সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.

ভয়

অনুব্রতা ভট্টাচার্য

প্রতাপ নগরের জমিদার রায় বাবুরা এককালে খুব পয়সাওয়ালা জমিদার ছিলেন । বর্তমানে তাদের তাল পুকুরে ঘটিটুকু খুব কষ্টে সৃষ্টে ডোবে । তবে বাস্তুখানি তাদের বিশাল জায়গা জুড়ে । গাছপালা , পুকুর , বড় মাঠ সব মিলিয়ে এক তপোবন যেন ।নানা ফলমূল গাছগাছালিতে ভরা বাগান এর জঙ্গল পরিষ্কারের অভাবে আলো আঁধারই এক রহস্যময়  পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে ।রায় গিন্নি আর কর্তা মানুষ ভালো। গ্রামের আদিবাসী বাচ্চাগুলো ফল পাকুড়ের লোভে প্রায়ই বাগানে উপদ্রব করে । রায় গিন্নীর শাশুড়ি থাকাকালীন ভয়ে কেউ এদিকে আসতো না ।ধবধবে সাদা চুলের মাথায় যখন টকটকে লাল সিঁদুর পরে বাড়ির দালানের ইজিচেয়ারে বসে তিনি যখন হুঙ্কার দিতেন ,’ কে রে ওখানে ? আবার পেয়ারা গাছে উঠেছিস? ঠ্যাং খোঁড়া করে দেবো “ , ওমনি দুপদাপ করে সব গাছ থেকে নেমে পালাত । রায় গিন্নীর শাশুড়ি মারা গেছেন বছর দুয়েক হল। রাশভারি মহিলার এ পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার পর রায় বাড়ির চারিপাশে যেন নিস্তব্ধতা গ্রাস করেছে । ফলের বাগানের পাশেই অযত্নে প্রায় ঝোপের মতো অবস্থা ফুলের বাগানের । এককালে মালি ফুল ফুটিয়ে সাজিয়ে রাখত বাগান ।আজ লোকের অভাবে সর্বত্র এক নিঝুম নিরবতা বিরাজ করছে ।

আজ মঙ্গলবার । রায় গিন্নী ভোরবেলা উঠে চান করে গাছ থেকে ফুল তুলতে বাগানে ঢোকেন ।টকটকে লাল শাড়ি ,পিট ছাপানো ভেজা চুলে যেন দেবী প্রতিমা। মুখখানি বড় স্নেহমাখা । সূর্যের প্রথম আলোয় ফুল তুলতে রায় গিন্নী বড় ভালবাসেন । চারিদিকে পাখির কিচিমিচি , নানা রঙ্গের জবা তুলতে তুলতে ভোরবেলার এই মায়াময় পরিবেশে মনটা কেমন অন্য জগতে চলে যায় ।সবে ফুলের সাজি অর্ধেক হয়েছে হঠাৎ বিকট চিৎকারে রায় গিন্নী ও বাবা কে রেবলে চিৎকার করে ওঠেন।

 তাঁর হাত থেকে ফুলের সাজিটা ছিটকে মাটিতে পড়ে যায়। একটা অদ্ভুত নাকি সুরের মেয়েলি কান্নায়  সকালের স্নিগ্ধ পরিবেশ যেন এক ধাক্কায় ভারি হয়ে ওঠে। রায় গিন্নি আকস্মিক ধাক্কা কাটিয়ে সাজি হাতে বেরিয়ে আসেন বাগান থেকে, আর একটু জোরেই চেঁচিয়ে ওঠেন, "কে রে ওখানে ? " কান্নার শব্দ আরো জোর হয় তাঁর গলার আওয়াজে। এবার তিনি ধীরে ধীরে পেয়ারা গাছটার দিকে এগিয়ে যান, আওয়াজটা ঠিক ওখান থেকেই আসছিলো। পেয়ারা গাছের কাছ থেকে শুরু হয়েছে ফলের বাগান , আর ওখান থেকেই কাঁটা বাঁশের বেড়া। ধীর পায়ে এসে দেখেন পেয়ারা গাছের পাশের জঙ্গলে একটা কম বয়েসি মেয়ে পড়ে আছে। গোঙানিটা আসছে ওর কাছ থেকেই। রায় গিন্নি প্রথমটা থতমত খেয়ে যান। ভাবেন এতো ভোরে কাকেই বা ডাকবেন তিনি, তাছাড়া এই বিশাল বাস্তু থেকে চেঁচিয়ে ডাকলেও কেউ শুনতে পাবে না। আবার পেয়ারা গাছটা টপকে যেতে একটু গা টা ছমছম  করছে, কারন ওই গাছের নীচেই তাদের বাস্তুর বন্ধন দেওয়া আছে। তাঁর শ্বশুর, শাশুড়ি বেঁচে থাকাকালীন হঠাৎ কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটায় ডাক পড়েছিল এক তান্ত্রিকের। যদি ও  সেই মানুষটি তন্ত্র সাধনা করতেন, কিন্তু তিনি ছিলেন একটি স্কুলের শিক্ষক ও। তিনি এসে সারাদিন হোম যজ্ঞী করে ভর সন্ধ্যেবেলা ওই পেয়ারা গাছের তলায় মাটির সরায় মন্ত্রপুত চিতু পিঠে ঢাকা দিয়ে পুঁতে দিয়েছিলেন।  আর বলে গেলেন কখনো যেন এই বাস্তুতে চিতু পিঠে না বানানো হয়। তাই ওই পেয়ারা গাছের কাছে গেলে গা টা অজান্তেই কেমন ভারি ভারি লাগে। মেয়েটা এমন ভাবে পড়ে গোঙাচ্ছে যে না গেলেও নয়,  তাই রায় গিন্নি কপালে হাত ঠেকিয়ে তাঁর গুরুদেব কে স্মরণ করে এগিয়ে গেলেন সেদিকে। 

জঙ্গলের এমন ভেতরে মেয়েটা পড়ে রয়েছে যে ভয় হয় সাপে কামড়ালো না তো। রায় গিন্নি জোর গলায় চেঁচিয়ে ওঠেন, " কে রে ওখানে?  কাঁদছিস কেন ? এই মেয়ে উঠে আয় বলছি ওখান থেকে, এত ভোরে বাগানে কি করতে এসেছিস, উঠে আয় বলছি। " কান্নার শব্দটা আরো জোর হয় তাঁর এই কথায়। মেয়েটা একটু নড়ার চেষ্টা করে কিন্তু আবার চেঁচিয়ে ওঠে, " ওমা ওমা করে "। রায় গিন্নি যতটা সম্ভব সাবধানে মেয়েটার কাছে পৌঁছে দেখেন তার সারা গা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। হঠাৎ যেন মনে কোথা থেকে সাহস পেলেন, চিৎকার করে বললেন " এই আমার হাত ধর, উঠে আয় বলছি। এখানে সাপ এর রাজত্ব, আর এখানে কি করতে এসেছিস বলতো?  সারা গা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মেয়েটা রায় গিন্নি কে সামনে পেয়ে " ও বড়মা, ও বড়মা গো মোকে  বাঁচাও গো, " বলে কাঁদতে শুরু করলো। রায় গিন্নি তাকে একটা জোর ধমক লাগলেন, "থাম বলছি, নে আমার হাত ধরে ওঠ।" এই বলে হাতটা বাড়িয়ে দেন। মেয়েটা কোনরকমে তাঁর হাত ধরতেই তাঁর শরীরের মধ্যে দিয়ে যেন  একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো। ভেতর থেকে কেমন যেন একটু অন্যরকম বোধ করলেন। যাইহোক মেয়েটাকে ধরে ধরে কোনোরকমে নিয়ে এলেন বৈঠক খানার বারান্দায়। একটা চেয়ারে বসিয়ে ড্রয়িং থেকে এক বালতি জল,  মগ, তুলো, বেটাডিন নিয়ে এসে দেখলেন মেয়েটা ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে, চোখেমুখে তার এখন ও ভয় ঠিকরে বেরচ্ছে। রায় গিন্নি তাঁর স্নেহমাখা মধুর স্বরে বললেন," এই মেয়ে তুই ওখানে পড়েছিলি কেন? কি হয়েছিল তোর ?  "মেয়েটা ভ্যাবলার মতো তার দিকে তাকিয়ে রইল। রায় গিন্নি বুঝলেন মেয়েটা বড্ড ভয় পেয়েছে, এখন আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। তার হাতে জল ঢেলে দিতে থাকলেন, সে জলের ঝাপটা দিয়ে দিয়ে মুখ ধুলো আর হাত পা গুলো কোনরকমে ধুলো। রায় গিন্নি স্পষ্ট দেখলেন মেয়েটার সারা গলা, মুখে কেউ যেন বড় নখ দিয়ে আঁচড়ে দিয়েছে। তিনি পরম মমতায় তার ক্ষত জায়গা গুলোতে ওষুধ লাগিয়ে দিলেন। মেয়েটা বলল,"  পিঠে বড্ড জ্বলতিছে গো বড়মা, টুকুন দ্যাখো না "। মেয়েটাকে তিনি কখনো দেখেন নি, অথচ সে কেমন বড়মা বলে তাকে ডাকছে, রায় গিন্নির মনটা বড় কেমন করে উঠলো অচেনা মেয়েটার জন্য। তার জামাটা তুলে পিঠটা দেখে আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলেন, " ওরে বাবা রে এ কি সাংঘাতিক অবস্থা, কে করলো রে এমন? " ঠিক যেন কেউ নখের আঁচড়ে  কাটাকুটি খেলেছে তার পিঠে। চোখ দিয়ে তার জল বেরিয়ে এলো এই রূপ দেখে। পরম যত্নে রক্ত মুছে ওষুধ লাগিয়ে দিলেন তিনি। তারপর তাঁকে গরম দুধ এনে বিস্কুট দিয়ে খেতে দিলেন। সে খুব কষ্ট করে দুটো বিস্কুট আর দুধ খেলো। রায় গিন্নি ব্যাগ হাতড়ে তাঁর ছোটো মেয়ের একটা প্রায় নতুন জামা বের করে এনে বললেন, বাইরের দিকে বাথরুমে গিয়ে পরে আয়, যা "। মেয়েটা বলল, " থাকুক বড়মা আমি থাকবনিকো, চলে যাবো "। রায় গিন্নি বড় বড় চোখ করে বললেন, " যা বলছি, পরে আয়। এখন এই অবস্থায় কোথাও যেতে দেবো না তোকে, একটু পরে যাবি খন। "

ওদিকে রায় কর্তা সকালবেলার প্রথম সূর্য কে রোজকার মতো প্রণাম করতে এসে বৈঠকখানার বারান্দায় অচেনা মেয়ের সাথে রায় গিন্নিকে এই সাতসকালে কথা বলতে দেখে অবাক হওয়ার সাথে সাথে একটু বিরক্ত ও হলেন। ভাবলেন নিশ্চয়ই আদিবাসী গ্রাম থেকে  কোনো কিছু চাইতে এসেছে, আর রায় গিন্নি তার সাথে বকবক করছেন। তাদের দুজনকে পাশ কাটিয়ে তিনি সূর্য  প্রণাম করতে যাচ্ছেন, এমন সময় কানে এলো রায় গিন্নি মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করছেন, " হ্যা রে মেয়ে এখন তোর শরীরটা একটু ভালো লাগছে আগের থেকে? " মেয়েটা উত্তর দেয় " টুকুন ভালো গো, আমি এবার যাই ".  রায় গিন্নি বলেন " তা এতো সকালে কি করছিলি তুই বাগানে ?  পেয়ারা পারতে এসেছিলি নাকি চালতা কুড়োতে? " প্রশ্ন শুনে মেয়েটার মুখটা সাদা হয়ে যায়। বলে " মোকে আর কুনো দিন ও তুমি ইখানে দেখবে নি কো, মুই কুনো দিনও ইধার মাড়াবো নি কো "। তার বলার ধরন দেখে রায় গিন্নি হেসে ফেলেন। তারপর কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করেন " এসেছিলি কেন?  আর কি করেই বা এসব বাধালি? " মেয়েটা নড়েচড়ে বসে একবার, তারপর সেই ভয়মাখা মুখে বলতে শুরু করে, " মোর মায়ের শরীলটা ঠিক নাই, রাইত হইলে জ্বর আইসে গো, বাপ গ্যাছল গুনিনের কাইছে, গুনিন বুলল  তুর বেটিকে বইল আঁধার রৈতে ঝুড়ি পড়া বট গাছের শিকড় লিয়ে আসতে, কুথা বোলা যাবেক নাই। শিকড় টুখুন বেইটে তিনদিন খাবাইতে হবেক, আর কুছুটা শিকড় লাল দড়িতে গলায় ঝুলাই দিবিক, জ্বর সারি যাবেক। সেই তরে তো মুই তুমার বাগানে আসলি বটেক। বাপ বুলছিলো আসবেক মুর সাথেক, কাল  রাইত থেকে ওর জ্বর আসে গেলেক, তো আইসতে পারলো নিকো। " এতটা কথা বলে মেয়েটা হাপাঁতে থাকে। তার কন্ঠার হাড়গুলো যেন আরো ঢুকে যায়,  গাঢ় কালো রঙে টানা টানা চোখ দুটো যেন অন্য কিছু বলার প্রস্তুতি নেয়। 

মেয়েটা আবার বলতে থাকে, " সইবে তুমাদের বাগানে ঢুকছি আর পিয়ারা গাইছটার পাশ দিয়া গেতেছিলি, ওমনি কে একটা পিছন নু মোকে ছুইড়া  দিলে কাঁটার বেড়ার উপর বটে। মুই কুনরকম পিছন ঘুরা দিখি একটা এত্ত বড় লম্বা সাদা চুলের বুড়ি। চোখ দিয়া অগুন বাইরাতে শিলক বটে। " এই পর্যন্ত বলে মেয়েটা ভয়ে দু হাতে মুখ ঢেকে নেয়। রায় গিন্নি বলেন, " কি বলতে কি দেখেছিস , আসলে ভয় পেয়েছিস তো  তাই ওরকম মনে হচ্ছে। মেয়েটা বলে, " না গো বড়মা না, সারাদিন তো জঙ্গলে ঘুরি বটে, ডর লাগে ন তো, তবে ই তো মুই ঠিক দ্যাখছি গো "।  রায় গিন্নী মেয়েটাকে একটা লাল ওষুধ হাতে দিয়ে বললেন এটা লাগাবি রাখ। আর  কখনো জঙ্গলে যাবি না। সাপে ভরা ওই জঙ্গল। রায় কর্তা জিজ্ঞেস করায় তাঁকে অল্প কথায় রায় গিন্নী সব বলেন। সব শুনে রায় কর্তা বলেন, " যত সব গাঁজাখুরি গল্প লোকে তোমাকেই শোনায়। তারপর  মেয়েটা কে বলেন যা বাটি আর দুধের কাপটা ধুয়ে রেখে আয়। আমাদের কাজের লোকটার অসুখ করেছে, আসছে না। মেয়েটা পুকুর থেকে মেজে নিয়ে এলে রায় গিন্নী বলেন, " আয় আমার সাথে তোকে দুটি মুড়ি আর নাড়ু দিবো, সঙ্গে হোমিওপ্যাথি ওষুধ, ঘন্টায় ঘন্টায় মা আর বাপকে খাওয়াবি।"মেয়েটা পিছু পিছু যায়। ড্রয়িং এর মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ ড্রয়িংয়ের দেওয়ালে টাঙানো ছবি দেখে চেঁচিয়ে ওঠে, " ই বুড়ি মোকে ঢেলে ফেইলে দিছে গ। " এই বলে হুড়মুড়িয়ে ঘর থেকে দৌড়ে পালায়। রায় গিন্নী থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কিছুই যেন তার বোধগম্য হয় না। মেয়েটা হাপাঁতে  হাঁপাতে বাড়ি ঢোকে। তার মা জ্বর গায়ে উঠে আসে মেয়ের কাছে। মেয়ের নক দিয়ে আঁচড়ানো গাল দেখে চেঁচিয়ে ওঠে, " তু রায়  বাবুদের বাগানে গেছুলু ? ক্যা কৈছিলো য্যাতে?  উদের বাগানে ওল চুরি করতে ঢুকছিলি , আর বুড়িটা এমন তাড়া কইরল যে কুন্ রকমে প্রাণ লিয়ে আইসলাম। তারপর থিকে তো জ্বর আইলো, ",  তার পিছনে তার বাবা কখন এসে দাঁড়িয়েছে, মা মেয়ে দেখতেও পায়নি। তার বাবা বলে, " মোকে কৈলুনু কেনে, তবে উদের পুকুরে মাছ চুরি করতে যেতাম নি রে। " মেয়েটা সারা দিন ভয়ে কাঁটা হয়ে রইল। রাত বাড়তে তার প্রবল জ্বর এলো, জ্বরের  ঘোরে বলতে লাগলো, " আর মুই যাবো নিকো রে। ও জঙ্গলে যাব নি রে। ও বুড়ি মোকে ছাইড়ে দে রে, আর যাবনি রে" বলে চেঁচাতে থাকে। তার মা দেখে মেয়ের জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। আর কোমরে গোঁজা  একটু লাল দড়ি  আর একটা বড় মাদুলি.মার বুঝতে আর বাকি থাকেনা। এসব গুনিনের কারসাজি, নজর পৈড়েছে তার ডাগর মেয়ের দিকে। এক টানে মাদুলিটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় উনানে। ভাতের  গন্ধে আজ তার বড় ভুখ লাগছে। সে জানে আর ভয় নেই এবার জ্বর চলে যাবে। 

ওদিকে মেয়েটার দৌড়ে পালানো দেখে রায় কর্তা ইজিচেয়ার থেকে ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়ান। রায় গিন্নী ও বেরিয়ে এসে রায় কর্তার পাশে দাঁড়ান। তারপর আপন মনে বলতে থাকেন "মেয়েটা কি সব বলল গো, ওর কি মাথাটা খারাপ? " সব শুনে কর্তা রেগে মেগে বললেন, " যাকে দেখো তোমার দরদ উথলে ওঠে, অচেনা লোক কে ঘরে ঢোকানো, কোনদিন আমাদের মেরে দিয়ে যাবে। রায় গিন্নী ঘরে ঢুকে কাজে মন বসাতে চাইলেও মন কিছুতে বসে না। ড্রয়িংয়ে রাখা শাশুড়ির ফটোটার তাকিয়ে ভাবেন কি জানি মেয়েটা কি বলে গেলো। কাজে কাজে দিন শেষ হয়ে সন্ধ্যে নামে। তুলসীতলায় সন্ধ্যে দিতে যান তিনি। অজান্তেই চোখ চলে যায় পেয়ারা তলার দিকে। চারিদিকে গভীর অন্ধকার নেমেছে। আজ ফলহারিণী অমাবস্যা, ভাবতেই গা টা ছমছম করে ওঠে। তুলসীতলায় প্রদীপ দেখিয়ে ভক্তি ভরে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ান তিনি, চারিদিকে ঝিঁ ঝিঁ পোকার তীব্র ঘোর লাগানো ডাক আর নিকষ কালো অন্ধকারে  কেমন যেন এক অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি করেছে । উঠে দাঁড়াতেই পা দুটো  হঠাৎ যেন ভারি হয়ে যায়,  তিনি এগোতে চেষ্টা করলেও এগোতে পারেন না। হঠাৎ এক ঝটকা হাওয়ায় তাঁর হাতের প্রদীপটা নিভে যায়। কিছু বোঝার আগেই সেই ভোরবেলার গোঙানির আওয়াজ শুনতে পান, এগিয়ে যেতে চেষ্টা করেন, পারেন না কিছুতেই।  কর্তাকে ডাকতে চেষ্টা করেন, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না তাঁর। কে যেন তাঁর কানের কাছে এসে গোঙাতে গোঙাতে বলতে থাকে, " বড়মা, ভুখ লাইগছে গো, দুটি মুড়ি দিবো? " দরদর করে ঘামতে থাকেন তিনি, ধীরে ধীরে অবশ হয়ে যায় শরীর, লুটিয়ে পড়েন তুলসীতলায়।         

  

0 comments: