সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
পিছুটান
স্বর্নব দত্ত
বিকাল সাড়ে পাঁচটা, অফিসে কাজ শেষ করে সবাই তখন বাড়ী ফেরার পথে,তবে সুমিত আজ একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছে, আজ একটা বিশেষ দিন,তার পাঁচ বছরের ছেলে শুভদীপের জন্মদিন,অনেক কাজ বাকি আছে, হয়তো অতিথিরা বাড়িতে আসতে শুরু করে দিয়েছে,সবাই রাতে খাওয়া দাওয়া করবে, প্রায় একশো জনের মতো অতিথি নিমন্ত্রিত।
শুভদীপ আজ প্রায় পাঁচবার ফোন করেছে শুধু একটাই কথা "বাবা কখন আসবে,আজ তাড়াতাড়ি চলে এসো",কিন্তু সেটাই বাঁধ সাধলো একরাশ কালো মেঘের দল,খুব জোড়ে বৃষ্টি নামলো অগতায় আর বাইক চালানো গেল না,কিছুটা গিয়ে একটা বাসস্ট্যান্ডের পাশে বাইক রেখে বাসস্ট্যান্ডের ভিতরে গিয়ে দাড়ালো,নির্জন রাস্তা,লোকজন তেমন নেই বললেই চলে,শুধু গাড়ীগুলো ঝড়ের বেগে কাদা ছিটকে চলে যাচ্ছে,একটা সিগারেট ধরালো সুমিত,হঠাৎ চোখ পড়ল রাস্তার ঠিক উল্টো দিকের বাসস্ট্যান্ডে,একটা ছেলে দাড়িয়ে রয়েছে,তবে ছেলেটা আর পাঁচটা ছেলের মত স্বাভাবিক নয়,মানসিক ভরসাম্যহীন,এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুমিতের দিকে,পকেট থেকে রুমালটা বের করে চশমা পরিষ্কার করে সেটা পরে ভালো করে দেখে তখন তার হৃৎপিন্ডের বেগ হটাৎ যেন বেড়ে যায়, মেরুদন্ড বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বইয়ে যায়,মুখ দিয়ে কাঁপা গলায় বেরিয়ে আসে"অ..র্ক,ফিরে এলো কি করে, ও কি এবার বদলা নিতে এসেছে!না এটা হতে পারে না",পকেট থেকে ফোনটা বের করে ঘরে ফোন করে, ওপাশ থেকে মৃন্ময়ীর গলা,"
কথায় আছো,এত বৃষ্টিতে অফিস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে না, বৃষ্টি থামলে এসো",মৃন্ময়ীর কোনো কথার উত্তর না দিয়ে সুমিত জিজ্ঞেস করে"শুভ কোথায়,কি করছে?,ওকে তুমি তোমার পাশে,চোখে চোখে রেখো,ওর খুব বিপদ","কি উল্টো পাল্টা বলছো,কি বিপদ,ও আমার পাশেই বসে আছে তোমার অপেক্ষায়, ইয়ারকি কর না,তার মানে তুমি কি চলে এসেছো,বাড়ীর গেটের কাছে এসে ফোন করছো" ।এই বলে ফোনটা কেটে দেয় মৃন্ময়ী।আবার ফোন করতে গেলে আর ফোন লাগে না,চারিদিকে ঠান্ডা বাতাস বয়ে চলেছে কিন্তু সাড়া শরীরে ঘামে ভিজে গেছে সুমিতের,কিছুক্ষনের জন্য অতীতের কিছু কথা মনে পড়ে যায় সুমিতের,বছর দশেক আগে কথা মৃন্ময়ীকে বিয়ে করার একবছর পর তাদের কোল আলো করে পৃথিবীতে আসে আর্কদীপ। দুজনের জীবনে আসে পরিবর্তন,খুব সুন্দর দিন কাটতে থাকে তাদের, কত স্বপ্ন,কত আশা নিয়ে কেটে যায় তাদের জীবন। তাদের সম্পর্কের একটা নতুন বাঁধন সৃষ্টি হয় অর্ক আসার পর,কিন্তু সেই আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হল না,ছয়মাস বয়স থেকে তারা কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার লক্ষ্য করে অর্কর মধ্যে। সে আর পাঁচটা ছেলের মত নয়,শুরু হয় হাজার ডাক্তার দেখানো,কিন্তু সব জায়গা থেকে নিরাশ হতে হয় তাদের,জন্মের সময় থেকেই মাথায় নার্ভের প্রবলেম তাই সুস্থ হওয়া সম্ভব নয়,কিছু সময়ের জন্য নিরাশ হয়ে যায় তারা,কিন্তু আবার ঘুরে দাঁড়ায়।
অর্ককে যে ভাবে হোক সুস্থ করে তোলার চেষ্টা শুরু হয় দুজনের অক্লান্ত পরিশ্রম, অর্ক হয়ে ওঠে নয়নের মণি,কিন্তু অর্কর বয়স যখন পাঁচ তখন তাদের জীবনে আসে তাদের দ্বিতীয় সন্তান শুভদীপ,আস্তে আস্তে ভাগ হয় ভালোবাসায়,অর্ক সেটা বুঝতে পারে,কিন্তু তার কাছে সেটা মেনে নেয়া সম্ভব হয় নি,তার মধ্যে শুরু হয় তার ভাইয়ের উপর প্রতিহিংসা,আস্তে আস্তে খিটখিটে হয়ে ওঠে সে,মা বাবাকে সে আরো বেশি কাছে পেতে চাই,কিন্তু মা বাবা ব্যস্ততা তখন শুভদীপকে নিয়ে,কারণ সে ছোটো,কিছু দিন পর সেই প্রতিহিংসা মারাত্বক রূপ নেই। একদিন সুমিত অফিসে মৃন্ময়ী রান্নাঘরে ব্যস্ত ঠিক এইসময় অর্ক,শুভদীপের গলা চেপে ধরে,কিন্তু কোনো কারণে মৃন্ময়ী এসে পড়ায় সে যাত্রায় বেঁচে যায় সে,তারপর আবার একদিন সেই চেষ্টা,শত বোঝানোর পরও সেই প্রতিহিংসা কমে না,অবশেষে দুজনে শুরু করে লাভ ক্ষতির অঙ্ক, ডাক্তারের পরামর্শে অর্ককে রেখে আসে মানসিক হাসপাতালে,প্রথমে দুদিন পর পর দুজনে তাকে দেখে আসতো,তারা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল অর্কর বাড়ী ফেরার আর্তনাদ,কিন্তু তখন কিছু করার সামর্থ্য ছিল না।
তারপর আস্তে আস্তে টানটাও যেন কমে গেল,মাসে একবার সময় হয় তাকে দেখতে যাওয়ার,মা বাবাকে না দেখতে পাওয়ার শোকে জীবন শক্তি হারিয়ে ফেলে অর্ক,একদিন হাসপাতাল থেকে শেষ খবর আসে,দুঃখের মাঝে একটা বোঝা হালকা হওয়ার অনুভব করে সুমিত আর মৃন্ময়ী যেন পিছুটান মুক্ত হয় তারা,হয়তো নাম তাও মনে নেই তাদের,শুভদীপকেও অর্ক নিয়ে বেশি কথা তারা বলে নি।
হটাৎ ফোনটা বেজে ওঠে,মৃন্ময়ী করেছে তাড়াতাড়ি রিসিভ করে সুমিত,ওপাশ থেকে শুভদ্বীপের গলা, আধো আধো গলায় বলছে,"বাবা তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো, আমার সব বন্ধুরা চলে এসেছে",শান্ত হয়ে জবাব দেয় সুমিত" এইতো চলে এসেছি বাবা,আর মাত্র দু-মিনিট, তুমি একটু বন্ধুদের সাথে খেলো, আমি আসছি",ফোনটা রেখে দিয়ে সুমিত দেখে বৃষ্টি কিছুটা থেমেছে রাস্তার ওপাশটা এখন বেশ স্পষ্ট, কথায় সে ছেলেটা! নীরবে বিদায় নিয়েছে ,দু একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে সেখানে,হয়তো চোখের ভুল অথবা মনের ভুল তার কারণ আজ সাড়াদিন অর্কর কথা মনে পড়েছে তার,বাইক নিয়ে বাড়ীর দিকে রওনা দেয় সুমিত,একবার ফিরে তাকায় কাউকে সে খুঁজে পায় না হয়তো ইতিহাসের ভিড়ে সে হারিয়ে গেছে।
0 comments:
Post a Comment