সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.


  ছোট ডোবার ভূত                 

  ঋভু চট্টোপাধ্যায়

 

এ শহরের নতুন এক উপদ্রব এসে উপস্থিত হয়েছে, লোডসেডিং।নতুন বলতে আগে যখন কম্পানির সাথে টাউনশিপের কারেন্টটা এক ছিল তখন লোডসেডিং কাকে বলে এই অঞ্চলের মানুষ সাধারণত বুঝতই না।সারা বাংলা যখন অন্ধকারে ডুবে থাকত তখনও এই টাউনশিপে দিনের মত আলো।অন্যরা হিংসা করত।অরূপদাও হিংসে করে বলে উঠত,‘অদ্ভুত জীবন আমাদের, আমরা বিল দেব অন্ধকারেও থাকবো, আর তোমরা বিনা পয়সায় আলো নেবে।’

তোমরা বলতে সম্রাট আর তার বন্ধুরা, যেমন সোনালি,বিনোদ।তারা সবাই টাউনশিপ থেকে সম্রাটদার কাছে সায়েন্সের টিউসন পড়তে আসে।অরূপদাকে এই অঞ্চলের অনেকে দাদা বললেও বয়স পঞ্চাশের ঘরে।একটা সরকারি স্কুলে অঙ্কের শিক্ষক।আগে দূরের স্কুলে শিক্ষকতা করতে গেলেও এখন কাছেই এসে গেছেন।বহু দিন ধরেই টিউসন করছেন অরূপদা।কেউ জিজ্ঞেস করলে বলেন,‘হয়ে গেল বছর তিরিশ বত্রিশ।সেই হায়ার সেকেণ্ডারি পাশ করে আরম্ভ করেছি তো।এখন এমন অবস্থা পড়াবো না বললেও শোনে না।’

সম্রাটের দুই দাদা পড়েছে এখন ও নিজে পড়ছে।যাদের এই রকম দাদা বা দিদিরা পড়েছে তারা একটু  অতিরিক্ত সুবিধা আদায় করে।যেমন সম্রাট, পঞ্চাশ বছরের একজন মানুষকে অন্যরা যখন স্যার বলে ও অনায়াসে দাদা বলে।মজা করে, ছদ্ম ঝগড়া করে। বিশেষ করে ওদের টাউনশিপে কারেন্ট যাওয়ার কথা বললেই সম্রাট রেগে যায়।সেদিনও রেগে গিয়ে ছদ্ম ঝগড়া আরম্ভ করল।এদিকে কারেন্ট নেই, অন্য দিকে ঝগড়া, অন্য সবাই একটু বিরক্ত হলেও কিচ্ছু করবার নেই।সেদিন আবার কোন কারণে ইনভার্টারও চলছিল না।বিনোদরা হঠাৎ করে আবদার করে বসল,‘স্যার, আজ আর পড়াতে হবে না।এমনিতেও আমাদের সিলেবাস প্রায় শেষের মুখে, দুটো চ্যাপ্টার বাকি….’

–তিনটে।পাশ থেকে তন্ময় বলে উঠল।ত্রিকোনামিতির হাইট অ্যান্ড ডিসটেন্সের একটা চ্যাপ্টার বাকি আছে।

-পরীক্ষারও অনেক দেরি।সব চ্যাপ্টারগুলোই বার পাঁচেক রিভিসন হয়ে যাবে।

–না না, আমি সে কথা বলছি না।তুই কটা বাকি জিজ্ঞেস করছিলি, তাই বললাম।

অবস্থা একটু উত্তপ্ত দেখে অরূপদাই একটু জোরে বলে উঠল,‘এই তোরা থাম তো, কোন ফাঁকি বাজি হবে না। আমি টেস্ট পেপার থেকে  অঙ্ক দিচ্ছি….।’

শেষের কথাগুলো শেষ করবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা একসঙ্গে সবাই চিৎকার করে উঠলাম,‘না হবে না।আজ গল্প শোনাতেই হবে।আজ আর পড়ব না।’

অবস্থা আয়ত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখেই অরূপদাও ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে বলে ।’ আমাদের শান্ত করবার চেষ্টা করলেও আমরা কেউই কোন কথা না শুনে আবার চিৎকার আরম্ভ করলাম।‘গল্প বলুন/ গল্প বল।’

-ঠিক আছে গল্প বলব।কিন্তু একটা কণ্ডিসন।এই রবিবার সকাল সাড়ে নটা থেকে অ্যালজ্যাবরার পাঁচটা চ্যাপ্টারের টেস্ট দিতে হবে।

–পাঁচটা! একটু কমান স্যার।সুনেত্রা বলে উঠল।

-তাহলে নো গল্প।

আমরা কিছু সময়ের জন্য সবাই চুপ করে গেলাম।তারপর বিনোদই বলে উঠল,‘ওকে, ডান। পাঁচটা চ্যাপ্টারের টেস্ট দেব। কিন্তু আজ গল্প হবে।’

-কিসের গল্প বলব, তোরা তো সব শুনেছিস।

–একটু ভাবো, দেখো কিছু না কিছু একটা মনে চলে আসবে।

–তবে স্যার ভূতের গল্প বলবেন না।সোনালী একটু কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠল।

 ‘না না ভূতের গল্পই হবে।’ আমি বললাম।

-না স্যার, আগের বছর ইংরেজির স্বরূপ স্যার একটা ভূতের গল্প বলেছিলেন।আমার বাড়ি গিয়ে জ্বর এসে গেছিল।

–তুই কানে আঙুল দিয়ে থাকবি।

আমি একটু জোরে কথাগুলো বলে উঠতেই আমার কথা শুনে প্রায় সবাই বলে উঠল,‘হ্যাঁ স্যার, ভূতের গল্পই হবে। অন্য কিছু নয়।এই আবহাওয়াতে ভূত ছাড়া অন্য কিছু মানাবেই না।

“তখন হুগলির একটা গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা আরম্ভ করেছি।” অরূপদা আরম্ভ করল।“গ্রামটা এমনিতে বেশ ভালো, বাস স্ট্যাণ্ড, বাজার সব কাছেই।স্কুলটাও বেশ বড় ছিল।কিন্তু সমস্যা হল আমার এই শহর থেকে প্রতিদিন যাতায়াত করা যাবে না।গ্রামের দিকে মাস্টার হোক বা অন্য কেউ, অবিবাহিতদের অতটা সহজে কেউ ঘর ভাড়া দিতেন না।আমিও স্কুলের হেড মাস্টার মশাইএর সাহায্যে একটা ঘর পেলাম বটে কিন্তু ঘরটা এক্কেবারে গ্রামের শেষ প্রান্তে, এবং স্কুলের ঠিক উল্টো দিকে।”

-স্যার আপনি তখনই বিয়ে করে নিতে পারতেন।সুরূপা কথাগুলো বলে উঠল।

আমাদের মধ্যে ও একটু বেশি ফাজিল।স্যারের সাথে এই রকম ইয়ার্কি করে দেয়।তবে এ যাত্রায় আমরা ওকে তাড়াতাড়ি থামিয়ে দিলাম।অরূপদা আবার আরম্ভ করল।

“সকালে ঘরটা দেখে আমার বেশ ভালোই লাগল।চারদিকে গাছ, দিনের বেলাতেও বেশ ঠাণ্ডা। ঘরটার পিছনের দিকে একটা ছোট পুকুরও আছে।হেড মাস্টার মশাই নিজে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে কালিপতি বাবু মানে ঘরটার মালিকের সাথে আলাপ করাতে নিয়ে গেলেন।আমাকে দেখে ভদ্রলোক বলে উঠলেন, ‘ এই প্যাঁকলা মত ছেলেটা মাস্টার!’ তারপর হেডমাস্টার মশাইকে বললেন, ‘তোমার কথা শুনে আমি তো অন্য কিছু ভেবেছিলাম।এই বাড়িতে ও থাকতে পারবে না।অসম্ভব।’কেমন যেন আাঁতে ঘা লেগে গেল। বলে উঠলাম,‘কেন? আমাকে কি দেখতে খারাপ?’

–না না, ছিঃ ছিঃ।ও কথা নয়, আসলে এই ঘরটা….।

–শোনো কালি, এই অরূপ দেখতে বাচ্চা হলেও অঙ্কে এম.এস.সি করে ফেলেছে।শুধু করেছে নয়, এক্কেবারে ফাস্ট ক্লাস পেয়েছে।

ভদ্রলোক কেমন যেন মন মরা হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে একটা ঢোঁক গিলে বললেন,‘ভালো।’ তবে ঘরটার জন্য আমাকে কোন ভাড়া দিতে হবে না।কালিপতিবাবু আমাকে বললেন।ইলেকট্রিক বিল যা লাগবে হেডমাস্টার মশাই বললেন সেটাও স্কুলের ফাণ্ড থেকে ম্যানেজ করে দিয়ে দেবেন।একটু অবাক হয়ে ‘কেন?’ জিজ্ঞেস করতেই হেড মাস্টারমশাই উত্তর দিলেন,‘দ্যাখো, নেহাৎ আমাদের গ্রামে বাড়ি ভাড়া দেবার কোন রীতি নেই, তার উপর আবার ব্যাচেলার, না হলে গ্রামের ভিতরেই থাকতে পারতে।এবার একটা বড় ছুটি দেখে তাড়াতাড়ি একটা বিয়ে করে নাও, আরাম করে গ্রামের  ভিতরেই থাকবে।তখন যা হোক একটা ভাড়া নেওয়া যাবে।এখন এখানে এমনিই থাকো।’ সব কিছু ভালো ভাবেই মিটছিল।শেষকালে হেডমাস্টার মশায়ের একটা কথা আমাকে কেমন যেন ভাবিয়ে তুলল।”

-কি কথা, কি কথা ? আমাদের বিনোদ জিজ্ঞেস করে উঠল।

-দাঁড়াও বলছি।

অরূপদা বোতল থেকে একটু জল গলায় ঢেলে আবার আরম্ভ করল।“হেড মাস্টার মশাই হঠাৎ বলে উঠলেন,     ‘রাতের দিকে খুব একটা ঘরের বাইরে এসো না।ঘরেই থাকবে।’ আমি একটু অবাক হয়ে ‘কেন?’ জিজ্ঞেস করলে স্যার উত্তর দিলেন,‘আসলে গ্রামের এক্কেবারে শেষ প্রান্তে তো, চোর ডাকাতের উৎপাত আছে।’

‘শোনো মাস্টার, তোমাকে খুলেই বলছি, এই ঘরটা আমার দাদু করে ছিল, শ্মশানের যাত্রিদের জন্য।রাতে, বা ঝড় বৃষ্টিতে কারোর যাতে কোন আসুবিধা না হয়।

-শ্মশান! এটা শ্মশান?

-না মাস্টার তোমার কোন চিন্তা নেই।এখন আর কেউ এখানে মরা পোড়ায় না।তারপর ঘরের পিছনের ডোবাটার দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘ওটা একটা বড় দীঘি ছিল, এখন ছোট হয়ে ডোবা করে দিয়েছি।আমিও ঘরটাকে চাষের কাজে ব্যবহার করি।ঐ দ্যাখো কত সব্জি লাগিয়েছি।’ আমি তাকিয়ে দেখে বোঝার চেষ্টা করলাম।

সেদিন স্কুলে কোন একটা কারণে ছুটি ছিল।আমি দুপুরেই স্কুলের একটা ঘর থেকে আমার সঙ্গের জিনিসপত্রগুলো এই নতুন ঘরটাতে নিয়ে এলাম।প্রথম দুদিন তো স্কুলের একটা ঘরেই থাকছিলাম।দুপুরে হেড মাস্টার মশায়ের  বাড়িতে নিমন্ত্রণ ছিল।খেতে বসিয়ে বৌদি কয়েকটা কথার মাঝে বলে উঠলেন,‘তুমি ব্রাহ্মণ হলে আমাদের ঘরেই থাকবার ব্যবস্থা করে দিতাম।আসলে গ্রাম তো, আমাদের মেয়েও বড় হয়ে গেছে।কথা উঠলে আর বিয়ে হবে না।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম,‘না না সে ঠিক আছে, আমি একা ঠিক থেকে যাবো।”

অরূপদার কথাগুলো শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই আবার সুরূপার গলা ঝাড়ার আওয়াজ পেলাম।আমাদের ভয়ে হয়তো কিছু বলল না।অরূপদা কিছু সময় চুপ থেকে আবার বলতে আরম্ভ করল।

“হেডস্যারের বাড়িতে খেয়ে আমার নতুন বাসায় চলে এলাম।স্যার একটা পুরানো সাইকেলের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেটা নিয়ে যাতায়াত করতাম।বাসায় এসে টুকটাক গোছগাছ করেই দুপুরের দিকে চোখটা টেনে এল। সময় নষ্ট না করে শুয়ে পড়লাম।যখন ঘুম ভাঙল দেখি চারদিকে সন্ধে নেমে গেছে।আমার সেই ছোট থেকেই সকাল সন্ধে চা পানের অভ্যাস।একটা স্টোভের ব্যবস্থাও করে নিয়ে ছিলাম।চা তৈরী করবার সময়েই দেখি চারদিকের অন্ধকারটা গাঢ় হতে আরম্ভ করেছে।হয়ত গ্রামের এক্কেবারে শেষপ্রান্তে জনমানবহীন জায়গা বলে আমার ওরকম মনে হল।চা বানিয়ে বেশ আরামে ঘরটার পিছনে থাকা একটা জানলার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা পান করছি হঠাৎ সামনের ডোবাটাতে চোখ যেতেই চমকে উঠলাম।ভুল দেখলাম নাকি? আরেকবার দেখলাম।হ্যাঁ, ঠিকই তো একজন বসে আছেন।ঘন অন্ধকার, তার উপর লোকটা জানলার দিকে পিছন করে বসে আছেন।কিন্তু এখন এই ডোবার ধারে বসে বসে কি করছেন? খুব কৌতূহল হল আমার।সেই সঙ্গে একটু আনন্দও হল, ‘যাক কারোর সাথে তো কিছু সময়ের জন্য হলেও গল্প করতে পারবো।’ একপা একপা করে ঘরের পিছন দিকে পৌঁছে গেলাম। তখনও বসে ছিলেন।শুধু একটা গাছের আড়ালে মাথাটা থাকবার কারণে আমি শুধু পিঠটা থেকে দেখতে পেলাম। চারদিকটা একবার দেখে নিলাম।এক্কেবারে মিশকালো।আর একটু এগোতে যাবো এমন সময় ওখান থেকেই একটা গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম,‘আর এগোবেন না।পড়ে যাবেন।’

চমকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম।কিছু সময় পরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি গেলেন যে ?’

–আমি গ্রামের, আপনি তো শহরের মানুষ, কিভাবে এই ডোবাতে অন্ধকারে নামতে হয় জানেন না।

-আমি কি এখান থেকেই আপনার সঙ্গে একটু গল্প করতে পারি ?

-না।

গলার আওয়াজে শরীরটা কেমন যেন কেঁপে গেল।আর কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়লাম।কিছু ক্ষণ পর আবার গলা শোনা গেল,‘বললাম ঘরের ভিতর চলে যান।দাঁড়িয়ে আছেন কেন ?’

বুঝতে পারলাম না আমি যে তখনও ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম কিভাবে ঐ ভদ্রলোক বুঝতে পারলেন? কোন কথা না বলে টুকটুক করে ঘরে গিয়ে ভিতর থেকে দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দিলাম।ভাবলাম হয়ত কোন মাতাল এখানে বসে আছে।আমি থাকলে ওনার নেশাতে অসুবিধা হচ্ছে। আমি যে স্কুলের মাস্টার সেটা জেনে গেছেন।যদি কাউকে বলে দি।’ ঘরের ভিতরেই বসে বসে কিছু একটা বই পড়ছিলাম।হঠাৎ বাইরের উঠানটা দিয়ে একটা সাইকেল পেরোনোর আওয়াজ পেলাম।একটু অবাকই হলাম।আমার সাইকেলটা তখন ঘরের একটা কোণে রাখা ছিল। সাইকেলটা বেশ কয়েকবার উঠোনের এদিকে সেদিকে গেল।তারপর সাইকেলটা রাখবার আওয়াজ পেলাম।দরজার কাছে দাঁড়ালাম।একটু ভয় করছিল।চোর ডাকাত নয় তো! দরজার সামনে সাইকেলটা রেখে দিলাম যাতে দরজাটা সহজে খোলা না যায়।না কোন পায়ের আওয়াজ পেলাম না।ভয়ে আমার হাত পা ততক্ষণে কাঁপতে আরম্ভ করেছে। জানলায় উঠে গিয়ে ডোবাটার দিকে তাকিয়ে দেখব সে ক্ষমতাও আর নেই।চারদিক থেকে একটা কেমন গন্ধ আসতে লাগল।ঘরের ভিতরের আলোটা আগেই নিভিয়ে ফেলেছিলাম।হাতে টর্চ আছে, ঘরের ভিতর একটা লাঠি ছিল সেটাই হাতে শক্ত করে চেপে দরজার পিছনটাতে দাঁড়িয়ে থাকলাম।কতক্ষণ ছিলাম জানিনা হঠাৎ বাইরে থেকে  একটা গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম, সঙ্গে আরো অনেকের গলার আওয়াজও পেলাম।একটু সম্বিৎ ফিরলেও দরজাটা বাইরে থেকে খোলবার সাহস পেলাম না।ঐ জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকলাম।কিছু সময় পর ঘরের পিছনের থেকে অনেকগুলো টর্চের আলো পিছনের জানলা দিয়ে ঘরে এসে পড়ল।সবাই বলতে লাগল,‘দরজা খুলুন, আমরা সব গ্রামের লোক।’ আমি সাহস নিয়ে দরজাটা খুলতেই দেখি হেড মাস্টারমশাই সহ গ্রামের অনেকেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখতে পেয়েই বলে উঠলেন,‘চলুন চলুন, আপনাকে আর এখানে থাকতে হবে না। গ্রামে আমাদের সবাই খুব অপমান করছে।কিছু হয়ে গেলে গ্রামের লোক কারোর কাছে মুখ দেখাতে পারবো না।একজনের বাড়িতে আজ রাতটা থাকুন কাল সকালে আরেকটা ব্যবস্থা করছি।’

স্যারের সঙ্গে যারা এসেছিলেন তারাই আমার জিনিসপত্র আমার সাইকেলটাতেই চাপিয়ে নিলেন।

পরের দিন যথারীতি স্কুলে যেতেই আমাকে হেডস্যারও অন্যান্য স্যাররা গতরাতের অভিজ্ঞতা কিছু বলতে বললেন।  কোন একটা কারণে কালিপতিবাবুও তখন স্কুলে ছিলেন।আমি প্রথমেই গতরাতে শোনা সাইকেলের আওয়াজের কথা বললাম।ডোবার ধারে বসে থাকা সেই লোকটার কথা বলতেই সবাই চমকে উঠল।আমি তাদের সব কিছু বলবার পর শেষে বললাম,‘ভদ্রলোকের মুখটা দেখতে পাই নি।শুধু পিঠটা দেখতে পেয়েছিলাম।’

শেষের কথাগুলো শুনেই হেড মাস্টার মশাই মুখটা ছোট হয়ে গেল।আমার কথাগুলো শুনে কালিপতিবাবুর দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তেই আমিও কিছু না বুঝে ওনার মুখের দিকেই হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।হেড মাস্টার মশাই বললেন,‘ যিনি বসে ছিলেন তিনি কালিপতি বাবুর নিজের ভাই।’

 –ও তাই! কিন্তু কাল রাতে ওরকম করলেন কেন? আজ একবার ওনার সঙ্গে দেখা করব। কোথায় পাবো বলুন তো।

-আপনি ওনার মুখ দেখতে পান নি তো? পেতেনও না। বেশ কিছু বছর আগে একটা রাজনৈতিক সংঘর্ষে কারা যেন ওর ঘাড় থেকে আলাদা করে দেয়। বেঁচে থাকাকালীন প্রতি সন্ধেই সাইকেল চেপে ঐ দীঘিতে মাছ ধরতে যেত।’

এরপর আর আমি কিছু শুনতে পাই নি।জ্ঞান ফেরে পরের দিন সরকারি হাসপাতালের বিছানাতে। ”


গল্পটা শেষ হয়ে যাবার পর কিছুক্ষণ কেউই কোন কথা বলতে পারলাম না।তখনও কারেন্ট না আসাতে সেদিনের মত আমাদের টিউসন একটু তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেলেও সবাই কারেন্ট আসার অপেক্ষায় বসে থাকলাম।স্বীকার করতে দোষ নেই অরূপদার গল্প শুনে আমরা সবাই কম বেশি ভয় পেয়েছিলাম।আর সোনালি! তার কথা থাক। বললে অনেকেই বিশ্বাস করবে না।

0 comments: