সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

 এক শীতের রাতের কাহিনী

(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

অশোক মুখোপাধ্যায়

ঘটনাটা বেশ কয়েক বছর আগের এবং হৃদয়বিদারক  I

ডিসেম্বরে শেষে দিল্লির এক প্রচন্ড শীতের রাত - তখন প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে I ঘরের  দরজা-জানলা বন্ধ এবং মোটা পর্দা দিয়ে ঢাকা  I  বাড়িতে আমি ও আমার স্ত্রী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আর তখন হঠাই ল্যান্ডলাইন ফোনটা বেজে উঠলো I সাধারণত ওই সময় কারো ফোন আসার কথা নয় তাই একটু বিরক্ত হয়েই লেপের মধ্যে থেকে বেরিয়ে ঘুম চোখে রিসিভারটা তুলে "হ্যালো" বললাম I আমার স্ত্রীও বিছানা ছেড়ে আমার পাশে এসে তখন দাঁড়িয়েছে I ওপাশ থেকে পুরুষ কণ্ঠের ভারী আওয়াজ - শুনলাম "ম্যায় মুরথাল চেক-নাকা পুলিশ আউটপোস্ট সে বোল রাহা হুন" I এই কথা শুনেই  আমি "রং নম্বর" বলে লাইনটা যেই কেটে দিলাম, তার পর মুহূর্তে আবার রিং ! আমি সেটা না ধরে বিছানার দিকে হাঁটতে শুরু করলাম কিন্তু আমার স্ত্রী বললো "পুরো ব্যাপারটা শুনলে পারতে তো" ? স্ত্রীর কথা শুনে একটু নিমরাজী হয়ে আবার রিসিভারটা তুললাম আর ঠিক তখনি ওপাশ থেকে এক মেয়েলী কণ্ঠে বলে উঠলো  "পিপা আমি পম্পা বলছি" I এই কথা শোনা মাত্র আমি বেশ সতেজ হয়ে উল্টো প্রশ্ন করলাম " কি ব্যাপার এতো রাত্রে তুমি কোথা থেকে কথা বলছো ?" ও বললো "একটু আগে মুরথাল চেকপোস্টের কাছে আমাদের গাড়ীর একসিডেন্ট হয়েছে I আমাদের  সবাইকে  এখন সোনিপথ গভর্মেন্ট হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে I" এই বলে ও লাইনটা কেটে দিলো I মুরথালের এক দিকে দিল্লী আর অন্য দিকে হরিয়ানা এবং সোনিপথ হরিয়ানার একটা ডিস্ট্রিক্ট টাউন I  

এই কথা  শোনার পরে আমি এতো ঠান্ডার রাত্রেও গলদঘর্ম হয়ে কাঁপতে শুরু করলাম I স্ত্রী আমাকে ধরে কি হয়েছে জানতে চাইলে আমি বলি যে অমিতের গাড়ীর একসিডেন্ট হয়েছে মুরথাল চেকপোস্টের কাছে  এবং ওদেরকে নিয়ে এখন হাসপাতালে যাচ্ছে  I এবারে একটু বলে রাখি যে অমিত আমার একমাত্র শ্যালক, তার স্ত্রী মন্দিরা, মেয়ে পম্পা আর ওদের ছেলে আয়ুস  I  ওরা পূর্ব দিল্লীর বসুন্ধরা এনক্লেভে থাকে I আমরা জানতাম যে  ওরা চারজনে নিজেদের গাড়ী করে অমৃতসরে বেড়াতে গেছে I তাই বুঝতে অসুবিধা হলো না যে সেখান থেকে ফেরার পথে ওদের দিল্লী বর্ডার থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে মুরথালে একসিডেন্ট হয়েছে I আমি বড়ো তাই ঠিক করলাম এক্ষুনি সোনিপথ হাসপাতালে আমার গাড়ী নিয়ে রওনা হয়ে যাবো I কিন্তু স্ত্রী আমাকে শান্ত হতে বলে - কি করা উচিত হিসাবে বললো যে এতো রাতে আমার এক যাওয়া কখনোই ঠিক হবে না এবং আরো বললো যে কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ I এই কথা শোনা মাত্র আমি আমাদের পাড়ার সুব্রতকে ফোন করলাম (সুব্রত আমার ছোট ভাইয়ের মতো, বিচক্ষণ এবং পরোপকারী মানুষ) এবং ওকে ঘটনাটা জানিয়ে বললাম "আমি গাড়ী নিয়ে যাচ্ছি - তুমি কি আমার সাথে যেতে পারবে ?"  সব শোনার পরে সুব্রত বললো "আমি একটু পরে আপনাকে ফোন করছি - আপনি একটু শান্ত হন" i  

আমি বাইরের অবস্থা দেখার জন্যে পর্দা সরিয়ে দেখি ঘন কুয়াশাতে দু -ফুট  দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছে না I বুঝলাম এই হলো উত্তর ভারতের কুয়াশা ও ঠান্ডার রাত ! এর মধ্যে কি ভাবে গাড়ী চালিয়ে যাবো ভাবতে ভাবতে আবার ফোন এলো I এবার সুব্রত I ও জানালো যে বাইরের অবস্থা যা তাতে আমার বা ওর কারোই গাড়ী নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না কারণ বাইরের "ভিসিবিলিটি জিরো" ! ও আরো বললো "আমি একজন প্রফেশনাল ড্রাইভারকে গাড়ী নিয়ে আসতে বলেছি - আপনি তৈরী থাকুন, আমি আসছি" I আমি গরম জামা কাপড় পরার সময় দেখলাম আমার স্ত্রীও ড্রেস করে নিচ্ছে I  কি ব্যাপার জিজ্ঞাসা করতে জানালো যে আমার একা যাওয়া ঠিক হবে না তাই সেও সাথে যাবে I আমি তাকে কিছু বলার আগেই  "ডোর বেল"  বেজে উঠলো , বুঝলাম সুব্রত এসে গেছে I যাইহোক আর কালবিলম্ব না করে সুব্রতর ভাড়াকরা গাড়ীতে আমরা তিনজনে রওনা হয়ে গেলাম I  

তখন ঘড়িতে রাত একটা বাজে I আমাদের বাড়ী থেকে দিল্লী  বর্ডার তিন কিলোমিটার I সেখান থেকে মুরথাল আরো বারো কিলোমিটার - সব মিলিয়ে ১৫ কিলোমিটার I ঠিক হলো প্রথমে আমরা মুরথাল পুলিশ চেকপোস্ট এ যাবো এবং সেখান থেকে একসিডেন্টের খবর জেনে সোনিপথের হাসপাতালে যাবো I ভিসিবিলিটি বেশ কম আর ঠান্ডাতে রাস্তায় গাড়ী প্রায় নেই বললেই চলে I  আমাদের ড্রাইভার খুবই প্রফেশনাল এবং অভিজ্ঞ, তাই বেশ সাবধানেই গাড়ী চালাতে থাকলো I বর্ডার পর্য্যন্ত পৌঁছাতে খুব একটা সময় না লাগলেও হাইওয়তে পৌঁছি দেধি লম্বা গাড়ীর লাইন  ! প্রচন্ড কুশাতে মাত্র অল্প দুর পর্যন্তই দেখা যাচ্ছিলো এবং আমরা যথারীতি গাড়ীর লাইনে ঢুকে ধীরেধীরে এগুতে লাগলাম I রাত যত বাড়তে থাকলো কুয়াশাও বেড়ে যেতে থাকলো এবং এক সময় এমন হলো যে সামনের গাড়ীর পিছনের লাল বাতি (tail lamp)  ছাড়া আগে, পেছনে বা দুই ধারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না I গাড়ীতে বসে আমাদের সকলেরই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিলো কিন্তু ড্রাইভার যাতে না ঘুমিয়ে পড়ে তার জন্যে আমরা ওর সাথে আজেবাজে কথা বলতে থাকলাম আর ড্রাইভার সামনের গাড়ীর "টেল ল্যাম্প" দেখে খুব সাবধানে গাড়ী নিয়ে এগুতে থাকলো I ড্রাইভার বলছিলো যে সে গত ৪০ বছর ধরে হাইওয়েতে গাড়ী নিয়ে যাতায়াত করেছে কিন্তু এমন কুয়াশা আর রাস্তার অবস্থা আগে কখনো দেখে নি ! শীতকালে উত্তর  ভারতে কুয়াশা নতুন কিছু নয় তবে এবারে যেন সেটা মাত্রাধিক I যাইহোক মনেমনে ঠাকুর স্মরণ করতে করতে আর আমার শালার গাড়ীর দুর্ঘটনার কথা ভাবতে ভাবতে আমাদের গাড়ী মুরথাল চেক-পোস্টে প্রায় রাত আড়াইটে নাগাদ পৌঁছালে, পুলিশ - পোস্টে গিয়ে দুর্ঘটনার খবর এবং হাসপাতালের অবস্থান (location) জেনে নিয়ে আমরা সেই দিকে আবার চলতে থাকলাম I

মুরথাল মোড় থেকে হাসপাতালের দূরত্ব বেশী নয় কারণ তাড়াতড়ি পৌঁছাবার জন্য পুলিশ আমাদের  একটা শর্টকাট রাস্তা দেখিয়ে দিলো I রাস্তাটা বেশ কম চওড়ার এবং পাথুরে মাটির I এতই ছোট যে পাশ দিয়ে অন্য কোনো গাড়ী যাবার জায়গায় নেই I তখন যত শীঘ্র সম্ভব হাসপাতালে পৌঁছানোটাই আমাদের প্রাধান্য লক্ষ্য, তাই আমরা সেই স্বল্প পরিসর রাস্তা দিয়ে চলতে থাকলাম I এই অন্ধকার রাস্তার দু ধারে জলা জায়গা মনে হচ্ছিলো যদিও ভালো করে কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না I গাড়ীর হেডলাইট জ্বললেও কুয়াশাতে খুব কমই রাস্তা দেখা যাচ্ছিলো I সুব্রত ড্রাইভারের পাশের সীটে ছিল এবং সে হঠাৎ ড্রাইভারকে গাড়ী  থামানোর  কথা বললে, সে  "হার্ড ব্রেক" করে গাড়ী থামায় এবং দেখা যায় রাস্তার ডানদিকে একটা বেশ বড়ো  ধরণের ফাটল - যার মধ্যে চাকা পড়লে গাড়ী উল্টে পাশের জলাতে অবশ্যই আমরা পড়ে যেতাম  I যাইহোক, ঠাকুরের দয়াতে বেঁচে গিয়ে আমরা তিনজন পুরুষ গাড়ী থেকে নেমে ওই ঠান্ডা এবং কুয়াশার মধ্যে ফাটলের  কিছুটা জায়গা মাটি ও কাঁকর দিয়ে ভরাট করে তার পরে ওই জায়গা পার হয়ে রাত তিনটের কাছাকাছি হাসপাতালে পৌঁছে গেলাম  !

এই হলো এক শীতের রাতে প্রবল ঠান্ডা আর কুয়াশার মধ্যে মাত্র ১৫ কিলোমিটার চলার এক বাস্তব অভিজ্ঞতা I

কিন্তু হাসপাঠালে পৌঁছে শালার সাথে দেখা হবার পরে যে খবর পেলাম তাতে আমাদের সকলের মন বিষাদে ভরে গেলো কারণ জানাতে পারলাম যে আমার শালা-বৌ অল্প কিছুক্ষন আগে রক্ত-বমি করে আমাদের সকলকে ছেড়ে ওপারে চলে গেছে এবং  তখন সেই মৃত শরীরকে মর্গে রাখার প্রস্তুতি চলছে I  মর্গে হাসপাতাল সংলগ্ন - তাই শেষ বারের মতো আমাদের শালা-বৌয়ের মুখ দর্শন করে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাকে চির বিদায় দিলাম  ! পরের দিন মর্গের রিপোর্ট অনুযায়ী জানা গিয়েছিল যে দুর্ঘটনাতে তার নাকি ফুসফুস ( lungs) ফেটে গিয়েছিল এবং  হাসপাতালে পৌঁছে রক্ত-বমি না হওয়া পর্য্যন্ত সে বেঁচেও ছিল  I  সেই অভিশপ্ত গাড়ীর  অন্য তিন জন যাত্রী প্রাণে বেঁচে গেলেও  বেশ ভালো রকমের আহত হয়েছিল এবং তাদের পুরো সুস্থ হতে অনেকদিনই সময়ও লেগেছিলো I

এই হলো আমার  শীত ও কুয়াশার রাতের এক অতি হৃদয়বিদারক সত্য কাহিনী  I  

0 comments: