সম্পাদকের কলমে

নারায়ণ দেবনাথ- সত্যি বলতে কি একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। একটা বিশাল বড় অধ্যায়, যেখানে বাবা/ মা, ছেলে/ মেয়ে বা দাদু/দিদা, পিসি, ঠাম্মা সব এক হয়ে গেছিল । চলে গেলেন শরীরের দিক থেকে কিন্তু সারাজীবন রয়ে গেলেন মনে, চোখে আর স্বপ্নে। কার্টুন তাও আবার নিখাদ বাংলা ভাষায়, বাংলা চরিত্র নিয়ে, কিন্তু সেই চরিত্র আবার খুব সাহসী। উনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা পৌঁছে গেছে। নারায়ণ দেবনাথ -এর প্রতি #গল্পগুচ্ছ এর পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম । ভাল থাকবেন, যেখনেই থাকবেন। আমরা কিন্তু আপনার দেশেই রয়ে গেলাম । নমস্কার সহ অঙ্কুর রায় সংখ্যার সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্ত্তী প্রধান সম্পাদক

লেখা পাঠানোর জন্য

আপনার লেখা পাঠান আমাদেরকে
golpoguccha2018@gmail.com

Total Pageviews

By Boca Nakstrya and Gologuccha . Powered by Blogger.


 তাজপুরের রাজবাড়ি


   শ্রবণা মজুমদার


- কিরে সোম সবে তো নিট দিয়ে উঠলি এবার তো ছুটি- ফুটি পাবি নাকি? 

- বাবা আমাদের সোম তো এবার হবু ডাক্তার হতে চলেছে আর আমাদের পাত্তা দেবে কেন ভাই? 

- কিরে ভুলে যাবি নাকি ভাই? এই আমাদের পাড়ার অশিক্ষিত মূর্খ বন্ধুগুলো কে আবার ভুলে যাসনা যেনো... তোর আশায় বসে আছি ফ্রীতে চিকিৎসা নেবো বলে... প্লিজ ভাই...হাসাহাসি চরম পর্যায় পৌঁছালো আর সোম মুখে মিটিমিটি হাসলেও মনে মনে যে বেশ খুশি হলো তা মুখের ভাবভঙ্গি দেখলেই বোঝা যায়... এই হাসাহাসির আওয়াজে পাড়ার রক যেনো গমগম করে উঠলো.. সোম জমিদার বাড়ির ছেলে তাই বিশাল দালান রক থাম দিয়ে সজ্জিত বাড়ি.. আর সেই কারণেই এই বাড়িতেই রোজ আড্ডা দিয়ে বিকেলটা শুরু করে সোম আর ওর চার বন্ধু মিলে..সোম,ঋজু,হাবলু,রিক আর বিল্টু এই হলো ওদের গ্রুপ.. পাড়ার সকলে ছোটো থেকেই ওদের পঞ্চপাণ্ডব বলে কারণ প্রায় ৯-১০ বছরের বন্ধুত্ব ওদের.. চিরকাল এই পাঁচজনের একসাথে ওঠা বসা খাওয়া দাওয়া সব কিছু একসাথে... এক স্কুল পেরিয়ে এবার ওদের কলেজে যাবার পালা..  এদের এই পাঁচজনের গ্রুপে সোম ছিলো সব থেকে বেশি পড়াকু তাই ওর ছোটো থেকেই ডাক্তার হবার শখ ছিল আর সেই মতোই সে পড়াশুনা চালিয়ে এখন ডক্টর হবার দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে.. হাবলু বিল্টু আর্টস কারণ ওদের পড়াশুনাতে মন কোনোদিনই ছিলো না শুধু খেলায় ঝোঁক তবে পয়সার অভাবে তেমন প্রফেশনালি সেটাকে নিতে পারেনি.. ওই টুকটাক পাড়ার ফুটবল কম্পিটিশন খেলা আর বাচ্ছাদের যা একটু আধটু খেলা শেখায় শখে ব্যাস এইটুকুই! ঋজু হলো কমার্সের স্টুডেন্ট তাই ও প্লেন চাকরি করবে; আর পরে রইলো রিক ওর বাড়ির বনেদি ব্যবসাতে বাবা কাকা দাদুর মতন ঝোঁক তাই ও ওই নামকে-বাসতে একটা কলেজ পাস গ্রাজুয়েটের খাতায় নাম লেখাবে ঠিক করে ফেলেছে... 

- কিরে কোন ভাবনাতে হারিয়ে গেলি সোম? বলে উঠলো বিল্টু.. বোধহয় ডক্টর হবার পর কোথায় কোথায় চেম্বার খুলবে তারই ভাবনা ভাবছে! পাশ থেকে ফুট কাটলো হাবলু.. সকলে আবার হেঁসে উঠলো.. 

- তোদের কি আমার সাথে ছেবলামি করা ছাড়া আর কোনো কাজ খুঁজে পাশ না নাকি রে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে বলতে বসলো সোম রকের ধার ঘেঁষে.. 

- আচ্ছা মামা ছাড়ো এসব! আসল কথায় আসি এবার.. গম্ভীর মুখে ঋজু যখন কথাটা বললো সোম বললো কি হয়েছে রে? অ্যানিথিং সিরিয়াস নাকি? 

- খুব সিরিয়াস ব্যাপার.. রিক বলেই বললো ধৈর্য ধরে সকলে বসো আর আমাদের ঋজু মামা কি বলছে তা মন দিয়ে গ্রাস করো .. বলেই ঋজুর দিকে  আজ্ঞার ভাব ধারণ করে বলে উঠলো জাঁহাপনা শুরু করুন দেখি... 

- শোন সোম দেখ আমরা যে লাইনে পড়াশুনা করেছি তাতে আশা করছি সকলে মানে আমরা চারজন এখানে থেকেই কাটাতে পারবো.. আশা করা যায় আমতলা ছেড়ে আমাদের কোথাও যেতে হবেনা তবে দেখ সোম তোর যা পড়া তাতে তুই কলকাতাতে চান্স পেতেও পারিস আবার আগামী পাঁচ বছরের জন্য তোকে অন্য কোথাও চলে যেতে হলেও হতে পারে .. তাই আমরা ঠিক করেছি যে এখন তো আমরা সবাই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে গেছি তাই আমরা এবার কোথাও বেড়াতে যেতেই পারি বন্ধুরা মিলে.. আমরা চারজন বাড়িতে মানিয়ে নিয়েছি এবার পরে আছিস তুই.. প্লিজ ভাই সোম বাড়িতে ম্যানেজ কর ভাই প্লিজ... একদিনের জন্য কি ম্যাক্সিমাম দুই ব্যাস..  তিনদিনের মাথায় বাড়ি চলে আসবো... খুব মজা হবে চল না ভাই.. এরপর আবার কবে দেখা হবে না হবে আদেও হবে কিনা কিছুই তো আর জানিনা তাই রিকোয়েস্ট করছি তোকে... 

- প্লিজ মামা বাড়িতে প্লিজ তুমি রাজি করাও.. দেখো তুমি না গেলে তো আর বেড়ানো জমবে না ভাই.. প্লিজ চল... রিক বলে উঠলো আর হাবলু বিল্টু দুজনেই তাতে মত দিলো..

- আরে এতবার প্লিজ বলার কিছু নেই রে আমারও যেতে বিশাল ইচ্ছে করছে রে.. আসলে উচ্চমাধ্যমিক তারপর নিট আমারও খুব প্রেশার গেছে আর সত্যি আমারও ভালো লাগছে না.. ঠিকাছে তোরা আজ বাড়ি যা আমি দেখছি কিভাবে কি করা যায়... 

   মোটামুটি একটা আশার আলো আছে দেখতে পেয়ে যখন হাবলু বিল্টু ঋজু রিক বাড়ির পথে হাঁটা দিলো তখন সোজা বড়ো গেট বন্ধ করে সোম ওপরে আসে আর ছক কাটা বিশাল বারান্দা পেরিয়ে বসার ঘরে এসে দেখে মা গা ধুয়ে বাসি কাপড় ছেড়ে কাচা কাপড় পড়ে ঘরে সন্ধ্যে দিচ্ছে আর বাবা বসে আছে সোফাতে আর টিভির চ্যানেল বদলাচ্ছে... মা বাবা তোমাদের সাথে একটু কথা আছে.. বলবো গো? বাবা সোমের মুখের দিকে না তাকিয়েই বললো কি চাই বল? বাবা ঐ হাবলু বিল্টুরা এসেছিলো একটা কথা বলেছে.. কি বল! বাবা বলে উঠলো ...দরজার কোনায় দাঁড়িয়ে আসতে আসতে বলে উঠলো - পরীক্ষার তো খুব চাপ গেছে ওরা বলছিলো যে দুদিনের জন্য যদি কোথাও থেকে ঘুরে আসা যায়.. মানে এই ধরো আজ যাবো কাল থাকবো পরশু বাড়ি চলে আসবো.. যাবো আমি? এক নিঃশ্বাসে কথাটা সেরে নিয়ে সোম তাকালো বাবার দিকে.. এবার বাবা টিভি বন্ধ করে ফিরলো সোমের দিকে.. মা একটু মুখ কাঁচুমাচু করলো ঠিকই তবে বাবা একবারেই পারমিশন দিয়ে দিলো..এবং বললো টাকাপয়সা সুভিধা মতন নিয়ে নিস আর সাবধানে ঘুরে আসিস..  ব্যাপারটা ম্যানেজ হয়ে যাবে ভেবেছিল মনে মনে তবে এতো সহজে ঘটবে ভাবেনি সোম... ঘরে ঢুকেই ফোন করলো ওদের.. কথা বার্তা সব ঠিক হয়ে গেলো... ফাইনাল করা হলো ১৫ই জুলাই ওরা রওনা দেবে অর্থাৎ ঠিক ৩দিন পর...

                 ১৫ই জুলাই সকাল সকাল বেরিয়ে হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে গেলো ওরা তাজপুর; দীঘার যেহেতু আগেই তাই সমুদ্রের ধার আছে এখানে... দীঘার মতন অত ভিড় নেই ঠিকই তবে লোকজন কম একেবারে তাও বলা চলে না.. ঋজুর বাবা যেহেতু সাবডিভিশনাল অফিসার তাই সেই সূত্র ধরেই তাজপুরে একটা হোটেল বুক করে নিয়েছিলো ওরা... পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা ১২টা বেজে গেছিলো তাই স্নান করে ভাত কসা মাংস খেয়ে টেনে ঘুম দিয়েছিলো পাঁচজনেই.. বিকেলবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখলো ক্লান্তি বেশ কমে এসেছে তাই এবার চারজনে বেরিয়ে পড়লো সমুদ্র দর্শনে তো বটেই সাথে সাথে তাজপুর এক্সপ্লোর করার উদ্দেশ্যেও! ঝাউবন ধরে পাঁচজন হাঁটতে হাঁটতে বেশ অনেকটা চলে গেলো এমন সময়ে বিল্টুর চোখে পড়লো দূরে একটা পোড়ো ভাঙাচোরা রাজবাড়ি.. জায়গাটা বেশ ইন্টারেস্টিং বলেই বোধহয় চোখে পড়ে গেছিলো ওদের... এ ভাই দেখ! ওটা একটা রাজবাড়ি না? বিল্টু বলতেই সবার চোখ ঘুরে গেলো ওদিকে... হ্যাঁ তাই তো! হাবলু সম্মতি জানাতেই রিক বললো চল তো গিয়ে দেখি কি কেস! আমাদের ঢুকতে দেবে? - সোম বলতেই ঋজু বললো আরে ভাই গিয়ে তো দেখি! না ঢুকতে দিলে না দেবে.. অ্যাটলিস্ট একবার যাই গিয়ে দেখা যাবে... পাঁচজন ওদিকে হাঁটতে শুরু করলো.. যতটা কাছে মনে হচ্ছিল দূর থেকে দেখে তত কাছেও নয় প্রায় ১৫মিনিট হাঁটতে হলো ওদের... গিয়ে চোখ যেনো বিস্ফারিত হবার জোগাড় হলো... ভাঙা পোড়ো ঠিকই তবে একটা সময়ে দেখলে মনে হয় যেন খুব জাঁকজমকপূর্ণ ছিলো.. চারিদিকে ধুলো বালি ময়লা ময়লা হলেও দেওয়াল গুলোতে হাত রাখলে যেনো গা শিউরে ওঠে... সমুদ্রের জল প্রায়ই ভেতরে চলে আসে বলে বোধহয় আঁশটে স্যাঁত স্যাঁতে একটা গন্ধ নাকে ভেসে আসছিলো সোমের... বেশ মন দিয়ে দেখতে শুরু করলো ওরা চারিদিকটা... সদর দরজা খোলা তাই ভেতরে ঢুকে পড়লো সহজেই... আসপাশে কোথাও এমন কাউকে দেখা গেলনা যে কিনা রাজবাড়ীতে প্রবেশাধিকার নিয়ে কিছু বলতে পারে... সোম একটু বেশিই মন দিয়ে বাড়ির বাগান বাগানে রাখা সিংহের মূর্তি সেই মূর্তির কারুকার্য দরজার কারুকার্য দেখতে দেখতে কিছুটা পিছিয়ে পড়লো ওদের থেকে... সোম পড়াশুনার পাশাপাশি পুরনো বাড়ি আসবাব এসব নিয়ে একটু চর্চা করতে ভালোবাসে এটা ওর শখের মধ্যেই পড়ে তাই মন দিয়ে সেগুলো পরখ করতে শুরু করলো... দেখতে দেখতে ও যে কখন ওদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাড়ির মূল ফটকে প্রবেশ করে ফেলেছে বুঝতেই পারেনি..  কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছিল বার বার.. কিছুতেই ছবি তুলতে পারছিলনা ক্যামেরাতে.. কাঁচ পরিষ্কার করে তুলতে গেলেও উঠছিল না কিছুতেই.. কি হলো রে বাবা ক্যামেরাটার উফফ..  একটু ছবি তুলবো ভাবলাম তারও দেখি উপায় নেই... হঠাৎ করে সোমের মনে হলো চোখের পাতা ফেলার নিমেষে কি যেনো একটা দরজা পেরিয়ে হুশ করে চলে গেলো কালো ছায়ার মতন... কিন্তু সেটা যে ঠিক কি ঠায়োর করতে পারলনা সে... সোম ভাবলো বোধয় মনের ভুল.. অন্ধকার পোড়ো রাজবাড়ীতে একটু থ্রিলিং কিছু ফিল আসবে এটাই স্বাভাবিক... তারপর খেয়াল হলো ওরা কোথায় গেলো..  চিৎকার করে ডাক দিলো বিল্টু, হাবলু, রিক এই ঋজু.. কই তোরা? কিরে? কই গেলি সব? - বাবুজি কাউকে খুঁজছেন?চরম নিঃস্তব্ধতার মধ্যেই একটা ভাঙা ভাঙা আওয়াজ শুনে চমকে পিছন ফিরে তাকালো সোম... দেখলো একটা রোগা সত্তর ঊর্ধ্ব কালো রঙের মাথা ভর্তি সাদা চুলের এক বৃদ্ধ ব্যক্তি দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে সোমের দিকে.. আপনি কাউকে খুঁজছেন? লোকটা আবার বলতেই সোম বলে উঠলো আপনি কে? আমি আমার বন্ধুদের খুঁজছি... ওরা কোথায় আছে? কথা শেষ করতে না করতেই লোকটি বললো আমি এই বাড়ির ঠিক পিছনে কুঁড়ে ঘরটায় থাকি এই বাড়ির দেখাশুনা করি... কয়েকটা ছেলেপুলে ঐ পিছনের বারান্দায় ঘুরছে আপনি বোধহয় ওদের কথাই বলছেন তাই না? আপনি চাইলে আমি আপনাকে ওনাদের কাছে পোঁছে দিতে পারি.. সোম কিছু না বুঝে বললো চলুন! সোম লোকটার সাথে যেতে যেতে তাকিয়ে ছিলো ওনার দিকে.. হাজার প্রশ্নের কৌতুহল যখন ছেঁকে ধরছে সোমকে তখনই লোকটা বলে উঠলো এই রাজবাড়ি প্রায় সাড়ে ৪০০ বছরের পুরনো... রাজা চন্দ্রিলরাজ এই রাজবাড়ি স্থাপন করেছিলেন তার মেয়ে কনক আর জামাই বীর সিংহের জন্য... এ রাজবাড়ি অত্যন্ত অভিশপ্ত... অনেক কাহিনী রয়েছে একে ঘিরে এখানে বেশিক্ষণ না থাকাই ভালো... এরম বলছেন কেন? কিসের বিপদ হওয়ার কথা বলছেন আপনি?কি কাহিনী আছে? আর আপনিই বা কে? সোম কৌতুহলবশত অনেকগুলো প্রশ্ন একসাথে করে বসলো..দাঁড়াও বাবুজি দাঁড়াও এতো প্রশ্ন করলে উত্তর দি কেমন করে! আমি এই বাড়ির বিশ্বস্ত কাজের লোক ছিলাম... বয়স হয়ে গেছে আর এই পোড়ো বাড়িটার প্রতি আমার অদ্ভুত মায়া কারণ আমার ১৪ পুরুষ ধরে এই বাড়ির কাজে লেগে আছি.. আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা এই রাজবাড়িতে রাজার নায়েবের কাজ করতো তারপর বিভিন্নভাবে আমরা জড়িয়ে গেছি আর কি! আমার নাম  হীরলাল.. আমার পরিবার পরিজন কেউ নেই... এই বাড়িতে ঝারপোছ করে আর চাএর দোকান থেকে যা রোজগার করি তাই দিয়ে দিন কাটাই.... তাজপুর এখন পর্যটকদের আকর্ষণস্থল হয়েছে ঠিকই তবে এদিকটায় সত্যিই কেউ আসেনা.. সন্ধের পর জনমানব শুন্য হয়ে যায়... আপনরা ফিরে গেলেই মঙ্গল হয়... কথা বলতে বলতে হঠাৎই দেখে সোম বিল্টু আর হাবলু ওর দিকে এগিয়ে আসছে আর এসেই বলছে এটা কি হলো মামা? তুমি তো আমাদের হালুয়া টাইট করে দিয়েছিলে পুরো... হাবলু কথা শেষ করতে না করতেই ঋজু বললো কোথায় ছিলিস তুই? টেনশনে তো হাত পা কাঁপছিলো আমাদের  নাকি! আমরা কখন থেকে অপেক্ষা করছি আর তোর দেখি পাত্তাই নেই... সোম কিছু বলার আগে রিক এসে বললো এই বুড়োটা আবার কে? কোথা থেকে ধরে আনলি একে? সোম বললো দাঁড়া দাঁড়া সব বলছি... এবার নাম হীরলাল... এই রাজবাড়ীর পেছনের কুঁড়ে ঘরে থাকে... আমাকে বলছিলো এই রাজবাড়ীর নাকি অনেক গল্প আছে জানিস.. আর এখানে বেশিক্ষণ থাকা নাকি বিপদজনক... তবে পুরো গল্পটা ঠিক কি সেটা শোনা হয়নি এখনো... ওরে মামা! এতো দেখছি পুরো হরর থ্রিলার.. আরি ব্যস্! হেব্বি জমবে মনে হচ্ছে গল্পটা... বিল্টু বলে উঠলো... এরপরই রিক বললো চারজনকে ডেকে শোননা আজকের রাত টা এখানে কাটাবি? হতেও তো পারে কিছুই নেই আমাদের প্লেন ছোটো ভেবে বোকা বানাচ্ছে দাদু টা... হতে পারে হয়তো সোমকে বাচ্চা ভাবছে কি বলিস! প্রস্তাব পেশ হতে না হতেই সকলে এক পায় খাঁড়া হয়ে গেলো! পাশের গ্রাম থেকে রুটি তরকা কিনে এনে সবাই মিলে হীরলালকে চেপে ধরলো সমস্ত কাহিনী খুলে বলার জন্য! প্রথমে সে রাজি ছিলনা ঠিকই তবে এতজনের জোরাজুরিতে ও বেচারা একা আর কি করে থামাবে সকলকে...ব্যাস আসর জমে উঠলো...

           হীরলাল অবশ্য বলার আগে লক্ষবার সাবধান করেছিলো কাহিনী বললে সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটে যাবে কিন্তু তবুও কেউ শুনতে ছাড়েনি...বার বার বলেছিল আরে দাদু তোমার যদি কিছু বিপদ হয় তাহলে তো আমাদের ও হবে  এতো ভয় পাচ্ছো কেন? দরকার পড়লে সবাই সবার পাশে থাকবো তুমি বলোতো শুধু তাহলেই হবে... হীরালাল যখন দেখলো যে সে জোরাজুরির কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য তখন কাহিনী শুরু করলো...  রাজা চন্দ্রিলরাজ মূলত উড়িষ্যার রাজা হলেও তার মেয়ে কনকের চিরকালই এই বাংলার প্রতি এক অসম্ভব আকর্ষণ ছিল.. সে বারবার যেকোনো ভাবেই বাংলা ঘুরতে আসতে পছন্দ করতো ... রাজা চন্দ্রিলের সে ছিল সব থেকে ছোট আর আদুরে কন্যা.. রাজার তিন পুত্র সন্তান ছিল আর কনক ছিলো তার একমাত্র কন্যা সন্তান তাই সে ছিল তার বড়ো আদরের ধন... যেমন ছিল রূপের তেমন ছিল গুণের.. তার দিকে কেউ তাকালে তার দৃষ্টিশক্তি কিছুক্ষনের জন্য হারিয়ে যেত এতোটাই রূপবতী ছিলো সে... ১৯বছর বয়সে যখন তার বিবাহের প্রস্তুতি শুরু হয় তখন রাজা তার জন্য সংম্বরের আসর বসিয়েছিল... দেশ বিদেশ থেকে অনেক রাজপুত্র এসেছিলো তবে উনিশটা পরীক্ষার পরই পাশ হয় রাজা বীরসিংহ.. এই সময় রাজা চন্দ্রিল ঠিক করে তার মেয়েকে সে বাংলায় পাঠাবে আর সেখানেই সে তার সংসার গড়ে তোলার পাশাপাশি বাংলার দায় দায়িত্বও সে পালন করবে... গল্প শুনছে মন দিয়ে কেমন যেন আবার সেই কিছু একটা চলে যাবার আভাস পেলো সোম.. এবার বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারলো একটা ছায়া মূর্তি দ্রুত সরে গেলো তার পাশ দিয়ে... উঠে দরজার কাছে আসতেই কাউকে দেখতে পেলো না .. খুবই অস্বস্তি হলো ঠিকই তবুও কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না কি হচ্ছে ব্যাপারটা.. কিরে উঠে পড়লি কেন? ঋজু জিজ্ঞেস করলো তবে ওর কথা শেষ হবার আগেই রিক বললো বোধহয় ভুত পেত্নী কিছু দেখলো বোধহয়.. যা ভুতুড়ে পরিবেশ তাতে ভূতের আনাগোনা থাকতেই পারে... হাবলু আর বিল্টু বললো লাইভ পেত্নী দেখবো ওয়াও ... দারুন অভিজ্ঞতা হবে তো! নিয়ে নিজেদের মধ্যে সকলে হেঁসে উঠল... হীরালাল অবশ্য চুপ আর তার মুখও বেশ পাংশু হয়ে উঠলো... বললো বাবুজিরা মজা করবেন না... আপনারা বরং বাড়ি চলে যান... বিপদ হলে কেউ বাঁচাতে পারবেনা কারণ এখানে.... বলতে গিয়েও কেমন চুপ করে গেলো সে... সবাই এখন বলার পর কি বলতে চাইছি জিজ্ঞেস করা সত্বেও সে চুপ করে রইলো... সোম ইতি মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে বাগান এর দিকে গিয়ে তাকিয়ে আছে কিছু ছিলো কিনা সেটা দেখার জন্য! বাগান এর মিষ্টি ফুলের শোভা যেন ক্রমশ বিভোর করে দিচ্ছিল সোম কে... মনে মনে ভাবছিল যে এত অযত্নের বাড়িতেও কিভাবে এত সুন্দর মিষ্টি ফুলের বাগান গড়ে উঠতে পারে.. তারপর মনে পড়লো হীরালালই তো এখানকার যত্ন করে... এরপর সে আবার সেই সদর পেরিয়ে মূল রাজবাড়ীর ভেতরে প্রবেশ করে তিনতলায় উঠলো সিঁড়ি পেরিয়ে.. চারিদিক ধুলো নোংরা হলেও অদ্ভুতভাবে চারতলার ঘোরানো সিঁড়ির ওপরে দেখলো একটা জমকালো আলো এসে পড়ছে.. এই ঘরে আলো জ্বলছে কেন? কেউ তো থাকেনা বলেই জানি এই রাজবাড়ীতে তবে অত আলো একটা ঘর থেকে ছিটকে আসছে কেন? ভাবতে ভাবতেই ঘোরানো সিঁড়ি পেরিয়ে ওপরে উঠলো সোম.. উঠতেই দেখলো আগের তলাগুলোর সাথে এর যেনো কনক যোগই নেই... একেবারে পরিষ্কার চকচক করছে চারপাশ... যেনো এখানে এখনো রাজকন্যা আর তার বর সংসার করছে বলে মনে হয়... তারপর সেই ঘরের সমানে গিয়ে দাঁড়াতেই সোমের মানসিক সত্ত্বা হারিয়ে গেল.. সে নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না... দেখলো রাজসিংহাসনে রাজবেশ পরিহিত অবস্থায় রাজা বীরসিংহ বসে আছে সমানে নর্তকীদের নাচের অনুষ্ঠান চলছে... আর তার পাশে বসে আছে অপরূপ সুন্দরী এক নারী যাকে প্রথমে সোম রাজকন্যা কনক কে ভাবলেও পড়ে বোঝা যায় সে কনক নয় অন্য কেউ.. আর সেই কালো ছায়া এখন পরিষ্কার ভাবে প্রকাশ পেয়েছে সোমের কাছে... সে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সোমের পাশে... তার বস্ত্র এলোমেলো শাড়ির আঁচলটা লুটিয়ে পড়ে আছে দূর অবধি... সিঁদুর লেপটে আছে কপালে আর গা ভর্তি গয়না ঝলমল করছে তার... হাতে ধারালো রক্তাক্ত তলোয়ার হাতে সে যেনো ছুটে যেতে চাইছে বীরসিংহের কাছে... এবং এক নিমিষে সে দৌড়ে গিয়ে এক কোপে রাজা এবং রানীর গলা ও দু হাত কেটে ফেলে দেয় আর মুখে বলতে থাকেআমার সুখের সংসার ধ্বংস করেছিস তুই , আমার স্বামীকে কেরে নিয়েছিস তুই.. আমার স্বামীর সাথে তোকে সুখের সংসার আমি করতে দেবো না রানী পত্রতী.. তাই আজ তোকে ধ্বংস করলাম... এই দৃশ্য দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনি এবং এমন ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে সে অসম্ভব জোড়ে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যায়... তারপর আর সোমের কিছু মনে নেই..  

         ভোরবেলা সে উঠে দেখে যে সে হোটেলের ঘরে শুয়ে আছে... পাশে তার বন্ধুরা... তারপর সোম প্রশ্ন করে যে সে হোটেল এর ঘরে এলো কি করে? এবং তখনো তার চোখ মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট... এরপর তার বন্ধুরা তাকে প্রশ্ন করলে সে সব বলে.. এবং বিল্টু বলে যে এই একই গল্প হীরলাল তাদের শোনায় এবং শুনতে শুনতেই তারা চিৎকার শোনে সোমের এবং তারপর তারা সঙ্গে সঙ্গে সেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায় এবং তারপর রাত কেটে যায় আর তারপর তারা অবশেষে হোটেল পৌঁছে যায়... এরপর তারা আর এক মিনিটও থাকতে পারেনি এবং তারপর পরেরদিন অবধি অপেক্ষা না করে বিকেলের ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরে আসে... সোমের মা বুঝেছিল যে যতটা আগ্রহ নিয়ে সোম গেছিলো সেই আগ্রহের ছাপটুকুও নেই বরং বেশ ক্লান্ত ও ভয়েরই প্রকাশ রয়েছে সোমের চোখে মুখে... কি হয়েছিলো জিজ্ঞেস করেছে বহুবার সোমের মা ঠিকই তবে কোনো সদুত্তর পায়নি... প্রায় এই ঘটনার এখন ২-৩ বছর ঘটে গেছে ঠিকই তবু আজও সোমের মন এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাটা মোছেনি... হীরালাল এর কি হয়েছিলো পরে বিল্টু হাবলু গেছিলো জানতে ঠিকই কিন্তু গিয়ে দেখেছিল সেই হীরালাল বলে কেউ নেই বরং তার কথা জিজ্ঞেস করায় গ্রামের লোক বলছিলো যে সে তো প্রায় ২০-২৫ বছর আগেই মারা গেছিল আজও একটা ছায়া ঐ রাজবাড়ীতে ঘোরে যে প্রথমে আকর্ষণ করে মানুষকে সেই বাড়িতে প্রবেশের জন্য তারপরই এক মারাত্মক অভিজ্ঞতা হয় সকলের কিন্তু সেটা কি সেটার কথা গ্রামবাসীদের জানা নেই.. বিল্টু হাবলুও অবশ্য তাদের কিছু বলেনি ঠিকই তবে সবটাই যে একটা ভ্রমের মধ্যে গিয়ে ঘটেছিলো সেটা বুঝতে ওদের বাকি থাকেনি...

0 comments: