সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
করুণাধারা
অনীত কুমার গঙ্গোপাধ্যায়
‘এই মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে,
এসো না গল্প করি’
দ্রিমি দ্রিমি করে জ্যাজের ড্রাম বাজছে। স্বল্পবসনা বার ড্যান্সার মিস নূপুর তার সমস্ত অঙ্গে হিল্লোল তুলে নাচছে। শ্যামলী হাতের করতালে তাল দিয়ে গান গাইছে। ওদিকে উত্তমকুমার রঙ্গীন পানীয়ের গ্লাসে ঠোঁট রেখে তার বিলোল দৃষ্টিতে মিস নূপুরের দিকে তাকিয়ে আছে। মিস নূপুরের নৃত্য দ্রুততর হচ্ছে। শ্যামলীর গানের তাল বাড়ছে। জ্যাজের ঝংকার লয় বাড়াচ্ছে। শ্যামলীও গানের তালে পা ফেলছে দ্রুততালে। উত্তমকুমার দাঁড়িয়ে উঠে মৃদু হাততালি দিচ্ছে। হঠাৎ খন্ খন্ শব্দে সব দৃশ্য দূরে সরে যায়। “ছিনাল মাগি, ঘুমের ঘোরেও নাচছে। কি করতে যে পয়সা দিয়ে এমন আয়া রেখেছে দীপু, বুঝে পাইনা বাবা। সেই থেকে বলছি, দে বেডপ্যানটা দে, শুনতেই পায়না।” ক্ষেমঙ্করী চেঁচিয়ে বলতেই থাকে। শ্যামলী তাড়াতাড়ি বেডপ্যানটা ক্ষেমঙ্করীর নিম্নাঙ্গের নিচে ধরে।
ওদিকে চেঁচামেচি শুনে ক্ষেমঙ্করীর বড় ছেলে দীপঙ্কর লুঙ্গির কষি আঁটতে আঁটতে ঘরে ঢোকে। ঘুম থেকে উঠে এসেছে, মেজাজ খারাপ। রুষ্টভাবে বলে, “দেখো শ্যামলী, রাত্তিরে তো কোন কাজ নেই। শুধু মাঝে মাঝে বেডপ্যান দেওয়া আর মার দিকে একটু লক্ষ্য রাখা। তুমিও যদি ঘুমিয়ে পড়ো, তো তোমাকে রেখে লাভ কি?” শ্যামলী লজ্জিতভাবে বলে, “ঠিক আছে দাদা, আর হবে না।” দীপঙ্কর ঘরে চলে যায়, ক্ষেমঙ্করীও খানিকক্ষণ গজগজ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে।
বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল শ্যামলী আয়ার কাজ ধরেছে। রাত্রে থাকার কাজটাই ও বেশি নেয়। দিনের বেলায় সেলাই মেশিন চালিয়ে একটু বেশি রোজগার হয়। যা দিনকাল, হাবাগোবা ছেলেটাকে নিয়ে খরচ চালানো কষ্টকর।
‘তখন তোমার একুশ বছর বোধহয়,
আমি তখন অষ্টাদশীর ছোঁয়ায়’
সত্যিই আঠারো বছর বয়সটা একটা অদ্ভুত সময়। হঠাৎ করে কাউকে দেখলে বুকটা ছলাৎ করে উঠতো। নিজেকে সুন্দর করে সাজাতে ইচ্ছে করতো। বারবার আয়নায় ঘুরে ফিরে নিজেকে দেখা। ভীষন ভালো লাগতো উত্তমকুমারের সিনেমা। উত্তমকে দেখলেই বুকের মধ্যে ধড়ফড়ানি। কাছাকাছি সিনেমাহলে উত্তমের সিনেমা আসলে, দেখতে ছোটা। পাড়ার একটা স্টুডিওর বাইরে উত্তমকুমারের একটা বাঁধানো ছবি ছিল। প্রতিদিন বিকেলে স্টুডিওর সামনে দিয়ে হেঁটে আসা চাই।
শ্যামলীর ছোটবেলায় ওর মা মারা গিয়েছিলেন। বাবা কালিপদবাবু স্বাবলম্বী মানুষ। উনিই ওকে একা হাতে বড় করে তুলেছেন। কালিপদবাবুর বাড়িতে একটা ছোট্ট ওয়ার্কসপ ছিল। সেখানে সাইকেল, গ্যাস ওভেন, সিলিং ফ্যান ইত্যাদি রিপেয়ার করতেন। সেই উপার্জনেই সংসার চলে যেত। বাড়িতে সব সময়ই ঠুকঠাক আওয়াজ লেগেই থাকত। তবু তারই মাঝে শ্যামলী গান গাইতো। রেডিওর গান শুনে, শিখে নিয়েছিল অনেক গান। পাড়া বেপাড়ার জলসায় গান গাওয়ার ডাক পেত।
এমনই এক ক্লাবের জলসার শেষে, বাড়ি ফেরার সময়, অসময়ের বৃষ্টিতে শ্যামলী আটকে গেল ক্লাবের মধ্যে। ওখানেই দেখা হল সুমিতের সঙ্গে। সুমিতকে ও চিনত। ওদের পাড়াতেই বাড়ি। দারুন কীবোর্ড বাজায়। এই ফাংশনে আমন্ত্রিত একজন শিল্পীর সঙ্গে সুমিত কীবোর্ড বাজাচ্ছিল। সুমিতই ওর দিকে এগিয়ে এলো। “আপনাকে আমাদের পাড়ায় দেখেছি, মনে হচ্ছে।” সুমিত আলগাভাবে জিজ্ঞাসা করল। “হ্যাঁ, ওটা আমাদেরও পাড়া।” শ্যামলী মৃদু হেসে বলল। সুমিতের মুখেও হাসি চলে এল। “হ্যাঁ, ঠিক তাই তো।” সুমিত নিজে যেচেই শ্যামলীকে বলল, “এই বৃষ্টিতো সহজে থামবে মনে হচ্ছে না। নিম্নচাপের বৃষ্টি। আমার গাড়ি আছে। আপনি কিছু মনে না করলে, আপনাকে বাড়িতে নামিয়ে দিতে পারি।” ইতিমধ্যে ক্লাবের একটা ছেলে একটা রিকশা জোগাড় করে নিয়ে এসেছে। “এইতো আমার জন্য রিকশা এসে গেছে। ওতেই চলে যাব। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।” শ্যামলী আর দেরি না করে রিক্সার দিকে এগিয়ে গেল।
সারা রাস্তা বৃষ্টি অঝোরঝরে ঝরে গেল। শ্যামলী বাড়ি ফিরল একদম ভিজে। মনে হচ্ছিল, সুমিতের প্রস্তাবটা নিলে ভালো হতো। সর্দি-জ্বরে বেশ কদিন কাহিল থাকলো । তারপর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হতে লাগল সুমিতের সঙ্গে। ওর গানের সঙ্গেও সুমিত কয়েকবার বাজালো স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে। পরিচিতি গড়ালো নিভৃতালাপে, ‘আপনি’ নেমে এলো ‘তুমি’তে।
সুমিত একদিন শ্যামলীকে কথা প্রসঙ্গে বললো, “দেখো আমি তো শহরের বিভিন্ন হোটেলে বিভিন্ন শিল্পীর সঙ্গে বাজাই। এমনই একটা বড় হোটেল ওদের নিজস্ব একজন স্টেজ আর্টিস্ট চাইছে। ওরা আমাকে ব্যাপারটা অ্যারেঞ্জ করার জন্য অনুরোধ করেছে। তুমি যদি বলো, তোমাকে নিয়ে একটা গ্রুপ তৈরি করতে পারি। ভালো টাকার অফার আছে। সবাইকে দিয়ে আমাদের দুজনের জন্য ভালোই থাকবে। তুমি কি বলো?”
শহরতলীর মেয়ে শ্যামলীর মধ্যবিত্ত মানসিকতায় হোটেলের স্টেজে গান গাওয়া একটা অভাবিত ব্যাপার। শ্যামলী চট করে কিছু বলে উঠতে পারেনা। সুমিতই ওকে বোঝায়, “দেখো, আমাদের বিয়ের পর একটা সুন্দর সাজানো সংসার করতে গেলে, টাকাটা একটা বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং আমার মনে হয় তোমার রাজি হয়ে যাওয়া উচিত। একটু সিরিয়াসলি ব্যাপারটা ভাবো। দু’চারদিন পরে আমাকে জানিও।” হোটেলে স্টেজ আর্টিস্ট হিসেবে গান গাওয়ার থেকেও একটা সুন্দর সাজানো সংসারের লোভ শ্যামলীকে আকর্ষণ করলো অনেক বেশি। তাছাড়া সুমিতের ওপর নির্ভরতা এসে গেছে ততদিনে। তাই সুমিতের প্রস্তাবে ও রাজি হয়ে গেল।
স্টেজ আর্টিস্ট হিসেবে শ্যামলী দাঁড়িয়ে গেল। পুরো এক বছরের চুক্তি হলো হোটেলের সঙ্গে। এই আনন্দের সময় সুমিত ও শ্যামলীর বিয়ে হল। শ্যামলী একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। সুমিতের মধ্যে ভীষণ একটা কেয়ারিং ভাব ছিল। শ্যামলী নিজের সবটা দিয়ে ওর কাছে সঁপে দিয়েছিল। ও বিশ্বাস করতে পারছিল না, শহরতলীর এক সারাইমিস্ত্রির মেয়ে হয়ে, এমন জীবনে ও চলে আসতে পারে। শহরের মধ্যে এক ছিমছাম ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ওর নিজের সংসার। সাজায়, গোছায়, গানের তালিম নেয়। সারাটা দিন কিভাবে কেটে যায়, ভেবে পায়না। এক অবিরাম জোয়ারের স্রোতে ভেসে চলা। সপ্তাহে একদিন স্টেজ শো বন্ধ থাকে। ওই দিনগুলোতে বাইরের কোনো না কোনো অনুষ্ঠানে ডাক আসে। জীবন যেন অঢেল হাতে ওদের দিয়ে যাচ্ছিল। কয়েক মাসের মধ্যে শ্যামলীর গর্ভে সন্তান এল। এই উপচে পড়া সুখ শ্যামলী প্রতি মুহূর্তে উপভোগ করছিল। ওর গানেও সেটা বোঝা যাচ্ছিল। কোলাহলমুখর গানের থেকে গভীরতর গানের দিকে ওর মন ঘুরে যাচ্ছিল।
‘আরো আঘাত সইবে আমার, সইবে আমারো।
আরো কঠিন সুরে জীবন-তারে ঝংকারো।’
জীবনের গতি বড় বিচিত্র। নিরবচ্ছিন্ন আনন্দ বা সুখ সবার কপালে সয় না। শহর থেকে দূরের এক অনুষ্ঠান শেষে, গভীর রাতে বাড়ি ফিরছিল ওদের গানের দল। সুমিত ও শ্যামলী ছিল একটা আলাদা গাড়িতে। রাতের চলমান অজস্র বালির লরির একটির সাথে ধাক্কা খেলো প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চলা ওদের গাড়িটা। ছিটকে পড়ল দুই রাস্তার মাঝের ঢালু অংশে। কম বয়সী চালক ছেলেটির তৎক্ষণাৎ মৃত্যু। সুমিত বেঁচে ছিল হসপিটাল নিয়ে যাওয়া অবধি। ওই প্রচন্ড দুর্ঘটনা থেকে শেষ অব্দি বেঁচে উঠল শ্যামলী গর্ভস্থ সন্তানকে নিয়ে। যেন আরো আঘাত সইবার জন্য, রেখে দিল শ্যামলীকে তার সোনার কন্ঠ ভগ্ন করে।
শ্যামলী সেরে উঠে ফিরে গেল বাবার কাছে। যে অর্থ জমে ছিল কয়েক মাসের, তার অনেকটাই খরচ হলো গলার চিকিৎসায়। যে গলায় সুর এসেছিল অনাবিল আনন্দের মধ্যে, তা যেন হারিয়ে গেল এই অভাবিত আঘাতে। তবু তারি মাঝে যখন সন্তান ভূমিষ্ঠ হলো, তখন সদ্যোজাত সন্তানের মুখ চেয়ে আবার বাঁচার উপাদান পেল শ্যামলী। শ্যামলীর মনে যে সুর সতত প্রবাহমান, সেই সুরের ভালোবাসায়, ছোট্ট ছেলেটির চোখের আলোয় নিজেকে নিয়ত আবিষ্কার করে সে। বাবু বড় হচ্ছিল একটু একটু করে। ওর নির্মল হাসি-কান্না দেখে, শ্যামলী তার সর্বনাশের দুঃখ ভুলে থাকত। কিন্তু আরো কঠিন আঘাত শ্যামলীকে যেন সুর থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। বাবুর বোধবুদ্ধি ঠিক স্বাভাবিক পথে চলে না। একটু অগোছালো, প্রতিটা কাজ ওকে বলে দিলে তবে করতে পারে। তবু শ্যামলীর বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন, উনি বাবুকে নিয়ে নিজের ওয়ার্কশপে রিপেয়ারিংএর কাজ চালাতেন। দাদুর কাজের প্রতি বাবুর তুমুল আগ্রহ ছিলো। বাবু নিজেই প্রতিটা কাজ শিখে নিয়েছিল দাদুর কাছে। কালিপদবাবুর মৃত্যুর পর তাই ওয়ার্কসপটা হয়ে উঠেছিল বাবুর খেলাঘর।
বাবা বেঁচে থাকাকালীন সংসার চালাবার ব্যাপারটা শ্যামলীকে ভাবতে হয়নি। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর ভাবতে বাধ্য হল। ওদের পাড়ার এক মহিলা আয়া সেন্টারে কাজ করতেন। অসুস্থ শয্যাশায়ী বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সেবা করার জন্য এই সময়ে ছোট পরিবারগুলোতে আয়া রাখার প্রচলন খুব বেড়েছে। এই রকমই কাছাকাছি এক সেন্টারে শ্যামলী নাম লেখাল।
‘আমার মনের কোণের বাইরে,
আমি জানলা খুলে ক্ষণে ক্ষণে চাইরে’
বাবুকে গান শেখাবার খুব ইচ্ছে হয়। মনে হয় নিজে আবার আগের মত গান গেয়ে উঠে, বাবুকে শোনায়, শেখায়। মৃদু গলায় গান ধরে, কিন্তু গলা খুলতে গেলেই ব্যথা পায়। বাবু মাঝে মাঝে মাকে বলে গান গাইতে। কখনো কখনো সন্ধ্যাবেলা, ঘরে যখন কোন কাজ নেই, পরিপার্শ্ব শব্দহীন, তখন শ্যামলী মৃদু গলায় গান গায়। বাবু মুগ্ধ হয়ে শোনে, চোখে অসীম মমতাময় আকর্ষণ। শ্যামলী কখনো হারমোনিয়াম নিয়ে বসে। বাবু অসীম আগ্রহ নিয়ে হারমোনিয়ামের রিড টেপে। শ্যামলী শেখানোর চেষ্টা করে। বাবু প্রথাগতভাবে অত কিছু বুঝতে পারে না, কিন্তু কখনো কখনো ওর হাতে সুর উঠে আসে। শ্যামলী বেশি কিছু আশা করে না। বাবুর সামান্য হারমোনিয়াম বাজানো, কি অল্পস্বল্প গান শুনেই খুশি হয়। বাবুর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। ওর মুখে যে সুমিতের আদল। বাবু বলে, “মা, আমি একদিন তোমার মত গান গাইব”।
কিছুদিন হলো সুমিতের ভাঙাচোরা কীবোর্ডটা শ্যামলী দেখতে পাচ্ছিল না। গাড়ির এক্সিডেন্টে সুমিতের দামি কীবোর্ডটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সব রিড বাজতো না। অনেকেই এসেছিল কম দামে কিনে নিতে। শ্যামলী প্রাণে ধরে দিতে পারেনি। ওটা যে সুমিত ভীষণ ভালোবাসতো। জায়গামতো কীবোর্ডটা খুঁজে না পেয়ে, শ্যামলী ঘরে-বাইরে এখানে-ওখানে খুঁজছিল। বাবু তখন ওয়ার্কসপ মানে ওর খেলাঘরে ছিল। শ্যামলী বাবুকে জিজ্ঞাসা করতে ওয়ার্কসপে গিয়ে দেখে, সুমিতের কীবোর্ডটা একটা টেবিলের ওপর শোয়ানো, বাবু খোলাখুলি করছে। শ্যামলী আতঙ্কিত হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, “বাবু ওটা তোর বাবার জিনিস, যদি একেবার নষ্ট হয়ে যায়?” বাবু বোকা বোকা হেসে বলে, “মা আমি এটা ঠিক করে ফেলতে পারব। একটা বাজনার দোকানে আমি দেখেছি এর ভেতরে কি কি আছে। মা তুমি ভয় পেয়ো না। দেখো আমি এটা ঠিক সারিয়ে ফেলবো।” অবিশ্বাস ভরা মন নিয়ে শ্যামলী বাবুর খেলাঘর থেকে বেরিয়ে এল। মনটা ছটফট করছিল, কিন্তু বোকা ছেলেটাকে কিছু বলতেও পারছিল না। কয়েকদিন পর, বাবুর খেলাঘর থেকে কীবোর্ডের আওয়াজ ভেসে আসতে লাগলো। বোকা ছেলেটা তাহলে সুমিতের কীবোর্ডটা সারিয়ে ফেলতে পেরেছে।শ্যামলীর মনটা অনেক শান্ত হলো।
‘আমি অকৃতি অধম ব’লেও তো কিছু কম করে মোরে দাওনি’
রাত্রির প্রত্যেক প্রহরের একটা নিজস্ব রূপ-রস-গন্ধ শব্দ আছে। ক্ষেমঙ্করীর বিছানার পাশে বসে শ্যামলী সেটা বুঝতে পারে। রাতে ও আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্ষেমংকরীর মৃত্যু হয়। ডাক্তারের সার্টিফিকেট, শববাহী গাড়ি এসবের ব্যবস্থা করতে করতে রাত গড়িয়ে যায়। পরের দিন দাহ করা হবে, তাই মৃতদেহ বাড়িতেই রেখে দেওয়া হল। শ্যামলী চলে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু মৃতদেহ ছুঁয়ে কাউকে থাকতে হয় বলে, দীপঙ্কর শ্যামলীকে অনুরোধ করে রাত্রে থেকে যাওয়ার জন্য। নিস্তব্ধ রাতে মৃতদেহ ছুঁয়ে, শ্যামলী জেগে থাকে। শেষ প্রহরে যখন বাইরের হাওয়ায় শিশিরের গন্ধ, তখন ঘরের ভিতরে মৃতদেহের কঠিন শীতল স্পর্শে এক অপার্থিব অনুভূতি শ্যামলীকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। সম্বিত ফেরে বাইরে লোকজনের আওয়াজে। বুঝল এবার শব যাত্রার প্রস্তুতি শুরু হবে। ক্ষেমঙ্করী মুখরা স্বভাবের হলেও, অনেক দিন সেবা করতে করতে একটু ভালোবাসাও তৈরি হয়েছিল। তাই শবযাত্রার সময় শ্যামলী নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।
আজ অনেক তাড়াতাড়ি শ্যামলী বাড়ি ফিরছে। এত ভোরে স্বভাবতঃ ওর বাড়ি ফেরা হয় না। একটু বেলা গড়িয়ে যায়। সারারাত মৃতদেহের স্পর্শে থেকেও, ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়ায় হেঁটে যেতে ভালই লাগছিল। মনে হচ্ছিল বাবুকে আজ অবাক করে দেওয়া যাবে। ওকে দেখে ওর অবাক হওয়া চোখে একগাল হাসির কথা মনে পড়তেই, শ্যামলী তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে পা চালাল। বাড়ির গেট খুলে, ও নিজেই অবাক হয়ে গেল। বাবুর ওয়ার্কসপ থেকে একটা সুরেলা গলা ভেসে আসছে, সঙ্গে কীবোর্ডের আওয়াজ। শ্যামলী দ্রুত নিঃশব্দ পদক্ষেপে এগিয়ে গেল বাবুর খেলাঘরের দিকে। আরো স্পষ্ট হলো সুর ও লয়ের সমন্বয়ে এক অসামান্য কন্ঠের মূর্ছনা। ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল, বাবু চোখ বন্ধ করে তন্ময় হয়ে গান গাইছে আর ওর আঙুলগুলো অভ্যস্ত চরণে বিচরণ করছে কিবোর্ডের বুকে।
গান শেষ হলে, মাকে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, বাবু মায়ের দিকে এগিয়ে আসে। মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “মা, আমি তোমার মতো গান গাইছি মা।”
শ্যামলীর অন্তস্থল থেকে স্রোতের মতো ভেসে উঠতে লাগল সুর, তাল ভেদ করে এক ভালোলাগা, ভালোবাসা। ওর চোখ ছাপিয়ে দুকুলব্যাপী অশ্রু ঝরে পড়তে লাগলো, সব হারানোর মাঝে ঈশ্বরের করুনাধারার প্লাবনে। শ্যামলী ওর বোকা ছেলেটার মাথাটা দুহাতের মধ্যে ধরে ওর গালে কপালে অজস্র চুমোয় ভরিয়ে দিতে লাগলো।
0 comments:
Post a Comment