সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

 বুড়ির সুতো

            
আশীষ দাঁ

আবাসনের ছাদে পায়চারি করছিল পিন্টু।খোলা আকাশে ফাগুনের ঠান্ডা বাতাসে ওর অবসর জীবনের প্রাণবায়ু ফুরফুরে মেজাজে। ভাবছিল বাজার থেকে লাটাই-ঘুড়ি নিয়ে আসবে। কাল ছাদে ঘুড়ি ওড়াবে। নীল আকাশের নীলিমাতে ওর দুটি চোখ বিস্ফারিত। শৈশবের সরলতা ওর  নীলিমাচ্ছন্ন চোখে। অনেকগুলো সাদা সুতোর মত ছোট্ট গোলাকার কিছু একটা ঘুরতে ঘুরতে ছাদের মেঝেতে এসে পড়ল। ঝুঁকে পড়ে দেখতেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল অস্ফুষ্ট আওয়াজ- কনি,তোর বুড়ির সুতো। কুড়িয়ে নিল। ওটার দিকে একভাবে তাকিয়েছিল। ও ওখন নিশ্চল বিহ্বল। দিনের শেষ আলো ওর  মুখমন্ডলের উপর। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ফেলা আসা জীবনাধ্যায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এল ওকে শোবার ঘরে। কিছুক্ষণ পর ওর সহধর্মিনী ডাকতে শুরু করল,"কি গো চা খাবে না? আবার শোবার ঘরে কেন গেলে?"
"আজ এখানেই দাও নিলাঞ্জনা"।
"কেন শরীর ঠিক লাগছে না?"
"প্রতিদিন তো লিভিংরুমে খাই। আজ না হয় এখানে"।
                          ******
ঘুঘুডাঙ্গাতে আসার পর ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হয় পিন্টু। ওদের পাশের বাড়িতে থাকতো কনি। মামা,দিদার কাছে থেকেই বেড়ে উঠেছিল সে।  ক্লাস ওয়ানে পড়তো। গভীর পুকুরের জলে ঢিল মারলে শব্দের যে গভীরতা তেমনই ছিল ওদের দু'জনের বন্ধন। তিস্তার পাড়ে কাশবন ছিল ওদের বিলাস চারণভূমী, ভাট ফুল ছিল মনস্তুষ্টির উপহার, হ্যাগড়া কাঁটা ছিল ওদের পিছনে লাগার অস্ত্র। জমির আল, ডোবা-পুকুরের ধার ওদের স্বাভাবিক বিচরণ ক্ষেত্র। কচা গাছের পাতা রস ছিল মনোরঞ্জনের উপকরণ। শৈশব থেকে কৈশোর। অনাবিল আনন্দ স্রোতে ভেসে বেড়াতো দুটি মন। 
                           ********
জৈষ্ঠের প্রখর তাপে রাস্তা গলা পিচ পিন্টু একটা কাঠের ডগায় আটকাতো। অবশেষে কাঠির আগা গোলাকার ধারণ করত। ঠান্ডা হলে সেই পিচের গোলক শক্ত হয়ে যায়। শালিমার চুলের তেলের টিনের কৌটে সেই পিচের কাঠি দিয়ে ড্রাম বাজিয়ে বন্ধুদের খেলার ময়দানে জড়ো করতো। কনিও সেই আওয়াজে ছুট আসতো। সেদিন ছিল রবিবার। দু'জনের ঘরে সবাই ঘুমাচ্ছে। কনি  পিন্টুর ঘরের কাছে এসে আস্তে আস্তে নারকেল তেলের কৌট পেটাতে লাগল। পিন্টু লাফ মেরে উঠে পড়ল। পা টিপে টিপে বাইরে বেরিয়ে এল পিন্টু। কনি ফিসফিস করে বলল , "পিন্টুদা ডেউ মাখা খাবে?"
"খাবো, নিয়ে এসেছিস?"
"চল, মাঠের ধারে আমাগাছ তলায় বসে খাবো।"
ওরা এগিয়ে চলে গাছতলায়। মাঠের পাশে একটা নারকেল গাছে সুকুমার বর্মন ডাকঘুরি বেঁধে রেখেছিল।
"কেমন হয়েছে মাখাটা পিন্টু দা?
পিন্টু কোন জবাব দেয় না।
"কেমন হয়েছে বললে না তো। বেশ করে কাসুন্দি দিয়েছি। কি হল ? চুপ করে আছে কেন?"
"কনি,ডাকঘুরির আওয়াজটা শুনতে পাচ্ছিস? বু -----উ-------।
"দুর, বলো না মাখাটা কেমন হয়েছে?"
"দারুন হয়েছেরে। জানিস কনি,মন চায় আমি নিজে ডাকঘুরি বানিয়ে উড়াই।"
"তাহলে চল সুকুমার কাকাকে বলি। উনি শিখিয়ে দেবেন।"
                           *******
কনি প্রাইমারী থেকে হাই স্কুলে। ক্লাস সিক্সে। পিন্টু ক্লাস এইটে উঠেছে। একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে বিকেলে কনি পিন্টুর মার কাছে চুলের বিনুনি বাঁধতে আসে। কনি বলে,"কাকী, আমি আর পিন্টুদা আজ সাইকেলে চড়ে কাশিয়াবাড়ি যাবো।"
"সাবধানে যাবি মা। দিনকাল ভাল না। চারিদিকে গন্ডগোল শুনতে পাই। সন্ধের আগেই ফিরে আসবি। পিন্টু কিন্ত বেশি দিন হয় নি সাইকেল চালানো শিখেছে। "
পিন্টু কনিকে নিয়ে বড় রাস্তা ধরে চলতে থাকে। কিছুদূর এগোতেই দেখে একটা মিছিল ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। শুনতে পায় একটি স্লোগান-তোমার বাড়ি, আমার বাড়ি,নকশাল বাড়ি।
কনি বলে ওঠে,"পিন্টুদা তাড়াতাড়ি বাড়ি চল। আমার ভয় করছে। কাকী বলেছে চারিদিকে গন্ডগোল হয় আজকাল। সন্ধের মধ্যে ঘরে ঢুকতেই হবে।"
"তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেন। ওরা অত্যাচারের বিরুদ্ধে কথা বলে। আমার দাদা বলে, চা বাগানের শ্রমিকদের উপর মালিকরা নিপিড়ন চালায়,কৃষকরা অত্যাচারিত। তাই ওরা মিছিল করে। ওরা আমাদের কিছু বলবে না।"
"মামা বলছিলেন, কলকাতাতে ওরা বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছে। অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। আমার ভয় করছে। চল, সাইকেল ঘোরাও। "
ফেরার পথে পিন্টু বলতে থাকে," মনিষীদের মূর্তি ভাঙা আমি পছন্দ করি না। আমার দাদা বলছিল ওরাও পরে বুঝেছে, বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা নাকি ভুল হয়েছে।"
                          *******
পিট্টু খেলতে পিন্টু মাঠে পৌঁছায়। বন্ধুরা সাতখানা অ্যাসবেস্টসের টুকরো পরপর বসাচ্ছিল। পিন্টু দেখতে থাকে কনি শূন্যে লাফাচ্ছে। হাত দিয়ে কিছু  ধরার চেষ্ট করছে। পিন্টু চিৎকার করে," কনি লাফাস নে, পড়ে যাবি"।
"পিন্টুদা, বুড়ির সুতো ধরবো আমি"।
হঠাৎ দেখে মাঠের এক পাশে গরু বাঁধার রশিতে পা জড়িয়ে পড়ে যায় কনি। মাথার পিছন দিকটা গরু বাঁধার খুটির উপর সজোরে আছড়ে পড়ে। কনি অচেতন হয়ে পড়ে থাকে। পাঁচ-ছয় জন বন্ধু সহ পিন্টু দৌড়ায়। পিন্টুরা ওকে কোলে করে ওর বাড়িতে নিয়ে আসে। চোখেমুখে জল দেয়। কনি বমি করতে থাকে। ওর মামা ছুটে যায় রিকশা ডাকতে। ডাক্তার খানায় ওকে নিতে হবে। পিন্টু বারবার ডাকতে থাকে "কনি, কনি"। কনির চোখের পাতা সরিয়ে তাকিয়েছিল ওর চোখে। চোখের আইরিশ দেখে পিন্টু বলে উঠল, "কনি, এই তো বুড়ির সুতো"। কনির চোখের পাতা একবার নড়ে উঠল। কিছুক্ষণ পর পিন্টু বলতে লাগল,"কনি, কালকে খোলসে মাছ ধরে এনে দেবো। বোতলে রাখবি। আর শুয়ে শুয়ে দেখবি।" কনি কোন সাড়া দিল না। পিন্টুর কী মনে করে ওর বুকে কান পাতে। শুনতে পেল,"পিন্টুদা, বুড়ির সুতোটা ধরা হল না আমার। আমার জন্য ভাট ফুলের তোড়া আনবে? বুকের উপর রেখো। আমি সারাক্ষণ গন্ধ শুকবো।" পিন্টু অঝোরে কাঁদতে থাকে। ধীরে ধীরে অনন্ত অস্তরাগের নামাবলি খসে পড়ল। অসীম নিঃসঙ্গতা নিষ্প্রভ পিন্টুকে   গ্রাস করলো।
                           -----------

0 comments: