সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

 দেশে ফেরা 

অঙ্কুর রায় 


আজকে পাঁচটা ছেলেমেয়ের ইন্টারভিউ নেওয়া আছে । এটাই আমার কাজ । গত পাঁচ বছর ধরে এই কোম্পানির জন্য উজ্জ্বল ছেলেমেয়ে সংগ্রহ করে চলেছি। বি টেক , এম টেক , এম বি এ পাশ করা সব ঝকঝকে ছেলেমেয়ে। আমিও একদিন এদের মতই ছিলাম । সদ্য কলেজ পাশ করা , রোদের গন্ধমাখা একটা ছেলে । ভালো থেকে আরো ভালো কোম্পানিতে ইণ্টারভিউ দিতাম সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উঠবার জন্য । কোন কোম্পানিই আমায় ফেরায়নি । আমিও একটার পর একটা পাহাড় টপকে আরো উঁচু পাহাড়ে উঠে গেছি । কুড়িটা বছর ধরে পাহাড় চড়তে চড়তে হয়তো একটু ক্লান্ত হয়েই থিতু হয়েছি এই বিশাল উঁচু কোম্পানির সর্বোচ্চ শৃঙ্গে । জানি না আর কতদিন এখানে থাকবো । আরো উঁচু কোন পাহাড় দেখতে পেলেই আমার আবার সেটা জয় করার ইচ্ছে জেগে উঠবে কিনা আমি সত্যিই জানি না । আপাতত বছর পাঁচেক এখানেই থিতু হয়ে আছি ।

আমার সাথে ইণ্টারভিউ বোর্ডে আরো জনা তিনেক থাকে কিন্তু তারা থাকতে হয় বলেই থাকে । আমার থাকাটাই আসল থাকা । কারণ আমার ঘাড় নাড়া দিয়েই ঠিক হয় কাকে নেওয়া হবে আর কারা বাদ যাবে । আমার অ্যাকাডেমিক রেকর্ড , চাকরির এক্সপেরিয়েন্স , বয়স আর লোক চেনার ক্ষমতাকে কোম্পানি ভরসা করে । আজ পর্যন্ত আমার কোন রিক্রুট খারাপ হয়নি । এখন আমার সাথে যারা বোর্ডে বসে তারাও আমারই রিক্রুট ।

কম্পিউটারটা অন করলাম । অনলাইনে ইণ্টারভিউ হবে । প্রথম যে ছেলেটি আছে অভিজ্ঞান ঘোষ , দুর্ধর্ষ তার অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার । ব্যাঙ্গালোরের একটা বিরাট আই টি কোম্পানির বেশ উঁচু পদে আছে । দেখতে পাচ্ছি লাস্ট মান্থে ও ছয় অঙ্কের সংখ্যা স্যালারি ড্র করেছিল । কী হল ? আমরা তো যেই পোস্টের জন্য ইণ্টারভিউ নিচ্ছি সেখানে পাঁচ অঙ্কের বেশি দেব না । বড় চাকরি ছেড়ে কলকাতায় কম টাকার মাইনেতে চলে আসতে চাইছে কেন ? বাড়িতে বুড়ো বাবা মা ? উঁহু , কেউ তো এমন করে না । হোমসিকনেস ? হতে পারে । নাকি ওখানে অন্য কোন সমস্যা ? খোঁজ নিতে হবে তো । 

এসব ভাবতে ভাবতেই স্ক্রিনে ছেলেটার মুখ ভেসে উঠলো । প্রথম নজরেই আমার ভিতর থেকে অভিজ্ঞতা বলে উঠলো এই ছেলেটাকে নিতেই হবে। আমি অন্য কাউকে কথা শুরু করতে না দিয়ে প্রথমেই সেই প্রশ্নটায় চলে এলাম । মনে মনে জানি উত্তর যাই হোক এই ছেলেটাকে আমার চাইই চাই। বললাম মি. ঘোষ আপনি কি জানেন যে এই চাকরিতে আপনি জয়েন করলে আপনার ডিমোশান হবে ?

- না স্যার প্রমোশন হবে বলেই তো অ্যাপ্লাই করেছি।

- কী করে ? লাস্ট মান্থে আপনি দেড় লাখ টাকা স্যালারি পেয়েছেন । আর এখানে জয়েন করলে আপনি এইট্টি ফাইভ থাউজেন্ড স্যালারি পাবেন । 

- তবুও স্যার এটা আমার কাছে একটা লিফট ।

- মানে ? আপনি ভেবেচিন্তে কথাটা বলছেন তো ?

দেখছি রাজীব , সুরজিত , অনিরুদ্ধও বেশ অবাক হয়ে গেছে । সুরজিত কিছু একটা বলতে গিয়েও বললো না ।

- হ্যাঁ স্যার আমি ভেবেচিন্তেই কথাটা বলেছি ।

সুরজিত এবার ওর প্রশ্নটা করেই ফেললো - আপনার ঐ অফিসে কোন সমস্যা হচ্ছে কি ?

- না স্যার কোন সমস্যা নেই । ইন ফ্যাক্ট নেক্সট মান্থে আমার প্রমোশন ডিউ আছে । আমার ম্যানেজার হবার কথা আছে ।

আমি জিজ্ঞেস করলাম - তাহলে নিশ্চয়ই পারিবারিক সমস্যা বা হোমসিকনেস ?

- না স্যার তা ও ঠিক নয় ।

এবার অধৈর্য হয়ে বলে ফেললাম - তাহলে প্লিজ এক্সপ্লেইন করুন বিষয়টা ঠিক কী । কেন আপনি এত বড় একটা পোস্ট ছেড়ে কম মাইনেতে এই কোম্পানিতে জয়েন করতে চাইছেন ?

- স্যার কলকাতা আমার হোম টাউন ।

রাজীব যেন আসল উত্তরটা পেয়ে গেছে এমন করে বললো - তাহলে আপনি হোম টাউনে ফিরতে চান ?

- হ্যাঁ স্যার ।

আমি বললাম - শুধু এটাই কারণ ? আপনি শুধু হোম টাউনে ফিরতে চান বলে এত বড় পোস্ট স্যাক্রিফাইস করে চলে আসছেন ? আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না !

- আমি কোন স্যাক্রিফাইস করছি না স্যার ।

- তবে ?

- স্যার লাস্ট মান্থে আমি টানা আটচল্লিশ ঘন্টা ড্রাইভ করে কলকাতায় আসতে বাধ্য হয়েছিলাম ।

- আই সি । কিন্তু কেন ?

- লাস্ট মান্থে যখন হঠাৎ করে দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা হল তখন আমি দেখলাম ব্যাঙ্গালোরে আমি একা । এমনকি অফিসও বন্ধ। ওয়ার্ক ফ্রম হোম । আমি ভাবলাম ব্যাঙ্গালোরতো আর আমার হোম নয় । তাহলে হোমেই ফেরা যাক কলকাতায় । ওখানে আমি একা একা কী করবো ? পাশে একটা লোক নেই , ফ্ল্যাট থেকে বেরোনোর উপায় নেই । কলকাতায় আমার বাড়ি আছে , পরিবার আছে , আত্মীয়-বন্ধু আছে । ফেরার পথে দেখলাম দলে দলে লোক হাঁটছে । বাচ্চা, বৃদ্ধ , শিশু কোলে মা সবাই বাড়ি ফিরছে । আমি গাড়িতে , আমার সেই সামর্থ্য আছে , টাকা আছে বলে । আর ওরা খেটে খাওয়া সাধারণ শ্রমিক , ওদের অর্থ নেই , সামর্থ্য নেই তাই ওরা হাঁটছে । কিন্তু আমরা সবাই বাড়ি ফিরছি । সবাই। এই কঠিন সময়ে নিজের দেশে ফেরার কথাই আমাদের সবার মনে হয়েছে - মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এক্সিকিউটিভ থেকে শুরু করে মজুর , সবার । আমি সেদিনই ঠিক করে ফেলেছিলাম দরকার নেই আমার বড় চাকরির , দরকার নেই অনেক টাকার । বিপদের দিনে যেখান থেকে পালাতে হয় থাকবো না আর সেখানে । আমি কলকাতায় ফিরে আসবো । মাইনে কম পাই , নিজের বাড়ি তো পাব । আমার জন্য আমার নিজের দেশই ভালো । এখান থেকে অন্তত পালাতে তো হবে না ।

আমি এতদিন ধরে ইণ্টারভিউ নিচ্ছি এমন উত্তর আমি কখনও শুনিনি । এরপর কী বলা উচিত আমি বুঝতে পারলাম না ।

0 comments: