সম্পাদকের কলমে
নারায়ণ দেবনাথ-
সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম ।
ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম ।
নমস্কার সহ
অঙ্কুর রায়
সংখ্যার সম্পাদক
অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী
প্রধান সম্পাদক
লেখা পাঠানোর জন্য
আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com
Total Pageviews
By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.
জীবন-মরনের
- অয়ন সেনগুপ্ত
- অয়ন সেনগুপ্ত
১
সিঁড়িতে বসে সূর্যাস্ত দেখছিল সেমন্তী। সামনে গোপালপুরের উত্তাল সমুদ্র। এই সন্ধ্যেবেলা তাকে আর জলে নামতে দেয় নি অর্ক, শুধু ছুঁয়ে দেখে এসেছে সমুদ্রকে। ট্রেন টাইমে থাকলে সেমন্তী আজই নামত সমুদ্রে। কিন্তু তারা পৌঁছালই দুপুর বেলা। খেয়ে দেয়ে একটু জিরিয়ে তবে এসেছে সমুদ্রের ধারে। অর্ক গেছে টুকিটাকি খাবার কিনতে। উদ্দাম যৌবনে উচ্ছল গোপালপুরের সমুদ্র যেন হাতছানি দিচ্ছে তাকে। সমুদ্রের বোধয় বয়েস বাড়ে না, একই রকম রয়ে গেছে ঠিক পঁয়তাল্লিশ বছর আগে যেমন ছিল। সেই বারের উন্মাদনাই আলাদা ছিল। মধুচন্দ্রিমা বলে কথা! আজ পঁচাত্তর ছুঁই ছুঁই বয়সে আর সেই উন্মাদনা কোথায়? আজ শুধুই স্মৃতিচারণ। অর্ক এখানে থাকলে বলত – “বয়স বেড়েছে ঢের নরনারীদের”। কবিতা খুব প্রিয় অর্কর। আর সেমন্তীর প্রিয় সমুদ্র। তাই পঁয়তাল্লিশ বছরের বিবাহবার্ষিকীতে তারা এসেছে গোপালপুরে। বেশী দিন নয় আজ কাল কাটিয়ে পরশু ফেরত।
২
দু হাতে ভেলপুরির ঠোঙা নিয়ে সি-বীচ থেকে উঠে আসছিল অর্ক। সিড়ি ভাঙতে আজকাল কষ্ট হয়। বয়স হানা দিচ্ছে সমস্ত শরীরে। মনি-কে দেখেও আজকাল কি রকম, একটা কষ্ট হয় অর্কর। সারা জীবন লড়াই করে বোধয় হাপিয়ে গেছে বেচারি। কখনও নিজের সঙ্গে লড়াই তো কখনও সমাজের সঙ্গে। আর এখন তো লড়াই সময়ের সঙ্গে। কার সময় আগে ফুরোবে তা কেউ জানে না। ইচ্ছামৃত্যু আর ক’জনের হয়? মৃত্যু বড় কাছ থেকে দেখেছে অর্ক। মৃত্যুকে সে ভয় পায় না। ভয় তো একা হয়ে যাওয়ার। তার কিছু হয়ে গেলে কে দেখবে তার মনি কে। অর্ক জানে পরিস্থিতি মানুষ কে সব শিখিয়ে দেয়, তবু চিন্তাটা আজকাল বড় ভাবায় তাকে। মনিকে বুঝতে দেয় না, হেসেখেলে থাকার চেষ্টা করে তবু মনি কী আর বোঝে না। বার্ধক্য পুরোপুরি গ্রাস করার আগেই শেষ বারের মতো একটু বেড়াতে এসেছে তারা। সমুদ্র বড় ভালবাসে মনি। আর ভালবাসে তাকে। ভালবাসার জায়গায় ভালবাসাকে নিয়েই কাটুক দুটো দিন।
৩
ঘুম আসছিল না সেমন্তীর। নতুন জায়গায় প্রথম দিন একটু অসুবিধে হয়ই আজকাল। কাল তাদের বিয়ের পঁয়তাল্লিশ বছর পূর্ণ হবে। সুখে দুখে এতগুলো বছর কাটিয়ে দিল তারা। নিছক বন্ধুত্ব দিয়ে শুরু হওয়া এই সম্পর্ক আজ এক অটুট বন্ধুত্বে পরিণত। অর্ক ঘুমাচ্ছে অকাতরে। ঘুমন্ত মানুষকে কী অসহায় লাগে। কিন্তু জেগে থাকা অর্ককে আজকাল আরো বেশি অসহায় লাগে সেমন্তীর। বুড়ো হয়ে গেছে সেই ছোকরা, চ্যংড়া অর্ক। সময় আজ তার থেকে কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু। রয়ে গেছে শুধু অর্ক। সেই প্রথম যৌবনের কথা মনে পরল সেমন্তীর। অর্ক বলত “মনি, আমার কচ্ছপের কামড়, সহজে ছাড়ব না”। অর্ক ছাড়েও নি, আঁকড়ে ধরে আছে তাকে। বস্তুত তারা একে অপরকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে আছে। তারা নিঃসন্তান। কথাটা মনে হতেই বুকের কাছটা চিনচিন করে উঠল সেমন্তীর। ব্যথাটা রয়ে গেছে এখনও। এই পঁচাত্তর বছর বয়সেও প্রশ্নটা শুনতে হয় তাকে। এই বছর পাঁচেক আগে যখন ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে তারা বৃদ্ধাশ্রমে চলে এল পাকাপাকি ভাবে, তখনো তো শুনতে হয়েছে প্রশ্ন – “ছেলে মেয়ে কোথায়? বাইরে থাকে?” “নেই” – কথাটা বলতে যে কি কষ্ট, এই আজও, এত বছর পরেও, কেউ তা বুঝবে না। অর্কও না। ছেলেদের শুনতে হয় না যে।
৪
অর্কর এখন নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে। মনির মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া মনটা খারাপ করে দেয় অর্কর। দুপুরের খাওয়াটা আজ সত্যিই বেশিই হয়ে গেছে। মনি বারণ করছিল কিন্তু পম্ফ্রেট আর গলদা চিংড়ী দেখে আর লোভ সামলাতে পারেনি অর্ক। জমিয়ে লাঞ্চ করে এখন পেট আই-ঢাই। আজকাল খাওয়া দাওয়াটা অনেক কমে গেছে। বিশেষ করে বৃদ্ধাশ্রমে চলে আসার পর একটা নিয়ম মাফিক জীবনে অভস্ত হয়ে গেছে তারা। অনেক সাবধানে চলতে হয় এখন। কিন্তু আজ পঁয়তাল্লিশ বছরের বিবাহবার্ষিকীতে এই পারমিশনটা সে আগেই নিয়ে রেখেছিল। তারমধ্যে সকালের সমুদ্র স্নান খিদেটাও বাড়িয়ে দিয়েছিল। সকালের স্নানের কথা ভাবতেই হাসি পেয়ে গেল অর্কর। বুড়ো-বুড়ির স্নান দেখে হাসছিল সবাই। সমুদ্রে এলে মনি সত্যি পাগল হয়ে যায়।
হাতে আর আজ সন্ধ্যেটাই। ঘরে বসে থাকার কোনও মানেই হয় না। উঠে পড়ল অর্ক।
৫
লাইট হাউসের ওপর থেকে সেমন্তীর অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল এই বিশাল সমুদ্রকে। সমুদ্রের কাছে কত ক্ষুদ্র তারা, কত ক্ষুদ্র তাদের সমস্যা, কত ক্ষুদ্র তাদের জীবন। এই বিশালত্বের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দিলেই বোধহয় সবচেয়ে শান্তি পাওয়া যায়। ঈশ্বর এতো বিরাট বলেই তো তার কাছে এতো সহজে নিঃশর্তে নিজেকে সঁপে দেওয়া যায়। প্রকৃতির থেকে বড় ঈশ্বর আর কে আছে? সেমন্তীর আজ মন চাইছে এই বিরাট সমুদ্রের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দিতে। এই প্রতি মুহূর্তে হারিয়ে ফেলার ভয় নিয়ে বেঁচে থাকার যে যন্ত্রণা, তা কি কেউ বোঝে? এক তুড়িতে জীবনের সব সমস্যা উড়িয়ে দিতে পারা অর্কও কি পারছে এই ভয় কে উড়িয়ে দিতে? আজকাল নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায় সে অর্কর মধ্যে। আজকাল বড় ভয় পায় অর্ক। যে ভয়টা সেমন্তী নিজে সারা জীবন বয়ে বেড়িয়েছে, সেই ভয়। একা হয়ে যাওয়ার ভয়।
৬
- “ঘুমায়ে পড়িতে হবে একদিন আকাশের নক্ষত্রের তলে
শ্রান্ত হয়ে উত্তর মেরুর সাদা তুষারের সিন্ধুর মতন!
এই রাত্রি, এই দিন, এই আলো, জীবনের এই আয়োজন,
আকাশের নিচে এসে ভুলে যাব ইহাদের আমরা সকলে!
একদিন শরীরের স্বাদ আমি জানিয়াছি, সাগরের জলে
দেহ ধুয়ে;— ভালোবেসে ভিজইয়েছি আমাদের হৃদয় কেমন!”
- এটা কার লেখা অর্ক?
- এক প্রেমিক কবির। যে জীবন কে ভালবেসেছিল, আবার মৃত্যুকে ভালবাসতেও দ্বিধা করেনি। জীবনানন্দ দাস।
- আচ্ছা, তুমি কবিতা বেশি ভালবাস না আমায়?
- এই বুড়ো বয়েসে এসেও তোমার সন্দেহ যায় নি? অবশ্যই তোমায়!
- আর তুমি আমায় বেশি ভালবাস না সমুদ্র?
- এই বুড়ো বয়েসে এসেও সন্দেহ আছে? অবশ্যই সমুদ্র !
- কিন্তু কি জান মনি, এই বয়েসে এসে, ভালবাসা-র থেকেও বড় কথা হল অবলম্বন, নির্ভরতা। একে অপররের হাতটা শক্ত করে ধরে থাকা।
- কিন্তু কতদিন অর্ক? কতদিন আমরা এই ভাবে শক্ত করে একে অপরের হাত ধরে থাকতে পারব? যে রয়ে যাবে তার হাতটা কে ধরবে?
- এ কথার কোনও উত্তর হয় না মনি।
- কিন্তু সারা জীবন তো তুমি এ কথার উত্তর দিয়ে এসেছ, বলে এসেছ যে কোনও দিন আমায় ছেড়ে যাবে না, সে কি শুধুই কথার কথা ছিল?
- না মনি, এ আমার এই পড়ে থাকা জীবনের একমাত্র ইচ্ছে।
- তালে এক কাজ করি চল, কলকাতায় না ফিরে সমুদ্রের কাছেই থেকে যাই !
- মানে? কি ভাবে? এখানে ওল্ড হোম দেখবো?
- না, এই যে হাত ধরে হাঁটছি আমরা, এই ভাবেই হাঁটতে হাঁটতে চলে যাবো সমুদ্রের কাছে, চিরদিনের মত ! আর কেউ আলাদা করতে পারবে না আমাদের! কে আগে যাবে কে পরে এই ভয় থাকবে না !
- যদি হাঁটতে হাঁটতে হাত ছেড়ে যায়?
- না সে ভয় নেই, তোমার যে কচ্ছপের কামড় !
- রবি ঠাকুরের ওই গানটা একবার শোনাবে, মনি?
- “ নয়নের জল গভীর গহনে আছে হৃদয়ের স্তরে,
বেদনার রসে গোপনে গোপনে সাধনা সফল করে।
মাঝে মাঝে বটে ছিঁড়েছিল তার, তাই নিয়ে কেবা করে হাহাকার--
সুর তবু লেগেছিল বারে-বার মনে পড়ে তাই আজি।
কী পাই নি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি”।
৭
অর্ক সেমন্তী দুজনেই শক্ত করে ধরে আছে একে অপরের হাত। এগিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের গভীরে। এক মৃত্যুভয়হীন জীবনের দিকে। এই বিরাট জীবন যুদ্ধে তারা কখনই ছাড়ে নি একে অপরের হাত। এ তো সামান্য ঢেউ। সেমন্তী জানে সমুদ্র কিছু নেয় কিছু ফিরিয়ে দেয়। আজ সমুদ্র তার থেকে চিরজীবনের মত নিয়ে নেবে এই একাকিত্বের ভয় আর তাকে ফিরিয়ে দেবে সেই মৃত্যু ভয়হীন অর্ককে। অর্ক জানে না, কি করতে যাচ্ছে তারা। শুধু জানে, মনি আকুল ভাবে চাইছে কিছু তার কাছে। এই জীবনে মনিকে অদেয় তার কিছুই নেই, মৃত্যুও নয়। সামনে বিরাট ঢেউ। অর্ক শক্ত করে ধরে থাকে সেমন্তীকে। সেমন্তী শক্ত করে ধরে থাকে অর্ককে। সূর্য ডুবে যায়। রাত নেমে আসে গোপালপুরের সমুদ্রে।
জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ব্যারাকপুরে। কর্মসুত্রে প্রায় দশ বছর গুরগাও-তে। নেশা বই পড়া ও গান শোনা। এক ঘেয়ে কর্মজীবন থেকে একটু দম নিতে লেখালেখি একেবারেই নিজের খেয়ালে।
----------------------------------------------------------------
----------------------------------------------------------------
Subscribe to:
Posts (Atom)
0 comments:
Post a Comment