সম্পাদকের কলমে
লেখা পাঠানোর জন্য
Total Pageviews
বসন্ত শপথ
বৈদ্যনাথ ধাড়া
কৃষ্ণচূড়া তখনো আসেনি তার রঙের বাহার নিয়ে। অথচ শিমুলের ডালে টকটকে লাল ফুলগুলো একটা একটা করে ঝরে পড়ছে মাটিতে। কিন্তু পলাশ হাজির তার মনমাতানো প্রেমের আগুন নিয়ে। শুকনো মঞ্জুরির ফাঁকে উঁকি মারছে কচি কচি আম। গাছে গাছে নতুন পাতার সমারোহ।
ইচ্ছেবাড়ি গ্রামের বছর ষোলোর মেয়ে কুঁদি। পাশের বাড়ির রেহানার মতো অতোটা ফর্সা নয়। তবে চেহারায় একটা শ্রী বিদ্যমান। নিজেকে সুন্দর করার জন্য দামি কোনো মেকআপ বাক্স ও তার নেই। কোঁকড়ানো চুলের বিনুনির মাঝে এই সময় পলাশের কয়েকটি ফুল গুঁজে নিজেকে সাজিয়ে নেয়। শ্যামলা রঙে তার শরীরের গড়ন মন কাঁড়া। যৌবন যেন চলকে পড়ে নিত্যকার চলার ছন্দে। গরীবের ঘর বেশি দূর পড়া হয় নি। বাবা দিন মজুরি করে যা পায় তাই দিয়ে কোনোমতে চলে ওদের সংসার।
কুঁদি গুন গুন গান গায় যৌবনের তাড়নায়। কখনো পুকুর পাড়ে, কখনো গাঁয়ের মেঠোপথে কাজে অকাজে ঘুরে বেড়ায়। তার মন মানতেই চায় না কোনো বাধার প্রাচীর। এভাবেই ঘুরতে ঘুরতেই একদিন আলাপ কুঞ্জ র সাথে।
পাশের গ্রাম রাজগোদায় ওর বাড়ি। মেছেদা শহরে পাঁচ মাথার মোড়ে ছোট্ট একটা ফুলের দোকান। এখন শহুরে হাওয়া সবার মনে। তাই বিয়ে,অন্নপ্রাশন, জন্মদিনে এখন ফুলের আধিক্য। বেশ চলে ফুলের দোকান।
মোটরসাইকেলে আসা যাওয়ার পথে কুঁদিকে অনেকবার দেখেছে কুঞ্জ। কখনো আপন মনে ঝরে পড়া পলাশ ফুল কুড়াতে, কখনো পুকুর পাড়ে একা একা গান গাইতে। মেয়েটার গলা খুব মিষ্টি। গ্রাম্য গাছ গাছালির ফুল ভালোবাসে। কুঞ্জর মনে ধরে মেয়েটাকে। কাজের ফাঁকে শয়নে স্বপনে মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তা করে। ওকে নিয়ে অনেক স্বপ্নের জাল বোনে। কিন্তু মনের কথা তো বলতে হবে।
বসন্তের বিকেল। শুকনো পাতা ঝরিয়ে গাছগুলো নতুনভাবে সেজে উঠেছে। কুঁদি আপন মনে কয়েকটি তাজা পলাশ ফুল কুড়িয়ে খোঁপায় গুঁজে, সে ও সাজে নিজের মতো। তারপর গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে পুকুর পাড়ে বসে। একা একা পুকুরের জলে ঢিল ছুড়ে। জলতরঙ্গ দেখতে দেখতে মনকে ভাসিয়ে দেয় কোন অজানায়। ভাবে সংসারের কথা। বাবার কষ্টের দিনমজুরির কথা। পরনের ভালো কাপড় নেই। নিজেও বড়ো হচ্ছি। মায়ের কষ্ট। তার উপর বিয়ে। চোখে জল ভরে ওঠে।
এমন সময় কুঞ্জর মোটরসাইকেল এসে থামে রাস্তার পাশে পলাশ গাছের তলায়। হাতে কয়েকটা নাম না জানা ফুল। দোকান থেকে আনা। মেয়েটা ফুল ভালোবাসে। কিছুতেই সাহস হয় না কাছে যাওয়ার। সাহস হয় না ফুলগুলো ওর হাতে দেওয়ার। যদি রেগে ওঠে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই হাতের চাপে গাড়ির হর্ণ বেজে ওঠে। কুঞ্জ নিজে যেমন চমকায়, তার চেয়ে বেশি চমকে ওঠে কুঁদি। পিছন ফিরতেই দেখে ও পাড়ার ছেলে কুঞ্জ। মুখ নিচু করে পলাশ তলায় দাঁড়িয়ে। কুঁদি ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করে
_কিছু বলবেন? মেয়ে দেখে হর্ণ বাজাচ্ছেন কেন?
কুঞ্জ ঠিক কি জবাব দেবে বুঝতে পারল না।
আচমকা মুখ থেকে বেরিয়ে গেল সরি! মানে
আমি ঠিক বাজাতে চাইনি। হাত পড়ে বেজে গেল।
ঠিক আছে। তা রোজ তো চলে যান এই পথ দিয়ে, তা আজকে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন কেন? ও বাব্বা হাতে আবার ফুল ও দেখছি। তা ভয়ের কিছু নেই। আমি বাঘ নই। আমি জানি চিনি আপনাকে। পাশের গ্রামে থাকেন। বাবা বলছিল কথায় কথায়। বলুন কি বলবেন?
মেয়েটার কথায় কুঞ্জর বুকে যেন এক আকাশ সাহসের সঞ্চার হল। মুখে একটু হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল, আমি কুঞ্জ দাস। তোমার সাথেই কথা বলতে এসেছি। এই ফুলগুলো নাও। আমি জানি তুমি ফুল খুব ভালোবাসো। আমার ফুলের দোকান থেকেই আনা।
নাম না জানা ফুলগুলো হাতে নিয়ে কুঁদি গন্ধ শুকে অদ্ভুত মাদকতায়। পরক্ষণেই জিজ্ঞাসা করে কি ফুল এগুলো। আমি তো শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া জানি। যার মধ্যে মাটির টান অনুভব করি। এই বিদেশী ফুলের নাম জানা নেই আমার।
কুঞ্জ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে এটা অর্কিড, এটা টিউলিপ, আর এটা তো জানো ভালোবাসার গোলাপ। এবার বলো আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ফুলটির নাম। যাকে আমি রোজ দেখি।
কুঞ্জর মুখে নিজেকে ফুলের সাথে তুলনীয় হয়ে, কুঁদির মুখ লজ্জায় রাঙা হয়। ফুলগুলো বুকে জড়িয়ে বলে
আমার নাম কুন্দরানী জাঙাল। আমরা দুলে বাগদির জাত। বাবা দিন মজুরের কাজ করে। খুব গরীবের মেয়ে। সবাই ডাকে কুঁদি বলে।
তারপর একটু চুপ থেকে ভালোভাবে নিরীক্ষণ করে কুঞ্জর মুখ। মুচকি হেসে পুনরায় বলে
যতদুর জানি, তোমারা হিন্দু মাহিষ্য। বুকের পাটা ভীষন চওড়া না থাকলে, কোনো হিন্দুর ছেলে একটি দুলের মেয়েকে ফুল দেয় না। ভালোবাসার সাহস করে না। তবে তোমার সাহস আছে। সামনে দোলের দিন দেখা হবে। তার আগে থাকবো না। মামার বাড়ি যাবো বালিচক। চলি।
কুঁদির শেষ কথার ভেতর কুঞ্জ হাবুডুবু খায়। যেতে আসতে,কাজে আকাজে, নিদ্রায় জাগরণে সারাক্ষণ ভাবিয়ে তোলে। দু চোখের পাতা এক করতে পারে না। দুলে বাগদি জাতের মেয়ে। পরিবারের লোক যদি না মানে? তখন কি করবে! কোথায় যাবে ! পরিবারের কথা থাক, যদি সমাজ না মানে? রাতের ঘুম উড়ে যায় কুঞ্জর। তবে কুঁদি বলেছে বুকের পাটা আছে। সত্যিই তো, আমি হারবো কেন? আমি পুরুষ। আমার ভালোবাসাকে আমি মর্যাদা দেব। আমি কুঁদিকেই ভালোবাসি, দুলে হোক, বাগদি হোক কুঁদিকেই ভালোবাসবো। কেউ আটকাতে পারবে না। এটা আমার নিজের একান্ত নিজের। কুঁদির মনের ভেতর প্রথম দিনের এই আত্মপ্রত্যয়, অন্যকে জাগ্রত করার মানসিকতা কুঞ্জকে আপ্লুত করে।
ভাবতে ভাবতেই তিন দিন কাবার। দোল এসে টোকা দেয় সবার মনে। ফাগের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে কুঞ্জর মন। বিকেলের জন্য প্রস্তুত আবির নিয়ে । সে আজ তার কুন্দরানীকে হলুদ রঙে রাঙিয়ে বলবে পরোয়া করি না জাতপাত। পরোয়া করি না কারো চোখ রাঙনি। কুন্দরানী আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। আজ পৃথিবীর সব রঙে রাঙিয়ে দেবো তোমার মন।
কুঁদিও হলুদ শাড়ির আঁচলটাকে গাছকোমর বেঁধে, সারাদিন রঙ মাখে হইচই করে । হোলির আনন্দে মনকে আন্দোলিত করে পাড়ায় সকলকে রঙ মাখায়। শুধু আপেক্ষা একলা বিকেলের। গোধূলির কুমকুম আলোয় পলাশ গাছের তলায়, যেখানে কেউ থাকবে না। সেখানেই, তার মনে যে রঙ ধরিয়ে নিশ্চিত ঘর বাঁধার স্বপ্নে বিভোর করেছে, তার গালে যদি প্রেমের রঙ মাখা হাজার চুমু দিতে না পারি তবে এই বসন্ত আমার কাছে অর্থহীন। আমি মিশে যেতে চাই তোমার সাথে। আমার বিশ্বাস কুঞ্জ, তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে আবির হাতে।
0 comments:
Post a Comment