সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.
 বন্দিপাখি- সুদীপ ঘোষাল





সুনিল টোটো চালায় মাধ্যমিক পাশ করে আর পড়ার সুযোগ পায় নি টাকা রোজগারের জন্য বাবার মারা যাবার পর এই কাজে নেমেছে বাবা বলতেন,কোনো কাজ ছোটো নয় আর খেটে খাওয়া সম্মানের কাজ
আজ টোটো নিয়ে সকালে বেরোনোর পর সুনিল চায়ের দোকানে এলো চায়ের দোকান বন্ধ কেন? ভেবে পেলো না অসিমকে দেখতে পেয়ে সুনিল জিজ্ঞাসা করলো,কি রে দোকান বন্ধ কেন? অসিম বললো,জানিস না, সমর বাবু মারা গেছেন তাই তার সম্মানে, আজ দোকান বন্ধ

সুনিল টোটো রেখে সমরবাবুর ছেলের সংগে দেখা করতে গেলো সমরবাবু সমাজসেবক তিনি দয়া করে টোটো কিনে দিয়েছেন সুনিল কে তিনি খুব ভালোবাসতেন তার বাবাকেও ভালোবাসতেন তাই তার ছেলের কাছে গিয়ে খোজ নেওয়া দরকার
সুনিলের ছোটোবেলার কথা মনে পড়ছে তাদের বাড়ির কাছে একটা পুকুর ছিলো একটা পানকৌড়ি ডুব দিয়ে তাকে খেলা দেখাতো কি যে খুঁজে  বেরাতো পুকুর জুড়ে জানত না সে শাপলা ফুল তুলে বাউরি বৌ একটা ফুল তার হাতে দিতো বেশ ভালো  ছিলো সেই সময়গুলো রাস্তা পার হতে গিয়ে বেজি আর শিয়াল দেখে তার মনে আনন্দের সীমা থাকত  না লাল মোরাম রাস্তায় হারিয়ে যেতো তার মনছুটে চলে যেতো  কদ তলার মাঠ পেরিয়ে অজয়ের ধার সেখানে পা ডুবিয়ে বসে থাকত ছোটো মাছগুলো পায়ে চুমু খেয়ে চলে যেত বারে বারে বালির চরে বালিহাঁসগুলো খেলা করত আপন খেয়ালে

তারপর কালের পরশে কালি লাগে মনে এখন আর তেমন করে ধরা দেয় না মন সংসারের চাপে গড়িয়ে যায় অজয়ের বানভাসি জল সমস্ত ভাললাগা স্বপ্নগুলো এলোমেলো হয়ে যায় জীবনে

সুনিল ভাবে,এই সংসারে টাকার দাম সবথেকে বেশি যার টাকা আছে লোকে বলে তার নাকি পৃথিবীটা হাতের মুঠোয় চলে আসে সে বিশ্বাস করে না টাকা থাকলে কি প্রকৃতি ধরা দেয় ধনী হলেই কি কবিতা লেখা যায় যায় না তাহলে সে নীল আকাশে তার মন ওড়াতে পারে না আয়নায় প্রেমিকার মুখ দেখতে পায় নানীল আকাশে মন ওড়ে না  শুধু অর্থ  বাড়াবার চিন্তা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় লোভের সাগরে চিন্তা করতে করতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে জানতে পারে নি আজ খালিহাতে বাড়ি গেছে মায়ের হাতে টাকা দিতে পারে নি মা রাতে খাবারের সময় বললেন,শুনেছিস সমরবাবু মারা গেছেন -
----হাঁ,মা, শুনেছি
-----তাদের বাড়িতে দেখা করেছিস
-----একবার গেছিলাম ছেলে আমাকে চেনে না তার বাবার সাথে আমার পরিচয়ের কথা বললাম ছেলে অত পাত্তা দিলো না আমি তারপর মাঠে বসে খেলা দেখছিলাম
----দুপুরে আবার কি খেলা
-----মা, সারা জগত খেলায় ব্যাস্ত শুধু দেখার মত চোখ চাইশোনার মত কান চাই
------ঠিক বলেছিস তোর বাবা যখন ছিলেন,তখন একবার চুপি পাখিরালয়ে নিয়ে গেছিলেন কি সুন্দর তাদের চলাফেরা ওড়া ওদের উড়তে দেখে মন চলে গেছিলো নীল আকাশে তোর বাবা বললেন, নামো, নামো পরে যাবে আমরা দুজনেই ছোটো হয়ে গেছিলাম তোর বাবাও তোর মত ভাবুক ছিলেন তাইতো ভরা চাঁদের আলোতে লাইন পার হতে গিয়ে ট্রেন চাপা পরলেন আমাদের রেখে তখন তুই তিন বছরের ছেলে তারপর বাড়ি বাড়ি কাজ করে তোকে বড় করেছি চাকরি না পেলেও মন তোর ছোটো নয় তুই বাবার মতোই বড়ো মনের মানুষ
-----মা তোমার ছোটোবেলার কথা বলো আমার শুনত ভালো লাগে
-----আমার বাবা ছিলেন পালক নরম,উদার মনের মানুষ কিন্তু লাঠি খেলা,সড়কি খেলায় তার জুড়ি মেলা ভার ছিলো দুর্গাদেবী মূর্তি  তিনি নিজেই বানাতেন আর অই কদিন আমরা বাবার কাছেই থাকতাম একমাটি,দুই মাটি করে রঙ করতেন মায়ের চোখ আকার দিনে আমাদের কৌতূহল বেড়ে যেত সকাল থেকে সাজ সাজ রব চোখ আঁকা হয়ে গেলে সাদা কাপড়ে ঢেকে দিতেন মায়ের দেহ সেই ঢাকা খোলা হোতো পুজোর দিনে ঢাকের বাজনার তালে তালে বেজে উঠতো আমাদের আমোদের তাল সেই তালে তালে মন নাচত অনেকদিন পড়ার ঘরে বাবা জোর কোরতেন না কোনোদিন আমরা আবার মিশে যেতাম সহজ জীবনে

মা বেটা গল্প করতে করতে রাত দশটা বেজে গেল তারপর মা চলে গেলেন নিজের ঘরে ছেলে নিজের ঘরে

তারপরদিন চা খেয়ে সুনিল বেরিয়ে পরলো নিজের কাজে টোটো চালিয়ে যা রোজগার হয় তার একটা ভাগ তুলে রাখে অভূক্ত মানুষের জন্য দিনের পর দিন চলে যায় সুনিল এখন একটা অনাথ আশ্রম গড়ে তুলেছে তার বাড়ির পাশের জমিতে মাটির বাড়িতে অনেক অনাথের বাস প্রথমে একটা ছিল বাড়ি ধীরে মানুষের সাহায্যে গড়ে উঠল আরও বাড়ি সে বুঝলো,ইচ্ছা থাকলে টাকা পয়সা বাধা হয় না কোনদিন আশ্রমের নাম রাখল,সমর নিবাস সমরবাবু তাকে টোটো কিনে দিয়েছেন আর তাই তার নামে সে আশ্রমের নাম রাখলো, সমর নিবাস সুনিলের বন্ধু দেবু বলছে,কে যে কখন কার আত্মিয় হয়ে যায় বোঝা কঠিন আশ্রমের নাম সুনিল বাবার নামে রাখলো না রাখলো তার মনের দেবতা সমরবাবুর নামে তার নিজের ছেলেও এই কাজ করতে পারেনি

দিকে দিকে সমর নিবাসের নাম ছড়িয়ে গেলো দান আস্তে লাগল প্রচুর সুনিল টোটো আশ্রমে রাখে আরো চারটি টোটো কিনে সে চারটি বেকার ছেলেকে কাজ দিয়েছে আর সমরবাবুর দেওয়া টোটো দান করেছে তার পাড়ার একটি গরীব ছেলেকে
সুনিলের পাড়ার ক্লাবে নেতাজী  জন্মজয়ন্তি পালিত হচ্ছে সভাপতি হয়েছে সুনিলসুনিল বলছে,নেতাজি আমাদের জন্য জীবন দিয়েছেনসমাজের সকল মানুষের জন্য  আসুন সবাই আমরা আজ গাছ লাগাই,তার সম্মানে   প্রচুর গাছের চারা তার নির্দেশে এসেছে সেগুলো গ্রামের চারদিকে লাগান হল গ্রামের পথে পথে গাওয়া হোলো গাছ লাগানোর গান
সুনিল নিজের হাতে সমর নিবাসের আশেপাশে অনেক গাছ লাগালো অনাথ আশ্রমের সবাই হাত লাগালো
এইসব কাজ করছে হঠাত বাড়ি থেকে হন্তদন্ত হয়ে এল বাড়ির কাজের মেয়েটা সে বলছে,সুনিলদা,তাড়াতাড়ি বাড়ি আসুন
-----কেন রে?
-----মা কেমন করছেন
কয়েকদিন ধরেই মায়ের শরীর খারাপ তাই মা নিজেই কাজের মেয়ে রুমাকে রেখেছেন রুমার কথা শুনেই সুনিল বাড়ি গেলো তার চোখে জল মাকে দেখে তার চিন্তা হোলো ডাক্তার ডাকতে মানা করলেন মা মা বললেন,আর সময় নেইতোর বাবা ডাকছেন এবার যাবোতবে যাবার আগে আমি এই রুমার হাত তোর হাতে দিলাম খুব ভাল মেয়ে তোরা বিয়ে করে সুখী হলে আমি শান্তি পাবো তুই আমাকে কথা দে
সুনিল বললো,কথা দিলাম
তারপর সুনিলের মা চলে গেলেন ধারাধাম থেকে সামনে সুনিল আর রুমা এক নতুন জীবনের পাঠ মা দিয়ে গেলেন তাকে মায়ের পায়ে মাথা রেখে কাদতে লাগল সুনিল

এবার মায়ের শ্রাদ্ধ মিটে গেলো কয়েক মাস পরে রুমাকে বিয়ে করলো সুনিল পাড়ার সবাই খুব আননন্দ করলো বিয়েতে বাপ, মা মরা মেয়েটা খুব ভাল সকলের প্রিয় রুমা এখন সমাজসেবকের স্ত্রী তাকে সকলে প্রথম প্রথম কাজের মেয়ে হিসাবেই চিনত কিন্তু সুনিলের মা জানতে পেরেছিলেন তার ভেতরের কথা রুমা কাজ করে যা রোজগার করতো তার অনেকটাই সুনিলের দানের বাক্সে দান কোরতো পাড়ার লোকেরা সুনিল মায়ের কানে কথাটা তুলেছিলো কিন্তু সুনিল জানত না রুমার জীবনে ছোটো থেকেই সুনিল আদর্শ পুরুষ তার বাবা জন্মের আগে মারা গেছেন আর মা তাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছেন দাইবুড়ি তাকে ছোটো থেকে মানুষ কোরেছেন এই দাইবুড়ি পরে দাতাবুড়ি হয়েছিলেন তিনি তার সবকিছু মানুষের জন্য দান করে গেছেন তার সমস্ত সম্পত্তি সমর নিবাসে দান কোরেছেন তিনি রুমাকে বোলতেন,কোনো কাজ ছোটো নয় খেটে খাবি তার সুখ আলাদা

রুমা সুনিলকে ছোটো থেকে মনে প্রাণে ভালোবাসত কিন্তু সে কথা কোনোদিন মুখ ফুটে বলতে পারে নি  সে খেতে গিয়ে ভাতের থালায় সুনিলের ছবি দেখতে পেত নীল আকাশে দেখত সুনিলের ছবি কিন্তু সে ভারতবর্ষের মেয়ে বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না নীরব প্রেমের শক্তি তার দেহ মনে

তার মনের কথা দাইমা জানতেন তাই রুমার সংগে পরামর্শ করে সব ঠিক করে দাতাবুড়িএকদিন হঠাৎ মরে গেলেন কিন্তু সুনিলের মায়ের অন্তর জানতে পেরেছিলো রুমার অন্তরের কথা তাই তিনি তাকে কাজের মেয়ে হিসাবে বাড়িতে এনে পুত্রবধু করে নিলেন ছেড়ে যাবার আগে

বিয়ের পরে সুনিল বললো রুমাকে,তুমি কি একটা ছেলের মা হতে চাওআমার কিন্তু অনেক ছেলে আছে রুমা উত্তর দিলো,আমি তোমার ছেলেমেয়ের দেখাশোনা কোরবো তারাই আমার নিজের সন্তান


সুনিল এই উত্তর আশা করেছিলো তার কাছ থেকে তার অন্তরে বেশ কিছুটা জায়গা রুমা ঘিরে নিল হৃদয় জুড়ে  সে বুঝতে পারলো,তার মা তাকে সঠিক জীবন সাথী খুঁজে  দিয়েছেন মায়ের স্মৃতি জুড়ে মায়ের মাটির বারান্দাকোঠা এখানে বাবা মায়ের আত্মা শান্তিতে আছে হৃদ মাঝারে, কোঠার মাঝে তাদের বন্দি কোরেছে রুমা আর সুনিল তাই সেই কোঠার নাম রাখল বন্দিপাখি...

সুদীপ ঘোষাল

    
লেখক পুর্ব বর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম থানার অন্তর্গত পুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। পিতা প্রভাতকুমার মাতা গীতারাণী। ছোটোথেকেই লেখার ওপর আকর্ষন। ১৯৮৪ সালে লেখা প্রথম উপন্যাস, মিলনের পথে। দুটি গদ্যগ্রন্থ ও কয়েকটি কাব্য পুস্তিকা আছে । পেশা শিক্ষকতা।



---------------------------

0 comments: