়ার্টার-এ হেমপ্রভা সাজায় তার সংসার।


নিমতার বাড়ি থেকে আসে এক বিধবা ননদ গিরি, ভাই-এর সংসারকে আগলে রাখে; সংসারে নতুন সদস‍্যরা আসে, প্রথমে ত্রিদিব, তার দুবছরের ছোট রমলা। মায়ের ধৈর্য‍্যের অভাব, অগত‍্যা পিসীমার স্নেহচ্ছায়ায় বড় হয়।

পুত্রসন্তানের ভবিষ‍্যৎ ঘিরেই মা স্বপ্ন দেখে, ছেলের মেধার বিচ্ছুরণে মা আহ্লাদিত হয়; ওদিকে মিশনারি স্কুলের গর্ব হয়ে ওঠে রমলা, সমস্ত বিষয়ে অসম্ভব তুখোড়, সকলের প্রিয়পাত্রী। বৃত্তি পরীক্ষায় দ্বিতীয়স্থান লাভ করে স্কুলকে এনে দেয় সম্মান। বাড়িতে অবশ‍্য ওর নিপুণ সেলাই, ঘরের কাজ আর দরকার মতো গাওয়া ভজনগানের কদর আছে। এর-ই ফাঁকে বাড়ির কোন নিভৃত কোণে সে ঠিক তার পড়াশুনা চালিয়ে যায়। পিসীমার অকালপ্রয়াণ রমলার মাথায় বাজ হয়ে নেমে আসে, সব আঘাত, গোঁড়ামি থেকে যে তাকে বাঁচিয়ে রাখত, পড়াশুনায় উৎসাহ দিত, তাকে হারিয়ে রমলা দিশেহারা হয়ে পড়ে, তার সব নিশ্চিন্ততার অবসান ঘটে।

রমলার পরে যে ভাইবোনেরা সংসারে এসেছে, পিসীমার অবর্তমানে তাদের পুরো দায়িত্ব রমলার ওপর এসে পরে।

পরবর্তী সময়ে শিক্ষাজগতে যারা দিকপাল হবে তাদের

পড়াশুনার প্রাথমিক পাঠ রমলার হাত ধরেই শুরু হয়। 

 রমলার মিশনারি স্কুল ক্লাস এইট অব্দি, এরপর সবই প্রায় বয়েজ

স্কুল, বাড়ির থেকে অনেক দূরে একটা কোএড স্কুল আছে কিন্তু সেখানে যাওয়ার অনুমতি মিলল না। মেধাবী রমলার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার এখানেই ইতি ঘটল, কিন্তু

তার অবসরের সঙ্গী হয়ে উঠল বই, যেখানে কারো অনুশাসনের হাত পৌঁছতে পারল না। এই সব কিছুর মধ্যে 

এসে পড়ে সেই এক গোত্রান্তরের নামে গ্রহান্তর প্রক্রিয়া, শেকড় ছিঁড়ে তাকে এক ভিনগ্রহের বাসিন্দা করার চেষ্টা।

পিসীমা চলে যাওয়ার পর থেকে সবকিছুকেই যেমন নিজের ভবিতব‍্য বলে মেনে এসেছে, ওর বিয়ে দেওয়ার চেষ্টাটাকেও সেভাবেই নিয়েছে রমলা, এবিষয়ে তার কোন বক্তব‍্য নেই, কোন অভিব‍্যক্তি নেই। এর মধ্যে মুখার্জি পরিবার পাটনা স্টেশনের কাছে নতুন বাড়িতে উঠে এসেছে, সেখানেই রমলার বিয়ের সানাই বাজে। দেশ

যে বছর স্বাধীন হল, সে বছর-ই রমলা নতুন করে পরাধীন হল।

পাত্র হাজারীবাগের বিখ‍্যাত উকিল বিনোদবাড়ুজ্জের ছেলে সুবিমল, গৌরবর্ণা সর্বগুণসম্পন্না রমলাকে বরপক্ষের খুব পছন্দ হয়েছিল। রমলা শশুরবাড়ি এসে দেখে সে

এক বিশাল পরিবার, শশুর-শাশুড়ি, দেওররা, বিধবা পিসতুতো ননদ, ভাসুর-জা; সকাল থেকে ঘূর্ণির মতো সংসার সামলায় রমলা, কারো কাকিমা, কারো মামীমা, কারো বউদি হয়ে। তার লেখাপড়া সীমাবদ্ধ হয় সন্ধ‍্যেবেলায় শাশুড়িকে গীতা, রামায়ণ- এসব পড়ে শোনানোর মধ্যে। তবে শশুরমশাই-এর কাছারিঘরে একটা

আলমারির সন্ধান পেয়েছে, যেখানে বাংলা ও ইংরেজি সাহিত‍্যের ভাল ভাল বই আছে। দুপুরের অবসরে যখন সবাই ঘুমে বা গালগল্পে ব‍্যস্ত থাকে, তখন গুটি গুটি পায়ে

রমলা হানা দেয় কাছারিঘরে, মগ্ন হয়ে যায় দেশবিদেশের

সাহিত‍্যপাঠে। একদিন মেজননদাই-এর কাছে ধরা পড়ে যায়, তিনিও বিদ্বানমানুষ, রমলার এই বই পড়ার আগ্রহে

খুশি হন ও প্রচ্ছন্ন স্নেহে নিত‍্যনতুন বই এনে জ্ঞানপিপাসাকে আরো উসকে দেন। আর একটা ঘটনা মনকে নাড়িয়ে দেয়, বাপের বাড়িতে থাকতে স্বাধীনতা আন্দোলনের খবর বাবা, দাদার কাছ থেকে পেয়েছে, কয়েকটা ঘটনা মনে দাগ কেটেছে, যার মধ‍্যে অন‍্যতম আন্দোলনরত অবস্থায় সাতছাত্রের মৃত‍্যু, যাঁদের স্মৃতিস্তম্ভ পাটনা শহরের এক দ্রষ্টব‍্যস্থান, সেদিন ওই হতাহতের মধ্যে নিজের দাদাও থাকতে পারত, খুব অল্পের

জন‍্য বেঁচে গিয়ে বাড়ি ফিরেছিল; এখানে এসে শুনল শাশুড়িমার মা-ই স্বয়ং বিপ্লবী দলে ছিলেন, বিভিন্ন গোপন মিটিং-এ যোগ দিতে দূর-দূরান্তে চলে যেতেন, সেইভাবেই একদিন বরাবরের জন্য নিখোঁজ হয়ে যান।


সময় গড়ায়, শশুরমশাই অসুস্থ হন, চিকিৎসার প্রয়োজনে কলকাতায় শশুর-শাশুরি চলে আসেন। ছেলেরাও কেউ দিল্লি, কেউ কলকাতা, কেউ আসানসোল চলে আসে। ভাসুর ওকালতি নিয়ে নিজের শহরেই থেকে যান, স্ত্রী আর মেয়ে রীতাকে নিয়ে। কাকিমা, রীতার নয়নের মণি, ছাড়তে মন চায় না, পারলে সেও চলে আসে কাকিমার সঙ্গে। রমলাও এরমধ্যে দুই সন্তানের মা হয়েছে, স্থায়ীভাবে স্বামীর কর্মস্থলে যাওয়ার আগে বেশ কিছুদিনের জন‍্য পাটনায় যায়।


রমলার হাতে গড়া ভাইবোনেরাও এখন বেশ বড় হয়েছে,

স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ে সব, একবোন কলেজে যায়, দাদা

ততদিনে দিল্লিতে রিসার্চের কাজে, সবচেয়ে ছোটবোন অবশ‍্য খুব-ই ছোট। ছোট ছোট বোনপোদের পেয়ে তারা আদর যেমন করে, তেমনি খবরদারি করতেও কসুর করে না। ছোট ছোট অপরাধে দুশোবার কানধরে ওঠবোস কিংবা এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা এসব চলতে থাকে তাদের ওপর, ওরাও অতিষ্ঠ হয়ে মায়ের আঁচল ছাড়তে

চায় না। রমলা আসন্নপ্রসবা, তৃতীয় সন্তানের জন্মের প্রতীক্ষায়। সংসারে এত জড়িয়ে গেছে যে বাইরের খোলা

আকাশটাই আর দ‍েখা হয় না; পুরোনো বান্ধবীরা যারা ভাগ‍্যক্রমে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল, জীবনের পথে অনেকটাই এগিয়ে গ‍্যাছে, তারা দেখা করতে আসে, বাইরের পৃথিবীর খবর আনে, রমলা বিভোর হয়ে শোনে।


নিজের সংসার মানে স্বামীর কর্মস্থলে ফেরে রমলা, সঙ্গে 

ছেলেরা ছাড়াও ছোটভাই অবনী আসে, দিদির বড় ন‍্যাওটা সে, জামার বোতাম ছিঁড়ে গেলেও দিদি ছাড়া উপায় নেই তার। স্বাধীনোত্তর ভারতে তখন গড়ে উঠছে ভারীশিল্প, সেরকম-ই একটা শিল্পকারখানায় রমলার স্বামী চাকরি করে। নিজের নিজের শেকড় ছেড়ে গোটা ভারতবর্ষের মানুষ সেখানে জড়ো হচ্ছে, আবাসন, স্কুল, হাসপাতাল সব গড়ে উঠছে।এরকম ধোঁয়া, কালির পরিবেশের সঙ্গে রমলার প্রথম পরিচয় ঘটল, যেখানে মেঘের রঙ সারাবছর-ই কালো থাকে, ঐ কালো মেঘগুলো যেন রমলার জীবন যা সমস্ত সম্ভাবনার পথ আগলে দাঁড়ায়। ভোর না হতেই রমলা উঠোন ঝাঁট দেয়,

স্নান সেরে চুলো ধরায় রান্নার জন‍্য, রান্নাঘরের তাকে কোন না কোন বই রাখা থাকে, রান্নার ফাঁকে পড়ার জন‍্য।

ছেলেদের সন্ধ‍্যেতে পড়াবে বলে সকালেই দু-বেলার রান্না

সেরে রাখে। হাতের কাজ সারতে সারতে অনায়াসেই ছেলেদের অঙ্কের সমাধান মুখে মুখেই করে দেয়, আশেপাশের মায়েরাও ছেলেপুলেদের পাঠিয়ে দেয় রমলার কাছে, হাসিমুখেই সে দায়িত্ব রমলা সামলে দেয়।

পাড়ার বাচ্ছাদের নিয়ে মেতে ওঠে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালনে, অসময়ে কেউ এলে নিজের আহারটুকুও তুলে দেয়। নেই ধর্মেরও গোঁড়ামি ফলে সকলের আপদে বিপদে পাশে দাঁড়ায় নিজের সবটুকু দিয়ে। সুবিমল সারাদিন ব‍্যস্ত থাকে কারখানার কাজে, নিরুপদ্রব, নির্বিঘ্ন জীবন তার পছন্দের, চিরদিন মহীরুহের তলায় লালিত হয়ে জীবনের

সিদ্ধান্তগুলো ঠিক নিতে পারে না, সব ব‍্যাপারেই রমলার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। ছেলেদের রোগ অসুখেও কেঁদে অ‍্যাকসা করে, অন্তহীন ভালবাসা ছাড়া কিছু দিতে

পারে না, আর করতে পারে অসম্ভব কষ্ট, সংসারে দু-পয়সা বাঁচানোর জন্য ডিউটির বাসের বদলে সাইকেল ব‍্যবহার করে, বিপদসঙ্কুল যাতায়াতের পথ-ও অনায়াসে পার করে। ছেলেরা যাতে একটু ভাল থাকে, দূরের কোন বড় স্বপ্ন নেই, ছোট ছোট স্বপ্ন আর দিনের শেষে একটু

বিশ্রাম, বড় জোর রেডিওতে বেগম আখতার, আলি আকবরের গান শুনলেই চলে যায়। যদিও সন্ধ‍্যেবেলায় রেডিও চলে না, রমলার বারণ, ছেলেদের পড়ার ক্ষতি হবে। মেজছেলে বিকাশ, বড় সৃষ্টিশীল হয়েছে, সুন্দর সুন্দর মডেল তৈরী করে, যেখানে পেট্রলপাম্পে আলো জ্বলে, গাড়ি ঢোকে-বেরোয়, প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে মায়ের মুখ উজ্জ্বল করে; ওর-ই সঙ্গী পার্থ, অসম্ভব সুন্দর

আঁকে, বাড়িতে ওর কদর নেই; কিশোরশিল্পীর কদর কে করবে, অগত‍্যা রমলাকাকিমা, রঙ, তুলি, কাগজ এনে দিয়ে উৎসাহ যুগিয়ে চলে। এরকম খোলামেলা পরিবেশে

ছেলেরা মুক্তির স্বাদ পায়, দুর্গাপূজোয় প‍্যান্ডেল সাজিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। সবার কাছে পূজো মানে নতুন জামা, ঠাকুর দ‍েখার আনন্দ, রমলা সে আনন্দ ছেলেদের দেয়; নিজের আনন্দ হল- শারদীয়া পূজো সংখ‍্যা, নতুন শাড়ি না হলেও তার চলে। কোন কোন বছর

এইসময় বোনেরা আসে, তারাও উপহার হিসেবে বই আনে, হইহই করে কটা দিন বেশ কেটে যায়। রমলার রাঙা বোনটি ভারী গেছো, পেয়ারাগাছে চড়ে পেয়ারা খায় আর 

বিলোয়, একদিন ডাল ভেঙে সোজা মাটিতে, দুমাস প্লাস্টার করা পা নিয়ে কাটল দিদির বিছানায়, দিদির সেবা- শুশ্রুষায়। কলেজের পরীক্ষার পড়াও তাকে পড়ে পড়ে শোনাতে হল, এসব চমৎকার রমলার পক্ষেই সম্ভব।

সুবিমল তার বিদুষী স্ত্রীর মনের তল পায় না, খানিকটা ভালবাসা, খানিকটা শ্রদ্ধা দিয়ে মানিয়ে, গুছিয়ে নেয়।

মামাতো দেওর বদলি হয়ে আসে সুবিমলের কারখানায়,

যদিও অনেক উচ্চপদে তবুও রমলাবউদি বলতে অজ্ঞান,

দুই পরিবারের যাতায়াত, বাচ্ছাদের মেলামেশায় প্রতিদিনের একঘেয়েমি বেশ কেটে যায়। রমলার সেজছেলে রক্তিমের একদিন রাতে অ‍্যাপেনডিক্সের ব‍্যথা ওঠে, কালবিলম্ব না করে কারখানার হাসপাতালে ছোটে,

ওই মুহূর্তেই অপারেশন হয়, নাহলে অ‍্যাপেনডিক্স ফেটে যেত। ওই সময় এক মায়ের আকুতি ডাক্তারকে মুগ্ধ করে, তিনি সুচারুভাবে অপারেশন করেন, রক্তিম সুস্থ হয়। মায়ের পড়াশোনার ঝোঁক ছেলেদেরও মায়ের ওপর

শ্রদ্ধাশীল করে, তাদের খুব ইচ্ছে মা তাদের সঙ্গে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়ে নিজের অসমাপ্ত পড়া শেষ

করে। সুবিমল অবশ‍্য হোঁচট খায়, বউ পড়লে সংসার সামলাবে কে, নিজে তো সাংসারিক কাজ কিছু পারে না।

ছেলেদের পীড়াপীড়িতে অবশেষে নিমরাজী হয়। রমলার মনে আনন্দের চোরা স্রোত বয়ে যায়, নতুন সম্ভাবনার বীজ বোনে মনে মনে।


সারাদিন ঘরের কাজ সেরে রাতে বই নিয়ে তার নিবিষ্ট

সাধনা, আশেপাশের টিপ্পনী উপেক্ষা করেই এগোয় রমলা, কাজটা তার আরো শক্ত কারণ সে প্রাইভেটে পরীক্ষা দেবে। সুবিমল অবাক বিস্ময়ে দেখে রমলাকে,

এই বয়সে যখন সবাই সিনেমা দেখে, গালগল্পে মেতে থাকে, তখন এ কোন নিবিষ্ট সাধিকা। রমলার বোনেরা

পরবর্তী সময়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে কেউ কলেজে পড়াচ্ছে, কেউ ডাক্তারী পড়ছে আর রমলা প্রাইভেটে হায়ারসেকেন্ডারী পরীক্ষা দেওয়ার দোরগোড়ায়। পাড়ায়

কচিকাচাদের কিন্তু রমলাকাকিমার পরীক্ষার প্রস্তুতিতে মহা উৎসাহ; কেউ তার বাড়তি পেন্সিল এনে দিচ্ছে, কেউ

দিতে চাইছে বাড়তি খাতা। ক্রমশ পরীক্ষার দিন এগিয়ে আসে, রমলার পরীক্ষার দু-দিন আগে বিকাশের টাইফয়েড ধরা পড়ে, ছেলের ধূম জ্বরে টেমপারেচার দ‍েখা, মাথায় জলপটি দেওয়া, ছেলের শিয়রে বসে সব করে রমলা, সঙ্গে বই-এর পাতায় চোখ বোলায়। ছেলের দল পরীক্ষাকেন্দ্রে যাওয়ার সুবিধে করে দেবে বলে রমলার জন‍্য গাড়ি জোগাড় করে, সঙ্গ-ও নেয় অনেকে,

শুধু ব‍্যান্ড-পার্টিটাই যা ছিল না। সপ্তাহখানেকের মধ্যে পরীক্ষা শেষ হয়, মনে আনন্দ নিয়ে ডুবে যায় নিত‍্যকার কাজে, শুধু দুরুদুরু বুক সুবিমলের, পরীক্ষা যদি যুতসই না দিয়ে থাকে বউ, তার নাক যে সব আগে কাটা যাবে; অফিসে, পাড়ায় তাকে নিয়ে সব হাসাহাসি করবে। সবাইকে অবাক করে রমলা প্রতিটা বিষয়ে লেটার মার্কস

নিয়ে পাশ করে। বাচ্ছাদের সুন্দর একটা স্কুল তৈরী করে।
জীবনে পড়াশোনাকে কেন্দ্র করে ফাঁকা জায়গাটা ভরে।
কালের নিয়মে সুবিমল, রমলা কেউ-ই আর বেঁচে নেই, তাদের গল্প নাতি- নাতনিদের মুখে ফেরে। স্বভাবত-ই

এমন ঠাকুমাকে নিয়ে তারা গর্ব -বোধ করে, এভাবেই এক

প্রজ্জ্বলিত শিখা হয়ে রমলা থেকে যায় সকলের মনে যা

কালের গর্ভে লীন হবার নয়।

1 comments:

Gopinath Das said...

An epic reflecting on the social structure of the period.