সম্পাদকের কলমে
নারায়ণ দেবনাথ-
সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম ।
ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম ।
নমস্কার সহ
অঙ্কুর রায়
সংখ্যার সম্পাদক
অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী
প্রধান সম্পাদক
লেখা পাঠানোর জন্য
আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com
Total Pageviews
By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.
ছড়ার সত্যজিত
অঙ্কুর রায়
বুঝে দেখ জটায়ুর কলমের জোর
ঘুরে গেল রহস্য কাহিনীর মোড় ।
থোড় বড়ি খাড়া
লিখে তাড়া তাড়া
অবশেষে লিখলেন খাড়া বড়ি থোড় ।
' হত্যাপূরী ' উপন্যাসের শুরুতেই সি বিচে দাঁড়িয়ে ফেলুদা মুখে মুখে এই লিমেরিকটি যে তৈরী করেছিল সেটা সত্যজিতের পাঠকমাত্রেই জানেন । এই ছড়াটির সাথে হত্যাপূরীর রহস্য উদ্ঘাটনের তেমন কোন সম্বন্ধ নেই , শুধুমাত্র পরিবেশ তৈরী ও ফেলুদার মুড ও সেই সময়ের হবির বর্ণনা দেওয়া ছাড়া । তবে আরেকটি কাজ এই লিমেরিকটি করেছিল এবং সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । সেটা হল কিশোর পাঠকদের সাথে লিমেরিক নামের এই বিদেশী ছড়া আঙ্গিকের পরিচয় করিয়ে দেওয়া । সেই সময় বাংলা ছড়া জগতে লিমেরিক অত পরিচিত ছিল না । ফেলুদাতো শুধু তোপসেকেই জ্ঞান বিতরণ করতো না , তোপসেকে বলার মাধ্যমে আমাদের মত কিশোরদেরও নানান বিষয়ে চোখ খুলে দিত ।
এই লিমেরিকটির সবচেয়ে গুরুত্ব এখানে যে এটি সম্ভবত সত্যজিতের লেখা ও প্রকাশিত একমাত্র মৌলিক ছড়া । যদি আরো কিছু ছড়া উনি লিখেও থাকেন তবে তা সংখ্যায় খুবই কম এবং তার মধ্যে এটি যে অন্যতম তা সন্দেহ নেই । সত্যজিত তাঁর ফিল্মে বা লেখায় যখনই কোন চরিত্রের মুখে ছড়া দিতে চেয়েছেন তখনই তিনি সুকুমার থেকেই উপযুক্ত একটা ছড়া ব্যবহার করেছেন । কিন্তু সুকুমার যেহেতু কোন লিমেরিক লেখেননি তাই হত্যাপূরীতে পরিবেশ অনুযায়ী সত্যজিতকে নিজেকেই একটি লিমেরিক বাঁধতে হয়েছে । আর ফেলুদার মুখ দিয়ে লিমেরিক কাকে বলে তা আপামর কিশোর পাঠকদের তা তিনি বুঝিয়েও দিয়েছেন । বাংলায় সত্যজিত অবশ্যই প্রথম লিমেরিকটি লেখেননি কিন্তু ওনার একার প্রচেষ্টায় এই বিদেশী ছড়া আঙ্গিক বাংলায় বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে ।
সত্যজিতের ছড়া ও লিমেরিক লেখার হাতেখড়ি অবশ্য হত্যাপূরীর বেশ কিছুদিন আগেই । তাঁর সত্তর বছর উপলক্ষে যখন '' সেরা সত্যজিত '' প্রকাশিত হয় তার ভূমিকায় তিনি নিজেই জানাচ্ছেন কী করে তাঁর ছড়ার রাজ্যে আগমন । সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্ররোচনায় যখন দ্বিতীয় পর্যায়ে '' সন্দেশ '' পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করলো তখন অন্যতম সম্পাদক হিসেবে তাঁরও কলম ধরার দরকার পড়লো । এর আগে কখনও সত্যজিত কিশোর সাহিত্য লেখেননি । কী লেখা যায় ভাবতে গিয়ে হাত দিলেন এডওয়ার্ড লিয়রের ননসেন্স ছড়া ও লিমেরিক অনুবাদে । তারপর সুদীর্ঘ পঁচিশ বছর কালসীমার মধ্যে লিয়রের অনেকগুলি , লুই ক্যারলের চারটি এবং হিলেয়ার বেলকের একটি ও ডার্মি টমসনের একটি অনুবাদ করেন । এই সবকটি ছড়া ও কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় ''তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম '' ।
অনুবাদ জিনিসটাই খুব কঠিন । কবিতা অনুবাদ তো আরও কঠিন । বলা হয় কবিতা অনুবাদ করাই সম্ভব নয় কারণ একটি ভাষা ও সংস্কৃতির ইডিয়ম , রূপক, সংকেত অন্য ভাষা ও সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত করা সম্ভব নয় । তবু কবিতার অনুবাদ হয়ে চলেছে সমস্ত প্রতিকূলতা জয় করেই । কিন্তু ননসেন্স কবিতা বা ছড়ার অনুবাদ কী করে সম্ভব ? যার কোন অর্থ নেই সেই নিরর্থক ধ্বনি , শব্দ , অর্থ ইত্যাদির কী রূপান্তর হবে ? অর্থবহ ভাবের সাথে অর্থহীন কথার সঠিক মেলবন্ধনেই তো জন্ম নেয় ননসেন্স কবিতা । তাহলে কী করে তার অনুবাদ সম্ভব ?
ঠিক এই জায়গাতেই সত্যজিত তাঁর প্রতিভা , তাঁর অনন্যতা দেখালেন । লিয়র এবং ক্যারল দুজনেই ননসেন্স ছড়া ও কবিতা লিখেছেন কিন্তু দুজনের লেখার ভঙ্গি , বিষয় , উপস্থাপন এবং শব্দ ব্যবহার সম্পূর্ণ আলাদা । লিয়র অর্থপূর্ণ শব্দ ও বাক্য দিয়ে অসম্ভব বা অবাস্তব বিষয় উপস্থিত করেছেন । তাঁর ননসেন্স বিষয়ের ননসেন্স । অন্যদিকে ক্যারল অর্থহীন শব্দসমষ্টি দিয়ে অর্থপূর্ণ বাক্য তৈরীর ভান করেছেন । ক্যারলের ননসেন্স শব্দের ননসেন্স । তাই অনুবাদের জন্যও সত্যজিত দুরকম পথ নিলেন ।
লিয়রের দুটো বড় কবিতা তিনি অনুবাদ করেছিলেন - The Jumblies এবং The Dong with a Luminous Nose . দুটি কবিতার ক্ষেত্রেই তিনি মোটামুটি মূলানুগ অনুবাদ করেছিলেন , মূল ভাব ও বক্তব্য একই রইলো । শুধু পরিবর্তন করেছিলেন নাম । The Jumblies হয়ে যায় পাপাঙ্গুল আর ডংকে এনে ফেললেন চ্যাংলি পাহাড় আর ঘুমভুলিয়ার মাঠে । একটু পাশাপাশি রেখে দেখা যাক -
The Jumblies
BY EDWARD LEAR
They went to sea in a Sieve, they did,
In a Sieve they went to sea:
In spite of all their friends could say,
On a winter’s morn, on a stormy day,
In a Sieve they went to sea !
সত্যজিতের অনুবাদে দাঁড়ালো -
তারা ছাঁকনি চড়ে সাগর পাড়ি দেবে
দেবেই দেবে।
তাদের সবাই করে মানা ,
বলে , 'আর কিছুতে যা না -
দিচ্ছে হাওয়া পুবে
ঘূর্ণিতে সব মরবি যে রে ডুবে । ' ..........
ঝোড়ো শীতের সকাল হয়ে গেল গ্রীষ্মের পূবালী হাওয়ার দিন । এ তো হবারই ছিল । বাংলায় গরম কালেই পূবালী হাওয়া ওঠে ।
লিয়রের অনেকগুলি লিমেরিক তিনি অনুবাদ করেছিলেন । এগুলো অনুবাদ করতে তিনি সম্পূর্ণ এক নতুন পদ্ধতির আশ্রয় নিলেন । তিনি না করলেন শব্দ ধরে ধরে অনুবাদ , না করলেন সারানুবাদ । তিনি করলেন ছবির অনুবাদ । প্রতিটি লিমেরিকের সাথে লিয়র যে ছবি এঁকেছিলেন তিনি সেই ছবিগুলো ধরে লিমেরিক লিখলেন । এক দিক থেকে এগুলো অনুবাদ না হয়ে মৌলিক ছড়া হয়ে গেল । কারণ মূল লিমেরিকের সাথে অর্থের পার্থক্য অনেক সময়ই হয়ে গেল ছবি ধরে লেখার জন্য । দু একটা উদাহরণ দেখা যাক -
There was an Old Man with a beard,
Who said ' It is just as I feared! -
Two Owls and a Hen, four Larks and a Wren,
Have all built their nests in my beard. '
সত্যজিত লিখলেন -
বললে বুড়ো , ' বোঝো ব্যাপারখানা -
একটা মোরগ , চারটে শালিকছানা ,
দুই রকমের হুতোমপ্যাঁচা
একটা বোধহয় হাঁড়িচাঁচা
দাড়ির মধ্যে বেঁধেছে আস্তানা ।'
বাংলা শব্দের ধ্বনিমাধুর্য ও অন্তহীন অন্তমিল কাজে লাগিয়ে অনুবাদ যে মূলকেও ছাড়িয়ে গেছে তা না বললেও চলে । এক্ষেত্রে মূল লিমেরিকের সাথে অর্থের পার্থক্য নেই। কিন্তু এটির সাথে অবশ্যই আছে -
There was an Old Man with a nose,
Who said, ' If you choose to suppose
That my nose is too long, you are certainly wrong! '
That remarkable Man with a nose.
সত্যজিত করলেন -
এক যে সাহেব তার যে ছিল নাক
দেখলে পরে লাগতো লোকের তাক ।
হাঁচতে গিয়ে হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ
নাকের মধ্যে লাগলো প্যাঁচ ।
সাহেব বলে , ' এইভাবেতেই থাক । '
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন ।
আবার ক্যারলের অনুবাদ যখন করেছেন তখন আবার তিনি অন্য সত্যজিত । প্রতিটি অর্থহীন শব্দকে তিনি অর্থহীন বাংলা শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করছেন কবিতাটির বঙ্গীভবন করার জন্য । এবং এমনই সার্থকভাবে তা করছেন যে দেখলে আশ্চর্য হতে হয় । মনে হয় সুকুমারপুত্র নব আবোল তাবোল লিখতে বসেছেন । একটা ছোট্ট উদাহরণ দেখি -
Jabberwocky
BY LEWIS CARROLL
’Twas brillig, and the slithy toves
Did gyre and gimble in the wabe:
All mimsy were the borogoves,
And the mome raths outgrabe.
সত্যজিতের অনুবাদে -
জবরখাকি
বিল্লিগি আর শিঁথলে যত টোবে
গালুমগিরি করছে ভেউয়ের ধারে
আর যত সব মিমসে বোরোগোবে
মোমতারাদের গেবগেবিয়ে মারে ।
খাঁটি ননসেন্সের এরচেয়ে খাঁটি ননসেন্স অনুবাদ বিশ্বসাহিত্যে আর দুটি নেই ।
কিন্তু আশ্চর্যের কথা ১৯৮৬ সালে যখন '' তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম '' প্রকাশিত হয় বা যখন এগুলো ''সন্দেশ '' পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়েছিল তখন থেকে আজ পর্যন্ত কোন পাঠকের এই ছড়া ও কবিতাগুলোকে বিদেশি বা অনূদিত মনে হয় নি । এতটাই স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল এই অনুসৃষ্টি । একটি সাধারণ মানের ভালো ছড়া লিখতে গেলেই ছড়াকারের পরিশ্রম , প্রচেষ্টা চোখে অনেক সময়ই ধরা পড়ে যায় কোন অন্তমিলের মধ্যে বা মাত্রা ঠিক রাখতে গিয়ে বাগধারা পরিবর্তিত হয়ে যাবার মধ্যে । কিন্তু ইংরেজি থেকে এরকম ননসেন্স রাইমের সাবলীল অনুবাদ বা অনুসৃষ্টির মধ্যে কোন রকম পরিশ্রমের নূন্যতম ছাপ আমাদের চোখে পড়ে না । সত্যজিত যে একজন বিরল প্রতিভাধর ছড়াকার ছিলেন তা এই ক্ষীণতনু গ্রন্থটি পড়লেই বোঝা যায় । মনে হয় আমরা পরের প্রজণ্মের আবোল তাবোল পড়ছি । আফশোস হয় সত্যজিত তাঁর দীর্ঘ লেখক জীবনে আরো ছড়া কেন লিখলেন না ।
Subscribe to:
Posts (Atom)
0 comments:
Post a Comment